অনুবাদকের অণুকথা
অনুবাদকের অণুকথা
হৈ হুল্লোড়ের শব্দ বুকে নিয়ে সিগন্যালে দাঁড়াল একটা গাড়ী। জানলা থেকে মুখ বাড়িয়ে উল্লসিত কণ্ঠে সঞ্চিতা জিজ্ঞেস করলো, “বাহ বাড়িটা তো বেশ!” সঞ্জীব বাবু মুখ বাড়িয়ে এক ঝলক দেখেই মিচকি হেসে বললেন, “কার বাড়ী জানিস?” গাড়ীতে অবস্থিত কিশোর কিশোরীর দল সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়ল, “না জানি না তো।” সঞ্জীব বাবু বললেন, “চল যেতে যেতে বলছি।”
গাড়ী ছুটে চলল ডায়মন্ড হারবার রোড ধরে রায়চকের দিকে। শীত মানেই বাঙালীর কাছে পিকনিক। তাই একটা সুবিধা মতো দিন দেখে সঞ্জীব ঘোষ সপরিবারে পিকনিকের প্ল্যান করলেন। সেই দলে একে একে যোগ দিল সব কচিকাচার দল। স্পট হিসেব ঠিক হল রায়চক। গঙ্গা বক্ষে হিমেল হাওয়া খেতে খেতে, রোদ পোহাতে পোহাতে, গরম গরম ভাত আর মাংসের ঝোল সহযোগে পিকনিক জমবে ভালো। আলিপুরের রাস্তা ছেড়ে ডায়মন্ড হারবার রোডের ওপর অবস্থিত ঠাকুরপুকুরে গাড়ী থামতেই সঞ্চিতা মানে সঞ্জীব বাবুর শ্যালিকার মেয়ে জিজ্ঞেস করে ফেলল প্রশ্নটা। সঞ্জীব বাবু এক নজর বুলিয়েই চিনে গেলেন। যাঁর আবক্ষ মূর্তি প্রতিষ্ঠিত বাড়িটির সামনে তিনি হলেন রেভারেন্ড জেমস লং।
“ ডায়মন্ড হারবার রোডের সমান্তরালে চলে যাওয়া রাস্তাটা হলো জেমস লং সরণি। পাদ্রী জেমস লং এর ভারতের স্বাধীনতা ইতিহাসের প্রতি অবদানকে মনে রেখেই রাস্তার এই নামকরণ। বুঝলি?” বললেন সঞ্জীব বাবু। বুকাই, সঞ্জীব বাবুর ভাইপো। সে মাথা চুল্কে বলল, “ কিন্তু উনি তো স্বদেশি বা বিপ্লবী ছিলেন না। ছিলেন ব্রিটিশ। তাহলে উনি কীভাবে ভারতকে সাহায্য করলেন?” সঞ্জীব ঘোষ মৃদু হেসে মাথা নেড়ে বললেন, “শুধু স্বদেশি করে বা বোম মেরে খুলি উড়িয়েই দেশে স্বাধীনতা আসেনি। সে এক বিরাট কূটনীতিক খেলা। তোদের কচি মাথায় সেসব এখন না ঢোকাই ভালো। তবে জেমস লং ভারতবাসীর জন্য যা করেছিলেন তা করতে বুকের পাটা লাগে।” কচিকাচার দল ঘিরে ধরলো তাদের প্ৰিয় মানুষটাকে। এই মানুষটা আসলে গল্প দাদুর ঝোলা নিয়েই ঘোরেন। যেখানে সেখানে যখন তখন গল্প আর ইতিহাসের কাহিনীর পসরা খুলে ফেলতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার।
সঞ্জীব ঘোষ শুরু করলেন, “ প্রথমেই বলি, জেমস লং ব্রিটিশ ছিলেন না। তাঁর জন্ম আয়ারল্যান্ডে এবং জীবনের বেশ খানিকটা সময় তিনি কাটান রাশিয়াতে। লন্ডনে পড়াশোনা চলাকালীন তিনি অনুভব করেন এই জাগতিক ও বস্তুবাদী সমাজ তাঁর জন্য নয়। প্রভু যীশুর চরণ ও সমাজ কল্যাণই তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। কিছু দিনের মধ্যেই তিনি চার্চের পুরোহিত হিসেব নিযুক্ত হন ও পরবর্তীকালে চার্চ মিশন স্কুলের একজন সভ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। বলাবাহুল্য, ব্রিটিশ শাসকদল ভারতে এসেছিল একহাতে অস্ত্র ও অপরহাতে বাইবেল