Keya Chatterjee

Classics

4.3  

Keya Chatterjee

Classics

একটি ঘুড়ি ওড়ানোর গল্প

একটি ঘুড়ি ওড়ানোর গল্প

3 mins
1.7K


বিশ্বকর্মা পুজো। নিয়মমতো ঘুড়ি ওড়ানোর দিন। কিন্তু আকাশের মুখ প্রবল ভার। বাঘা বাঘা খেলোয়াড় ছাদে উঠছে আর ভিজে কাক হয়ে নামছে। ঘুড়ি গুলোও বাঘ হয়ে উঠছে বটে, তবে জল পেয়ে তিলের নাড়ু হয়ে টুপ করে খসে পড়ছে। ভাদ্র মাসে এমন বৃষ্টি মেয়েবেলায় দেখিনি। তবে মেয়েবেলায় আকাশ ছাপানো ঘুড়ির হাট দেখেছি। তাদের নাম জানতাম না। অতো ঠাঁটা রোদে দাঁড়িয়ে নাম জানার ইচ্ছেও ছিল না। কিন্তু মাঝেমধ্যে দাঁড়াতে হতো।

 কিছু ছেলে ছিল যাদের ওই কটাদিন ঘুড়িই ছিল প্রাণ আর ধ্যান। তেমন এক ছেলে রঘু। পাড়ার এমন কোনো বাড়ির ছাদ বাকি ছিল না যার মাথায় তার পদধূলি পড়েনি। নানান ধরনের ছাদের অভিজ্ঞতা তার ছিল। ন্যাড়া ছাদ, নির্মীয়মান ছাদ, নির্মিত ছাদ, সিঁড়িহীন ছাদ (ঈশ্বর জানেন কিভাবে উঠত), টালির ছাদ। নিখুঁত সুতোর প্যাঁচে টপাটপ আকাশ থেকে ঝরে পড়ত পেট-কাটি, চাদিয়াল। এই সুতোর জন্যও চলতো প্রচুর প্রিপারেশন। কাঁচ গুঁড়ো, সাবু , পচা ভাত আরো কতো প্রকারের উপকরণ জড়ো করে, ইঁটের উনুন বানিয়ে চলতো মাঞ্জা তৈরির কাজ। সেই মাঞ্জা ঠান্ডা হলে দুটো গাছের গুঁড়ির সঙ্গে সুতো পাকিয়ে চলতো মাঞ্জা লাগানোর কাজ। তবে এসব কাজ চলতো বাড়ি থেকে দূরে ক্লাব ঘরে।

 রাত জেগে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে সকলেই দলবল নিয়ে রঘু ঝাঁপাত যুদ্ধের ময়দানে। রঘুর মায়ের এই সময় হাজার কাজের মধ্যে আরেকটা কাজ বেড়ে যেত। ছেলে আসলে কোন বাড়ির ছাদে আছে উদ্ধার করা এবং হাতের গরম খুন্তি বা বেলন দেখিয়ে ছেলেকে সেই ছাদ থেকে নামিয়ে স্নান ও আহার নামক অতি নগন্য কাজ দুটি বলপূর্বক করিয়ে নেওয়া। তিনি জানতেন এই খুন্তি, ঘটি, বেলন সবই নিমিত্ত মাত্র। দুপুরে তার চোখটি লেগে এলেই ছেলে আবার ফুড়ুৎ। 

 আমার কাজ ছিল প্রক্সি দেওয়া। যখন কোনো বন্ধু জুটতো না, তখন আমায় লাফিয়ে ঘুড়ি উড়িয়ে দিতে হতো, লাটাই ধরতে হতো, তার নির্দেশ মতো সুতো ছাড়তে বা গোটাতে হতো। কখনো কখনো সুতো ধরতেও বলতো কিন্তু কচি হাতে বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারতাম না। অবাক হয়ে দেখতাম কিভাবে একটা ছোট্ট কাগজ রাঙিয়ে তুলছে বিশাল আকাশ। একটা আনন্দের গন্ধ বয়ে যেত নাসারন্ধ্র ছুঁয়ে।

 একদিন এরকম ঘুড়ি ওড়ানোর বেলায়, রঘুর বাবা বাড়িতে ছিলেন। ছেলেকে ধরে আনতে লাঠি নিয়ে বেরোচ্ছেন, এমন সময় পাড়ার কেউ একজন এসে বলে গেল, দাদা রঘুকে বোধহয় গাড়ি ধাক্কা মেরেছে। ঘুড়ির পিছনে ছুটছিল। তাড়াতাড়ি এসো। রঘুর বাবা, ওরে রঘু রে, কি হলো রে তোর বলে লাঠি ফেলে, তিনটি সিঁড়ি এক লাফে টপকে ছুটলেন রাস্তার দিকে। জানলেন যে রাস্তার মাঝখানে যে devider ছিল তার ওপর দাঁড়িয়ে একটি ছেলে ঘুড়ি ওড়াচ্ছিল। ঘুড়ি ভোকাট্টা হতেই লাফিয়ে রাস্তায় নামে ঘুড়ি ধরতে আর তখনই একটা গাড়ি এসে ধাক্কা মারে ছেলেটিকে। রঘুর বাবা ভিড় ঠেলে সামনে এসে দেখলেন, ছেলেটি তার পরিচিত কিন্তু তার ছেলে নয়। সামান্য আহত হয়েছে কিন্তু ভয় পেয়েছে তার থেকেও বেশি। আরো বেশি ভয় বাড়ি ফিরে তার কপালে কি পরিণতি নাচছে সেই চিন্তার। 

 এমন সময় ভিড়ের মধ্যে থেকে ফাঁক গলে সামনে এলো একটা চেহারা, ঝাঁটার ওপর আলুরদমের মতো লিকলিকে শরীর, ঝাঁকড়া চুল, কোটরাগত চোখ, মুখে হাতে রোদে পোড়ার চিহ্ন স্পষ্ট, দাঁত দুটো একটু উঁচু হয়ে বেরিয়ে এসেছে। রঘু। বাবার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলল, চারটে ঘুড়ি কেটেছি। তার বাবা চোখ বিস্ফারিত করে জিজ্ঞেস করলো, কোথায় ওড়াচ্ছিলি? রঘু আঙুল উঁচিয়ে বলল, ওই যে ফ্লাটের ছাদে। তার বাবা দাঁত পিষে বলল, ওটা তো ন্যাড়া ছাদ, এখনো তৈরি হয়নি। পরে হাত পা ভাঙলে কে দেখবে? বলার সঙ্গে সঙ্গে মোক্ষম একটি কিল এসে পড়লো রঘুর পিঠে। ও মা গো! বলে লাফিয়ে উঠলো রঘু। এরপর চড়-কিলের বর্ষা নামলো। সেই বর্ষণে ভিজতে ভিজতেই রঘু চলল বাড়ি। সে জানে আজ বাড়িতে গিয়ে তার কপালে দুর্ভোগ আছে।

 আমি ড্যাবড্যাব করে দেখতাম। ছোট ছিলাম কি না! আসলে ছেলেটা আমার দাদা। আর ওর আসল নাম রঘু নয়। ওই নামে ওকে ক্ষ্যাপানো হতো। 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics