রঘুবাবু আর সেই লোকটা
রঘুবাবু আর সেই লোকটা
১.
পুরো দিনটা মাটি গেলো। এখানে এসে একটা কাজ ও হলো না।
এবার এখান থেকে লালপুর চক হয়ে স্টেশন রোড ঠিক সময় মতন না পৌঁছাতে পারলে আরও কেলো। বাসটাও মিস করবো।
কলকাতা ঠিক সময় মতন কাল না পৌঁছালে, চাকরি তো যাবেই -- সাথে আরও কি কি যেতে পারে, ভেবে কুলকিনারা পেলো না রঘু।
চা শেষ করে, ব্যাগটা নিয়ে বড় রাস্তায় এসে দাঁড়ালো।
পিছন ফিরে আরও একবার বাড়িটার দিকে তাকালো রঘু। বাদামি রঙের দেওয়াল দেওয়া বাড়িটার, পিচের রাস্তার বেশ খানিকটা যাবার পর, রিসেপশন। বিশাল বপু আর মেজাজ নিয়ে একজন চশমা পরা বিশাল কর্তা-ব্যক্তি বসে। একশো-খানা প্রশ্ন: কোথা থেকে আসছেন, নাম কি, কার সাথে দেখা করতে চান, কেন দেখা করতে চান, আপনার কি পূর্ব পরিচিতি আছে কোনো, কে অনুমোদন করলো, আপনার কেন মনে হলো যে আমরা দেখা করতে দেব, কতোক্ষন কথা বলবেন, কি কি প্রশ্ন করবেন --
ওফফ মাইরি। শালা, বোধহয় রাষ্ট্রপতি'র সাথে দেখা করতে গেলেও এতো প্রশ্ন করে না।
যাক গে, লোকটা শুধু একগাদা প্রশ্ন করেই খুশি হলো যে তা নয় -- ওকে বসিয়ে রেখে কোথায় যেন গেলো। পাক্কা বত্রিশ মিনিট সাড়ে আঠেরো সেকেন্ড পর ফিরে এসে বলে -- দেখা করতে দেওয়া যাবে না। "ওপর মহল" নাকি রাজি হচ্ছে না।
রঘু নানান কিছু বোঝালো। অনেক দূর থেকে আসছি। দেখা হওয়াটা খুব জরুরি -- আর আসা যাবে না, আজকে দেখা না হলে। ইন্টারভিউ না করতে পারলে, চাকরি যাবে।
কিচ্ছু লাভ হলো না। লোকটা মন দিয়ে কিসব লিখে চলেছে একটা লাল খাতায়। মুখ তুলে দেখলোও না একবারও রঘু'র দিকে।
রঘু আরও কিছুক্ষন বসে, উঠে বেরিয়ে এলো।
এবার কাল কলকাতা ফিরে কি উত্তরটা দেবো ও? ওর ওই মাথামোটা বস সুরজিৎ কোনো কথা শোনে?
ভয়ানক রাগ হলো ওর কিছুক্ষন। আচ্ছা লোকটা কি গাধা? বারবার বলছি অনেক দূর থেকে আসছি, আমি এক রিপোর্টার, এক উইকলি ম্যাগাজিন কম্পানিতে চাকরি করি। এবারের টপিক 'প্যারানরমাল এক্সপিরিয়েন্স' নিয়ে। আপনাদের পাগলাগারদ -- থুড়ি -- এসাইলামে বহুদিন ধরেই ভর্তি আছেন বিনয় চৌধুরী।
হ্যাঁ, হ্যাঁ -- কলকাতার মল্লিক বাজারের বিনয় চৌধুরী।
নিন না, একটু কথা বলিয়ে দিন না। ওর একটু ইন্টারভিউ নেওয়া গেলে - মানে ওর জীবনে ঘটা ঘটনাগুলো যদি একবার ছাপাতে পারতাম...
রঘু'র স্থির বিশ্বাস নিজের কলমের ওপর: বাকিটা মশলা আর বাহার দিয়ে এমন রঙ মিশিয়ে লিখতো....
আজকাল কে কত মশলা মেশাতে পারে, সেটাই কৌশল, তাই না?
ব্যস্স -- টপাটপ সেল কে আটকায় ! সব জেনে বুঝেই সুরজিৎ পান্ডেকে বুঝিয়ে একদিনের জন্য রাঁচি এসেছে ও। লোকটা যা চামার -- এবার যা যা খরচ হয়েছে সেগুলো আদৌ পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ।
কেন?
