Keya Chatterjee

Comedy

4  

Keya Chatterjee

Comedy

কৃপণ কথা

কৃপণ কথা

7 mins
1.5K



 ভবানীপুরের চারতলা বাড়ির ঝুল বারান্দা দিয়ে শহরের অনেকখানিই দেখতে পাওয়া যায়। আগে গাছগাছালিতে ভরা ছিল জায়গাটা। এখন ধীরে ধীরে বাড়ি-বহুতলে ছেয়ে যাচ্ছে এলাকা। 

 আমাদের বাড়িটা অনেকদিনের পুরোনো। নিচের তলা দোকানকে ভাড়া দেওয়া। দোতলা, তিনতলায় থাকে ভাসুর আর দেওরের পরিবার, আমরা থাকি চারতলায়। আমাদের একটি মেয়ে। বিয়ে ও চাকরি নিয়ে পুনেতে বাসস্থান গেড়েছে। কলকাতা আসে বছরে একবার। আমাদের এই দুটি প্রাণীর জীবনে কোনো চাহিদা নেই আর। বুড়োবুড়ি দুজনা'তে বেশ সুখেই আছি।

 আমার বুড়ো ক'দিন আগেই অবসর নিলেন। প্রথম প্রথম অবসর জীবনটা বেশ উপভোগ করছিল কিন্তু মাস কাটতে না কাটতেই শুরু হলো বিরক্তি আর মন খারাপের টানাপোড়েন। আমিই বলে কয়ে পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানে পাঠাতে শুরু করলাম। এখন তিনি সকালে উঠে এক কাপ চা খেয়ে মর্নিং ওয়াকে যান। তারপর বন্ধুদের সাথে আড্ডা মেরে বাজার সেরে, খবরের কাগজের আদ্য শ্রাদ্ধ করে ন'টা নাগাদ ঘরে ঢোকেন। তারপর বই নিয়ে বসেন। ওটি তার বরাবরের স্বভাব। আমারও।

 এইভাবেই দিন কাটছিল। কিন্তু তাল কাটল একটা অদ্ভুত ব্যাপারে। আগেই বলেছি আমাদের বাড়ি অনেক পুরোনো। সেই বাড়িতে আজ পর্যন্ত ভগবানের কৃপায় উইপোকার উপদ্রব হয়নি। কিন্তু কয়দিন ধরেই দেখছি আরশোলার ভারী উৎপাত শুরু হয়েছে। এদিকে আমি সবজান্তা গৃহিনী ইঁদুরের ল্যাজ ধরে ফেলতে পারি, টিকটিকির কাটা লেজ ফেলতে পারি, ছুঁচোর সব ব্যাপারে নাক গোলানো বন্ধ করতে পারলেও এই আরশোলা বস্তুটিকে একটু সমঝে চলি। আসলে ওদের ব্রহ্ম অস্ত্র হলো ওই পাখনা দুটো। একবার মেলে দিয়ে যে কোথায় গিয়ে বসবে ভগা ন জনান্তি। যাইহোক, আমার কপালেই এই আরশোলা নামক বস্তুটি এসে জুটল। রান্নার গ্যাস সিলিন্ডার বা ওভেনের পাশে, মশলার কৌটোর বক্সে, বাজারের ব্যাগে, ডিনার টেবিলে, বাথরুমে, বইয়ের তাকে, এমনকি ড্রেসিং টেবিলেও আরশোলা। ওই কদর্য চেহারা, লিকলিকে শুঁড়, খোঁচা খোঁচা ছ'টা পা দেখলেই আমার হৃৎপিন্ড তড়াক করে লাফিয়ে উঠতে শুরু করলো। পাঁচ-ছয় দিন এরকম কাটলো। এবার সকাল থেকেই সঙ্গে একটা ছোট লাঠি রাখতে শুরু করলাম। যেখানেই দেখতাম সেখানেই খোঁচা, যখনই দেখতাম তখনই খোঁচা। কি আশ্চর্য! এতো খোঁচা খেয়েও পতঙ্গটা মরতো না। সে শুধু লাফিয়ে লাফিয়ে স্থান পরিবর্তন করতো। 

