SHUBHAMOY MONDAL

Drama Thriller

3.5  

SHUBHAMOY MONDAL

Drama Thriller

অন্ধকারের যাত্রী

অন্ধকারের যাত্রী

4 mins
454


অন্ধকারের যাত্রী

শুভময় মণ্ডল


২০০০ সালের ঘটনা। শান্তিনিকেতন যাচ্ছি - বিএস সি জুলজী/বোটানী অনার্সের অ্যাডমিশন টেস্ট দিতে। তুমুল বৃষ্টি চলছে, অজয় প্রায় দু'কূল ছোঁয়। ছাতার বাধা অগ্রাহ্য করে, দাম্ভিক বর্ষা এসে বারংবার ছুঁয়ে গেলো - শরীরের পোশাক পরিচ্ছদ। 


সর্দির ধাত আমার জন্মসূত্রে লব্ধ। বৃষ্টির বদান্যতায় স্বভাবতই সে আমার সঙ্গী হলো। যাবার কথা ছিল আমার মাষ্টার মশাইয়ের বাড়ি। কিন্তু এই বৃষ্টিতে আরও ভেজার সাহস দেখাতে, মন সায় দিল না। অগত্যা বিশ্বভারতীর গেস্ট হাউস - একটা ডর্মিটরী মত ছিলো তখন - সেখানেই আশ্রয় নিলাম। রাতে একটু পড়াশুনা করার ইচ্ছে ছিলো, কিন্তু শরীর সাথ দিলো না।


পরদিন, ব্যাগ থেকে শুকনো জামা প্যান্ট একটা বের করে নিলাম পরীক্ষায় বসার আগে। পরীক্ষায় বসেই টের পেলাম - শরীরে জ্বর বাড়ছে, আর সেই সঙ্গে বাইরে বৃষ্টিও। পরীক্ষার পার্ট চুকিয়ে দৌড় দিলাম বোলপুর স্টেশনের দিকে। সঙ্গে স্কুলেরই আমার এক সিনিয়র দাদা - রাজীব দা ছিলো।


তিনটে চল্লিশের বামদেব এলো চারটে চল্লিশে! সেও আবার ভেদিয়ার কাছে এসে আরো আধ ঘন্টা দাঁড়িয়ে রইলো। পিচকুরির ঢাল অতিক্রম করলো যখন তখন সাড়ে পাঁচটা। গুসকরায় নামলাম পাঁচটা চল্লিশ! বাড়ির দিকে যাবার আর কোনো বাস নেই!


অনেক অপেক্ষা করার পর, একটা বাস পেলাম যেটা আবার মুরাতিপুর অবধি যাবে। রাজীবদা বললো - ভাই, চলে যাই চল। এখন সাড়ে ছটা, যদি সাতটাতেও ওখানে নামায়, আমরা বলগোণা পর্যন্ত তিন সাড়ে তিন কিমি রাস্তা হেঁটে দেবো। পৌনে আটটায় আমাদের রুটের লাস্টবাস, বর্ধমান থেকে ওখানে এসে, দাঁড়ায় পনেরো মিনিট। আটটার মধ্যে ওখানে গেলেই বাসটা পেয়ে যাবো।


ব্যস, দুজনে রওনা দিলাম। মুরাতিপুরে নেমেছি, তখন ঝিম ঝিম করে বৃষ্টি হচ্ছে। দুজনে ছাতা মাথায় হাঁটছি, উষা গ্রামের শ্মশানটা পড়ে ঠিক ঐ রাস্তার ওপরেই। তখন, শুধু ছাউনি ছাড়া আর তো কিছুই ছিলো না সেখানে। আমরা যখন কাছাকাছি পৌঁছেছি, তখন দেখি দাউ দাউ করে জ্বলছে চিতা! কিন্তু আসে পাশে, কেউ কোথাও নেই, আশ্চর্য!


এমন সময় দমকা হাওয়ায় ছাতাটা গেলো উল্টে! তীব্র আক্রোশে ঝোড়ো হাওয়া যেন, ভিজে কাপড় নিংরানোর মত করে, দলা পাকিয়ে মুচড়ে দিলো আমাদের ছাতাদুটো! শ্মশানের দিক থেকে হুক্কা হুয়া ডাকে তাতে সায় দিলো দুটো শিয়াল। আর সেই দলে যোগ দিলো তুমুল বেগে বৃষ্টি আর তীব্র বেগে হাওয়া।


