কড়চা #১৭ | তুম বিন...ভ্যাকসিন
কড়চা #১৭ | তুম বিন...ভ্যাকসিন
১২ এপ্রিল ২০২০
দেখতে দেখতে বেশ ক’টা দিন কেটে গেল এই দেশে। অনেক জায়গায় ঘুরেছি, অনেক জায়গায় আড়ি পেতেছি, পেশাদার গোয়েন্দার মতো জানার চেষ্টা করেছি এরা আমাকে নিয়ে কি ভাবনাচিন্তা করছে, কতোটা ভয় পাচ্ছে, কেমনভাবে আমাকে ঠেকানোর চেষ্টা করছে এই সব। এটা সত্যি যে সাদা চামড়ার লোকগুলোকে যেভাবে নাজেহাল করে যমের দুয়ারে পাঠিয়েছি সেইভাবে হয়তো এদের নাস্তানাবুদ করতে পারিনি এখনো। তবু বলবো, কাজ কারবার মন্দ চলেনি। এ সব কিছু কিন্তু রোজ ডায়েরিতে (এরা বলে 'কড়চা') লিখেও রেখেছি। সেটাই আমার কাজকর্মের রিপোর্ট, বস্ সেটাই তো দেখবে। এবার অবশ্য আমার মনে ইচ্ছে জেগেছে একটু ঢিমেতালে, রয়েসয়ে চলার! মানেটা বুঝলেন? কড়চা লিখবো কিন্তু ছাড়াছাড়া, 'রোজনামচা' নয়। তারিখ দেখলেই বুঝবেন।
এবার আজকের কথায় আসি। সন্ধ্যেবেলায় এক অবাঙালীর বাড়িতে ঢুকে টিভি দেখছি। এরা রাজস্থানের লোক। কনস্ট্রাকশন আর প্রমোটিংয়ে আছে। টাকাকড়ি ভালোই আছে। দুটো বাচ্চা মেয়ে - দশ আর চার বছর... নিজেদের মধ্যে মারপিট করছিল কার্টুন না হিন্দি সিনেমা, কোনটা দেখবে! এমন সময় ওদের বাবা কারুর সঙ্গে একটা ফোনালাপ সেরে এসে সোফাতে বসলো পাশে। দুজনের মধ্যে টানাটানি হতে থাকা রিমোটটা কেড়ে নিল জোর করে, চালু করল একটা হিন্দি নিউজ চ্যানেল। সেখানে একটা প্রোগ্রামে দেখাচ্ছে - ক্যায়সে রাহত মিলেগা করোনা সে! রিমোট হাতছাড়া হওয়ায় মেয়ে দুটো ঘ্যান ঘ্যান করতে লাগল। বিরক্তিকর! ওদের শান্ত করতে একজনকে আইফোন আরেকজনকে আই প্যাড ধরিয়ে দিল বাবা। তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে মন দিলো টিভিতে। গিন্নি ওদিকে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আঁচলে ঘাম মুছতে মুছতে সোজা বেডরুমে ঢুকলেন। এসি অন করে বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন। বালিশের পাশে রাখা ফোনটা টেনে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে কি একটা ভেবে পাউট করার ভঙ্গিতে দু'চারটে মনের মতন সেলফিও তুললেন। পাসওয়ার্ড লাগিয়ে খুললেন ফেসবুক মেসেঞ্জার। নীতিশ বলে একজনকে সেলফিটা পাঠিয়ে নিচে লিখলেন,
- ফিলিং সো বোরড অ্যাণ্ড টায়ার্ড!
সাথে সাথেই ওদিক থেকে উত্তর এল,
- হোয়াই হানি?
- এভরিওয়ান ইজ অ্যাট হোম। সো মাচ অব ওয়ার্ক!
- হুমম্; নো মেডস আর কামিং?
- নহি (সাথে একটা হাপুস নয়নে কান্নার ইমোজি)।
উল্টোদিক থেকে এলো তিনটে চুমুর ইমোজি।
- তুমলোগ ভি কমাল হো, ডক্টর হোনে কা বাবজুদ অভি তক এক ভি ভ্যাকসিন নহি নিকাল সকে?
- ভ্যাকসিন বনানা ডক্টরোঁকা কাম নহি, ওয়হ্ সায়েণ্টিস্ট লোগোঁকা কাম হ্যায়, সমঝি!
- যো ভি হো! (সাথে চারটে রাগের ইমোজি)
মনে মনে ভাবছিলাম ভ্যাকসিন বানানো যেন এতই সোজা! ফ্লু ভাইরাস মুখ চেপে হাসছিল, আমি বললাম,
- অ্যাই, হাসছো কেন?
- আরে, আমি ভাবছি যে মানুষগুলোর মধ্যে একদল এযাবৎ খালি খেটেই গেছে। হতে পারে তারা সংখ্যায় খুবই কম, কিন্তু এরাই তো অনেক কিছু আবিষ্কার করে, সৃষ্টি করে। আর তার ফলেই আজ মানুষের জীবনে এত উন্নতি এসেছে। তারা মাথা ঘামিয়ে শুধু খেটেই গেছে আর বাকিরা খালি তার ফলভোগ করেছে আর গালমন্দ করেছে পান থেকে চুন খসলেই।
- সেকি! এসব কি বলছো! এরা আমাদের মতন একজোট নয়, একে অপরের জন্য নয়, তাই বলছো?
- হুমম্... তাছাড়া আর কি! আরে তুমি তো এই সেদিনের, নতুন এসেছ। এরা তোমাকে কোভিড ১৯ বলে একটা কি যেন খটমট নাম দিয়েছে। কেউ কেউ আবার তোমাকে 'নোভেল করোনা ভাইরাস' বলেও ডাকছে। তুমি এতসব অতীতকথা জানবে কি করে? তাহলে বলি শোনো, আমার প্রতিষেধক ভ্যাকসিন তৈরি করতে এরা প্রায় দু'হাজার বছর লাগিয়ে দিয়েছিল, তা কি জানো?
- বলো কি! তুমি দেখা দেবার পর থেকে এতোটা সময় লাগিয়েছে তোমাকে জব্দ করতে!
- হ্যাঁ, তবে আর বলছি কি। সেই ১৯৪২ সালে কি একটা ভ্যাকসিন-ম্যাকসিন বার করলো মাথা খাটিয়ে, তাও সেটা ফুলপ্রুফ না। তাই তো এখনো মাঝেমধ্যে আমি ভেল্কি দেখাই।
দেখি তো এখন টিভিতে কি দেখাচ্ছে। ওমা, মেয়েরা বাপের দেওয়া গ্যাজেট নিয়ে খেলায় মগ্ন, বাবা সোফায় বসে টিভি দেখতে দেখতে কোন ফাঁকে ঘাড় এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে - এসির ভেণ্ট সুইং ফ্ল্যাপের ছন্দে ছন্দ মিলিয়ে নেয়াপাতি ভুঁড়িটা ওঠানামা করছে।
গিন্নি মহারাণী তাঁর বেডরুম-ন্যাকামির পর্ব সেরে ড্রয়িং স্পেসে ফিরে চারদিকে চোখ মেললেন। হাতে ধরা রিমোটের মিউট বাটনে বেখেয়ালে চাপ পড়েছিল বোধহয়, নিউজ চ্যানেলে ছবি আসছে, শব্দ নেই। টিভির রিমোটটা হাত থেকে টেনে নিয়ে ওটা দিয়েই কত্তার ভুঁড়িতে একটা খোঁচা মেরে তিনি কিছুটা রাগত স্বরে বলে উঠলেন,
- এ জী, উঠো! সির্ফ শোতা রহতা হ্যায় সারা দিন, রোজানা এক হি সিন!
কত্তা ধড়মড় করে উঠে বসেই...
- ক্যা বোলি, ভ্যাকসিন? নিকলা ক্যা?
সবাই একসাথে হেসে উঠলো...
- সুবহ বজার সে কটহল তো লায়া। সব্জি খানা হ্যায় তো ব্যয়ঠে ব্যয়ঠে উসে কাটো অভি, কুছ তো সহারা দো ...
গিন্নি ফ্রিজ থেকে একটা ইঁচড় বার করে আনলেন। কাটিং বোর্ড আর ছুরিটা কত্তার হাতে ধরিয়ে বিরক্তিতে গজগজ করতে করতে টিভিটা দিলেন অফ করে। মহা মুশকিল... বেশ দেখছিলাম... চলো, এখানে আর না। অন্য কোথাও...
ফ্লু ভাইরাসকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে এলাম। কয়েকটা বাড়ি খুঁজে একটা বাড়িতে দেখলাম বছর তিরিশের এক ছোঁড়া টিভি চালিয়ে সেই চ্যানেলের অনুষ্ঠানই একমনে দেখছে। সেঁটে গেলাম শুনতে। পর্দায় মেয়েটা আশার বাণী শোনাচ্ছে। বলছে যতদিন না কোভিড ১৯-এর ভ্যাকসিন বেরোচ্ছে, ততদিন চেষ্টা চলবে প্লাজমা থেরাপির সাহায্যে সেটার মোকাবিলা করার। যারা কপালগুণে সুস্থ হয়ে উঠছে, তাদের ওপর কড়া নজরদারি চলতে থাকবে। পরের চোদ্দ দিন যদি তাদের শরীরে আমার সংক্রমণের আর কোনোরকম নতুন লক্ষণ দেখা না দেয়, তখন তাদের শরীরের ব্লাড প্লাজমা নিয়ে দেওয়া হবে সেই রোগীদের, যাদের অবস্থা শোচনীয়, ভেন্টিলেশনে রাখা। যদি বাঁচিয়ে তোলা যায়। কিন্তু এটার সীমাবদ্ধতা হলো, একজন সেরে ওঠা রোগী কেবলমাত্র চার জনকে নিজের প্লাজমা দিতে পারবে।
যাক, শুনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। একজন সংক্রামিত রোগী তো অগুনতি লোকের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারে আমাকে, ধরে নিচ্ছি সেই সংখ্যাটা একশো। যদি তার মধ্যে চারজন বাঁচে সে তো নস্যি, হিঃ হিঃ!
ধন্যবাদ - শ্রী অমরনাথ মুখোপাধ্যায়