কড়চা #১৬ | পাম্প অ্যাণ্ড ডাম্প
কড়চা #১৬ | পাম্প অ্যাণ্ড ডাম্প


০৯ এপ্রিল ২০২০
আচ্ছা, আজ কেন আমার এত গরম লাগছে! চৈত্রশেষের দিন এগিয়ে আসছে, বসন্তও বিদায়ের মুখে। এখানে গ্রীষ্ম তো পয়লা বৈশাখ দিয়ে শুরু হয়, তার তো এখনো ক'দিন বাকি! তবে? পারদ তো সবে ৩৩°, তবে কি গুমোটের জন্যে। লোকেরা বলাবলি করছে, অন্যান্য বছর এই সময়ে নাকি এর থেকেও বেশি গরম থাকে। আসল কারণটা আশা করি বুঝতে পেরেছেন? এই বেয়াড়া গরমটার জন্যে প্রকৃতিকে দোষ দিয়ে কি লাভ! দায়ী তো আপনারাই! বন কেটে বসত - মুছে দিচ্ছেন সবুজের চিহ্ণ, শহরের স্কাইলাইন জুড়ে এখন সারি সারি হাইরাইজ্ বিল্ডিং। না আছে মাটি, না দেখা যায় গাছপালা। কংক্রিট, ইঁট-কাঠ-পাথরে মোড়া শহরটা ধুঁকছে। এ সব কিসের জন্যে - ইনভেস্টমেন্ট অ্যাণ্ড প্রফিট! রাস্তায় সার বেঁধে গাড়ি চলছে। কিসের জন্যে - স্টেটাস সিম্বল। রাশি রাশি জিনিসপত্রে ঠাসা শপিং মল! কিসের জন্যে - স্পয়েলড ফর চয়েস। অথচ দেখুন, বেঁচে থাকার তাগিদে এখন যতটুকু আপনার প্রয়োজন, সব রসদই এমনকি মাস্ক, হ্যাণ্ড সানিট্যাইজার ইত্যাদিও তো ঠিক জুটিয়ে নিয়েছেন। ঢুকে পড়েছেন বাড়ির দুর্গে, সেখানে থেকে ভালোই তো যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন আমার সাথে। তাহলে বাড়তি জিনিস কেন বানান, কেন কেনার জন্যে হাপিত্যেশ করেন, কিসের এত লোভ! এসব ভেবে দেখবেন আমি বিদায় হলে। শুধু ভেবেই থেমে থাকবেন না, চেষ্টাও করবেন নিজেদের স্বভাবচরিত্র, আচার-আচরণ বদলানোর। নাহলে শিগগিরই আবার আমার মতন অন্য কোন আপদ এসে হাজির হবে, আবার মৃত্যুর বন্যায় ভাসবেন...
বন্যার কথায় মনে পড়লো গতকাল রাতে শোনা দু' বন্ধুর কথাবার্তা।
- এই রুদ্রনীলটা কে রে?
- তোর মনে নেই, বেহালাতে থাকতো! ক্লাস সেভেন অবধি পড়েছিল আমাদের সাথে, নীল চোখ...
- ওহ হো! ও ব্যাটাকে কোথা থেকে জোটালি?
- আরে লকডাউন অ্যানাউন্স হতেই আমি ছুটেছিলাম কিছু দরকারি জিনিসপত্র কিনতে। বাজারে গিয়ে ব্যাটার সাথে দেখা। স্কুটার চালিয়ে চলে এসেছিলো আমাদের চেতলা বাজারে।
- বলিস্ কি রে! তা কে চিনলো? তুই...
- হ্যাঁ, দেখতে একইরকম আছে। আমি পরিচয় দিতেই কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। তারপর ডান হাতটা বাড়িয়ে প্রায় জোর করে হ্যাণ্ডশেক করলো। বললো, "হ্যাঁ, মনে পড়েছে, তোমার বাবা তো ডাক্তার... আচ্ছা বলছে এটার ভ্যাকসিন নাকি বেরিয়ে গেছে?"
- তুই কি বললি?
- না-হ্যাঁ কিছুই বলিনি। ভাবছিলাম কতক্ষণে বাড়ি গিয়ে হাত ধোব!
- ঈ-ঈ-স্, কাকে গ্রুপে ঢুকিয়েছিস্ মাইরি! হরিবল্। পরপর চারটে গুড মর্নিং, তারপরেই সাঁইবাবা-বেসড্ ভিডিওর বন্যা...
