গঙ্গাজল সই
গঙ্গাজল সই
১.
"কবের থেকে এরকম হচ্ছে?"
"তেমন বলতে গেলে গত তিন-চার মাস ধরেই", রণিতা বলল, অর্ণবকে একবার দেখে নিয়ে।
"আর তার আগে তেমন কিছু কখনো সেন্স করেন নি আপনারা?"
রণিতা কাঁধ ঝাঁকালো কিছু মনে করতে না পেরে। অর্ণব বলল -- "দেখুন সে ভাবে বলতে গেলে -- প্রথম প্রথম, রিচার এক্সিডেন্টের পর ও বেশ কিছুদিন কোনো কথাই বলছিলো না। আমরা অনেকভাবে ওকে কথা বলানোর চেষ্টা করিয়েছিলাম। কোনো ফল হয় নি। তারপর আসতে আসতে -- অন্তত প্রায় মাস তিনেক বাদে, ও সারা দিতে শুরু করলো। কথা বললে, কথার উত্তর দেয়, বারান্দায় খেলে, ওর 'মিকু'র সাথে খেলাধুলো করে", অর্ণব ম্লান হাসলো -- "জানেন, কিছুদিনের জন্য হলেও মনে হয়েছিল....বোধহয় আমরা দুই মেয়েকেই হারালাম। খুব ভয় গেছিলাম, জানেন? রিচার ওরকম একটা ব্যাপার, সেটার ধাক্কা মিটতে না মিটতেই এরকম --"
"একটা জিনিস নোটিস করেছেন কখনো কি", ডাক্তার ভদ্র কথা কেটেই বললেন -- "আপনাদের মিকু -- ওটা তো একটা পাগ, তাই না? ছবি দেখে তো তাই মনে হলো...."
"হ্যাঁ, পাগ", রণিতা বললো।
ডাক্তার ভদ্র চশমা খুলে তাকালেন রণিতার দিকে -- "রিচা আর চারি। জমজ বোন। Maternal zygote -- দুজনকে এতটাই একরকম দেখতে, যে আপনারা নাম দুটো ও একই রেখেছেন। বাইরে থেকে দেখে দুজনকে আলাদা করা যায় না, গলার স্বর, ইচ্ছে-অনিচ্ছে ও খানিকটা একই। তফাৎ হলো ওদের ব্যবহারে। একজন ভীষণ ডানপিটে, ভয়ানক দুরন্ত। আরেকজন খুব চুপচাপ। আপাতদৃষ্টিতে খুব কনফিউসিং লাগলেও, যখন এমনটা হয়, তখন এটার প্রভাব সব থেকে বেশি পড়ে -- বাড়িতে পোষা কুকুর বা বেড়ালের ওপর।"
রণিতা আর অর্ণব মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো।
"আপনার কুকুর বুঝতে পারে কোনটা কে। ওরা নিজেদের মতন বুঝে নেয় কার সাথে কিভাবে মিশতে হয়: একজন একটু ডানপিটে, দুরন্ত -- তখন ও নিজের থেকেই ওর সাথে ও ভাবেই মিশবে। খেলছে, লাফাচ্ছে, দৌড়াচ্ছে, যত্তরকমের সব ছেলে-মানুষী -- যেন ওর পাশে বসা, স্কুলের বন্ধু। আরেকজন একটু গম্ভীর। ওর সাথে থাকলে নিজের থেকেই ও একটু চুপচাপ হয়ে যাবে, চুপচাপ বসে আছে, নড়া-চড়া করছে না। যেন এক ধাক্কায় কত বড় হয়ে গেছে। এটা...এই ক্ষমতাটা কুকুরদের মধ্যে খুব থাকে।"
রণিতার মনে পড়লো। হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন। মিকু দুজনের সাথে দুভাবে মিশতো। ওর খুব মনে আছে।
"রিচা। রিচার একসিডেন্ট", ডাক্তার ভদ্র বললেন -- "সত্যি -- ব্যাপারটা ভাবলেই ভয় লাগে। এইটুকু একটা বাচ্ছা...আর ওরকম একটা ঘটনা।"
রণিতা অন্য দিকে চাইলো, অর্ণব ওর হাতটা নিলো নিজের হাতে।
"আর তারপর -- কিছু মাস বাদে চারি বলছে ও চারি নয়, ও আসলে রিচা?"
অর্ণব মাথা নাড়লো -- "যার মানে দাঁড়াচ্ছে -- আমরা চারিকে হারিয়েছি, রিচাকে নয়।"
ডাক্তার ভদ্র হাসলেন -- "এটার উত্তর কে দিতে পারবে জানেন? আপনাদের মিকু। ওর ব্যবহারটা দেখেছেন? যেভাবে রিচার সাথে মিশতো, সেইভাবেই মিশছে কিনা চারির সাথে?"
