রম্যকথা: জুয়া
রম্যকথা: জুয়া
হাসি কান্না হীরা পান্না : জুয়া
গ্রাম্য মেলায় ছোট ছোট জটলার মধ্যে জুয়া খেলার দোকান বসে, দেখেছেন হয়তো। ছোটবেলা থেকেই লক্ষ্য করেছি এই ধরণের জুয়া খেলার প্রতি আমার আগ্রহ অপরিসীম।
না, আমি নিজে কোনোদিন জুয়া খেলিনি বা খেলবার ইচ্ছাও নেই। আমার আগ্রহ সেইসব মানুষদের নিয়ে যারা জুয়া খেলেন। বিভিন্ন নম্বর লেখা একটা গোল চাকতি ঘুরছে। আপনি বাজি ধরলেন কোনো একটা নম্বরে। চাকতি যদি সেই নম্বরে এসেই থামে, তো আপনি রাজা। নয়তো, আপনি ফকির। অন্যরকম জুয়াও আছে। দুটো চ্যাপ্টা ঘুঁটি টেবিলের উপর রাখা। জুয়ার দোকানদার দ্রুত হাত পাল্টে পাল্টে ঘুঁটি দুটো কোনো একটা হাতের নিচে চাপা দিয়ে রাখলো। আপনাকে আন্দাজ করতে হবে কোন হাতের নীচে আছে ঘুঁটি দুটো। আপনার চোখের সামনেই সে রেখেছে হাত চাপা দিয়ে। অথচ আপনি যেমন আন্দাজ করবেন, হাত তুললে দেখা যাবে ঘুঁটি আছে ঠিক অন্যহাতে। ব্যাপারগুলো এতোই সহজ মনে হয় যে লোকে বার বার হেরে গিয়েও নতুন করে বাজি ধরে। আবার হারে। আবার খেলে। কচ্চিৎ-কদাপি যদি বা একটা খেলা জিতেও যায়, দেখা যায় সে আরও বেশি টাকার লোভে ওই জিতে যাওয়া টাকা দিয়েই আবার বাজি ধরে। ফলতঃ শেষপর্যন্ত কিছুই তার থাকে না, লাভ হয় জুয়ার দোকানদারের।
আসলে জুয়া খেলাটা তো সোজা। জেতাটাই শুধু যা কঠিন।
জুয়ায় জিততে গেলে লাগে ভাগ্য। যা আমার নেই। একদমই নেই। রোজ জানলা দিয়ে টুকরো টাকরা কিছু ফেলতে গেলেই আমি টের পাই আমার ব্যাড লাক কতোটা খারাপ। হয়তো ছোট্ট একটুকরো বাদাম, কিংবা একটা পেঁপের দানা, খোলা জানলা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলতে গেলাম। জানলার গ্রিলে অজস্র ফাঁকা জায়গা। অধিকাংশই ফাঁকা। চলে যাওয়া উচিৎ। কিন্তু যা-ই ছুঁড়ে ফেলতে যাই, সে ঠিক গ্রিলে ঠোক্কর খেয়ে ঘরের ভিতরেই এসে পড়ে। বার বার প্রতিবার। এতোই কি ভাগ্য খারাপ আমার ? একবারও কি ফস্কে গলে যেতে নেই, অতো ফাঁকা জায়গা যেখানে ? কী করে ঠিক প্রতিবার গ্রিলে আটকে যায় ? কী মনে হতে আমি একদিন পকেট থেকে একটা একটাকার কয়েন বার করলাম। করে ছুঁড়লাম সেই জানলার গ্রিলে। পুরোনো দিনের বড়ো মাপের কয়েন। আটকানোর চান্স বেশি। কিন্তু সেটা ফাঁকা জায়গা দিয়ে সুরুৎ করে গলে ঠিক বাইরে পড়ে গেলো। অনেক খুঁজেও আর সেটাকে দেখতে পাইনি পরে।
