কড়চা #১৯|জুমের ধুম, ক্লাসে ঘুম
কড়চা #১৯|জুমের ধুম, ক্লাসে ঘুম
২০ এপ্রিল ২০২০
গতকাল একটা বিষয় নিয়ে আমার সাথে ডেঙ্গু আর ফ্লু ভাইরাসের খুব একচোট ঝগড়া হয়ে গেলো। আমি কেন ওদের মতন বাচ্চাদের আক্রমণ করিনা! আক্রমণ করলেও তারা কেন সুস্থ হয়ে যায় কিছুদিনেই?
চিন্তা করুন, কি নীচ মনোবৃত্তি আমার স্যাঙাতদের! আমি বললাম - এই পৃথিবীতে আমিও তো বাচ্চাদের মতন নতুন। তাই কিছুটা নিজের সাথে ওদের আইডেণ্টিফাই করে নিই। ওরা তো বড়দের মতো শুধু নিজেদের কথাই ভাবেনা। বড় মানুষগুলো নামেই বড়ো, শরীরে কিম্বা বয়সে, ওদের মনগুলো কিন্তু অত্যন্ত ছোট - নিজেদের স্বার্থে পৃথিবীকে চালনা করে, তার ওপর অত্যাচার চালায় ক্রমাগত। এদেরকে শাস্তি দেব না তো কাকে দেব! শিশু, কিশোর, তরুণ, যুবক এরা কিন্তু বেঁচে থাকলে এই চরম অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেবে। ওরা চারপাশ থেকে স্পঞ্জের মতো শুষে নেবে পরিবেশের ভালোবাসা। ওরা ভালবাসবে প্রকৃতিকে, যত্ন করবে পৃথিবীর, সম্মান করবে প্রতিটি প্রাণের, পৃথিবীতে নিয়ে আসবে সত্যিকারের স্বর্ণযুগ। ঠিক বলেছি কিনা?
সেদিন এক ডাক্তারবাবুকে ওর বন্ধু ফোনে জিগ্যেস করছিল,
- আচ্ছা, এখন সোশ্যাল ডিস্ট্যানসিং আর হাইজিন মেন্টেন করা ছাড়া আর কি কি করলে করোনার হাত থেকে বেঁচে যেতে পারি বলতো?
- শরীর আর মনের বয়সটাকে কমিয়ে ফ্যাল্, যতটা পারিস্।
- মানে?
- মানে আমাদের শরীরের চুপসে থাকা অলস সেলগুলোকে ছোটদের মতো চনমনে আর লড়াকু করে তোল্। বেশিক্ষণ একজায়গায় শুয়ে বসে থাকিস্ না, রেগুলার এক্সারসাইজ কর্, প্রোটিন, ভিটামিন ইনটেক বাড়া। দিনে কয়েকবার গরম জল খা, স্টিম ইনহেল কর্। আর দিনে সাত থেকে আটঘন্টা ঘুম, পরিপূর্ণ বিশ্রাম। এর সাথে মনটাকে চাঙ্গা রাখতে নতুন কিছু শেখার, জানার চেষ্টা কর্। দিনের মধ্যে কিছুটা সময় নিজের পছন্দমতো যা যা করতে ভালোবাসিস সেটাই কর্।
- চেষ্টা করব রে।
- চেষ্টা না, অবশ্যই করবি। দ্যাখ, কোভিডকে সম্মান কর, তাতে ওর সাথে এমনিতেই দূরত্ব তৈরি হবে।
শুনে বেশ একটু গর্ববোধ হল! মন্দ বলেনি, এই দেখুন না আমিও তো রোজই মিউটেশন করে চলেছি। ওরা বুঝতেই পারছে না, দিশেহারা হয়ে পড়ছে। নিত্যনতুন লক্ষণ বা উপসর্গ নিয়ে আসছি আক্রান্তদের মধ্যে। যেমন, কমবয়সীদের ক্ষেত্রে কোভিড টো - অনেকটা ফ্রস্ট বাইটের মতো - দুটো পা ফোস্কায় ভরিয়ে দিই। কিছু রোগীদের আবার পেটখারাপ হয়, কিছু রোগীর শরীরে আবার উপসর্গ বা লক্ষণের কোনো চিহ্ণ নেই - আপনারা যাকে অ্যাসিম্পটোম্যাটিক বলেন!