রণিতা ফিরে চাইলো ডাঃ ভদ্রের দিকে।
"এটা কখনো লক্ষ্য করেছেন কি?"
"হ্যাঁ...ঠিক বলেছেন", অর্ণব যেন কিছু মনে করার চেষ্টা করলো -- "মিকু রিচাকে দেখলেই লাফ-ঝাঁপ শুরু করতো, এখন চারিকে দেখেও শুরু করেছে।"
ডাঃ ভদ্র তাকালেন চারির দিকে। দূরে বসে একটা একুয়ারিয়ামের মাছ দেখছে।
"রিচা সেদিন ব্রাউন রঙের একটা ফ্রক পড়েছিল, আর চারি নীল রঙের", অর্ণব বললো -- "আমার মা এসেছিলেন সেদিন। আমি আর মা রান্নাঘরে ছিলাম। আর রণিতা ওর ঘরে -- অফিসের কিছু কাজ করছিলো। এমন সময় চিৎকার। ভয়ানক চিৎকার। আমরা বাইরে এসে দেখি...", অর্ণবের গলাটা ধরে এলো -- "রিচা লনের মাটিতে পড়ে আছে, মাথাটা ফেটে গেছে। চারি ওর পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে।"
রণিতা বললো -- "ওরা ছাদে ছিল। ওখান থেকে পড়েছে রিচা।"
ডাঃ ভদ্র উঠলেন। চারি আঙ্গুল দিয়ে দিয়ে হার্মিট-ক্র্যাবটার দিকে তাকিয়ে কি যেন বলছে।
চারি? না রিচা? শিবলিং রাইভালরি? ব্যাপারটা নতুন কিছু নয়। দুই বোনের ভিতর প্রবল ঝগড়া, বাইরে থেকে বোঝাই যায় না। আমায় মা বেশি ভালোবাসে না -- মা ওকে বেশি ভালোবাসে। বাবা ওর সাথেই বেশি থাকে, আমার সাথে নয় -- এইগুলো অন্তর্দ্বন্দ্বের ট্রিগার পয়েন্ট একেকটি। শুনতে হাসি পেলেও এর ফলশ্রুতি মাঝে মাঝে অনেকদূর অবধি ও গড়াতে পারে।
সেদিন কি এরকমই কিছু হয়েছিল? ডাঃ ভদ্র থামলেন চারির কাছে এসে। ছাদের থেকে বোনের সাথে জামা অদল-বদল করে ঠেলে ফেলে দিয়ে --
"চারি?"
চারি ঘুরে দেখলোই না।
"চারি?", ডাঃ ভদ্র হাঁটু গেড়ে বসলেন ওর পিছনে।
"আমার নাম চারি নয়। আমি রিচা। ঋষিলতা।"
"কিন্তু -- তুমি তো তোমার স্কুলের বইতে লিখেছো তোমার নাম চারি। চারুলতা।"
"আমি লিখিনি -- ওগুলো চারির বই। ওর নাম লেখা আছে।"
"আচ্ছা -- বেশ", চারিকে ডাঃ ভদ্র কোলে নিয়ে চোখ গোল গোল করে জিজ্ঞেস করলেন -- "একটা খেলা খেলবে? ভারী মজার খেলা।"
"কি খেলা? কি খেলা?"
"বলছি -- এই দেখো", উনি চারিকে একটা হাই-ব্যাকেড চেয়ারে এলিয়ে দিলেন -- "আমি এখন থেকে একশ গুনবো -- তুমি আমার কথা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়বে। তারপর ঘুম ভাঙাবার পর -- তুমি একশ গুনবে, আমি ঘুমাবো, কেমন?"
অর্ণব আর রণিতা এগিয়ে এলো -- ডাঃ ভদ্র হাত তুলে থামালেন ওদের -- "আপনারা এখানেই থাকুন। আমি deep hypnosis করবো -- সময় লাগবে। তবে অনেক উত্তরই পাওয়া যাবে।"
২.
"শুনতে পাচ্ছ? আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?", ডাঃ ভদ্র'র গলা ক্ৰমশঃ হালকা হতে হতে এমন হয়ে গেছে বোধহয় পাশে যে বসে থাকবে সেও শুনতে পাবে না -- "এই দেখো আমি পুরো একশ গুনলাম। শুনতে পাচ্ছ আমার কথা?"
উত্তর নেই।
"চারি? আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?"