এইজন্যই আমি কক্ষনো কোনোদিন লটারি কাটি না। লটারির সাথে জুয়ার একটু পার্থক্য আছে। জুয়াতে হাতসাফাইয়ের একটা ভূমিকাও থাকে, ব্যাপারটা শুধুই লাক-ফ্যাক্টর নয়। কিন্তু লটারি সম্পূর্ণভাবে ভাগ্যের ব্যাপার। আপনার ভাগ্যে থাকলে পাবেন, নচেৎ পাবেন না। অন্যভাবে বললে, লটারিতে জুয়াচুরি হয় না আর কি। কিন্তু ওই যে বললাম, আমার ভাগ্য আমার উপর এতোই প্রসন্ন যে জানলা দিয়ে পেঁপের দানা পর্যন্ত যায় না, আমি কি আর কোটি টাকা পাবো ? প্রশ্নই ওঠে না।
কিন্তু লোকে লটারিতে ভাগ্য খুলে যাবার স্বপ্ন দেখে। এমন অনেক মানুষ আছেন যারা দিনের পর দিন ব্যর্থ হয়েও নিয়মিত লটারির টিকিট কেটে যান। চায়ের পয়সা বাঁচিয়ে, সিগারেটের পয়সা বাঁচিয়ে হলেও একটা টিকিট ঠিক কাটেন। রোজ। তারা বিশ্বাস করেন, একদিন হয়তো ঠিক লেগে যাবে লটারি। ফিরবে ভাগ্য। বদলে যাবে দিন।
আমার পরিচিত এক লটারির দোকানে এইরকমই এক ভদ্রলোক আসতেন প্রতিদিন টিকিট কাটতে। ভদ্রলোককে দেখে খুব অবস্থাসম্পন্ন বলে মনে হয় না। তিনি রোজ নতুন টিকিট কাটতেন, আর আগের দিনের রেজাল্ট শুনে বিফল মনোরথ হয়ে চলে যেতেন। পরদিন আবার আসতেন নতুন আশা নিয়ে। এভাবে কয়েক বছর পার হলো। দোকানদার আমার বন্ধু। একদিন তার সামনেই ভদ্রলোককে বললাম, "দাদা, এই যে রোজ লটারির টিকিট কাটছেন - ধরুন কোনোদিন সত্যিই আপনার একটা কোটি টাকার প্রাইজ লেগে গেলো। আপনি সবাইকে জানিয়ে দিলেন। আর সেই সুযোগে কোনো গুন্ডার দল আপনার বউকেই হয়তো কিডন্যাপ করে নিয়ে গেলো। তারা আপনার জেতা ওই এক কোটি টাকাই মুক্তিপণ হিসাবে দাবি করলো। কী করবেন তখন - এতোদিনের পরিশ্রমের ফল সব জলে গেলো তো ?"
আমার নিগূঢ় উদ্দেশ্য ছিলো সেই ভদ্রলোককে এভাবে অন্ধের মতো লটারি কাটা থেকে নিরস্ত করা। কিন্তু তিনি আমাকে যা উত্তর দিলেন, তাতে আমিই উল্টে নির্বাক হয়ে গেলাম। ভদ্রলোক মৃদু হেসে বললেন, "এখানে একটা লটারিই লাগছে না, আর আপনি একসাথে দুটো লটারি লাগার কথা বলছেন। পারেন বটে!"
একটি গল্পের কথা এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে। এক ভদ্রলোক বেশ টাকার কুমির। রোজ তিনি নেশা করেন, জুয়া খেলেন আর সর্বস্বান্ত হয়ে বাড়ি ফেরেন। বাড়িতে রোজই এই নিয়ে বচসা হয়। একদিন তিনি জুয়ার আড্ডা থেকে বেড়িয়েছেন। এই সময় এক ভিখারি এসে তার সামনে দাঁড়ালো। দেখেই বোঝা যায় আর্থিক পরিস্থিতি খুব সঙ্গীন। সে বললো, "স্যার, কিছু মনে করবেন না, আমি ভদ্র ঘরের সন্তান। আজ দুর্বিপাকে পড়ে আমার এই অবস্থা। কিছু টাকা যদি সাহায্য করেন, খুব উপকার হয়।"
তার মলিন চেহারার দিকে তাকিয়ে জুয়াড়ি ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, "তুমি কি নেশা-টেশা করো নাকি হে ?"
"আজ্ঞে না, কোনো নেশা করি না।"
"জুয়া-টুয়া খেলো নিশ্চয়ই ?"
"আজ্ঞে না না, ওসব বদ-অভ্যাস একদমই নেই।"
শুনে খুব খুশি হয়ে তাকে বাড়ি নিয়ে গেলেন জুয়াড়ি ভদ্রলোক। বাড়িতে ঢুকেই গিন্নিকে ডেকে বললেন, "এই দ্যাখো, তুমি যে আমাকে রাতদিন কত কথা বলো - এখন দ্যাখো, নেশা-টেশা না করলে, জুয়া না খেললে, মানুষের কী পরিণতি হয় নিজেই দেখে নাও।"
তবে এসব নিতান্তই টাকাকড়ির ব্যাপার। রাস্তাঘাটে বেরোলে এখন হামেশাই জীবন নিয়ে জুয়া খেলতে দেখা যায়। আর তার সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত - অটো।
অটো হলো এমন একটি উড়ুক্কু যান, যাতে যাত্রীর চেয়ে পাইলট ও কো-পাইলটের সংখ্যা বেশি থাকে। কলকাতা শহরের ভিতরে ততো না হলেও, একটু শহরতলির দিকে গেলেই দেখতে পাবেন তার নমুনা। অটোর পিছনে তিনজন। সামনে পাঁচজন। ড্রাইভারের ডানদিকে দু'জন, বাঁদিকে দু'জন, কমপক্ষে। কখনো কখনো আরো বেশিও নিয়ে নেয়। কোথাও কোথাও নিয়ম আছে যে ড্রাইভারের ডানদিকে কোনো লোক নেওয়া যাবে না। সে নিয়ম কিন্তু কঠোরভাবে পালন করা হয়। ওই চারজন লোকই তখন বাঁদিকে চড়ে বসেন। ড্রাইভার ডানদিকে সরে সরে প্রায় অটো থেকে বেরিয়েই যাবার উপক্রম। সেই সুদূর উপকূল থেকে লম্বা দু'হাত বাড়িয়ে তিনি অবলীলাক্রমে এই উড়ুক্কু যানটিকে চালনা করেন। কী তার দক্ষতা, কী অদ্ভুত তার কন্ট্রোল। ওই অবস্থাতেই ট্রাক-লরির সাথে রান-রান খেলে, চার চাকার গাড়িকে কিছু মধুভাষ্য শুনিয়ে, বাসকে ওভারটেক করে, ফুটপাথে একচাকা তুলে পুলিশের নাকের ডগা দিয়ে সিগন্যাল ভেঙে যাওয়া - আর তারই মধ্যে এক হাত বাড়িয়ে চলন্ত গাড়ির যাত্রীদের থেকে আগাম ভাড়া নেওয়া - মাল্টি টাস্কিং আর কাকে বলে! এই বাংলার অটো চালকদের থেকে বেশি রোমাঞ্চকর রাইড আপনি বোধহয় ডিজনিল্যান্ডেও পাবেন না।
এখানেই শেষ নয়। একবার এক অটো-আলার সাথে পরিচয় হয়েছিল বাসন্তী যাবার পথে। নাম কার্তিকদা। দেখতে কার্তিক হয়তো নয়, কিন্তু কাজে বিশ্বকর্মার ডবল। পিছনে তিনজনের জায়গায় তিনি চেপেচুপে চারজন তুলতেন, সামনে ছ'জন কি সাতজন আমি দেখেছি। সবশেষে অটো যখন চলতে শুরু করতো, কার্তিকদা অটোর বাইরে। একহাতে অটোর রড ধরে ঝুলতে ঝুলতে অন্যহাত ভিতরে প্রসারিত করে কোনোক্রমে হ্যান্ডেলটি ধরে তিনি চালিয়ে নিয়ে যেতেন। এবং ঘোষণা করতেন, "পোস্ট অফিস, বাদামতলা, বাসন্তী - আসুন সীট খালি, স
ীট খালি" ! আমি জানি না তিনি সীট বলতে সিটিং বোঝাতেন নাকি স্ট্যান্ডিং।
তো যাইহোক, কয়েক বছর পর ওই পথে আবার যেতে গিয়ে দেখলাম কার্তিকদার পদোন্নতি হয়েছে এখন। অটোতে এতো বেশি লোক তুলেছেন যে পা-টুকু রাখারও জায়গা নেই। রড ধরার জায়গাও নেই। কার্তিকদা নিজে অন্য একটা অটোতে উঠে সেই অটো থেকে হাত বাড়িয়ে এই অটোটিকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। দেখে তো আমার চক্ষু-চড়কগাছ!
