Subhashish Chakraborty

Horror Crime Thriller

3  

Subhashish Chakraborty

Horror Crime Thriller

আদি প্রেত

আদি প্রেত

10 mins
382


১.


আজ আবার ডরোথিকে দেখতে পেয়েছে ও।

ম্যালের ঠিক চৌমাথার মোড়টার কাছে যে মোমোর দোকানটা আছে -- ওখানে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল প্রবীর। পাহাড়ি শহরের উঁচু নিচু রাস্তা টপকে বেশ কিছুটা হাঁটার পর খুব হাঁফাচ্ছিল ও। সন্ধ্যা নামবে একটু পরেই, দূর পাহাড়ের ঘেরের ওপারে সূর্যের পিষে যাওয়া দেহটার রক্তে লাল দিক চক্রবাল। কোথাও বাঁশি বাজছে -- পাহাড়ি সুর ছাপিয়ে টুরিস্টদের কলকোলাহল। কেউ ফটো তুলছে, কোথাও কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে একটু থেমে, একঝাঁক নতুন পায়রার নিৰ্ভেজাল কলতান, কেউ ভয়ানক দরদস্তুর করছে জ্যাকেটের দোকানের চ্যাপ্টা নাকের সাথে, কোথাও বা লাল পোশাকে মোড়া পরিব্রাজকের হাতের জপযন্ত্রের নিরলস ঘড়ঘড় আওয়াজ, কোথাও বা নিরিবিলিতে খাদের ধারের রেলিঙে রঙ-তুলি আর ক্যানভাসটা রেখে দিয়ে কফিতে চুমুক দিয়েছেন এক প্রৌঢ় পেন্টার-বাবু। ধোওয়া উঠছে খাদের থেকে, হাওয়ায় জমা ভেজা ভেজা কুয়াশায় যেন লেখা আছে আসন্ন সন্ধ্যার কনকনে শীতের স্নেহসচুম্বন।

দার্জিলিং জমজমাট।

টমেটো কেচাপ আর হট কোকোর মিশ্র গন্ধে খিদেটা যেন আরও বেড়ে যায়। মোমোর দোকানটাতে বেশ ভিড়। হাত বাড়িয়ে টাকাটা দিতে গিয়েই পরিষ্কার দেখতে পেলো ও।

ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে।

"ড-রো-থি?!!!", খানিকটা যেন সিলেবেল ভেঙেই চেঁচিয়ে উঠলো প্রবীর।

কিছুক্ষণের নীরবতা। ডরোথি ওরই দিকে তাকিয়ে আছে। মুখে একটা অদ্ভুত হাসি। যেন বলছে -- সবটা জানি, কিন্তু বলবো না।

তারপর.......তারপর স্যাৎ করে যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো ও।


*****


ঘরটায় লাশকাটা ঘরের নীরবতা।

ভূরভুরিয়ে ধোঁয়া -- দার্জিলিঙর খাদের ধারের আদুরে আদ্র বাতাস না। কড়া মার্লবোরো লাইটসের গোল গোল কুন্ডলীর ভ্রূকুটি ঘেরা চাহনি।

"ডরোথি কে, বললেন না তো?"

"ডরোথি...ডরোথি আমার মায়ের নাম", কেন জানি না প্রবীর নামটা নিতে চায় না। মনেই করতে চায় না মায়ের কথা।

"আপনি আপনার মাকে নাম ধরে ডাকেন?"

দীর্ঘশ্বাস ফেললো প্রবীর -- "ডাকি না -- ডাকতাম। মা ভীষণ মজা পেত নাম ধরে ডাকলে।"

"আপনার মা -- ?"

"আমি কলেজে পড়া কালীনই মা মারা যান", গলার অনেক ভিতরে কেমন একটা অসহ্য তিক্ততা। মায়ের কথা উঠলেই কেন জানি না আজ ও পৃথিবীটা খুব তেতো লাগে -- "ক্যান্সার হয়েছিল।"

সিগারেটটা ছাইদানির গাদায় গুঁজে সৃজা সোজা হয়ে বসলো -- "আপনি বলতে চান কুড়ি বছরের আগে মারা যাওয়া মানুষকে আপনি দেখতে পেতেন?"