নিয়ে। মিশনারিদের তত্ত্বাবধানেই ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে শিক্ষা বিস্তার সম্ভব হয়। ব্রিটিশ সরকার পাশে না থাকলে হয়তো আমাদের দেশীয় সমাজ সংস্কারকগন যেমন রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়দের আরো কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে, আরো প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হতো।
তাঁকে পাঠানো হয় ভারতে একটি চার্চের পুরোহিত হিসেব। শুধুই পৌরহিত্য নয়, মিশনারি স্কুলের শিক্ষকতার দায়ভারও তার ওপর ন্যাস্ত হয়। তিনি এসে পৌঁছলেন বাংলায়। এলেন কলকাতার ঠাকুরপুকুরে অবস্থিত চার্চের দায়িত্বে। এখানে তিনি খ্রিস্টান ও গরিব শিশুদের শিক্ষার দায়িত্ব তুলে নিলেন নিজের হাতে। পরবর্তীকালে তাঁর স্ত্রীও এইকাজে ব্রতী হন।” সঞ্জীব বাবু একটু দম নেওয়ার জন্য থামতেই প্রশ্নের বাণ ছুটে আসে, “এটা তো উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু নয়! এর থেকে অনেক বেশি কাজ মাদার টেরিজা করেছেন। আর মিশনের লক্ষ্য তো শুধু শিক্ষা ছিল না, ছিল ভারতে খ্রিস্টান ধর্ম প্রবর্তন।” বলল মুনিয়া, সঞ্জীববাবুর মেয়ে। মুনিয়া এখন ইতিহাস পড়ছে। যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে বিশ্লেষণ করতে শিখছে। সন্দেহ প্রকাশ তো করবেই। সঞ্জীব বাবু হাসলেন, “সেটা কিছুটা ঠিক, কিছুটা ভুল। তখনকার দিনে প্রচার মাধ্যম এতো স্ট্রং ছিল না। তাই উনি শিক্ষা প্রসারের জন্য কি কি করেছিলেন বা তার বাইরে কি কি করেছিলেন আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। তবে জেমস লং এর মতো শিক্ষাবিদ খুব কমই দেখা যায়। বাংলায় এসে বাংলা ভাষার প্রতি তিনি এতটাই আকৃষ্ট হন যে তিনি রীতিমতো বাংলা ভাষা রপ্ত করেন। বাংলা সাহিত্য, বাংলা সংস্কৃতি তাঁকে আকর্ষণ করে। সেই টানেই তিনি গবেষণা শুরু করেন বাংলার প্রবাদ বাক্য নিয়ে। তাঁর রচিত সেই গ্রন্থ বাংলা সাহিত্যের একটি রত্ন। তাছাড়াও তিনি বহু গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, সাপ্তাহিক ও দৈনিক পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন, তাঁর অনেক রচনা অপ্রকাশিত অবস্থায় রয়ে গেছে এখনো। তবে জেমস লং সাহেব ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে যে অবদান রেখেছেন তা একেবারেই ভোলার নয়।” সঞ্জীব বাবুকে থামতে হল। বুকাই প্রশ্ন করল, “জেমস লং তো নিজেই সাহেব ছিলেন। তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের সাহায্য করবেন কেন? এতে তো তাঁরই ক্ষতি।” সঞ্জীব বাবু আবার হাসলেন, “ কিছু মানুষ জানিস তো নিজের লাভ ক্ষতির বাইরেও অনেক কিছু ভেবে ফেলেন। তখন তাঁকে অনেক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়। বিদ্যাসাগরের কি দরকার ছিল বিধবা বিবাহ প্রচলনের? তাঁর তো কোন লাভ হয়নি। বরং প্রচুর অ