- আরে আমি তো ওকে আমাদের ক্লাস, স্কুলের প্লাস সাউথ ক্যালকাটা অ্যালুমনি গ্রুপেও ঢুকিয়েছি। নেট রেজাল্ট, আমিও ওই সব মেসেজ চারটে করে পাচ্ছি, রেগুলার।
- এ তো বিরাট চাপ!
- দাঁড়া, আরো আছে, আজ আমাকে ফোন করে বলছে, আমার ওয়াইফের পার্লার আছে, এখন তো "নো টাচ", তাই বন্ধ। ভাবছি শেয়ারে টাকা লাগাবো, এখন তো মার্কেট ডাউন, হাজার পঁচিশেক টাকা দাওনা। একমাসে আঠাশ রিটার্ন দেব তোমাকে।
- বাড়ির ঠিকানা দিস্ নি তো?
- ভাগ্যিস দিইনি!
- দিলে এই বাজারেও হানা দিত হয়ত। তবে শেয়ারের ব্যাপারটা কিন্তু খুব একটা খারাপ বলেনি। মার্কেট স্টাডি করিস্, দেখবি গত তিনদিনে হাজার পয়েণ্টের ওপর উঠেছে নিফটি !
- বলিস্ কি?
- এটাকে পাম্প অ্যাণ্ড ডাম্প বলে...পরে ডিটেলসে বোঝাবো একদিন। ওই ব্লু-আইড বয়ের কথা ছাড়্। এমনিতেও হোঅ্যাটসআপে এত মেসেজ আসছে যে সামাল দিতে পারছি না, সব দেখা হয় না।
- আরে বেশিরভাগই ফালতু!
- কিন্তু কিছু ভালোও থাকে, কাজেরও। এই তালেগোলে সেগুলোও ডিলিট হয়ে যাচ্ছে।
- হুমম্। এক কাজ কর, প্রথমত গ্রুপের কোনো পোস্ট পড়বি না, যতক্ষণ না কেউ রিঅ্যাক্ট করছে। দুই, তোকে ডাইরেক্টলি কেউ ফরোয়ার্ড করলে চেক করে দেখে নিবি কার ফরোয়ার্ডেড মেসেজ। সেনসিবল কেউ করলে তবেই দেখবি, কারণ সেটা ফিল্টার্ড মেসেজ, কাজের হওয়ারই চান্স বেশি। আর ফোনের সেটিংএ গিয়ে অটোমেটিক মিডিয়া ডাউনলোড অপশন অফ্ করে দিবি।
- ভালো বলেছিস্, নাহলে করোনাতে আমি টিকে গেলেও, ফোনটা অক্কা পাবে।
ওরা যে 'পাম্প আ্যন্ড ডাম্প' বলছিলো, শেয়ার মার্কেটে সেটা আসলে যে কি, কাকে বলে তা জানি না। আমার আক্রমণ করার পদ্ধতি কিন্তু অনেকটা ওইরকমই - মানুষের শরীরে ঢুকে পড়ো, যতটা সম্ভব বাড়িয়ে নাও নিজের সংখ্যা আর তারপরেই সেই বেকার শরীরটা ছুঁড়ে ফেলে দাও। হাঃ হাঃ হাঃ।
এদিকে আরেক মজা, গরম বাড়তে থাকলে জলের সাপ্লাই কম হতে থাকবে। এখন প্রচারের চোটে পাব্লিক আমার ভয়ে যত পারছে হাত ধুচ্ছে, এন্তার, কল খুলে। কাল কলকাতা পুরসভা জলের অপচয় ঠেকাতে বৈঠকও করেছে - খেলা জমে গেছে। খেল খিলাড়ি কা!
এই জল নিয়েই আরও একটা ঘটনার কথা বলি। কাল দৃষ্টিহীনদের একটা হোস্টেলে কাটিয়ে এলাম কিছুটা সময়। ঘুরেফিরে, সব দেখেশুনে মনটা কেমন যেন একটু নরম হয়ে গেলো। যাদের জীবনে ছোঁয়ার অনেক দাম, সেটা ছাড়া চলে না, তারাও এখন ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলছে একে অপরের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে। ওদেরই একজন অনেকক্ষণ কল খুলে হাত-মুখ ধুচ্ছিলো। একনাগাড়ে পড়ে চলা জলের শব্দ শুনে আরেক জন বললো,
- অ্যাই, করছিস্ কি! এক হাতে মুখ ধো, অন্য হাতটা দিয়ে কলটা খোলা-বন্ধ কর, জল কম নষ্ট হবে।
ধন্যবাদ - শ্রী অমরনাথ মুখোপাধ্যায়