প্রবীরের খুব বিরক্ত লাগলো। আবার সেই এক প্রশ্ন। বারবার একই প্রশ্ন করলে উত্তরটা কি পাল্টে যাবে?

"হ্যাঁ, পেতাম। একবার নয়, একাধিকবার দেখেছি।"

আরেকটু ঝুঁকলো সৃজা প্রবীরের দিকে -- "কি বলতেন আপনার মা, দেখা দিয়ে?"

আবার দীর্ঘশ্বাস ফেললো প্রবীর। মানবে এরা? বললে বিশ্বাস করবে?

"কি হলো? বললেন না তো? কি বলেন আপনার মা দেখা দিয়ে?"

প্রবীর কি ভাবে কথার উত্তরটা দেবে বুঝতে পারছিলো না। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে ইন্সপেক্টর সৃজা মিশ্রার দিকে তাকিয়ে রইলো।

আর তারপর।

"মৃত্যুর পর সেই জগতের কথা। কি হয়, কোথায় যায়, কে থাকে সেখানে, কেমন সে জায়গা -- আমার মা আমায় অনেক কথাই বলেছে। আর শুধু তাইই নয়", প্রবীর চশমাটি নামিয়ে রাখলো -- "হারিয়ে যাওয়া অনেক মানুষকেই মা আমার কাছে নিয়ে আসতো।"


২.


ভারী দরজাটা খুলে, অন্ধকারে কিছু পা হাতড়ে হাতড়ে সিঁড়ির মুখে এসে পরিষ্কার টের পেলো প্রবীর ব্যাপারটা।

কেউ দাঁড়িয়ে আছে। একটা অবয়ব।

কাঁপা কাঁপা হাতে পকেট থেকে লাইটারটা বের করে জ্বালালো ও।

কোই? না তো -- কেউ নেই তো?

আস্তিন দিয়ে মাথার ঘাম মুছে, বাজারের ক্যারি ব্যাগটা নামিয়ে রাখলো সিঁড়ির কাছে। একটু আগেই কারেন্ট গেছে, এখন আসবে না। রাত্রি হয়েছে, পাহাড়-চূড়ায় ঠান্ডা নামছে। চটপট রান্না শেষ করে খেয়ে নি....কাল তো আবার সকালে উঠতে হবে। এখান থেকে সোনাদা...

উফফফ....এই বয়সে এতো ঝক্কি পোশায়?

প্রবীর ফ্লোরবোর্ড মচমচিয়ে উঠতেই আবার টের পেলো সিঁড়ির মাথায় কেউ দাঁড়িয়ে আছে।

এবার যেন ভীষণ ভাবে স্পষ্ট।

থামলো প্রবীর।

একটা গন্ধ। খুব চেনা গন্ধটা। ভীষণ ঘুম পেয়ে যায় গন্ধটা পেলেই।

জেসমিন, তাই না?

ডরোথি মাখতো রোজ সন্ধ্যাবেলা। গন্ধটা নাকে এলেই, এক ধাক্কায় মার মুখটা মনে পড়ে যায়।

"ম....মা?", প্রবীর জিজ্ঞেস করলো।

উত্তর নেই। না তো....কেউ নেই তো কোথাও। কাঠের কেবিনের অন্দরমহল যেন অন্ধকারে কলাপ্স করছে ওর ওপর।

"মা -- ? তু....তুমি এসেছো মা?"

উত্তর নেই।

লাইটারের ফ্লেমটা নেভালো প্রবীর।

আচ্ছা, আলোতে....আলোতে দেখা দিতে কি মায়ের কষ্ট হচ্ছে?

"আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?", প্রবীরের গলায় ছেলেমানুষের জেদ -- "যদি....যদি সত্যিই শুনতে পাও, যদি....যদি তুমি সত্যিই এখানে এসে থাকো -- তাহলে ফ্লোরবোর্ডে আওয়াজ করো মা...."

না....কোনো উত্তর নেই। ঝিঁঝি আর ব্যাঙের ক্যাকোফনিতে কান পাতা দায়।

"মা?" প্রবীর আবার হাঁক পাড়লো -- "মা, আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?"