কার্তিকদার মতোই অসংখ্য মানুষ, যাদের রোজ জীবন হাতে নিয়ে জীবিকার জন্য নামতে হয়, তাদের বোধহয় আলাদা করে আর জুয়া খেলতে লাগে না। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের একটা গানের কথা ভুলে গিয়ে না-থাকলে হয়তো আপনার মনে পড়বে, 'জীবন জুয়ায় বীর জিতে গেলে, বোকার হদ্দ তুমি হেরে গেলে।' কার্তিকদারা হয়তো ওই প্রথম ক্যাটেগরিতে পড়েন। কিন্তু সবার ক্ষেত্রে এমনটা ঘটে না। খবরের কাগজে আজকাল প্রায়শই দেখা যায় পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংবাদ।
এরকমই একটা ঘটনা। দশজন পলিটিক্যাল নেতা একবার গাড়িতে করে কোনো একটা মিটিং থেকে ফিরছিলেন। রাস্তায় ভয়ানক একটা দুর্ঘটনা ঘটে এবং তারা ঘটনাস্থলেই সকলে মারা যান। এরপর যথাসময়ে তারা পৌঁছে যান স্বর্গলোকে। স্বর্গে ঢোকার মুখে স্বয়ং ভগবান দাঁড়িয়ে সেদিন পাহারা দিচ্ছিলেন। রাজনৈতিক নেতাদের দেখে তিনি বললেন, "দাঁড়ান। দাঁড়ান। আপনারা পলিটিক্যাল নেতা তো ? আপনাদের মধ্যে যারা যারা ঘুষের টাকায় বসে বসে আয়েশ করতে চান, তারা নরকের পথে গিয়ে দেখুন। ওইসব সিষ্টেম স্বর্গে এখনো আসেনি। কিন্তু নরকে সব পাবেন।"
এই শুনে আশ্বস্ত হয়ে নয়জন নেতা তৎক্ষণাৎ নরকের পথে পা বাড়ালো। একজন নেতা তখনও চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলো স্বর্গের গেটে। তাকে ভালো করে অবলোকন করে ভগবান ওই নয়জনের দলটিকে পিছন থেকে ডাকলেন। বললেন, "এই হদ্দ-কালাটাকে এখানে রেখে গেলেন কেন ?"
