Subhashish Chakraborty

Comedy Romance Tragedy

4  

Subhashish Chakraborty

Comedy Romance Tragedy

বিবাহ অভিযান

বিবাহ অভিযান

5 mins
297


মোটা...মোটাকে মনে আছে?

মোটা -- মানে তথা? তথাগত। ওই যে ক্লাস সেভেনে পিটি করতে গিয়ে ফ্রগ-ব্যালান্স-এ বসতে গিয়ে প্যান্টটা ছিঁড়েছিলো। পশ্চাত দেশে দুদিকের দুপাশে ছোট দুটো গর্ত। মোটা হাঁটছে থপথপ করে, হাওয়াও ঢুকছে সো-সো করে। সেই থেকেই তো ওর নাম হয়ে গেছিলো তথাগর্ত।

মনে আছে তার কথা?

হ্যাঁ...আজ মোটার বিয়ে। আর কপাল দেখো -- আজই আবার প্রিয়াঙ্কাকে দেখতে পেয়েছে।

তাও ঠিক অগ্নি প্রদক্ষিণ করবার সময়। অনেক লোকের ভিড়ের মাঝে ও নাকি পরিষ্কার দেখে প্রিয়াঙ্কা দাঁড়িয়ে। হাতে জুতো'র শুকতলা ধরা। 

সেই জুতোটা। মোটার ঐতিহাসিক জুতো।

মোটা কিছুক্ষন দেখে -- সোজা মাথা ঘুরে আরেকটু হলে আগুনে পড়ছিলো আর কি। জোর বাঁচান বেঁচেছে।

আরেকটু হলেই পুরো ‘সতীর দেহত্যাগ - পার্ট টু’ হতে যাচ্ছিলো আর কি।

না, না -- ব্যাপারটা বাকিরা আর কেউ দেখেনি। কলেজ আর স্কুলের প্রচুর বন্ধু এসেছিলো। সবাই এসেছে বৌ নিয়ে। বেশিরভাগ বন্ধুরই অলরেডি বিয়ে হয়ে গেছে। বৌদের সামনে এ ওর ছোটবেলাকার নাম ধরে ডাকছে -- যা তা কেচ্ছা যাকে বলে। 

আসলে নামগুলো তো আর ভদ্রলোকের নাম নয়, তাই না?

ইন্দ্রর নাম সরু (অত্যন্ত রোগা বলে), গণশার নাম শিকনি (নাক দিয়ে অনবরত বুদ্ধি বেরোতো বলে), শৈবালের নাম কালো-জাম (গায়ের রঙটা সদ্য পিচ গালা রাস্তাকেও হার মানায়), ঈশানের নাম নাগিনা (সেই যে মনসা পুজোর দিন সন্ধ্যাবেলা নাগিন ড্যান্স নেচেছিল), পীযুষের নাম ছিল সাবিত্রী (সেই যে ফার্ষ্ট ইয়ারে ঢুকে Ragging-এ সাবিত্রী সাজিয়েছিল সেকেন্ড ইয়ারের দাদারা, আর কুন্তলকে সত্যবান), নীতিনের নাম ছিল পবন (কি যে ওর মোহ ছিল মুলোর প্রতি কে জানে ! মুলো খাবে আর ঠুসঠুস করে গন্ধ ছড়াবে), আর শমিকের নাম ছিল কুত্তা (হিসি করার সময় কেন যে একটা পা ওকে তুলতে হবে কেউ আজ ও জানে না)। 

আমার নাম কি ছিল.....তা আর নাই বা বললাম। নিজের কুকীর্তি কে আর বলে?

মোটা ফার্স্ট ইয়ারে প্রেমে পড়লো প্রিয়াঙ্কার।

প্রিয়াঙ্কা শুধু সুন্দরীই না, অসম্ভব আকর্ষনীয়া এক ব্যক্তিত্ব। কলেজের নানান ক্রিয়েটিভ অনুষ্টানে ওর নাম সব সময় দেখা যাবে, যে কোনো ডিবেটে, যে কোনো আলোচনায়, যে কোনো টপিকে ওর প্রগাঢ় জ্ঞান। শুধু তাইই না, নানান NGO, নানান পশুপ্রেমী সংস্থার সাথে ও জড়িত। Animal cruelty নিয়ে ওর নানান ভিডিও ব্লগ, হ্যাশ-ট্যাগের ছড়াছড়ি -- প্রিয়াঙ্কা শুধু একটা নামই না, রীতিমত চর্চা।

মোটা ওর প্রেমে পড়েছিল ঠিকই, তবে মুখ ফুটে বলতে পারেনি।

সেই যে কলেজ ফেস্টে -- 'যদি কিছু আমারে সুধাও' গেয়েছিল। উফফ,সে কি স্টাইল, কি আবেগ, কি গলা -- পারলে স্টেজেই কেঁদে দেয়।  

পিছনের স্টেজ থেকে দাদারা আওয়াজ মারছে -- "ওরে রফির ভাই, ব্ল্যাক কফি -- বুকে আয় ভাই, বুকে আয়...."