আরে -- এখানে এসে তো কোনো কাজই করতে পারলো না ও।
রিসেপশনের মোটা লোকটাকে জুতো খুলে পেটাতে খুব ইচ্ছে হলো ওর।
নাহঃ, মনে হয় না এখানে দাঁড়িয়ে আর বাস- ট্রাম কিছুই পাওয়া যাবে না বলে। হাতে আর দেড় আছে। পৌঁছতে পারবো তো রাঁচি স্টেশন সময় মতন?
রঘু হাঁটা শুরু করলো। ভর-দুপুরে তো রিকশা ও পাওয়া যাবে না।
কপালের ঘাম মুছলো ও, রুমাল দিয়ে।
.....ভট-ভট-ভট-ভট-ভট......
কি একটা আসছে, না? রঘু পিছন ঘুরে তাকালো, ব্যাগটা নামিয়ে।
একটা অটো আসছে। রঘু হাত তুললো। বেশ অদ্ভুত, না? এতক্ষন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছু এলো না, আর যেই হাঁটা শুরু করলাম, আর ওমনি অটোটা চলে এলো?
********************************************************************************
অটোটা এসে কাছে দাঁড়াতেই দেখলো প্যাসেঞ্জার সিটে একজন মাঝ-বয়সী লোক বসে। টাক মাথা -- একদম অবাক পৃথিবী।
রঘুকে দেখে হাসলো লোকটা।
"কাঁহা জানা?", অটো ওয়ালা জিজ্ঞেস করলো।
"স্টেশন", ব্যাগটা ওঠালো রঘু -- "রাঁচি স্টেশন।"
"চালিয়ে, বৈঠিয়ে", অটো ওয়ালা স্টার্ট দিলো গাড়িতে। ব্যাগ নিয়ে অটোয় উঠে বসলো রঘু।
পাশে বসা লোকটা তখনও ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে।
********************************************************************************
"কা ভৈল বা", অটো ওয়ালা হাঁক পাড়লো -- "ইতনি হাসি কাহে বাবুয়া?"
রঘু বুঝলো পাশে বসা লোকটার উদ্দেশ্যে বলছে।
"কা দাদা -- কালকাত্তা সে হো কা?", লোকটা ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো। হাসিটা কিন্তু ঠোঁটে লেগেই রয়েছে।
"হা", অল্প কথায় উত্তর দিলো রঘু।
"আপকি আঁখোকা চশমা দেখানকেই পাতা চল গায়া থা", লোকটা হঠাৎ হাততালি দিতে লাগলো -- "জয় কালী, কলকাত্তা ওয়ালী।"
শালা পাগল নাকি?
অটো চলছে নিজের তালে। মেঠো পথ, ছাড়া ছাগল, একতাল গোবর। দূরে দূরে এবড়োখেবড়ো টিলা।
"পাগালখানে আয়ে থে কা?"
রঘু'র খুব ইচ্ছে হলো বলতে: তোর বাবার কি?
"হাঁ।"
"কিসি সে মিলনে আয়ে থে কা?"
উফফ, কেন? কি দরকার তোমার? "হাঁ, আয়া থা।"
"না মিলেহি যা রাহে হো?"
"দেখা করতে দেয়নি।"
লোকটা আবার খুব জোরে হেসে উঠলো, হাততালি দিয়ে।
রঘু ভয়ানক বিরক্ত হয়ে ঘুরে লোকটার দিকে।
"কাহি আপ বিনয় চৌধুরী সে মিলনে তো নেহি আয়ে থে?", লোকটা'র প্রশ্ন শুনে এত ওয়ালাটাও হাসতে শুরু করলো।
"ইসমে হাসনে-ওয়ালী কেয়া বাত হ্যায়?", রঘু বিরক্তিটা চেপে চিবিয়ে চিবিয়ে জিজ্ঞেস করলো -- "হাসি'র কি আছে এতে?"
লোকটা মাথা নাড়াচ্ছে। যেন গান গাইছে গুনগুনিয়ে -- "যদি জানতে চান, ওর গল্প, তাহলে পুরোটা বলতে পারি।
প্রমাণ সমেত।"
"ক....কি? আ...আপনি বিনয় চৌধুরী'র কথা জানেন?", রঘু বেশ ঘাবড়ে গিয়েই প্রশ্নটা করলো।
"হাঁ -- সির্ফ জানিই না – উসকি কালি কার্তুতো কি সারি সুবুত ভি হ্যায় আপনে পাস", লোকটা আবার হাসলো -- "শুনাউ? শুনবেন সে গল্প?"