সিঁড়ির নিচের দিকে একটা আওয়াজ হলো। কে যেন সিঁড়ি বেঁয়ে নেমে যাচ্ছে।

"মা.....মা?"

অন্ধকারে সিঁড়ির রেলিঙে হাত দিয়ে, লাইটারটা আবার জ্বালালো প্রবীর -- "ডরোথি?"

কাঁপা কাপ আলোয় সিঁড়ির মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা একটা চেহারা....কে যেন মাঝরাস্তায় থেমে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

কালো অলস্টারে এক বিশাল দীর্ঘকায় পুরুষ।

এ....এই লোকটার ফটো আমি একবার দেখেছিলাম, তাই না? কতকটা নিজেকেই যেন প্রশ্ন করলো প্রবীর।

হ্যাঁ.....হ্যাঁ দেখেছিলাম।

মা....মারা যাবার পর, মায়ের ভ্যানিটি ব্যাগে।

 

*****


"সোনাদায় আপনার বাবা থাকেন?"

"হ্যাঁ", প্রবীর মাথা নাড়লো -- "বাবার শরীর খুবই খারাপ। আমায় রোজই গিয়ে দেখা করে আসতে হয় একবার।"

"বাবাকে নিয়ে রাখতে পারতেন তো সাথে", সৃজা আবার একটা সিগারেট ধরালো -- "বারবার এতটা যাওয়া আসা করা --"

"সম্ভব নয়", মাঝপথেই কথা কেটে দিয়ে বললো প্রবীর -- "বাবাকে সাথে রাখা সম্ভব নয়।"

"কেন?"

মুখ ঘুরিয়ে নিলো প্রবীর -- "পরিবারের ব্যক্তিগত সমস্যা। আমি বলতে বাধ্য নই।"

সৃজা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো প্রবীরের দিকে -- "বেশ....তারপর .বলুন। মায়ের কথা।"

"আপনার কি মনে হচ্ছে আমি ইয়ার্কি মারছি? মিথ্যা বলছি?", প্রবীর বেশ বিরক্ত -- "জানেন, মা আমার সাথে রোজই এসে দেখা করেছে। আমি জানি না আমার পরিবারের সম্বন্ধে -- এমন অনেক কথাই মা আমায় বলেছে। পরে মিলিয়ে দেখেছি -- সব কথাই সত্যি।"

"তাই?", সৃজা সিগারেটটা নামিয়ে রাখলো -- "বেশ তো, কি এমন শুনলেন, শুনি?"

"আমি বলতে বাধ্য নই", প্রবীরের গলার স্বর চড়ছে -- "প্রথমত আপনি কেন যে আমায় গ্রেফতার করলেন -- সেই ব্যাপারটাই আমার কাছে ধোঁয়াটে। তারপর আপনি আমায় এরকম ব্যক্তিগত প্রশ্ন করছেন।"

"ওহ, রিয়েলি?", ঠেস মেরে এক হাসি সৃজার -- "আপনি সত্যিই বুঝতে পারেন নি, না -- কেন আপনাকে arrest করা হয়েছে?"

"না।"

"আইবোগা....ট্যাবেরন্যান্থে আইবোগা....নামটা শোনা শোনা লাগছে, না?", চিবিয়ে চিবিয়ে জিজ্ঞেস করলো ইন্সপেক্টর সৃজা মিশ্রা -- "না পড়লে বলুন, মনে করানোর অন্য ব্যবস্থা ও আমার জানা আছে।"