উত্তর নেই। ঘরের হালকা, হলুদ বাল্বের আলোয়, ছোট্ট মেয়েটি ঘুমে ঢোলে পড়েছে, ছোট্ট দুটো ঠোঁট দিয়ে ঘরর..ঘরর আওয়াজ করতে করতে।
"চারি?"
ডাঃ ভদ্র'র কপালটা ঘামছে। এত ছোট্ট বাচ্ছার ওপর হিপ্নোসিস করাটা কি ঠিক ছিল?
"চারি?"
ডাঃ ভদ্র এগিয়ে এসে গলার জোরটা একটু বাড়ালেন -- "চারি?"
"হুম?"
ডাঃ ভদ্র'র ধড়ে যেন প্রাণ এলো -- না, না আমার ক্যালকুলেশন ভুল হতে পারে না। এই জিনিস আমি কমপক্ষে হাজার হাজার মানুষের ওপর চালিয়েছি -- ভুল হতে পারে না আমার এই বিজ্ঞান।
"তোমার বোন -- রিচাকে তোমার মনে আছে?"
"হ্যাঁ।"
"তুমি নিজেকে রিচা বলছো কেন চারি? তুমি তো রিচা নও।"
উত্তর নেই।
"চারি?"
"হ্যাঁ -- আমিই রিচা।"
বেশ ফাঁপরে পড়লেন ডাঃ ভদ্র -- "এই যে বললে তুমি চারি?"
"চারি অনেক ভিতরে আছে। একটা ঘরের ভিতর। ও বেরোতে পারছে না -- তাই আমি এসেছি। ও বেরিয়ে এলেই আমি চলে যাবো"
"কোন....কোন ঘরে আছে ও? কোথায় আছে ও?"
উত্তর নেই।
কি বলছে এসব মেয়েটি। রিচা না চারি —— "চারি?"
"হুম?"
"কোথায় আছে চারি? তোমার বোন?"
"ওই যে।"
"কোথায়?"
"তোমার...."
"আমার?"
"তোমার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে।"
চমকে উঠলেন ডাঃ ভদ্র। আমার পিছনে কে দাঁড়িয়ে আছে? ফিকে রঙের গ্রান্ডফাদার ক্লকের টিকটিক ছাড়িয়ে ঘরের আলোটা যেন মরেই গেছে। মেঝের ওপর পাতা ফরাসের ওপর বসে, প্রোঢ় ডাক্তারবাবু পিছন ফিরলেন আসতে আসতে।
হালকা মেরুন রঙের দেয়ালটার সামনে একটা আবছায়া।
একটা বাচ্ছা মেয়ে দাঁড়িয়ে।
হ্যাঁ। হুবহু দেখতে কিন্তু চারিরই মতন।
ছ্যাৎ করে উঠলো ডাঃ ভদ্র'র বুকটা। "কে...কে ওখানে?"
এগিয়ে এলো ছায়ামূর্তি -- "আমি চারি। তুমি ভুল বলছিলে -- ও রিচা, আমি চারি।"
৩.
অনির্বাণ।
কিছুতেই অনির্বাণকে আর ভুলতে পারলো না রণিতা। বেশ কিছুদিন গাঁজা আর কোকেনের ভিতরে থাকার পর ব্যাপারটা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছিলো। অর্ণব, অর্ণবের মা, অর্ণবের সবকিছুতেই হস্তক্ষেপ, সিমাহীন বিধি নিষেধ। দম বন্ধ হয়ে পড়েছিল রণিতার।
আর ঠিক সেই সময়ই -- রিচা আর চারি এলো।
কি করে বলি....এরা তোমার সন্তান নয়, অর্ণব?
পিতা হবার কোনো ক্ষমতাই তোমার মধ্যে ছিল না। সাধ করে তোমার মা তোমায় বিয়ে দিয়েছিলো -- কলকাতার বনেদি পরিবার, উচ্চ-শিক্ষিত সুন্দরী রাজকন্যা। আর দেখো -- বিয়ের রাতেই টেরটি পেলাম আমি…তোমার আসল স্বরূপ।
ভুলটা পুরোটাই রণিতার বাবার, রণিতা আজ ও সেটা মানে।
জানো বাবা, অদ্ভুত তোমার ইগো, তোমার বর্ণ ও গোত্রের অহংকার। অনির্বাণ ছেলে হিসেবে খারাপ ছিলই না। অন্তত ভালো তো আমায় বাসতো….