কথায় কথায় জুয়া থেকে আমরা পলিটিক্সে চলে এসেছি। সবচেয়ে বড়ো জুয়া তো এই রাজনীতিতেই চলে। কিন্তু সে প্রসঙ্গ এখন থাক। বরং জুয়া নিয়েই আরেকটি গল্প বলি।
নামীদামী এক পানশালায় একদিন এক জুয়াড়ি এলো। পানশালায় ভর্তি লোক। জুয়ারিটি সোজা কাউন্টারের কাছে গিয়ে বারটেন্ডারকে বললো, "এখানে উপস্থিত প্রত্যেকের জন্য আমার তরফ থেকে একটা করে ড্রিঙ্কস দেওয়া হোক।"
বারটেন্ডারটি জিজ্ঞাসা করলো, "বিল -"
লোকটা নিজের বুকের দিকে ইশারা করে বললো, "আমি দেবো, যত বিল হবে আমি দেবো।"
পানশালার মালিক কাছাকাছিই দাঁড়িয়ে ছিলেন। মালদার কোনো পার্টি এসেছে বুঝতে পেরে তিনি এগিয়ে গেলেন। বললেন, "আমাদের খুব সৌভাগ্য যে আপনি আমাদের গরীবখানায় এসেছেন। তা আপনি নিশ্চয়ই কোনো বড়ো বিজনেসম্যান কিংবা পলিটিশিয়ান হবেন -"
"না না, আমি ওসব কিছুই নই। আমি জুয়া খেলি, জুয়া। আর লোকজনকে কথার জালে হারিয়ে দিয়ে হাজার হাজার টাকা রোজগার করি। বুঝলেন ?"
"না স্যার, ঠিক বুঝলাম না।" অকপট স্বীকারোক্তি করলেন পানশালার মালিক।
লোকটি তখন বললো, "নো প্রবলেম। এক্ষুনি বুঝিয়ে দিচ্ছি।" এই বলে মদভর্তি একটা গ্লাস হাতে তুলে সে বললো, "আচ্ছা ধরুন, আমি আপনার সাথে পাঁচশো টাকার বাজি ধরলাম। এই কাঁচের গ্লাসটা আমি মেঝেতে ছুঁড়ে মারলেও ভাঙবে না, বা একটুও চিড় খাবে না। বলুন, আপনি রাজী বাজি ধরতে ?"
ব্যাপারটা অসম্ভব। বুঝে নিয়ে মালিক ভদ্রলোক রাজী হলেন বাজি ধরতে। একটা পঞ্চাশ টাকার গ্লাস যায় যাক, তার বদলে পাঁচশো টাকা তো আসবে।
তিনি রাজী হওয়া মাত্রই জুয়াড়িটি গ্লাসটা মেঝেতে ছুঁড়ে মারলো, আর সঙ্গে সঙ্গে সেটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো। সে তখন তৃপ্তমনে পানশালার মালিকের দিকে তাকিয়ে বললো, "নিন, দেখে নিন, আপনার মেঝে কোথাও ভেঙেছে কিনা, বা চিড় খেয়েছে কিনা।"
মালিক ভদ্রলোক বুঝলেন ব্যাপারটা একরকম চিটিং হলো। কিন্তু এই কায়দাটা তিনিও পরবর্তীকালে অন্য কারুর উপর প্রয়োগ করতে পারবেন, বুঝে তিনি পাঁচশো টাকা দিয়ে দিলেন জুয়ারিটিকে। সে বললো, "আমি আপনার এই ক্ষতিতে সমব্যাথী। তাই আপনাকে একটা সেকেন্ড চান্স দিতে চাই।"
"কিরকম ?"