সিঁটিয়ে উঠলো প্রবীর।

হ্যাঁ। শোনা শোনা লাগছে বৈকি।

"হ....হঠাৎ এ কথা এলো কেন?", কথা জড়িয়ে যাচ্ছে প্রবীরের।


"আহা , জানেন না বুঝি?", শ্লেষ মেশানো হায়নার হাসি নিয়ে সৃজা বললো -- "আফ্রিকার ক্যামেরুন, গ্যাবন বা জাইরে পাওয়া এই প্রজাতির গাছটির মূলের নির্যাসে এক অদ্ভুত বিষ আছে। এক ভয়ানক ক্ষমতাশালী সাইকেডেলিক ড্রাগ। সেবনের কিছু সময় পর থেকেই মস্তিষ্কের কোণায় কোণায় নানান dysfunctionality অনুভব করা শুরু হয়। চোখের সামনে ফ্যাকাসে হওয়া নানাবিধ মনগড়া উপস্তিতি -- অনেককেই চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, যাঁরা এখন আর ইহজগতে নেই। আমার সামনে কেমন হেসে-খেলে-চলে-ফিরে বেড়াচ্ছে। প্রথম প্রথম মনে হবে -- আমি কি ভুল দেখছি? মরা মানুষ কি ভাবে ফিরে আসতে পারে? তারপর আস্তে আস্তে বিচার করার সেই ক্ষমতাটি ও লোপ পাবে। এই উপস্থিতিগুলি এতটাই convincing, এতটাই প্রত্যয়জনক -- আপনি আস্তে আস্তে বিশ্বাস করতে বাধ্য যে সত্যিই আপনার হারানো প্রিয় মানুষটি ফিরে এসেছে", সৃজা উঠে দাঁড়ালো -- "কি জানেন, হারানো প্রিয়জনকে কে না চায় ফেরত পেতে। সে যে ভাবেই হোক, তাই না?"

"ক....কি বলতে চান আপনি?"


"আপনাকে আইবোগা ড্রাগের পেডলিং ও সেবন করার কারণে গ্রেফতার করা হয়েছে। আপনার মায়ের স্মৃতি আপনাকে এমনভাবে ধাক্কা মেরেছিলো, যে তাঁর মৃত্যুর এতো বছর পর ও তাঁকে আপনি ভুলতে পারেননি। নিত্যদিন কিছু না কিছু ভাবে ফিরে পেতে চেয়েছেন। এবং তখনই আপনার হাতে এই ড্রাগটি আসে। গেলো বছর আপনি ইথিওপিয়া যান -- অ্যাডিস-আবাবাতে। সেই সময় আপনি এই ড্রাগটির সন্ধান পান। আপনার হোটেল রুমে দেদার এটি সবেন করে প্রায় দুদিন অজ্ঞান হয়ে পরে থাকেন। অদ্ভুত এক মোহ জন্মে যায় জিনিসটার প্রতি। ফেরার সময় ট্যালকম পাউডারের ট্যাল্কে ভরে নিয়ে আসেন ফ্লাইটে চড়ে। পাঁচ-পাঁচটি ট্যালকম পাউডারের কেস -- এমনভাবে প্যাক করা, যে কেউই কিছুই টের পায়নি।"

"ভুল হলো কথাটি", প্রবীরের চোখ দুটি সটান সৃজার চোখের ওপর -- "ড্রাগ আমি নিজে নিলেও, কোনোদিন পেডলিং করিনি। ড্ৰাগটি কিছুদিন নেওয়ার পর ছেড়ে দি। ড্রাগটির প্রথম প্রথম দরকার পড়ে ওই জগতের সাথে এই জগতের একটা চ্যানেল খোলার জন্য -- একধরণের পোর্টাল -- বুঝলেন কিনা ? এক ধরণের গেটওয়ে। এখন তো ওই ড্রাগ না নিলেও মা আমার সাথে দেখা করতে আসে।"  

মাথার চুলে হাত চালালো সৃজা। খুব ধরেছে মাথাটা।

"আ....আজ আমি পূর্ণ.....আমি খুব খুশি, জানেন?", প্রবীরের চোখে এক অদ্ভুত খুশির ছোঁয়া -- "ওপার-এপার-স্বর্গ-নরক: সব.....সবটা জানতে পেরে।"

"ভুল। সর্বৈব ভুল", চেঁচিয়ে উঠলো সৃজা।

"কি ভুল? আমার মা আমায় দেখা দেয়, আমার সাথে কথা বলতে আসে -- এতে প্রব্লেমটা কোথায়? "

"ভুল.....এটাই তো ওই ড্রাগটার মহিমা", সৃজা খুব জোরে টেবিল চাপড়ালো -- "আপনার মনে একটা ফ্যাব্রিকেটেড জগতের এমনভাবে একটা ছবি বানিয়ে দেবে -- যে আপনি স্বপ্নেও বুঝতে পারবেন আপনি স্বপ্ন দেখছেন। এই জন্যই তো এই ধরণের ড্রাগগুলোকে সাইকো-অ্যাকটিভ ড্রাগ ও বলে।"

বোকার মতন তাকিয়ে রইলো প্রবীর -- সবই কি মনের ভুল?