হাতে ধরা ব্যাগটা বুকের কাছে চেপে ধরে রাখলো রঘু -- "হাঁ....."
টুক করে রেকর্ডারটা অন করলো ও।
লোকটা বোধহয় বুঝতে পারেনি।
********************************************************************************
বিনয় চৌধুরী।
বাবার নাম প্রকাশ চৌধুরী, মায়ের নাম সুরভী চৌধুরী। বোন -- হ্যাঁ একটা বোন ও আছে। নাম কৃপালি। ওকে নিয়েই গল্পটা।
বিনয়ের বয়স যখন সাড়ে পনেরো বছর (কৃপালি'র ছয়) -- তখন ওদের বাবা-মায়ের ডিভোর্স হয়ে যায়। মা চললো ক্যানাডা আর বাবা বম্বে। যেহেতু দুজনেই নাবালক-নাবালিকা, তাই মা'র জিম্মেদারিতে বাচ্ছাদের নিয়ে মা উড়লেন টরোন্টোতে। বাবা পড়ে রইলেন বান্দ্রায় -- তাঁর নতুন সংসার, নতুন বৌকে নিয়ে।
টরোন্টো…..ছবির মতন সুন্দর শহর। মা নতুন চাকরি আর দুই সন্তানকে নিয়ে প্রথমদিকে একটু জেরবার হলেও আস্তে আস্তে বেশ সামলেই গেছিলেন। আসলে ছেলে তো বেশ বড়োই হয়ে গেছে, ছোট বোনকে দেখভাল করা নিয়ে খুব একটা চাপ হয়নি।
গন্ডগোলটা হলো কিছুদিন পর।
কাহিনীটার নতুন মোড় সেখান থেকেই।
********************************************************************************
"কি হয়েছিল?"
"না, না -- বিশেষ কিছু না", লোকটা ঘাড় চুলকাতে চুলকাতে বললো -- "কৃপালি'র ঠান্ডা লেগে ভয়ানক নিউমোনিয়া। কাশি আর জ্বর কিছুতেই কমছে না, সেই সঙ্গে শ্বাসকষ্ট -- সে প্রাণ যায় যায় অবস্থা। বাবা এখান থেকে ফোন করছে, আর মা ফোন কেটে দিচ্ছে। মানে বুঝতেই তো পারছেন, একাকেই সবকিছু করতে হচ্ছে, আর ওদিকে আরেকজন কোনো কাজেই আসতে পারবে না -- তার লেকচারবাজি শুনতে আর কার ভালো লাগে বলুন?"
"তারপর?"
"কৃপালি প্রায় মাসখানেক ভর্তি ছিল হসপিটালে", লোকটা একটা দেশলাই কাঠি বের করে দাঁত খোঁচাচ্ছে -- "আস্তে আস্তে কমলো সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়া, দু-সপ্তাহ আরও হসপিটালের থেকে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরলো কৃপালি। মায়ের মুখে হাসি ফুটলো, কাটলো চিন্তার মেঘ। শুধু ডাক্তার একটাই কথা বললেন।"
"কি?"
"টরোন্টোর ঠান্ডা কৃপালি'র সহ্য হচ্ছে না। শীতের চার মাস ইন্ডিয়াতে থাকাই ভালো। বিশেষ করে বম্বে-কলকাতা'র মতন নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলই ওর জন্য ভালো। মার্চ থেকে এখানে থাকলে কোনো প্রব্লেম নেই।"
"হুম, তারপর? সুরভী রাজি হয়েছিলেন এতে?"
"কি আর করবে? বাধ্য হয়েই মা রাজি হলো -- চার মাসের জন্য বম্বে রাখতে। মার্চের শেষে মা ইন্ডিয়ায় এসে নিয়ে যাবে ছেলে-মেয়েকে এমন কথাই রইলো।"
"বাহ্, বেশ তো !"
"বললাম না, ওখানেই গন্ডগোলটা'র যত সূত্রপাত", লোকটা দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে কাঠিটা দাঁত থেকে বের করে কানে ঢোকালো।
বাহ্, বেশ তো -- ডুয়াল মোড কাঠি। কখনো দাঁতে, কখনো কানে।
"ওখানেই গন্ডগোলটা, বুঝলেন দাদা?", লোকটা কান খোঁচাতে খোঁচাতে চোখ বুজে ফেলেছে -- "এখান থেকে শুরু হচ্ছে আসল গল্পটা।"
২.