তোমার সেটা সহ্য হলো না বাবা। তুমি -- তুমি জানো তুমি কি করেছো? আমার ঘেন্না হয় সে কথা মুখে আনতে। বাইপাসের মোড়ে ভয়ানক বৃষ্টির রাতে বাইকের নিচে কাতরাতে কাতরাতে বলে গেছে আমার নাম। ওর শেষ মুহূর্ত অবধি। তোমার ভাড়া করা কুকুরের দল মেরে বেরিয়ে গেছিলো ওকে। আমি থাকতে পারিনি, ওর শেষ সময়ে। কত কথা ছিল ওর -- বলে গেলো না।
অনির্বাণের কথা ভাবলেই কষ্ট হয়। ওর -- ওর শেষ স্মৃতি আমার কোলে।
রিচা আর চারি।
তুমি জানতে পেরেই রাতারাতি পাত্রস্থ করলে আমায় -- অর্ণবের সাথে। একটা অপদার্থ কীট -- যে কিনা অফিসের কাজ ছাড়া কিছুই জানে না।
পোড়া কপাল আমার -- কেন তোমার কথায় রাজি হলাম।
সেদিন ও খুব কষ্ট হচ্ছিলো ওর কথা ভেবে।
অর্ণব আর ও মা কিচেনে ছিল -- আমায় নিয়ে শ্রাদ্ধ করছিলো। আমি ডাইনি, প্রেতিনী -- ডিভোর্স দিয়ে দে -- আরও ভালো মেয়ে আছে।
রণিতা ঘরের দরজা বন্ধ করে অনেকক্ষণ কাঁদলো। খাটের পাওয়ার তলায় লুকোনো পানের ডিব্বা।
গোঁজা আছে -- স্বর্গসুখ।
কোকেইন।
রণিতা বিষ খেয়ে বিষ ভুলছিলো। বিষ স্মৃতি।
হায়রে অদৃস্ট -- মেয়ে দুটো আমার। ছাতের কার্নিশে এসে অনেকবার ডেকেছে আমায়। সারা দিই নি। ফিরে গিয়ে ওপর প্রান্তে ওদের বাবাকে ডেকেছে অনেকবার। সারা দেয় নি ওদের বাবা।
কি করে দেবে? ব্যস্ত ছিল আমার শ্রাদ্ধ করতে যে ! ওর মায়ের সাথে। অন্য কিছুতে হুঁশই নেই ।
ঠিক সেই সময় রিচা -- না, না জানি না আজও ও রিচা না চারি -- ওপর থেকে পড়ে গিয়েছিলো...ভাঙা ইঁট, নিতে পারেনি ওদের ওজন।
কি জানো অনির্বান, আজ ও আমি জানি না -- দোষটা কার?
আচ্ছা, যদি তোমায় বিয়ে করতাম -- এরকম কি হতে পারতো তাহলে?
***************************************************************************************************************************************************************************************************
অর্ণব কাঁদছিলো, পাগলের মতন -"না, না -- আমি কোনোদিনই মানতে পারিনি --ওরা আমার সন্তান। ওরা অন্য এক গাছের বীজ -- ওদের ঘেন্না হয় দেখে। কিন্তু কল্পনা করতে পারিনি এমনটা হবে।"
কাঁপতে কাঁপতে ডাঃ. ভদ্র উঠে বসলেন চেয়ারে -- "জানেন কে দায়ী এই মৃত্যুর জন্য?"
কেউ কোনো উত্তর দিলো না।
"আপনারা দুজনেই। তবে...আপনার দায়টা একটু যেন বেশি।"
রণিতার চোখ ইঁটভাটার মতন লাল।
"কি মনে করেছিলেন অন্যের গায়ে দোষ দিয়ে পালিয়ে বেঁচে যাবেন? আপনার বাবা, আপনার প্রাক্তন, আপনার বর্তমান -- সবাই দায়ী? আপনার ভবিষ্যতের ওপর কোনো দায়ই নেই? আপনি গিঁথে আছেন না আকাশে, না মাটিতে -- শ্রোডিঙ্গারের বেড়াল হয়ে মৃত্যু আর জীবনের মাঝে কোনো এক খোপে। খুঁজে বেড়াচ্ছেন শান্তি কোথায় পাওয়া যায়: গাঁজা না কোকাইনের সিরিঞ্জে", উঠলেন ডাঃ ভদ্র -- "লজ্জা। লজ্জা হওয়া উচিত আপনাদের।"
চারি ঘুমোচ্ছে।
দুটি বোন। গঙ্গাজল সই। এতো বেশি টান দুজনের মধ্যে -- মৃত্যুর পর ও রয়ে গেছে দুজনের যোগসাজশ।
তাই তো একজনকে ঘুম পাড়ালে আরেকজন জাগে।
আর গল্প বলে।