একদিন সন্ধ্যেবেলা বসার ঘরে বসে টিভি দেখছি। মেগা সিরিয়াল আমার পোষায় না বাপু! খবরের চ্যানেল আর ডিসকভারি চ্যানেলেই কালাতিপাত করি। এমন সময় দেখি টিভির ওপর ঘুরে বেড়াচ্ছে আমার শত্রু। সেই খয়েরি রং, লিকলিকে পা, নোংরা শুঁড়। গা ঘিনঘিন করে উঠলো। হাতের কাছে পেলাম লাঠিটা। ধরে সবে কাজটা সারতে যাবো এমন সময় কে যেন বলে উঠল, “এই এই একদম খোঁচা দিবি না বলে দিলাম।” চমকে উঠলাম। কে বলল কথাটা? আরশোলা? না না, সে আবার হয় নাকি? লাঠি বাগিয়ে আবার এগিয়েছি এমন সময় আবার শুনলাম, “খবরদার!” এবার থমকালাম। নাঃ এতো মনের ভুল নয়। স্পষ্ট শুনছি কেউ হুমকি দিচ্ছে। ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করলাম, “কে? কে কথা বলছে?” অমনি উত্তর এলো, “আমি রে আমি মৌমিতা।” ভাবতে বসলাম কে মৌমিতা, আমার সাথে তার কোথায় দেখা ইত্যাদি। কিন্তু মরচে পড়া স্মৃতির পাতায় তাকে খুঁজে পাওয়ার আগেই আবার কণ্ঠস্বরটি বলে উঠলো, “চিনতে পারছিস না? আরে সেই যে তোর মেয়ে আর আমার ছেলে এক স্কুলে পড়তো। আমরা প্রতিদিন এক বাসে সঙ্গে যাওয়া আসা করতাম। আমি থাকতাম পঞ্চাননতলায়...” ঝপ করে মনে পড়লো, হ্যাঁ ঠিক তো। আমার মেয়ে তো সেই কোন ছোটবেলায় একটা প্লে স্কুলে পড়তো। সেই সময় বন্ধুত্ব হয় মৌমিতার সাথে। গোলগাল, বেঁটে খাটো চেহারার মানুষটি বেশ আমুদে ছিল। কিন্তু একটাই দোষ ছিল ― কিপ্টেমি। সেই নিয়ে অবশ্য ওকে কম খ্যাপানো হয়নি। তারপর মেয়েকে নিয়ে চলে আসা হয় এই বাড়িতে। ছোট স্কুল ছেড়ে বড় স্কুলের গন্ডিতে পা দেয় মেয়ে আর মেয়ের মা উভয়েই।   


   কিন্তু এতদিন পর সেই মৌমিতা কোথা থেকে এলো? চোখ কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলাম, “হ্যাঁ রে মনে পড়ছে। কিন্তু তুই কোথা থেকে কথা বলছিস?” কণ্ঠস্বরটি উত্তর দিল, “কেন এই যে আরশোলার থেকে।” চমকে উঠে সোফায় পা গুটিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম , “ও মা গো! তুই আরশোলা হয়ে গেছিস? এতদিন ধরে তুই আমার বাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছিলি?” সে বলল, “হ্যাঁ রে অনেক দিন ধরে একটা জরুরি কথা বলার ছিল। সুযোগই পাচ্ছিলাম না। আজ হলো অবশেষে। কিন্তু তোর দেখছি মায়া দয়া কিচ্ছুটি নেই রে। এইটুকু একটা প্রাণীকে কেউ অতো বড় লাঠি দিয়ে খোঁচা দেয়!” আরশোলার পাখনা দুটো থেকে যেন এক ঝলক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। আমি একটু আমতা আমতা করে বললাম, “জানিস তো আরশোলায় আমার ভয়। তাই আর কি...” সে বলল, “কি করবো বল। পুনর্জন্মের সেকশানে এতো লাইন পড়েছিল না! ধৈর্য্য রাখতে পারলাম না। তাই যার শরীর দিল বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিলাম। মানুষ হলে একহাত তর্ক জুড়ে দিতাম কিন্তু অশরীরি কিনা, তাই বিশেষ ট্যাঁ ফুঁ করতে পারলাম না। যদি ব্যাটা নরকে পাঠিয়ে দেয়!” মৌমিতার ওরফে আরশোলার কথা শুনে হাসবো না কাঁদবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। একটু গম্ভীর হয়েই বললাম, “তা কি জরুরি কথা বলবি বললি যে?” আরশোলার দিক থেকে উত্তর এলো, “হ্যাঁ তা একটা আছে বৈকি। জীবন্ত অবস্থায় মনে ঘুরঘুর করতো জানিস তো। মরার পরেও দেখছি ভুলিনি। তাই তোর বাড়ি খুঁজে এলাম।” আমি একটু অধৈর্য হয়েই বললাম, “বল না কি কথা?” তারপর যে উত্তর এলো তাতে আমার চক্ষু চরক গাছ। শুনলাম, “আমার সেই সাত টাকা তো ফেরৎ দিলি না রে?”

