শ্মশানযাত্রীর দুঃস্বপ্ন
শ্মশানযাত্রীর দুঃস্বপ্ন
শ্মশান যাত্রীর দুঃস্বপ্ন
শুভময় মণ্ডল
ঘটনাটা প্রায় বছর চল্লিশেক আগের কথা। তখন আমাদের গ্রামে, মরা পোড়ানোর জন্য বাঁশের খাটিয়ায় করে গঙ্গার পাড়ে নিয়ে যাওয়ারই রেওয়াজ ছিল। মরে গঙ্গা না পেলে, মৃত/মৃতার আত্মার শান্তি হয় কি হয়না জানিনা, কিন্তু তাঁর ছেলে মেয়েরা যে পাড়া প্রতিবেশীদের কটূক্তির স্বীকার হয়ে, অশান্তিতে থাকতে বাধ্য হতেন - এটা ঘটনা।
যা হয় আর কি, সব গ্রামেই - বাপে খেদানো, মায়ে তাড়ানো গোছের কিছু তরুণ থাকেই সব সময়, যারা বেশির ভাগই শিক্ষিত কিম্তু বেকার, এবং ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোই তাদের অলিখিত পেশা! তো আমাদের গ্রামও তার ব্যতিক্রম ছিলো না!
গ্রামের গোটা দশেক ছেলেকে তো সবসময় পাওয়া যেত শ্মশানযাত্রীর দলে! এই ঘটনাটার স্বীকার তাদেরই একজন হয়েছিলো। ছেলে ছোকরার দল কোন অকৃতদারের শবদাহ করতে বেরোলে, ইয়ার্কি ঠাট্টা তামাশার অন্ত রাখতো না। আর সেটাই কাল হলো তাদের!
যে ভদ্রলোকের শবদাহ করতে চলেছিলো তারা সেদিন, তিনি ছিলেন গ্রামের অন্যতম বিত্তশালী, কৃপণ এবং তাদের ভাষায় একেবারে হাড় বজ্জাত! একটা ছোট্ট ঘটনার কথা বললেই বোঝা যাবে, তাঁর ওপর ছেলেদের রাগের কারণ।
ছোটকত্তা (ঐ ভদ্রলোককে গ্রামে ঐ নামেই ডাকতো সবাই।) একবার নিজের পুকুরের একটা ধার ধরে, প্রায় বিঘে তিনেক জায়গা বেড়া দিয়ে ঘিরে আমবাগান বানিয়ে ছিলেন। সারা দিন রাত সেখানেই একটা মাচা বেঁধে তিনি শুয়ে থাকতেন - আম পাহারা দেবার জন্য! কস্মিন কালে কাউকে একটা ঝড়ে পড়া আমের আঁটিও দেন নি তিনি!
তো ছেলেদেরও রোখ চাপলো - চেয়ে যখন পেলাম না, চুরি করে পেড়ে নিয়ে আসবো! ব্যস, একদিন রাতে, আমার বাবার কাছে টিউশান পড়ার মাঝে, বাথরুম করতে যাবার নাম করে বেরিয়ে গিয়ে, তারা বেড়া টপকে ঢুকলো সেই আমবাগানে!
আম পাড়া চলছে এমন সময়, ছোটকত্তার কোন কারণে সন্দেহ হওয়ায় সেদিকে আসেন। তাঁকে আসতে দেখে, বাকিরা তো মার দৌড় - বেড়া টপকে পালালো। কিন্তু গাছের ওপরে ছিলো বাপিন, তার আর পালানো হলো না। তার আগেই ছোটকত্তা এসে আস্ফালন শুরু করলেন - কে রে ওখানে, নেমে আয়। আজ তোরই একদিন, কি আমারই একদিন! নেমে আয়, কে রে তুই?
বাপিন দেখলো তার ধরা পড়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন পথ নেই! তাই বাঁচার একটা শেষ চেষ্টা করলো - তড়াং করে ছোটকত্তার গায়ে লাফিয়ে পড়ে, উত্তর দিলো - তোর বাপ! বলেই সেও বেড়া টপকে দিলো দৌড়। ছোটকত্তা তার ধাক্কায় পড়ে যাওয়ায়, আর ঘটনার আকস্মিকতায়, সেই মুহুর্তে কিছুই করে উঠতে পারলেন না।
কিন্তু দমবার পাত্র তিনিও তো নন। সেটা টের পেল সবাই পরের দিন সন্ধ্যায়। সবাই আমার বাবার কাছে পড়তে এসেছে টিউশানি, এমন সময় ছোটকত্তা এসে হাজির। বারান্দায় বাপিনের ঠিক সামনেটায় এসে বসে, বললেন - বাবা গো, এলাম!
আমার বাবা তো শুনে হতবাক - কি হ'ল ব্যাপারটা? ছোটকত্তাই তখন আগের রাতের পুরো ঘটনা বললেন বাবাকে। আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমাদের সেই খড়ের চালের বারান্দার চালের বাতায় গোঁজা ছিল - লাঙল দেবার সময় গরু ঠ্যাঙানোর পাঁচন (বাঁশের মোটা কঞ্চি বলা যেতে পারে), সেটাই নামিয়ে এনে বেধরক মার মেরেছিলো বাবা বাপিন আর ওর বন্ধুদের।
তো এ হেন ছোটকত্তার শবদাহে চলেছে কিনা বাপিনদের সেই গ্রুপটাই - যাদের সাথে বরাবর সাপে নেউলে সম্পর্ক ছিল তাঁর জীবদ্দশায়! যাই হোক, তারা তখন ঐ বিশেষ সমাজসেবাটিতে গ্রামে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছিলো, তাই কেউই অনিচ্ছা সত্ত্বেও না করতে পারলো না।
সেদিন আবার গুরুবার, অমাবস্যা কিংবা প্রতিপদের রাত - খুব গভীর অন্ধকার। তাদের সাথে একটা হ্যাজাক আর লিটার দশেক কেরোসিন তেলের একটা জার ছিল - এইটুকুই যা ভরসা। সেই আলোয় ফাঁকা জায়গার বেশি দূর অবধি এমনিও অবশ্য দেখা যায় না। তার ওপর আবার তিন তিনবার ডানদিক থেকে এসে রাস্তা কেটে চলে গেলো শিয়াল, যা অশুভ লক্ষণ বলেই ধরা হয় সাধারণত।
শবদেহ নিয়ে গ্রাম ছাড়ার পরই ওরা ঠিক করলো - দুষ্টু ছোটকত্তা বেঁচে থাকতে তাদের অনেক জ্বালিয়েছেন, কিন্তু এবার তো আর তাঁর কিছু করার নেই, ওরা শোধ নেবে তাঁর মরার ওপরেই। সেইমত, নদীর চড়ে শ্মশানে পৌঁছে, প্রথমেই প্রত্যেকে একটা করে চেলা কাঠ তুলে নিয়ে, বেধরক ধোলাই করলো মৃত ছোটকত্তাকে।
তারপর, শবদাহের আগে কিছু খেয়ে নেবে ঠিক করলো তারা। নিয়ম অনুযায়ী, শবদেহ ছেড়ে তো যাওয়া যায় না, কিন্তু তাদের তখন কোনো নিয়ম মানারই ইচ্ছে ছিল না তাঁর ব্যাপারে। কিন্তু এই মাটিতে মরা রেখে যাওয়াটাও ঠিক হবে না ধরে নিয়ে, সবাই মিলে কাঠের বোঝার ওপর দাঁড়িয়ে, কাপড়ে ঢাকা শবদেহটাকে পাশের গাছের ডালে বেঁধে দিলো!
শুধু হরি আর রামু গেলো না খেতে। ওরা চুলোর কাঠগুলো সাজাতে লাগলো। ঘন্টা খানেকের মধ্যেই চুলো সাজানোও হয়ে গেলো, আর তাদের খাওয়া দাওয়াও! এবার শবদেহটা চিতায় তোলা আর তাতে আগুন দেওয়াই বাকি রইলো।
বোঝাটা না থাকায় মাটি থেকে শবদেহ নামানো মুশকিল হলো! অগত্যা বাপিন গাছে উঠলো একটা কাস্তে নিয়ে। মাথার আর পায়ের দিকের বাঁধনটা কেটে, হেঁট হয়ে বসে কোমরের বাঁধনটা কেটেছে কি কাটেনি - ছোটকত্তার একটা হাত দেখে তার চুলের মুঠি ধরে রেখেছে! ভয়ে আঁতকে উঠে, চিৎকার করে উঠতে উঠতেও চুপ করে যায় সে!
বাকিরা, তার এই অবস্থার কথা জানতে পারলে সব ছেড়ে পালাবে! তাই নিজেই চেষ্টা করতে থাকলো চুলটা ছাড়াবার তাঁর হাত থেকে, কিন্তু কোন ফল হয়না! এইরকম ভয়ঙ্কর অবস্থায় সে আগে কখনও পড়ে নি! বিপদে আছে, সঙ্গীরাও আছে, অথচ তাদের থেকে সাহায্য চাওয়া যাবে না।
অগত্যা কাস্তে দিয়ে মুঠিসমেত তার চুলের গোছাটা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে কেটে ফেলে সে! তার মাথার মাঝখানের সব চুলই প্রায় মুড়িয়ে কেটে ফেলতে হয় তাকে। তারপরই এক টানে মরার কোমরের বাঁধনটাও কেটে দেয়, আর গাছের ওপর থেকেই ধপাস করে নিচে এসে পড়ে ছোট কত্তার শবদেহটা।
তারপর সাবধানে গাছ থেকে নেমে আসে। রামুর কাছ থেকে জলের জগটা নিয়ে, ঢক ঢক করে এক পেট জল খায় কাঁপতে কাঁপতে! বাকিরা শবদেহটা ধরাধরি করে চুলোয় তোলার সময় দেখে - তাঁর হাতের মুঠো ভর্তি একগোছা চুল! তারপর বাপিনের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারে সেটা কোথা থেকে এল!