আমার দৌরাত্মিতেই তো আপনাদের এই ঘরবন্দি অবস্থা। সবকিছুই তো বন্ধ - স্কুল, কলেজ, অফিস, মল, সিনেমাহল সব। খোলা রয়েছে শুধু হাসপাতাল, চিকিৎসাকেন্দ্র আর জরুরি পরিষেবার কিছু দোকানপাট ও অফিস। কিন্তু পড়াশোনা থেমে থাকলে তো চলবে না। ঘরে বসেও সব কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়ার জন্যে মানুষেরা একটা অ্যাপ বার করেছিল, নাম 'জুম'। সেটা দিয়েই ঘরবন্দি থেকেও পড়াশোনা, অফিস, ব্যবসা সবকিছুই চলছে। কাল আটটায় দেখি বারো বছরের রিমি স্কুলড্রেস পরছে; ইসস্ এখানেও সেই ডিসিপ্লিনের কড়াকড়ি! জুম অনলাইন ক্লাসেও শান্তি নেই। শার্ট, স্কার্ট, বেল্ট, গলায় স্টুডেণ্ট ব্যাজ পরে তবেই ক্লাস করতে হবে। রিমি আজ পৌনে আটটায় উঠেছে; পনেরো মিনিটে তাড়াহুড়ো করে কোনোরকমে ব্রাশ, টয়লেট, ব্রেকফাস্ট পর্ব সেরে বসে পড়লো ইউনিফর্মের স্কার্ট ছাড়াই, শুধু শর্টস পরে। ক্যামেরায় তো খালি শরীরের ওপরটা দেখা যাবে, সেটাই যা রক্ষে! চল্লিশ মিনিট ক্লাসের পর কুড়ি মিনিটের ব্রেক। এই করে চলবে দুপুর একটা অব্দি - কি শাস্তি রে বাবা। আর পড়ানোর কি ছিরি! একজন টিচার তো রোল কল করতেই কুড়ি মিনিট লাগিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, পরে ইউ টিউবে ভিডিও দেখে নিতে। স্কুলের ওয়েবসাইটে দেওয়া আছে হোমওয়ার্ক। রিমির হাই ওঠে বিছানার ওপর বসে ক্লাস করতে করতে। ওর ক্লাসের আদি মেহরা স্কুলের ক্লাসে রোজ ঘুমোত। এখানেও সেটাই চালিয়ে যাচ্ছে। ট্যাবে কয়েকটা সেলফিও তুলেছে স্কুল ড্রেস পরে। জুম ক্লাসে স্টুডেণ্টদের সাউণ্ড মিউট করে রাখতে হয়। এই মওকায় ও ফোনের সামনে ওর ট্যাবের সেলফিটা রেখে আরামসে ঘুমোয়।
রিমির বিকেলে গানের ক্লাস, তারপর সন্ধ্যে হলেই প্রাইভেট টিউশনের বন্যা। লকডাউনের মজা কয়েকদিন পরেই উবে গেছে জুম মিটিংয়ের চাপে। মা'ও এখন বন্ধুদের সাথে জুম মিটিং করে। বাবা ব্যাঙ্গালোরে আটকে গেছে কাজে গিয়ে। সেদিন বাবা ওকে ক্লাসের মাঝেই ফোন করেছিল, ও চট করে বলল – এখন মিটিংয়ে আছি। পরে করছি। সেটা শুনে ওর বাবার মনে মনে হাসি পায়। এই কথাটা আগে বাবাই বলত মেয়ে বাড়ি থেকে মিটিঙের মাঝে ফোন করলে! স্কুলে তবু বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে হাসি, মজা হত। এখন সেই আড্ডাও হোয়াটসঅ্যাপ গ্ৰুপে করতে হয়! লাভের মধ্যে লাভ - মায়ের পুরোনো ফোনটা আপাতত রিমির জিম্মায়। এর মধ্যেই শুনলাম রিমির ঘরের দরজায় একটু আঁচড়ানোর শব্দ, একটু হালকা ভৌ ভৌ। ওর চার মাসের ভাই লিও দিদিকে দরজা খুলতে বলছে। অনলাইন ক্লাসের সেকেণ্ড দিনে একটা ক্লাসের সময় ও এসে ফোন শুঁকছিল। সেই দেখে টিচারের কি চিৎকার – হোয়াট ইজ দ্যাট থিং ডুইং হিয়ার! আচ্ছা, লিও তো একটা প্রাণ; ওকে যে জিনিস বলে সেও যে কি বস্তু, তা আমার বুঝতে বাকি নেই! ভাগ্যিস আমাদের ভাইরাসের দুনিয়ায় এরকম টিচার-স্টুডেণ্ট ভেদাভেদ নেই।
রিমির বাবা সেদিন বলছিল জুম মিটিংয়ে নাকি সিকিউরিটি রিস্ক আছে বলে গভর্নমেণ্ট সব অফিসকে ওটা ব্যান করে দিতে বলেছে। ওদের স্কুলে কেন যে ব্যান করেনা। আরও একটা কারণে রিমির মনখারাপ – এই সামার ভেকেশনে নর্থ বেঙ্গল যাওয়ার প্ল্যানটা ভেস্তে গেছে। অনেকে বলছে এবার নাকি সামার ভেকেশন থাকবেই না। ওদের প্রি-মিডটার্ম পরীক্ষাও নাকি এবার অনলাইনে হতে পারে। ওদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্ৰুপে সবাই সেই পরীক্ষায় চিটিং কি ভাবে করা যাবে সেটা নিয়ে নানান প্ল্যান করছে। রিমি আবার কারোর থেকে কপি করে না বা জিগ্যেসও করে না কাউকে, কিন্তু কেউ হেল্প চাইলে নিজের লেখা থামিয়ে লেগে পড়ে তাকে কোনোভাবে উদ্ধার করতে।
দুপুর নাগাদ রিমির বাড়ি থেকে বেরিয়ে এক দিদিমণির বাড়ি গেলাম। ছবির অন্য দিকটাও তো দেখা দরকার। এরাও জুম মিটিংয়ে ক্লাস করছে। দিদিমণির স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখি - একি, মাত্র তেরোজন ছাত্রী! ক্লাস চলার মাঝে ওদের কথাবার্তায় বুঝলাম ওরা সকলেই মামুলি এক সরকারি স্কুলের, কেউই তেমন অবস্থাপন্ন ঘরের নয়। অনেকের বাড়িতে স্মার্টফোনও নেই।
- তোরা কেউ সোনালির খবর জানিস্?
- হ্যাঁ দিদিমণি, জানি। কাল ওর বাড়িতে ফোন করেছিলাম।
- কেমন আছে রে? কতদিন দেখিনি ওকে...
- ভালো আছে, তবে ওর বাবা তো মুম্বইতে কাজে গিয়ে আটকে পড়েছে। ওখানে একটা ক্যাম্পে আছে।
- তাহলে ওদের চলছে কি করে?
- প্রতিদিন দুপুর সাড়ে বারোটায় আর রাত সাড়ে আটটায় ওদের রাস্তার মোড়ে একটা খাবারের গাড়ি আসে, ভাত-ডাল-তরকারি দেয়।
- ওহ্, কি অবস্থা, মেয়েটা তো তাহলে পিছিয়ে পড়বে। অনেকেই তো অ্যাবসেণ্ট; আমরা বরঞ্চ এখন একটু আস্তে আস্তে এগোই। কি বলিস্?
সবাই সমস্বরে হ্যাঁ বলে উঠলো।
- দিদিমণি, সোনালিও কাল আপনার কথা জিগ্যেস করছিল। আপনাকে বলতে বললো যে ও পড়া তৈরি করছে, যতটা পারে। আমার কাছ থেকে জেনে নিচ্ছে কি কি পড়ানো হচ্ছে। ওদের পাশের বাড়ির এক দাদার কাছ থেকে পুরনো বই জোগাড় করে নিজে নিজেই পড়ছে। আপনাকে জানাতে বলেছে যে ও প্রমিস করেছে এবারেও ভালো রেজাল্ট করবে।
ধন্যবাদ - ডঃ কৌশিক মজুমদার, শ্রী অমরনাথ মুখোপাধ্যায়