**************************************

প্রিয়াঙ্কাদের লেডিজ হোস্টেলের বাইরে বিশাল বড় পাঁচিল।

মোটা সে রাতে হেব্বি বার খেয়েছে। না, না -- আজ আমি অবশ্যই বলবো ওকে। আমার মনের কথা। আমার ব্যথা। 

গনেশ (মানে শিকনি-ভাই) বললো -- "খুব রিস্ক নিচ্ছি কিন্তু -- ছড়াবি না তো শালা?"

চুলটা ব্যাক কম্ব করতে করতে ছেলে বললো -- "আজ হয় বলবো, নইলে মরবো।"

সব তো বুঝলাম, কিন্তু প্ল্যানটা কি?

রাত একটায় প্রিয়াঙ্কা শুতে যায়। ওর ঘরের আলোটা নিভবে। আমরা পাঁচিল বেঁয়ে উঠবো -- মোটাকে আমরা তিনজন ঠেলে সাপোর্ট দেব: আমি, গনেশ আর কুন্তল। মোটা ওর জানলায় টোকা মারবে। ও জানলা খুললে, মোটা ওকে প্রপোস করবে।

গনেশ বললো -- "আবার জিজ্ঞেস করছি, ছড়াবি না তো? ধরা পড়লে কিন্তু সর্বনাশ..."

"আজ আমার মধ্যে পৃথ্বীরাজ চৌহান ভর করেছে বুঝলি", মোটা ডিও লাগাতে লাগাতে বললো -- "ছড়ানোর প্রশ্নই নেই।"

পরে সত্যিই টের পেয়েছিলাম, ওটা পৃথ্বীরাজ চৌহান নয় -- সুনীধি চৌহান হবে।

**************************************

বাকিটা ইতিহাস।

একটা বাজলো, প্রিয়াঙ্কার ঘরের আলো নিভলো। আমরা তিনজন ওকে ঠেলে তুললাম। প্রিয়াঙ্কার জানলায় মৃদু টোকা। অন্ধকারে প্রিয়াঙ্কা জানলা খুলেছিলো। মাঝরাতের চাঁদের আলো -- ওর মুখে।

"তুই?", প্রিয়াঙ্কার গলায় ঘুম আর প্রচন্ড রকমের চমক।

ঠিক তখনই মোটা একটা ঠুসস করে রকেট ছেড়েছে। কি খেয়েছিলো কে জানে ডিনারে -- নিঃশব্দে প্রাণঘাতিকা যাকে বলে। ডাইরেক্ট কুন্তলের মুখে। কুন্তল সেই গন্ধের ত্বেজ সহ্য না করতে পেরে পাঁচিল হড়কে সোজা নিজে পড়েছে।

মোটার অসম্ভব ওজন আমি আর গনেশ সহ্য না করতে পেরে আমরাও পড়ে গেলাম কুন্তলের সাথে।

কিছুক্ষন মোটা প্রিয়াঙ্কার জানলার ব্র্যাকেট ধরে ঝুলে থাকবার পর, সেও মাটিতে।

আওয়াজ পেয়ে হোস্টেলের আলো জ্বলে উঠেছে -- আমরা তিনজন পালাচ্ছি।

মোটা বেশ ব্যাথা পেয়ে কিছুক্ষন ঘটোৎকচের মতন শুয়ে থেকে উঠেছে কোনোরকমে। চৌকিদার আর গার্ডের গলা -- "কৌন হ্যায়?"

গনেশ শিকনি ঝাড়তে ঝাড়তে বললো -- "তেরা বাপ।"

**************************************

না, কোনো রকমে পালিয়েছিলাম চারজনেই। দে বন্য দৌড়। এক দৌড়ে বড় রাস্তায় এসে থেমেছি। দৌড়াতে দৌড়াতে গলা শুকিয়ে গেছে। হাইওয়ের কাছে মাঝ রাতে খোলা দোকানে চা অর্ডার দিলো গনেশ আর কুন্তল। প্রচন্ড রাগে গড়গড় করছে তখনও - "শালা? পাঁদবার আর সময় পেলি না, ক্যালানে?" 