পমান সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে। রাজা রামমোহন রায়ই বা কেন গোটা সমাজের সাথে লড়াই করে সতিদাহ প্রথা রদ করলেন, নারীশিক্ষা প্রচলন করলেন? চৈতন্য দেব সংসার ত্যাগ করে পথে পথে ঘুরে কেন প্রেমের, বন্ধুত্বের বাণী প্রচার করলেন? যীশু খ্রিস্ট কেন ক্রুসবিদ্ধ হলেন বলতে পারিস? অনেক কেনর উত্তর হয়না রে বুকাই।”
“সেইসময় নীলকর সাহেবদের অত্যাচার বেড়ে গিয়েছিল। নীলকর কারা জানিস?” ছোটরা মাথা নাড়ল, নাহ্ জানে না। “তখন ইংরেজরা নীল চাষ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। ব্যবসা বৃদ্ধির জন্য তারা এদেশে নীল ফলিয়ে নিজের দেশে পাঠাতো। কিন্তু নীল চাষের একটা বিরাট খারাপ দিক ছিল যে জমিতে একবার নীল চাষ হতো সে জমিতে আর কোনদিন কোনো ফসল চাষ করা সম্ভব হতো না। যে সাহেবরা এই নীল চাষের জিম্মা নিত তাদের বলা হতো নীলকর সাহেব। এরা চাষিকে দিয়ে তার নিজের জমিতে চাষ তো করিয়ে নিত কিন্তু উপযুক্ত মজুরি তো দিতই না, বরং এই চাষের জন্য চাষিরাই উল্টে কর দিত। এদিকে চাষির সব দিক থেকেই ক্ষতি। নীল চাষ করলেও ক্ষতি, না করলে জুটত মার আর অপমান। তারা এবার আন্দোলনে নামল। কিছুতেই নিজের জমিতে তারা নীল চাষ করবে না। নীলকররা ক্ষেপে গেল। তারাও অত্যাচার শুরু করলো। তারা ভাবলো চাবুকের ঘায়ে, জুতোর মারে হয়তো এই বিদ্রোহ দমন হবে কিন্তু সে গুড়ে বালি। বরং গোটা দেশ চাষিদের পাশে এসে দাঁড়ালো। পাশে এসে দাঁড়ালেন বুদ্ধিজীবীরা, সাহিত্যিকরা। জেমস লং সহ অন্যান্য পাদ্রীদের গায়েও এই বিদ্রোহের আঁচ এসে লাগল। তাঁরা যখনই ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে মানুষের সাথে দেখা করতে যেতেন, এই গরিব, শোষিত মানুষদের রোষের মুখে পড়তেন। গরিব মানুষরা তাদের কথা শুনতেই চাইতেন না। জেমস লং অনুভব করতে পারতেন তাঁদের দুঃখ, কষ্ট। কিন্তু মানুষগুলোর কাছে পৌঁছন সহজ ছিল না মোটেই। তাঁদের কাছে সাদা চামড়া মানেই অত্যাচারী, সুবিধাবাদী। সুযোগটা এসে গেল। সময়টা ১৮৬০ সাল। ঢাকা থেকে প্রকাশিত হলো দীনবন্ধু মিত্রের “নীল দর্পণ” নাটক। একটা সাংঘাতিক আলোড়ন পড়ে গেল চারিদিকে। মজার ব্যাপার হল নাট্যকারের নাম ছাড়াই প্রকাশিত হয় বইটি। কিছু গোপন সূত্রই রচয়িতার নাম জানতেন। লং এর হাতে এসে পড়ে বইটি। তিনি পড়ে ভীষণ সন্তুষ্ট হন। তাঁর চিন্তা ভাবনার সাথে কি সুন্দরভাবে মিলে গেল নাট্যকারের ভাবনা। কিন্তু নাটকটি তখনও দেশজ মানুষদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ইংরেজ সরকার জানতেই পারেনি তাদের গালে কি নিদারুন একটা থাপ্পড় কষিয়েছেন লেখক। লং ঠিক করলেন তিনি এটি অনুবাদ করবেন। প্রকাশকও পাওয়া গেল। এই বইটিও প্রকাশিত হল রচয়িতার নাম ছাড়াই। তবে একটি দীর্ঘ ভূমিকা সহ। যেখানে দেশবাসীর