 আমি আকাশ থেকে পড়লাম। “সাত টাকা? কিসের সাত টাকা?” প্রায় চিৎকার করেই বলে ফেললাম। ওদিক থেকে উত্তর এলো, “ভুলে গেছিস? জানতাম ভুলে যাবি। সেই যে একদিন বাসে তোর কাছে খুচরো ছিল না বলে কন্ডাক্টারের সাথে তুমুল ঝগড়া বাধল তোর। আমি তোদের থামিয়ে তোর ভাড়াটা দিয়ে দিলাম। তুই বললি, মৌমিতা তোকে পরে টাকাটা দিয়ে দেবো। আমি শুধু ঘাড় নেড়েছিলাম। তারপর তুইও ভুলে গেলি। আমিও লজ্জায় চাইনি। কিন্তু মনের মধ্যে ঘুরঘুর করতো কথাটা। আসলে স্বভাবটা একটু কিপটে গোছের কিনা। দেখ না এই জন্য মুক্তিও পাচ্ছি না।” আমি মুখে হাত চালিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তুই কি করে পারিস মৌমিতা! এতটা কিপটে কেউ হতে পারে!” বলেই একটু সামলে নিলাম। এই মুহূর্তে ও আমার থেকে শক্তিশালী। একে ভূত তার উপর আরশোলা। বললাম, “কিভাবে দেবো? তোর বাড়ি গিয়ে?” সে উচ্ছসিত হয়ে বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ তাই কর তাই কর।” এই বলে সে তার বেহালার বাড়ির ঠিকানা সমেত পথ নির্দেশিকা সব বলে দিল।

 পরেরদিন সকালেই বেরিয়ে পড়লাম। ভেবে অবাকও হচ্ছিলাম, হাসিও পাচ্ছিল, শেষে কিনা ভূতের বাড়ি স্বেচ্ছায় চললাম। তাও আবার আরশোলা ভূত। সে আবার কথাও বলে। হা ঈশ্বর, এই দুনিয়ায় কতো কি না ঘটে।

কথা অনুযায়ী এসে পৌঁছলাম একটা দোতলা বাড়ির সামনে। বাড়িটার সামনে একটা সাদা কাপড়ের গেট লাগানো। বোঝাই যাচ্ছে ভেতরে শ্রাদ্ধ কাজ চলছে। আরো কিছু লোক এদিক ওদিক ছড়িয়ে রয়েছে। আমি সটান ঢুকলাম বাড়ির ভেতর। বসার ঘরেই বেশ কিছু লোকজন বসে আছেন মাটিতে। একটি বছর ত্রিশের ছেলে পুরোহিতের সামনে বসে মন্ত্রপাঠ করছে। তার একটু দূরেই ফুল মালা মিষ্টিতে প্রায় ঢাকা পরে আছে মৌমিতার ছবি। ঘরের মধ্যে চোখ চালিয়ে বুঝলাম ওর স্বামীও বেশ কিছুদিন হলো গত হয়েছেন। “আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না।” পিছন ফিরে দেখি একটি সাতাশ আঠাশ বছর বয়সী বউ আমার দিকে সন্দিগ্ধভাবে তাকিয়ে। অনুমান করলাম হয়তো মৌমিতার পুত্রবধূ।

হেসে বললাম, “আমি আসলে মৌমিতার বান্ধবী। আমার মেয়ে আর ওর ছেলে একই স্কুলে পড়তো।” সে আস্বস্ত হয়ে বলল, “ও, কিন্তু মা তো...বুঝতেই পারছেন।” বললাম, “হ্যাঁ। আসলে ও আমার কাছে কিছু টাকা পেতো। তাই দিয়ে গেলাম।” মেয়েটির হাতে টাকাটা গুঁজে দিয়ে প্রায় পড়ি মরি করে ঘর থেকে বেরোতে যাবো এমন সময় সে আমার হাত চেপে ধরে পাশের একটি ঘরে নিয়ে গিয়ে বলল, “আপনিও?” আমি অবাক হয়ে বললাম, “আমিও মানে?” সে আরো গলা নামিয়ে বলল, “আপনিও কি আরশোলার সাথে কথা বলেছেন?”

