রম্যকথা: ভূত-প্রেত
রম্যকথা: ভূত-প্রেত


হাসি কান্না হীরা পান্না : ভূত-প্রেত
ভূতেদের ঐতিহ্য কিন্তু ভগবানেরও আগে। ক'দিন আগেই পড়ছিলাম এক জায়গায়, প্রাগৈতিহাসিক যুগে যখন ঠাকুর-দেবতার সেইভাবে চল হয়নি, তখনকার দিনের কবরের পাশেও মানুষের নিত্য-ব্যবহার্য জিনিস যেমন পোশাক, খাদ্যশস্য, চিরুনি বা দামি পাথর সাজিয়ে রাখতে দেখা যেত। অর্থাৎ, মৃত্যু-পরবর্তী জীবন নিয়ে একটা ভাবনা বা একটা ধারণা তখন থেকেই মানুষের মনে খেলা করতো। তাদের হয়তো মনে হতো, মৃত্যুর পর মানুষটা দেখা না গেলেও, সে নিশ্চয়ই আছে। তার নিশ্চয়ই চুল বড়ো হবে এবং আর কিছু হোক না-হোক, চুল আঁচড়াবার প্রয়োজন নিশ্চয়ই হবে। কী জানি, চুলচেরা বিচার করেই তারা হয়তো এহেন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলো। নাহলে এতো জিনিস থাকতে চিরুনিই কেন ?
ভূতেদের মধ্যে আবার অনেক রকম ভাগ আছে। ব্রাহ্মণবংশের কেউ মারা গেলে হয় ব্রহ্মদত্যি। তারা নাকি ভূতেদের মধ্যে সবচেয়ে কুলীন। থাকে বেলগাছে। মুসলিমদের আত্মাকে বলা হয় মামদো ভূত। তারাও খুব একটা ক্ষতি করে না, একটু বোকাসোকা হয়। আর সাধারণ প্রেতাত্মারা সবাই হলো গিয়ে এমনি ভূত। এর বাইরে আছে গেছো ভূত যারা গাছে গাছে ঘোরাফেরা করে। আর মেঠো ভূত শুধু খোলা মাঠে চড়ে বেড়ায়। মেছো ভূত তো সবাই জানে মাছ খেতে ভালোবাসে আর কন্দকাটা হলো গিয়ে সেই ভূত যার মাথা কাটা গেছে। মেয়েভূতেদের দুটি প্রজাতি - পেত্নী আর শাঁকচুন্নি। এইরকম এক মেয়ে ভূতের গল্প বলি একটা।
গল্পটা অবশ্য মৃত্যুর আগে থেকেই শুরু। এক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান দম্পতির তুমুল ঝগড়া। রোজই তাদের মধ্যে অশান্তি হয়। স্বামীর চরিত্র নিয়ে ঘোরতর সন্দেহ করে তার বউ। সে রোজই হুমকি দেয়, "আমি মরলে দেখবে কবর খুঁড়ে উঠে আসবো। তুমি ভেবেছো কি, আবার একটা বিয়ে করে সুখে দিন কাটাবে ? জেনে রেখো আমি পেত্নী হয়ে এই বাড়িতেই থাকবো, আর তোমার সুখের পিন্ডি চটকাবো। বলে দিলাম, কবর খুঁড়ে উঠে আসবো আমি, এই মনে রেখো।"
এইভাবেই দিন যায়। একদিন দীর্ঘ রোগভোগের পর বউটি সত্যি-সত্যিই মারা যায়। তাকে কবরে শুইয়ে আসা হয়। পারলৌকিক সব কাজকর্ম মিটে গেলে লোকটি একদিন তার নতুন গার্লফ্রেন্ডসহ বাড়িতে পার্টি দেয়। হইচই খানাপিনার মাঝখানে এক পড়শী তাকে বলে, "আপনার ভয় করছে না ? রোজই তো শুনতাম আপনার মিসেস আপনাকে হুমকি দিতো যে কবর খুঁড়ে উঠে আসবে, উঠে এসে পেত্নী হয়ে আপনার সর্বনাশ করবে।"
"হুমকি দিতো, তো কী হয়েছে ?"
"না মানে, ভাবছিলাম, সত্যি সত্যিই যদি কবরের মাটি খুঁড়তে শুরু করে ?"