দুটো মদভর্তি গ্লাস হাতে তুলে নিয়ে জুয়াড়ি তার মধ্যে একটা ওই মালিকটিকে দিলো, আর একটা নিজের হাতে রাখলো। বললো, "এবারে কিন্তু বাজির টাকা দ্বিগুন হতে হবে। বাজি হচ্ছে, আমি আমার গ্লাসটা ওই দেওয়ালে ছুঁড়ে মারবো। যদি একফোঁটাও মদ কোথাও পড়ে, দেওয়ালে বা মেঝেতে, তাহলে আপনি পাবেন হাজার টাকা। নাহলে আপনি আমাকে হাজার টাকা দেবেন।"
এটা তো অসম্ভব! মালিক ভদ্রলোক একবার ঠকেছেন। তাই এবার তিনি অনেক সতর্ক হয়ে চিন্তা করে দেখলেন। গ্লাসে মদ ভর্তি। গ্লাস ছুঁড়ে দেওয়ালে মারবে। মদ উল্টে পড়বে না, এটা হয় না। অনেক ভেবে তিনি বললেন, "ঠিক আছে, আমি রাজী।"
জুয়ারিটি তখন জামার বুকপকেট থেকে একটা সানগ্লাস বার করে দেওয়ালে ছুঁড়ে মারলো।
দু'দুবার ঠকলেন ভদ্রলোক। যতই মনে মনে রাগ হোক, পয়সাঅলা খদ্দেরকে না চটানোটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। তাই ব্যাপারটার এখানেই ইতি টানলেন তিনি পকেট থেকে আরো হাজার টাকা খসিয়ে। অতঃপর জুয়াড়ি লোকটিও ঘরভর্তি লোকের ভিড়ে মিশে গেলো।
প্রায় ঘন্টা দু'য়েক পরে সে আবার ফিরে এলো কাউন্টারের কাছে। নেশায় দুই পা তখন তার টলছে। দোকানের মালিকটিকে লক্ষ্য করে সে বললো, "সরি, আমার জন্য আপনার আজ অনেক টাকা লস হয়ে গেছে। তাই আপনাকে শেষ একটা চান্স দিতে চাই, জ্যাকপট জেতার।"
"না না, আমি আর বাজি লড়বো না।" দৃঢ়স্বরে জানালেন ভদ্রলোক।
"আরে শুনেই দেখুন না। এই যে আপনার কাউন্টারে কাঁচের বোতল সাজানো আছে অনেক, আমি এখান থেকে ইচ্ছামতন বোতল তুলে মেঝেতে আছড়ে ফেলবো। কিন্তু একটাও বোতল ভাঙবে না। মাইরি বলছি। দশ লক্ষ টাকার বেট। বলুন, লড়বেন ? দশ লক্ষ টাকা। বলেন তো আমি অ্যাডভান্স চেক লিখে দিচ্ছি।"
ইচ্ছা না থাকলেও মালিক ভদ্রলোক ভেবে দেখলেন, এখানে হেরে যাবার কোনো চান্সই নেই। কোনো বোতল যদি ভাগ্যক্রমে নাও ভাঙে, অন্য বোতল তো ভাঙবেই। একটাও বোতল ভাঙবে না, এটা হতেই পারে না। দশ লক্ষ টাকা তো অনেক টাকা। নিশ্চয়ই ব্যাটা নেশার ঘোরে ভুলভাল বাজি লড়ছে। এটাই সুযোগ ওকে জব্দ করার। তিনি ভেবেচিন্তে শেষে রাজী হলেন।
জুয়ারিটি তখন একটা বোতল তুলে নিয়ে মেঝেতে আছড়ে ফেললো। সেটা ভেঙে ছত্রখান হয়ে গেলো। আর তাই দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলেন পানশালার মালিক। দশ লক্ষ টাকা জেতার খুশী আর ধরে না। জুয়ারিটি তখন আরও বোতল কাউন্টার থেকে তুলে মেঝেতে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ভাঙতে লাগলো। আর মালিক ভদ্রলোক নাচতে নাচতে তাকে উৎসাহ দিতে লাগলেন, "ভাঙো, ভাঙো, তোমার বাজি হেরে গেছো তুমি, যত পারো ভাঙো, সাবাশ, সাবাশ!"
কিছুক্ষণ পর পানশালায় উপস্থিত বাকী লোকজনের দিকে নজর গেলো তার। তিনি দেখলেন, সবাই এই ঘটনায় খুব বিমর্ষ। তাদের কেউ কেউ মাথা চাপড়াচ্ছে।
"কী হয়েছে ?" আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি।
জুয়ারিটি বললো, "কিছুই না। আমি ওদের প্রত্যেকের সাথে এক লক্ষ টাকা করে বাজি লড়েছি যে আমি আপনার দোকানে সাজানো মদের বোতলগুলো তুলে আছড়ে আছড়ে ভাঙবো আর আপনি তাই দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে নাচবেন।"
~ সমাপ্ত