চোখ গোল গোল করে জোরে জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানালাম। সে বলল, “আর বলবেন না, পুজোর সময় একটা তিন হাজারের জামদানি আদায় করেছিলাম বরের থেকে। তা আমার শাশুড়ি মায়ের পছন্দ হয়নি। তখন কিছুই বলেননি। মৃত্যুর কিছুদিন পর আলমারি খুলে দেখি ঠিক ওই শাড়ি টার ওপর বসে আছে একটা আরশোলা। ভয়ে চিৎকার করে সরে গেলাম। ওমা অমনি শুনি আরশোলাটা শুঁড় নেড়ে বলছে, “এই শাড়িটা কিন্তু দুই হাজার দাম বৌমা। হাজার টাকা অযথাই খোকার থেকে ঝাপলে। পরেরবার আর করো না কেমন। টাকা তো আর গাছে ফলে না।” আমি তো ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। বলুন তো আর ঐ শাড়ি পড়া যায়!” আমি হাসবো না কাঁদবো ভেবে পেলাম না। সত্যি মৌমিতা কিপ্টেমির একটা লিমিট থাকতে হয়! মেয়েটি বলল, “তা আন্টি এসেছেন যখন একটু বসুন। একটু জল মিষ্টি খেয়ে যান।” আবার মিচকি হেসে বলল, “পাশের ঘরে গিয়ে দেখুন তো পরিচিত কাউকে পান কিনা?” পাশের ঘরে গিয়ে সত্যিই অবাক হলাম। আরো জনা কয়েক মহিলা বসে আছে। তাদের মধ্যে দু তিনজন পরিচিত। যে স্কুলের সুবাদে মৌমিতার সাথে আলাপ হয়েছিল, সেই স্কুলেরই বান্ধবী এরা। এদের সাথেও একই ঘটনা ঘটেছে। কারুর কাছে দশ টাকা বাকি ছিল, কারুর কাছে পাঁচ টাকা। ঘটনাটা এতটাই তাজ্জব ও হাস্যকর যে কথার মাঝখানে হাসি চেপে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। এদিকে শোকের বাড়ি কোনোভাবেই উচ্চ হাসি এলাউড নয়। বৌমাকে সাবধানে থাকতে বলে আমরা কজন বেরিয়ে পড়লাম বাড়ি থেকে। বেশ একটা রিইউনিয়নই হয়ে গেল আমাদের। কতো কথা, কতো স্মৃতি। মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম মৌমিতাকে। ওর জন্যই তো গতানুগতিক সংসারিকতার বাইরে আজকের দিনটা পেলাম।

 বেশ খোশ মেজাজেই সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরেছি। দরজা দেখি আলগা ভাবে বন্ধ। খুলতেই চোখ পড়লো সোফায় বসা কর্তা মশায়ের ওপর। এই সময় সাধারণত থাকেন না। আজ আমি নেই বলেই হয়তো রয়েছেন। এখুনি বেরোবেন। কিন্তু তার চোখ মুখ তো ঠিক লাগছে না। কেমন যেন ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে আছেন দেওয়ালের দিকে। হাতের খবরের কাগজটা বারে বারে কেঁপে উঠছে। আমি গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “কি গো, কি হলো?” অমনি চমকে উঠে, “কে কে" করে চিৎকার করে উঠলেন। আমিও গলা চড়িয়ে বললাম, “এই যে আমি আমি। কি হয়েছে?” তিনি কিছুই বললেন না। শুধু জিজ্ঞাসা করলেন কোথায় গেছিলাম। আমিও কাল সন্ধ্যে থেকে আজ বিকেল অব্দি সব কিছুর বৃত্তান্ত দিলাম। এটাও বললাম যে কাল রাতে উনি যদি ভয় পান সেই চিন্তায় কথাটি চেপে গেছিলাম। কর্তা মশাই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বললেন, “এরকম হয় বোলো?” আমিও বললাম, “হম হয় তো।” তারপর চোখ কুঁচকে বললাম, “তা তোমার যদি কোনো ধার দেনা থেকে থাকে, দিয়ে দাও, বুঝলে?” কথাটা শুনেই সে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে মানি ব্যাগটা পাঞ্জাবির পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে ফিরতে দেরি হবে বলে প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। আমি দেওয়ালে ঝুলন্ত টিকটিকির দিকে তাকিয়ে বললাম, “চিন্তা করবেন না ঠাকুরপো আপনার পাওনা গন্ডা আজকেই শোধ পেয়ে যাবেন।” মনের ভুল কিনা জানিনা, মনে হলো যেন টিকটিকিটা লজ্জায় পর্দার আড়ালে মুখ লুকালো।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Comedy