বিনয়ের একটা পুরনো গুণ ছিল। কানাডায় গিয়ে গুণটা আরও শানিয়েছে ও।
"কি?"
"ড্রাগস", হাসলো লোকটা। নিষ্পাপ-পাপী হাসি -- "কানাডায় এমনিতেও ড্রাগস ব্যানড নয়। মা সারাদিন অফিসের কাজে ব্যস্ত -- ওত্তো সময় নেই ছেলে কি করছে না করছে দেখার। আর ছেলে সেটারই সুযোগ নিয়ে গাঁজা-হেরোইনে চুড় হয়ে থাকতো দিনরাত। মা রাতে ফিরতে ফিরতে আবার এপার্টমেন্টে ফিরে বই, খাতা, পেন নিয়ে -- উফফ সরস্বতী'র বরপুত্রটি যেন।"
"তারপর?"
"হে-হে-হে -- তারপর আর কি? বম্বে এসে ওরকম ড্রাগখোর বন্ধু-বান্ধবী ও জুটে গেলো বেশ কিছু। বাবা ওদিকে নতুন বৌ নিয়ে ব্যস্ত, ছেলে এদিকে হেরোইন আর চরস নিয়ে, আর কৃপালি দুপুর বেলা বাবা'র দেওয়া নতুন ফোনে 'মোটা-পাতলু' নিয়ে। সময় নিজের চক্রে চলছে, বুঝলেন দাদা? একই সংসারে পার্টিশন করা ছোট ছোট আরও অনেকগুলি সংসার। কেউই কারোর কোনো খবর রাখে না।"
"তা---তারপর?"
লোকটা একটা বিড়ি ধরালো। দল পাঁকানো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে উদাস হয়ে বাকি গল্প বলতে লাগলো।
********************************************************************************
এরপর একদিন সন্ধ্যাবেলা। হঠাৎ বিনয় এসে বাবাকে বললো বন্ধুর জন্মদিন আছে। ওকে যেতে হবে, ফিরতে রাত হবে। বাবা প্রথমে গাঁইগুঁই করছিলো ঠিকই, কিন্তু একটু পরেই ব্যাপারটা মেনে নিলো।
"তাহলে কৃপালিকেও নিয়ে যা", বাবা কি যেন একটা ভেবে বললো -- "তুই তো ড্রাইভ করতে পারিস, আমার গাড়িটা নিয়েই যা।"
বিনয় গত বছরই একুশে পা দিয়েছে -- লাইসেন্স ও পেয়ে গেছে নভেম্বরে। গাড়িটা বেশ ভালোই চালায়।
"কৃপালিকে কেন নিয়ে যাবো?"
বাবা বেশ বিরক্ত হয়েই বললো -- "আরে ইতনা ভি খুদ্গারজ মত্ বন্ -- বেচারি সারা দিন বাড়িতেই বসে থাকে। কোথাও তো যাবার ও নেই। তোর বন্ধুদের ওখানে কি বাচ্ছাদের নিয়ে যেতে নেই?"
বিনয় কেমন যেন নিমরাজিই হলো।
বেশিক্ষণ থাকা যাবে না, তাহলে -- এইই যা।
"ঠিক আছে, ওকে নিয়ে যাবো।"
"বহুত আচ্ছা", বাবার মুখে খুব হাসি। ছবি আজ বাড়ি নেই।
প্রেরণা-কো বুলালু তো ফির?
********************************************************************************
বম্বের থেকে কার্যাত বেশি দূর নয়। মোটে ৬২ কিলোমিটার। দুপুরে বেরোলে, ভাগ্য ভালো থাকলে ২-২.৫ ঘন্টা লাগবে। সন্ধ্যা-সন্ধ্যাই পৌঁছানো যাবে।
ঝিরঝির বাতাসে ঘেরা, ছোট ছোট টিলায় ঘেরা উলহাস নদী, পটল-চেড়া চোখে মিষ্টি মিষ্টি হাসি। সরু রাস্তার কথা কাটাকাটি পেরিয়ে, হাঁটু অবধি আসা নরম ঘাসের চোরা কাঁটার চক্রবুহ্য পেরিয়ে নবীনদের আউটহাউস। নবীনেই বাবা-মা পুনা গেছে দু-সপ্তাহের জন্য। আজ বাড়িতে কেউ নেই। নবীন বললো -- "শেয়াম কো আজানা -- আরিফ অউর ফিলিপ্স ভি আয়েগা।"
"অউর রানী?"