মনে জমে থাকা ইংরেজ সরকার ও নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে প্রবল বিতৃষ্ণা ও ঘৃণার স্পষ্ট চিত্র অংকিত। প্রকাশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বইটি ছড়িয়ে পড়ল ওপর মহলে। ক্ষেপে উঠল সরকার। আংলো- ইন্ডিয়ান সাংবাদিকরা ছড়িয়ে পড়ল গোটা দেশে। খুঁজে বের করল প্রকাশককে। প্রকাশকের সূত্র ধরে গ্রেপ্তার হলেন অনুবাদক জেমস লং। জেমস লং কিন্তু কিছুতেই আসল নাট্যকারের নাম প্রকাশ করলেন না। বেশ কিছু বিচার সভা ও জিজ্ঞাসাবাদের পড়েও তাঁর মুখ থেকে একটা কথা বের করতে পারল না পুলিশ। অবশেষে জেমস লং এর হলো একমাসের জেল ও এক হাজার টাকা জরিমানা। কিন্তু সামান্য শিক্ষকের কাছে এতো টাকা আসবে কোথা থেকে? লং নীরবে, হাসি মুখে মাথা পেতে নিলেন এই শাস্তি। ততদিনে তিনি শিক্ষাবিদ ও সমাজ সেবক হিসেবে পরিচিত হয়েছেন শহরে। তাঁর জরিমানার টাকার দায়িত্ব নিলেন কালিপ্রসন্ন সিংহ। কিন্তু তাঁর একমাসের জেল এড়ানো যায় না। এই ঘটনার পড়ে সারা বাংলায় জেমস লং সাহেবের নাম ছড়িয়ে পড়ল। তাঁর নামে চিঠি, শুভেচ্ছা বার্তা আসতে লাগল। তাঁর সাথে দেখা করার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল মানুষ। মানুষ বুঝল জেমস লং সাহেব তাঁদেরই লোক।” সঞ্জীব বাবু থামলেন। ছোটরা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। মুনিয়া বলল, “ তারপর কি হল?”
“ তারপর কি আর হবে? জেমস লং সাহেব ভারত ও বঙ্গের শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে, সমাজের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেলেন। তিনি ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি, এশিয়াটিক সোসাইটি, বেথুন সোসাইটির মতো আরো অনেক সংস্থার একজন অন্যতম সভ্য হয়ে ওঠেন। তৎকালীন শিক্ষা ব্যবস্থায় লং সাহেবের অবদান ভোলার নয়। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে তিনি লন্ডন ফিরে যান। বাকি জীবন ওখানেই কাটিয়ে দেন। ১৮৮৭ সালে লন্ডনে তিনি দেহত্যাগ করেন।” বুকাই শিহরিত হয়। কতো ইতিহাস ছড়িয়ে আছে এই দেশে। কতো অখ্যাত গ্রাম, নগর, ধান ক্ষেতে ছড়িয়ে আছে শহিদের রক্ত, কান্না। সঞ্জীব বাবু আবার বললেন, “এই যে ডায়মন্ড হারবার রোডের সমান্তরালে চলে গেছে আরেকটি রাস্তা এটির নাম জেমস লং সরণি। এর আগে নাম ছিল রেল লাইন। হ্যাঁ রেল চলত এখানে। দেশ ভাগের পরে পূর্ববঙ্গ থেকে আগত বহু শরণার্থী বাসা তৈরি করেন এই রেল লাইনের ধারে। ঘর হারানোর যন্ত্রণা বুকে চেপে অপরিকল্পিত সংসারে টিকে থাকার লড়াই। ভারত সরকার রেল কোম্পানীর অনুমোদনক্রমে জায়গাটা শরণার্থীদের পুনর্বাসনের জন্য দিয়ে দেন জায়গাটা। জেমস লং এর আশ্রয়ে আবার দুস্থরা প্রাণ পেল। এভাবেই জমে আছে কত ইতিহাস, কত গল্প এ বাংলার আনাচে কানাচে। আমরা কতটুকুই বা জানি?”