"খুঁড়ুক না। কত খুঁড়বে খুঁড়ুক মাটি। আমি তো ওইজন্যই চিৎ করে শোয়াইনি ওকে, উপুড় করে কবর দিয়েছি।"
আপনার যুক্তিবাদী মনকে একটু সরিয়ে রেখে ভাবুন তো, ভূত হতে পারলে কত সুবিধা! ভূতেদের মতো এতো ভালো জীবন আর হয় না। এখন গরমকাল। মাঝে মাঝে বৃষ্টি হচ্ছে। আপনি হয়তো বিছানায় আধশোয়া হয়ে কোলবালিশ জড়িয়ে টিভি দেখছেন আর মাথার উপর সিলিং ফ্যান ঘুরছে। ফ্যানটা একটু কমানোর দরকার। তো আপনি ভূতের মতো হাত বাড়িয়ে দূরের রেগুলেটর থেকে ইচ্ছেমতো ফ্যানের স্পীড কমিয়ে নিলেন। আপনার বউ হয়তো রান্নাঘরে লুচি ভাজছে। আপনি গন্ধ পেয়ে একটা হাত বাড়িয়ে খান-দুই লুচি নিয়ে এলেন রান্নাঘর থেকে। এরপরেও ভাবুন, এখন তো লকডাউনের বাজার। সবজিঅলা, ফলবিক্রেতার কাছ থেকে জিনিসপত্র টাকাপয়সা দেওয়া-নেওয়া করার জন্য কাছে যাবার দরকার নেই, দূর থেকেই লম্বা হাত বাড়িয়ে সেসব আদানপ্রদান করতে থাকলেন। তাতে আপনিও সুরক্ষিত রইলেন, তিনিও সুরক্ষিত রইলেন। কত্ত সুবিধা।
আরেকটা মজার কথা, ভূতেদের রোগব্যাধিও বড়ো একটা হয় না। কোনো ভূত কখনো গ্যাস-বদহজম বা কিডনির রোগে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছে, এমনটা সচরাচর শোনা যায় না। আর যদি পড়েও বা, চিন্তা কীসের - ভূতেদের তো আর মরবার রিস্ক নেই। তবে হ্যাঁ, চোখের ব্যামো, কানের ব্যামো হলে আলাদা কথা। তাতে প্রভূত বিপত্তির সম্ভাবনা। সেরকমই একটা গল্প শোনা যাক।
একবার শহরের এক হীরক ব্যবসায়ী দেনার দায়ে জর্জরিত হয়ে এক পাদ্রীর কাছে এসেছেন। শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে পাদ্রীসাহেবের বাড়ি। বাড়িতে ঢুকেই তিনি দেখলেন চারদিকে কত্ত বই। ডাইনিং রুমে, সিঁড়িতে, ঘরের আনাচে-কানাচে যত্রতত্র অসংখ্য বই। থরে থরে সাজিয়ে রাখা আছে। দেখে তিনি চমৎকৃত হলেন, পাদ্রীসাহেব তার মানে ভারী বিদগ্ধ ব্যক্তি।
পাদ্রীর সাথে দেখা করে তিনি নিজের সমস্যার কথা বললেন। বিজনেসে তার প্রচুর ক্ষতি হয়ে গেছে। অনেক ধারদেনা চারদিকে। কিছুতেই শান্তি পাচ্ছেন না মনে। পাদ্রীসাহেব তাকে বাইবেল থেকে বেশ কিছু অংশ পাঠ করে শোনালেন। মনকে শান্ত করে ব্যবসায়ে মনোসংযোগের উপদেশ দিলেন।
যাবার আগে ভদ্রলোক পাদ্রিকে একবার জিজ্ঞাসা করলেন, "ফাদার, আপনি বই পড়তে খুব ভালোবাসেন, তাই না ? এতো বই ছড়ানো চতুর্দিকে, নিয়মিত বই কেনেন নিশ্চয়ই ?"
পাদ্রীসাহেব মাথা নেড়ে বললেন, "বই ? না না। বই কিনবো কেন। আসলে এই বাড়িতে এক জাদুকর ভূত আছে। আপনি তার কাছে যা চাইবেন, তাই পাবেন। তারই কৃপায় রোজ রাত্রে শোবার আগে আমার বিছানায় একটি করে নতুন বই থাকে। রোজ একটি করে নতুন বই। সেই করে করেই তো এতো বই জমে গেছে বাড়িতে।"
ভদ্রলোক পুলকিত হয়ে বললেন, "বাহ্, অদ্ভুত তো। আমি কি একবার সেই ভূতের দেখা পেতে পারি ?"