নবীন হেসে বলেছিলো -- "কৌশিশ করুঙ্গা লানেকে কে লিয়ে।"
রানী। নবীনের মামাতো বোন।
গাড়ি পার্ক করতে করতে দারুন এড্রিনালিনের কামড়ে শিরায় শিরায় ভয়ানক দাঙ্গা টের পেলো বিনয়।
রক্তে হেরোয়িন আর সাথে যদি প্রেমিকার ঠোঁট যোগ হয় -- আর জীবনে কি চাই?
********************************************************************************
ছাতে ছোট একটা ঘর আছে ওদের।
বিনয়ের হাত ধরে এক হেঁচকা টান মারলো রানী -- "আব চলো ভি?"
হেঁসে ফিসফিসিয়ে নবীনকে বললো বিনয় বললো -- "কৃপালিকে একটু দেখিস। আমি আসছি এখনই।"
চোখ মেরে টেবিলের ওপর ছড়ানো পাউডারে মন দিলো নবীন।
********************************************************************************
রাত আড়াইটে যখন, তখন মোবাইল ফোনটা এতো জোড়ে বেজে উঠলো যে খাট থেকেই পরে যাচ্ছিলো প্রকাশ চৌধুরী।
সুরভী।
শালী -- আর ফোন করার টাইম পেলো না?
পাশে প্রেরণা ঘুমাচ্ছে। খুব অনিচ্ছা সহকারে ফোনটা ওঠালো প্রকাশ -- "হ্যালো?"
"কি ব্যাপার? বিনয় আর কৃপালি যে ঘরে ফেরেনি, সে ব্যাপারটার খেয়াল আছে?"
রাতে শুতে যাবার আগে হুইস্কির ঢেঁকুরটা এখনো উঠছে, প্রকাশ টের পেলো -- "আরে সুরভী, বিনয় এখন যথেষ্ট বড়ো হয়ে গেছে। Give them some space -- এতো টেনশন করছো কেন?"
"What nonsense -- এতটাও বড় হয়ে যায় নি, যে রাস্তায় ছেড়ে দেবো। বিনয় একা নেই, ওর সাথে কৃপালি আছে। সেই কথাটা খেয়াল আছে?"
ফোন কেটে দিলো প্রকাশ।
ইয়ার বিনয় -- তু মারওয়ায়েগা মুঝে। অন্ধকারে ফোন খুঁজে বের করে বিনয়’র নম্বর ডায়াল করলো প্রকাশ।
ফোন বাজছে।
বেশ কিছুবার বাজার পর, ধরলো বিনয় -- "জি, পাপা?"
"তুই কোথায়?"
"ফিরছি পাপা। রাস্তায় আছি।"
প্রকাশ মাথার চুলে হাত চালালো -- "ইয়ার, তেরি মাম্মি মাঝে কল করকে গালি দে রহি হ্যায়, অউর তু হ্যায় কি কোয়ি ফিকর হয় নেহি তুঝে?"
"টেনশন মত্ লিজিয়ে পাপা", হাসছে বিনয় -- "আকেলে হো -- এনজয় কিজিয়ে।"
প্রকাশ কিছুক্ষন ফোনটা ধরে দাঁড়িয়ে রইলো।
এনজয় কিজিয়ে মানে?
প্রেরণা'র কথা ও জানে নাকি?
********************************************************************************
পিছনের সিটে শুয়ে শুয়ে কটর-কটর করে আওয়াজ করে চলেছে কৃপালি।
খুব পুরোনো আর বাজে একটা অভ্যাস ওর একটা। জিভটাকে আলটাগ্রাতে তুলে, পিছনের সারির দাঁতগুলো দিয়ে একটা আওয়াজ করা। সে প্রায় জন্মানোর সময় থেকেই করে চলেছে ও এটা।
অনেক বলেও পাল্টানো যায়নি ওকে। এখন তো ওর ন-বছর বয়স, এখন থোড়াই এই অভ্যাস পাল্টাবে ও?
নিজের মনে গাড়ি চালাচ্ছিলো বিনয়।
আজ সন্ধ্যাটা দারুন কেটেছে। রানী ছাড়তেই চাইছিলো না ওকে। মা এক নাগাড়ে ফোন করে চলেছে। নইলে আরও থাকতাম। রানীকে এভাবে এতক্ষন কাছে পাবো ভাবি নি।
আর নবীন -- শালাকে পরে দেখে নেবো।
কৃপালিকে হেরোইন খাইয়ে দিয়েছে।
গাধাটাকে কি বলবো?! কথাটা মা জানতে পারলে প্রথমে বিনয়ের গর্দান তো যাবেই, পরে বাবা'র -- আর শেষে নবীনের।
নবীনকে বেশি চটানো যাবে না। রানী হাত ছাড়া হয়ে যাবে।
কটরর....কটরর...কটরর…..
"ইয়ার কৃপা, কেয়া কার রহি হো?"
কিছুক্ষন চুপচাপ থাকার পর -- "ভাইয়া -- গাড়িকি এসি বন্ধ কিজিয়ে না।"
"কেন? এসি বন্ধ করতে হবে কেন?"
"খিড়কি খুলনি হ্যায়।"
"কেন?"
জানলা খুলছে কৃপালি -- "বমি পাচ্ছে।"
হঠাৎ হাত-পা ঠান্ডা হতে লাগলো বিনয়ের। বমি পাচ্ছে? কেন? এ....এটা কি হেরোইন খাবার ফল?
গাড়িটা কি থামাবে?
না, না -- তাহলে আরও দেরি হয়ে যাবে। স্পিড বাড়ালো বিনয়।
টানা দশ মিনিট ধরে বমি করতে করতে কাশতে শুরু করলো কৃপালি। বিনয়ের মনে পড়লো ডাক্তারের দেওয়া সেই সাবধান বাণী -- কোনো রকমভাবে যেন লাংসে কিছু না ঢোকে।
বমি করতে গিয়ে লাংসে ঢুকলো নাকি?
সিঁটিয়ে গেলো ভয়ে বিনয়।
স্পিড বাড়িয়ে প্রায় ২০০'র ওপর চালাতে গিয়ে, আগে আসা একটা লাইটপোস্টে যে কখন কৃপালির মাথাটা গিয়ে ধাক্কা খেয়েছিলো, বিনয় সেটা টের পায়নি।
"ধাক্কা খেয়েছিলো?", রঘু জিজ্ঞেস করলো।
"আরে না না -- ধাক্কা না", লোকটা বিড়িটা আবার ধরালো, কথা বলতে বলতেই নিবে গেছিলো -- "স্ট্রিট ল্যাম্পটায় ওসব ধাক্কা-টাক্কা কিছু লাগে নি।"
"তা....তাহলে?"
"বাচ্ছাটার মাথাটা সোজা কেটে রাস্তায়...."
শিউরে উঠলো রঘু।
"ধরটা গাড়ির ভেতর। তখনও কাঁচের ওপরে হাত দুটো রাখা। পুরো ব্যাপারটা এত্ত তাড়াতাড়ি ঘটে গেছে -- কেউই কিছু বুঝতে পারেনি। না রঘু, না কৃপালি।"
"আর বি....বিনয়?"
"কি আর করবে বেচারি?", মাথা নাড়ালো লোকটা -- "কাটা মাথাটা রাস্তার থেকে উঠিয়ে সিটে বসিয়ে, বাকিটা রাস্তা ড্রাইভ করতে করতে বাড়ি ফিরেছে।"
৩.সুরভী কিছুদিনের জন্য ইন্ডিয়াতে এসেছিলেন।
মেয়ের কাটা মাথা স্টিচ করে ধরে লাগিয়েছিল ওরা। সেটা দেখে সনাক্ত করতে হয়েছে ওনাকে। তাও সেটা করা ছিল না -- সুরভীকে দেখে কথা থেকে মাথাটা চুলের মুঠি ধরে নিয়ে এসে জুড়েছে।
সুরভীকে এটা পুরোটাই দেখতে হয়েছে, মর্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।
সুরভীর দ্বিতীয় পক্ষের স্বামী রামানাথন ও ছিল সাথে। রামা ব্যাপারটা শুনেই রাজি হয়েছিল ওর সাথে আসতে। নইলে, এ দৃশ্য সুরভীর পক্ষে একা দাঁড়িয়ে দেখা ও হজম করা সম্ভব ছিল না।
সুরভীর জীবনে নতুন আগন্তুকের আগমনী বেজে উঠেছে।
ও সাড়ে তিন মাসের প্রেগন্যান্ট।
********************************************************************************
ছবি ও সন্তান-সম্ভবা।
ছবি'র সাথে প্রকাশ-বাবুর বয়সের তফাৎটা একটু বেশি হলেও, প্রকাশবাবু কিন্তু বেশ ফিটফাট। হ্যাঁ, কৃপালিটা ওরকম চলে যাওয়াতে একটু কষ্ট হয়েছিল ঠিকই -- কিন্তু কি আর করা যাবে?
একজন গেছে -- আরেকজন তো আসছেই, তাই না?
এটাকেই তো জীবন চক্র বলে।
********************************************************************************
রোজ রাতে বিনয়ের ঘুম ভেঙে যায়।
আর বাস্কেট বলটার ওপর চোখ পড়ে। কে...কে যেন দাঁড়িয়ে আছে না, ওখানে? দু পায়ের ঠিক মাঝ খানে বলটা।
শরীরটাকে দেখা যাচ্ছে। মাথাটাকে না....
থরথরিয়ে কাঁপতে কাঁপতে উঠে, পরিষ্কার শুনতে পায় বিনয়:
কটর....কটর....কটর....কটর....
********************************************************************************
ঠিক আরও নয় মাস কুড়ি দিনের মাথায় কোল আলো করে একটি মেয়ে জন্মায় প্রকাশবাবুর।
রোশনি।
ছবি নাম দিয়েছিলো।
ঠিক ঠিক সাড়ে ন'দিন বেঁচে ছিল বাচ্ছাটা। হঠাৎ খুব বমি করতে করতে....তারপর আর টানতে পারেনি।
জন্মানোর পর একটানা "কটর....কটর....কটর...." করে আওয়াজ করছিলো মুখে।
"একটা মজার ব্যাপার দেখেছেন?"
"ক...কি?", রঘু জিজ্ঞেস করলো।
"কৃপালি যখন মারা গেছিলো তখন ওর বয়স নয় বছর ছ-মাস", লোকটার বিড়ি খাওয়া শেষ -- "বাচ্ছাটা ও ঠিক সাড়ে ন’দিনের মাথায় মারা গেলো।"
হাঁ করে চেয়ে রইলো রঘু -- "আর প্রকাশ জি?"
"সুইসাইড করেছিল", মাথা নাড়লো লোকটা চুক চুক আওয়াজ করে -- "বাথরুমে ব্লেড দিয়ে হাতের শিরা কেটে...."
********************************************************************************
এর পর এক মাসের মাথায় সুরভীর ও একটা মেয়ে হয়।
কাকতালীয় ভাবে সেও সাড়ে নয় দিন বাঁচে ও বমি করতে করতে মারা যায়।
জন্মে সেও একটানা মুখে "কটর....কটর....কটর...." আওয়াজ করে চলছিল।
"সেকি?", রঘু টের পেলো ওর হাত পা কাঁপছে।
"এরপর সুরভী ও আত্মহত্যা করে", লোকটা পাগলের মতন হাসছে -- "বাথরুমে ব্লেড দিয়ে শিরা কেটে।"
********************************************************************************
বিনয় আজ ও টের পায়, ঘরে কেউ দাঁড়িয়ে আছে, পা দুটোর মাঝখানে ওর বাস্কেট বলটা রাখা, মাথাটা দেখা যায় না।
আর একটানা সেই আওয়াজটা: কটর....কটর....কটর....
"তাহলে ওকে পাগলাগারদে কেন ঢোকালো?"
"পাগল কো পাগলখানে মে হি রাখেঙ্গে, না?", লোকটা পাগলের মতন হেসে চলেছে -- "মালটা ন-ন বার আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছে। যেখানে পারে সেখানেই লেখে: 'কৃপালি' -- কখনো রক্ত দিয়ে বাথরুমের মেঝেতে, কখনো ছুরি দিয়ে দেওয়াল খসিয়ে খসিয়ে, কখনো কলেজের খাতায় খাতায়। এখন বলুন -- এমন লোককে পাগলাগারদে ঢোকাবে নয়তো কোথায় রাখবে?"
********************************************************************************
"কি? কেমন লাগলো গল্পটা?", লোকটা আরেকটা বিড়ি ধরালো।
কাঁধ ঝাঁকালো রঘু -- "ভালো। তবে ভয় কম, বীভৎসতা বেশি। আরও ভালো হতো যদি লোকটার ছবি তুলতে পারতাম। প্রমাণ ছাড়া কোনো কাজ হয় কি?"
লোকটা পকেট থেকে একটা ফোন বের করলো -- "এতে অনেক ছবি আছে। এই দেখুন: বিনয়ের ছবি। তখন ওর আট বছর বয়স। এটা ষোলো বছর বয়সে, ওর মায়ের সাথে ক্যানাডার থেকে ফেরার সময় -- অটোয়াতে। আর এটা এলিফ্যান্টায়, বম্বে।"
বাহ্, এই লোকটা তো বেশ চৌকস। কোথা কোথা থেকে ফটো জোগাড় করেছে !
"আর এই যে কৃপালি", লোকটা আরও ফটো দেখাচ্ছে -- "এটা ওর তখন তিন বছর বয়স। এটা আট বছরের জন্মদিনে তোলা। আর এই যে এটা দেখুন --", একটা অদ্ভুত দল পাকানো বস্তু, এতো লাল যে আলাদা করে চোখ, নাক মুখ কিছুই বোঝা যাচ্ছে না -- "এটা ওর সেই কাটা মাথাটা। চিনতে পারছেন?"
রঘুর গা গুলিয়ে উঠলো -- এই লোকটা কি পাগল? নাকি মানুষ রুপি জন্তু?
এ...এই ছবি কেউ রাখে ফোনে?
"আর এই যে দেখুন -- স্টিচ করছে", রঘু মুখ বের করে বমি করলো অটোর থেকে।
"এই ফটোগুলো চাই? চাই?", লোকটা ফোনটা এগিয়ে দিলো -- "নিয়ে নিন, নিয়ে নিন। এগুলো আপনার লেখায় লাগিয়ে দেবেন। পাবলিক হেব্বি খাবে।"
রঘু একটু ধাতস্ত হয়ে ফোনটা হাতে নিলো। একটু পুরোনো ফোন। হোয়াটস্যাপ বা MMS সাপোর্ট করে না।
"Bluetooth-এ নিন দাদা", লোকটা তখনও হাসছে।
রঘু নিজের Bluetooth অন করে পেয়ার করে ট্রান্সফার চালু করলো। ১৭টা ফটো, ট্রান্সফার করতে পাক্কা তিন মিনিট লাগলো।
"একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?", লোকটাকে ফোন ফিরিয়ে দিয়ে, জিগ্গেস করলো রঘু।
"হাঁ, পুছিয়ে না", লোকটা বিড়ি শেষ করলো।
"আপনার কাছে এই ফটোগুলো এলো কি করে? ছয় বছরের, আট বছরের, কোনটা ক্যানাডা থেকে ফেরার পথে, কোনটা এলিফ্যান্টায়। আপনি এতো কাছ থেকে পুরো গল্পটা জানলেন কি করে?"
"এই গল্প তো সবাই জানে", লোকটা কাঁধ ঝাঁকালো।
"তা বলে এতো ডিটেল্সে? এতো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে?", রঘু ফোনটা ব্যাগে গুঁজলো -- "ও....ওই এক্সিডেন্টের রাতে যে প্রকাশ বাবুর বাড়িতে ওনার গার্লফ্রেন্ড এসেছিলো, কি করে জানলেন? বাপ্ ছেলেটা কি কথা হয়েছিল, ছেলে বাপকে মস্করা করে কি বলেছিলো -- এ যেন মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা সামনের থেকে দেখা।"
লোকটা হাত উঠিয়ে রঘুকে কব্জির কাছটা দেখালো। নরম, কাঁচা রক্তে এখনো লাল হয়ে আছে কব্জিটা।
সরু ধমনিটার ঠিক মাঝখান থেকে কাটা -- "এইযে দেখছেন -- দেখুন এখনো ভরাট হয়নি, ঘা-টা। আজ ও রক্ত বয়।"
"আপ....আপনি ক....কে?"
"কেয়া দাদা, প্যায়চান নেহি পায়ে?", লোকটা হাততালি দিয়ে বলে উঠলো -- "আমিই বিনয়ের সেই অভাগা বাপ -- প্রকাশ। প্রকাশ চৌধুরী।"
"আ...আপনি তো আত্মহত্যা করেছিলেন?", রঘু সিটিয়ে গেছে অটোর সিটের সাথে।
"তো কেয়া হুয়া?", লোকটা এগিয়ে এলো -- "কউন বোলা, মরে হুয়ে ওয়াপিস নেহি আতে?"
চলন্ত অটোর থেকে এক লাফ মারলো রাস্তায় রঘু।
আর কিছু মনে নেই।