বেশ কিছুক্ষন চুপচাপ থাকার পর মোটা বলল কথাটা।

"একটা কেস হয়েছে।"

"কি?"

"আমার জুতোর নিচটা -- মানে শুকতলাটা ছিঁড়ে ওখানেই পড়ে আছে। প্রিয়াঙ্কার জানলার নিচে। ওটা যদি ওরা খুঁজে পায়?"

"তাতে কি হবে?", আমি বললাম -- "শুকতলায় কি তোর নাম লেখা আছে নাকি, যে ওরা তোকে চিনে ফেলবে ?"

**************************************

এরপর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর।

কুন্তল আর গনেশ এখন আর এ দেশে থাকে না। মোটা এখন বড় কোম্পানির বড়বাবু হয়ে গেছে। ওজন ও ঝরিয়েছে কয়েক কিলো -- এখন দেখে তো চেনাই যায় না।

শুধু ও কেন, চেনা যায় না অনেককেই। সম্পর্ক নেই অনেকের সাথে। কেউ ইচ্ছে করেই রাখেনি। অনেকের মানসিকতা এতটাই পাল্টে গেছে, যে কখনো যে আমরা বন্ধু ছিলাম সেটাও স্বীকার করতে লজ্জা পায়।

সে যাক গে -- প্রিয়াঙ্কার কথায় আসি।

প্রিয়াঙ্কা গুহ'র বিয়ে হয়েছিল বিশাল বড়ঘরে। নেভিতে কাজ করে বর -- পাউন্ড আর ইউরোর ওজনে আর অডি গাড়ির ধোঁয়ায় ধোপেই টিকি না আমরা বাকি বন্ধুরা। ফেসবুক আর ইন্সটায় রেগুলার ফটো আপলোড করে ইউরোপ ট্রিপের, হাসব্যান্ডের সাথে। আলো আর রঙের ঝলকানিতে চোখ ঝলসে যায়।

মোটা তো দুঃখ পেয়ে পেয়ে ব্লকই করে দিলো একদিন ওকে।

এরপর মোটা আর কোনো খবর রাখে নি ওর।

এরপর একদিন খবর পেয়েছিলাম হাতের শিরা কেটে প্রিয়াঙ্কা নাকি আত্মহত্যা করেছে। কোনো সুইসাইড নোট ও রেখে যায় নি। অনেক ঘেঁটে, অনেক চেটেপুটে কিছুই বেরোয় নি। কি হয়েছিল, কেন ও এমন করেছিল -- আজ ও কেউই জানে না।

আসলে আমরা দু ধরণের জীবন যাপন করি। সাজগোঁজ, ঠাট-বাট আর মৌরুসি পাট্টায় ঢাকা যে সোশ্যাল এমব্লেমটা নিয়ে ঘুরি আর আদতে যে আমরা কি -- তার মধ্যে অনেক ফারাক।

আমরা আসলে প্রত্যেকেই এক এক জন অভিনেতা। সবাই এটাই দেখাতে ভালোবাসি দেখো আমি কত সুখে আছি।

প্রিয়াঙ্কার মৃত্যুটা যেন সেই মুখোশ খুলে, সেটাই মনে করিয়ে দিলো।

যেন কোন ফাঁকে বলে সে চলে গেছে -- আমি আদতেই সুখী কোনোদিনই ছিলাম না.....

**************************************

মোটার বিয়েতে প্রিয়াঙ্কা এসেছিলো।

হাতে মোটার ফেলে আসা সেই জুতোর শুকতলা।

কোথায় যেন কলেজের দিনগুলির সেই নির্ভেজাল ভালোবাসাকে আজ ও ওর আত্মাটি খুঁজে চলেছে। যেন জানতে চায় -- জানলা খুলে তুই সেদিন আমায় তোর পুরো কথাটা কেন বললি না বল তো? কিসের ভয় ছিল তোর?

যদি তোর কথা শুনতাম, হয়তো আজ আমায় এভাবে চলে যেতে হতো না।

হ্যাঁ....আজ ও অনেক ভালোবাসা এরকম না বলা, না শেষ করা গল্প হয়েই ঝুলে থাকে। বরণ করে নিতে হয় সেই আপস করে চলার সম্বলটিকে। যেন বারবার দুনিয়াকে বলা আমি কত সুখে আছি।

ভরে যায় কম্প্রোমাইসের ভেকধারী প্রোফাইল নিয়ে রাঙানো আমাদের সোশ্যাল ইমেজ।

 



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Comedy