নিজেদের এক একটা পা ফেলে এগিয়ে যেতেও যেন ভীষণ কষ্ট হচ্ছে! মনে হচ্ছে একটা হাওয়ার জাল দিয়ে আমাদের আটকে, পিছন পানে ঐ শ্মশানের প্রজ্জ্বলিত চিতার দিকে, টানছে কোন এক আসুরিক শক্তি! আমরাও দমবার পাত্র নই, প্রাণপণে তাকে অগ্রাহ্য করে, সামনের দিকে এক পা, এক পা করে এগোচ্ছি।


অন্ধকারে পা হরকে যাচ্ছে, চলতে প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে, তবু আমরা থামছি না দেখে, সেই আসুরিক শক্তির বুঝি সহানুভূতি জন্মালো আমাদের প্রতি। তাই পথ দেখতে আমাদের সুবিধা করে দেবার জন্য, চিতার সেই আগুনের শিখাকে সঙ্গী করে দিল আমাদের!


আমরা সামনের দিকে প্রায় পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রী ঝুঁকে, পা ফেলে দুজনে সামনে এগোবার চেষ্টা করছি। আর রাস্তার নয়ানজুলির পাশে, আমাদের থেকে সমান্তরালভাবে দূরত্ব রেখে, একই তালে চলেছে সেই জ্বলন্ত চিতাটাও! ঝড়, বৃষ্টির প্রভাব আমাদের ওপর পড়লেও, না তো জ্বলন্ত চিতাটার কিছু হচ্ছে, নাই তার অনুগামী রক্তচক্ষু শিয়ালগুলোর!


রাজীবদা আমায় বলছে - ভাই, ওদিকে তাকাস না, ওরা আমাদের আটকাবার জন্যই এসব করছে। ভুল করে এখানে এসে পড়েছি অসময়ে, কিন্তু এখন থামা যাবে না কিছুতেই, তাহলেই সব শেষ। আরও পাঁচ ছয়শো মিটার যেতে পারলেই শুরু হবে জনবসতি। তখন ওরা ফিরে যাবে, আমরাও বাসটা পেয়ে যাবো। একটু চোখ বন্ধ করে হাঁট।


আশ্চর্যের জিনিস আরও একটা ছিলো - এত ঝড়, জল হচ্ছিল কিন্তু, না তো বিদ্যুত চমকাচ্ছিল, নাই কোনো বজ্রপাতের শব্দ শুনতে পেলাম। অবশ্য, যেটা শুনতে পাচ্ছিলাম সেটা আরও বেশি ভয়ঙ্কর -বুক কাঁপানো ঐ দীর্ঘাঙ্গ শিয়ালগুলোর, থেকে থেকে মিলিত হুক্কা হুয়া চিৎকার। মনে পড়লে - তাদের সেই জ্বলন্ত চোখগুলো আর চিতার সেই আগুনে স্পষ্টভাবে দেখতে পাওয়া, লালাঝরা তাদের লকলকে জিভগুলো, আজও বুক কেঁপে ওঠে, বাবা রে!


বলগোণা যেতে যেতে আটটা বাজলো, সেই লাস্ট বাসটা যথারীতি ছেড়ে চলে গেছে। দোকান পাট সব বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এক এক করে। দৌড়ে একটা ওষুধের দোকানে ঢুকলাম, গায়ে জ্বর আর বৃষ্টিতে ভেজার কথা বলে ওষুধ নিলাম। কিন্তু খাবার জল নেই, দোকান বন্ধ করবে বলে, তারা সব জল ফেলে দিয়েছে। অগত্যা সরাসরিই গিলে নিলাম ওষুধ গুলো।


ওখান থেকে আরো সাত কিমি হেঁটে, রাজীবদার বাড়িতে গিয়ে যখন পৌঁছালাম, তখন আর বিশেষ হুঁশ নেই আমার। সারারাত দুটো কম্বল, একটা চাদর এবং লেপ চাপা দিয়েও যেন শীত কমছিলো না আমার! পরদিন দুপুরে জ্ঞান ফিরলে, আমার ঐ স্কুলেরই আর এক দাদা, সুদীপদা তার সাইকেলে চাপিয়ে আমায় বাড়ি ছেড়ে এলো। 


ততক্ষণে, প্রবল বন্যায় সারা রাজ্যই প্রায় জলের তলায়। সেই রাতের ঘোর কাটতে আমার বেশ সময় লেগেছিলো - প্রায় এক সপ্তাহ! তীব্র জ্বরের মধ্যে, তখন মাঝে মাঝেই শুনতে পেতাম, সেই শিয়ালগুলোর তীব্র চিৎকার, আর চোখে ভাসতো বারবার সেই জ্বলন্ত চিতাটা।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama