এ কেমন প্রতিহিংসা
এ কেমন প্রতিহিংসা
ভূতপূর্বাংশ
সে তখন ইংরেজ আমলের শেষ দিক। বিদায় আসন্ন বুঝতে পারার পর, অপিসে তখন নিজেদের দোর্দণ্ডপ্রতাপ বজায় রাখার জন্য, লালমুখো ইংরেজ কর্তারা ভয়ংকর হম্বিতম্বি শুরু করে দিয়েছিলেন।
কোনো কর্মচারীর উপর খাপ্পা হয়ে, তাকে “ফায়ার করা” – সেই সময় খুব সাধারণ ব্যাপার ছিলো ঐ বসদের জন্য। আত্মসম্মান থাকা কত সজ্জন ব্যক্তি, তখন ঐসব কারণে চাকরী হারিয়েছিলেন!
তাদেরই একজন ছিলেন টোভার সাহেব। তো সেই টোভার সাহেব, সত্যি সত্যিই একদিন – প্রচণ্ড তর্কাতর্কির পর একজন কর্মচারীকে রাগের বশে আক্ষরিক অর্থেই ফায়ার করে বসলেন, মানে গুলি করে মারলেন আর কি!
সেই কর্মচারী ভদ্রলোকের আবার, স্বাধীনচেতা বাঙালীদের মধ্যে খুব জনপ্রিয়তা ছিল। ভিতরে ভিতরে নাকি বিপ্লবীদের, দেশভক্তদের তিনি মদতও করতেন!
যাই হোক, তাঁকে গুলি করা মাত্রই প্রতিবাদে উঠে দাঁড়ালো অফিসেরই চারজন কর্মচারী – যারা নাকি তখন স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল।
তাদের কাছে ছিল রিভলভারও! তাই সাহেবের ঐ অন্যায় দেখে, চারজনে একসাথে চারদিক থেকে গুলি করে ঝাঁঝড়া করে দিলো টোভার সাহেবকে – তাঁর নিজের অফিসেই, সবার সামনেই!
তারপর আর কি, সেই অফিস বন্ধ হলো, পুলিশ পোস্টিং বসলো সেখানে। আর টোভার সাহেবের ঐ প্রাসাদ পড়ে রইলো বেওয়ারিস হয়ে। তারপর একদিন এই দেশও স্বাধীন হলো।
সেই প্রাসাদও তারপর একদিন হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়লো হঠাৎ। সরকার থেকে তখন ঐ বেওয়ারিস সম্পত্তি দখল করে, ইঁট কাঠ সব সাফ করিয়ে সেটাকে বাচ্চাদের জন্য পার্ক কাম খেলার মাঠ বানিয়ে দেওয়া হলো।
কাহিনীর সূত্রপাত
আমাদের ছেলেমেয়েদের অ্যনুয়াল ডে ফাংশান হচ্ছিলো এবার ঐ টোভার গার্ডেনেই। আজ সন্ধ্যায় সেখানে তাদের একটা নৃত্যানুষ্ঠান ছিলো।মাঠের একধারে, ইনডোর গেমের স্থায়ী টেন্টের দোতলার একটা ঘরকে ব্যবহার করা হচ্ছিলো গ্রীনরুমের জন্য। স্টেজ বানানো হয়েছিলো তার পাশেই।
আমি, আমার এক বন্ধু, আর আমার এক জুনিয়র ভাই – স্টেজের পিছন দিকটায় অপেক্ষা করছিলাম। কারণ, প্রোগ্রামটায় এরপরেই আমার বন্ধুটির মেয়ের এন্ট্রি ছিলো। আর সবশেষে এণ্ডিং পার্ট ছিলো ঐ জুনিয়র ভাইটির, সে-ই আজকের এই অনুষ্ঠানের হোতা।
বন্ধুর মেয়ে তো স্টেজে উঠে গেলো। এরপর ঐ জুনিয়র ভাইয়ের পালা। সে তাড়াতাড়ি প্রাচীরের ধারে একপাশে গেলো বাথরুম করতে। তারপর অদ্ভুতভাবে, সোজা গটগট করে স্টেজের দিকে এগিয়ে গেলো!
এই ভাইটি আমার খুবই স্নেহের পাত্র। এইরকম অনুষ্ঠানে সাধারণত স্টেজে ওঠার আগে নিজে থেকেই এসে, সে আমার শুভেচ্ছা নিয়েই স্টেজে যায়। তাই, ওর আজকের এই আচরণ একটু যেন অদ্ভুতই লাগলো আমার!
আমার বন্ধুটি আবার নিজের মেয়ের স্টেজ-পারফরমেন্স দেখতে পারে না, টেনশান হয়! তাই, ওর গিন্নি স্টেজের সামনে থেকে পুরো অনুষ্ঠানের ভিডিও রেকর্ডিং করছিলো। আর সে নিজের টেনশন কাটাতে আমায় বললো – চল, আমরাও গিয়ে একটু টয়লেট করে আসি। এখনই তো প্রোগ্রাম শেষ হলেই, আবার ডিনারের জন্য দৌড়াতে হবে।
আমার অবশ্য না ডিনারের তাড়া ছিল, না প্রকৃতির ডাকের কোন বেগ। যাই হোক, তার অনুরোধে ঐ জুনিয়র ভাইটির মতই, আমরাও প্রাচীরের পাশের সেই জায়গাতেই ঐ অনুচিত কর্মটি করতে গেলাম। সেখানে প্রসাব করার সময়েই, আমার শরীরে কেউ যেন একটা ধাক্কা দিলো বলে মনে হলো আমার!
কি লগ্নে, কোন রাশীতে আমার জন্ম জানা নেই, কিন্তু ভূত প্রেতেরা আমায় দর্শন দিলেও কখনই বিশেষ প্রভাবিত করতে পারে না। এইতো, আজই সন্ধ্যায় আমার তিন বছর আগে মৃতা দিদিমাকেই যেমন দেখতে পেলাম, এখানেই, তার সাথে কথাও বললাম।
গ্রীনরুমের নিচে বারান্দায় বসে ছিলো দিদিমা। আমায় দেখে বললো – আয়, তোর জন্যই তো অপেক্ষা করছিলাম। এত দেরী করে আসলি কেন?
আমি হেসে বললাম – তুমি তো তিন বছর আগেই পটল তুলেছো। এখানে আবার আসা কেন? বলে তার মুখে আমার হাতের টর্চের আলোর ছটা মারলাম, আর দিদিমাও নিমেষের মধ্যে অন্ধকারে গায়েব হয়ে গেলো।
।ক্রমশ।