"নিশ্চয়ই, মাই সন।" এই বলে তিনি চোখ বন্ধ করে কিছু একটা বিড়বিড় করে বললেন। অকস্মাৎ তাদের সামনে হালকা নীল রঙের একটা বাহারি ভূত শূন্য থেকে উদয় হলো।
"এই হলো সেই ভূত। একসময় ছিলো জাদুকর, এখন ভূত হয়ে এখানেই থাকে আর কি।" পাদ্রীসাহেব বললেন।
ব্যবসায়ী ভদ্রলোক তখন সেই নীল প্রেতাত্মার দিকে তাকিয়ে বললেন, "তা, ভূত তুমি কথা বলতে পারো ?"
নীল মূর্তি জবাব দিলো, "আপনি কী বর চান বলুন, আমি মানুষের যেকোনো একটি ইচ্ছা পূরণ করতে পারি। মাত্র একটিই ইচ্ছা, মনে থাকে যেন।"
ভদ্রলোক লোভে পড়ে বললেন, "আচ্ছা ভূত, জাদুকর ভূত, তুমি আমাকে এক ব্যাগ হীরে এনে দিতে পারবে ?"
"তথাস্তু -।" বললো সেই ভূত। তার তৎক্ষণাৎ সেই ভদ্রলোকের সামনে একটা জিরের বস্তা এসে উপস্থিত হলো।
ভদ্রলোক সাতিশয় আগ্রহের সাথে বস্তা খুলে দেখলেন তাতে জিরে ভর্তি। তিনি ক্ষোভের সাথে পাদ্রীসাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, "ফাদার, এটা কী হলো ? চাইলাম হীরে, এ তো দেখছি জিরে এনে হাজির করলো।"
পাদ্রীসাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, "ওইটাই যা সমস্যা, কানে একটু কম শোনে। হীরেকে জিরে শুনেছে। তোমার কী মনে হয়, আমি রোজ রাত্রে আমার বিছানায় একটি করে নতুন 'বই' চেয়েছিলাম ?"
ভূত শব্দের অনেকরকম অর্থ হয়। তার মধ্যে একটি হলো, কোনো ঘটনা ঘটা যেমন আবির্ভূত হওয়া। সেই থেকেই হয়তো ভূত-ভবিষ্যৎ গোছের শব্দবন্ধের উৎপত্তি হয়েছে। তা ক্লাস সিক্সের রাকা এতোসব কিছু জানতো না। সে পরীক্ষাহলে 'অভূতপূর্ব' শব্দের মানে লিখে এসেছে, যিনি এর আগে কোনোদিন ভূত হননি। সেই দেখে মাস্টার তাকে এই মারে কি সেই মারে, বলে - "তোকেই আমি মেরে ভূত ভাগিয়ে দেব।"
রাকাকে কী দোষ দেব। ছোটবেলায় আমার নিজেরও ধারণা ছিলো ভূতেদের নিয়ে যে বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয়, তারই নাম বোধহয় ভৌত বিজ্ঞান। ভূতে ভয় পায় যে বাঙালী, সেই হলো ভেতো বাঙালী। আচ্ছা বলুন তো, ভূতেদের বিয়েতে যে তত্ত্ব সাজিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, তাকে কী বলে ? হ্যাঁ, আমি জানতাম আপনি পারবেন। একদম ঠিক বলেছেন, তাকেই ভূতত্ত্ব বলে। আর যারা তাই নিয়ে গবেষণা করে, তাদের ভূতাত্ত্বিকবিদ বলে।
এর চাইতেও মারাত্মক একটা ঘটনা বলি। একবার এক বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্রের পরীক্ষায় প্রশ্ন এসেছিলো, সমোচ্চারিত ভিন্নার্থক শব্দের পার্থক্য লেখো - পত্নী ও পেত্নী। পুরুষ পরীক্ষার্থীরা তাই নিয়ে আন্দোলন শুরু করেছিল যে প্রশ্নপত্রে ভুল আছে। সমোচ্চারিত ভিন্নার্থকের জায়গায় নাকি সমার্থক শব্দ দেওয়া হয়েছে।
পেত্নীর প্রসঙ্গে আরেকটা গল্প মনে পড়ছে। এক ভূত বিয়ের সময় তার পেত্নীকে যৌতুক হিসাবে একটা বিশাল আয়না উপহার দিলো। আপনি হয়তো জানেন না, ভূতেদের মধ্যে নিয়ম আছে বিয়ের সময় বরপক্ষ যৌতুক দেবে, কণেপক্ষ নয়। তো যাই হোক, আয়না পেয়ে পেত্নী তো খুব খুশি। বেঁচে থাকাকালীন সে ছিলো ডাকসাইটে সুন্দরী, দেমাকে মাটিতে পা পড়তো না তার। কিন্তু অনেকক্ষণ আয়নায় নিজের চেহারা দেখে তার কেমন সন্দেহ হলো। সে তার হবু বরকে বললো, "আমাকে দেখতে কী হয়ে গেছে... চোয়ালগুলো যেন গর্তে ঢোকা, চামড়া কেমন খ্যাসখ্যাসে, সেই ঔজ্বল্য আর নেই। চুল এলোমেলো, কেমন রাক্ষুসী-রাক্ষুসী লাগছে। ওগো, আমার একটু প্রশংসা করো তো দোহাই তোমার, এই চেহারা দেখে আমার যে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। আমার কোনোকিছুর একটু প্রশংসা শুনতে চাই তোমার কাছে, প্লীজ।"
ভূত তখন আমতা আমতা করে বললো, "বাকী সব যা হয় হোক, তোমার চোখ কিন্তু একদম প্রখর এবং নির্ভুল আছে, মানতেই হবে। এতো নিখুঁত দৃষ্টিশক্তি খুবই কম দেখা যায়।"
এবার একটা সত্যি ভূতের গল্প বলে এই পর্ব শেষ করবো।
একবার ভূতল পরিবহন নিগমের পক্ষ থেকে একটা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে যে ভূতের অস্তিত্ব কে প্রমান করতে পারে। একজন তান্ত্রিক, এক জীববিজ্ঞানী এবং একজন পলিটিক্যাল লিডার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছে। ঠিক হলো, তিনজনের মধ্যে যে সবচেয়ে কম সময়ে ভূত আছে বলে প্রমান করতে পারবে, তাকেই সেরার শিরোপা দেওয়া হবে।
প্রথমে তান্ত্রিক বাবা বেরোলেন ভূতের খোঁজে। অনেক খোঁজাখুঁজির শেষে প্রায় ১৬ ঘন্টা পরে তিনি এসে একটা মাদুলি দেখালেন। বললেন, এই মাদুলিতেই তিনি ভূতকে কব্জা করে এনেছেন। টেবিলের উপর সেই মাদুলি রাখতে দেখা গেলো অল্প-স্বল্প নড়ছে। এতে ভূতের অস্তিত্ব প্রমাণ হলো।
এইবারে জীববিজ্ঞানীর পালা। তিনি আট ঘন্টা ধরে অনেক জায়গায় অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে একটা কাঁচের জার সমেত ফিরে এলেন। জারের মধ্যে নীল রঙের একটা ধোঁয়া। দেখা গেলো ধোঁয়া ইচ্ছামতন রঙ বদল করছে। তখন জীববিজ্ঞানী বললেন, "এই হলো ভূত, বর্তমানে বায়বীয় অবস্থায় আছে। আর আমি একে চাক্ষুস দেখালাম। চাইলে এই ভূতের ওজনও নিতে পারেন আপনারা।"
সবার শেষে পলিটিক্যাল লিডার ভূত খুঁজতে গেলেন আর মাত্র চার ঘন্টার মধ্যে তিনি একটা রোগা, শীর্ণকায়, হতদরিদ্র লোককে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এলেন। লোকটার গায়ে কালশিটে, চড়-থাপ্পড়ের দাগ। যেন ধরে তাকে বেদরম কশে পেটানো হয়েছে।
কেউ কিছু বলার আগেই লোকটা হাঁটু মুড়ে বসে দু'হাত জড়ো করে সবার উদ্দেশ্যে বলতে লাগলো, "আজ্ঞে আমি একজন ভূত। আমি ভূতেদের পক্ষ থেকে সরকারকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। বিশ্বাস করুন, আমি সত্যিই ভূত। আর যেন কী... হ্যাঁ, আমার সাথে কোনোরকম জবরদস্তি করা হয়নি। আমাদের বাড়ির সবাই ভূত। আমার বাবাও ভূত, তার বাবাও ভূত, আমাদের চোদ্দ গুষ্টি ভূত।"
~ সমাপ্ত