সব ভুল হয় কি করে? 


৩.


"আমার হাত ধর", ডরোথি হাতটা এগিয়ে দিলো। খুব ছোটবেলায় ইস্কুলে যাবার স্মৃতি। মা তো কোথাও যায়নি ছেড়ে আমায়। বড় তো আমি হইনি। মিথ্যাই মনে হয়েছে বোধহয় কেটে গেছে অনেকগুলো বছর -- "এরপর আর একা একা তোর পক্ষে এগোনো সম্ভব নয়। এরপরের রাস্তাটা বড় পিচ্ছিল রে বাবা...."

"আমি কোথায় মা?"

ডরোথি কোনো উত্তর দিলো না।

প্রবীর এক ঝটকায় টের পেলো খুব জোরে হাওয়া দিচ্ছে। জংলা নদীর ধারে দাঁড়ালে, ঝড় উঠলে যেমনটি লাগে -- ঠিক সেরকম।

আদ্র বাতাস আর জলের চকাং চকাং করে পারের পলি মাটিতে আছাড় খাওয়া।

"কি জানিস বাবা", ডরোথি বললো -- "মৃত্যু শেষ কথা নয়। মৃত্যু বরং একটা বড় চৌ-মাথার মোড়ের মতন। সামনে অনেক রাস্তাই খোলা আছে, যেটা খুশি তুমি যাও। এই নদীটির ওপারে অনেকগুলো শহর আছে, জানিস -- তুই ঠিক যেরকমটি দেখতে যাস, নদীর ঢেউ ঠিক তোকে সেখানেই নিয়ে যাবে।"

প্রবীর মায়ের হাতটা খুব শক্ত করে ধরলো। কি সুন্দর হাওয়া। কি সুন্দর গন্ধ ঢলে রয়েছে বাতাসে।

"তুমি কোথায় থাকো মা?", প্রবীরের গলা ধরে আসছিলো -- "আমি......আমিও সেখানেই যেতে চাই।"

প্রবীরের গলায় নাছোড়বান্দা ছেলেমানুষি।

"তোর বাবা এসেছিলো রে আমায় নিতে", মা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো -- "নইলে আমি হারিয়ে যেতাম যে।"

"বাবা?", ছ্যাৎ করে উঠলো বুকটা প্রবীরের -- "বাবা নিতে এসেছিলো মানে?"

হাসলো মা -- "তুই যাকে বাবা বলে জানিস, সে তোর আসলো বাবা নয় রে।"

প্রায় পড়েই যাচ্ছিলো প্রবীর মাথা ঘুরে।

প্রভাত নস্কর। আজও সকালবেলা সোনাদায় গেছিলো প্রবীর। সেবা করে এসেছে।

যে মানুষটাকে এতো বছর ধরে বাবা বলে জেনে এসেছি....সে কে তাহলে?

"নস্করবাবুর চিরকালই আমার ওপর প্রচন্ড লোভ ছিল। তোর বাবা ওনার ড্রাইভার ছিল। তুই তখন সবে জন্মেছিস -- বয়স বড়জোর মাস দুয়েক। রাস্তায় গাড়ি খারাপ হতে, গাড়ির থেকে নেমে তোর বাবা গাড়ির বনেট খুলে চেক করছে, নস্করবাবু পিছন থেকে লোহার রড দিয়ে মেরে খাঁদের ওপর থেকে ফেলে দেন। আর খবর রটিয়ে দেন যে তোর বাবা নাকি গাড়ির জন্য জল ভরতে গিয়ে পা স্লিপ করে খাঁদে পড়ে মারা গেছে।"

প্রবীরের মাথা ঘুরছিলো। এ....এ তো অসম্ভব.... 

"নস্করবাবু তোকে দত্তক নেন -- শুধু এই শর্তেই -- যে আমি যেন তাঁর শয্যাসঙ্গী হয়েই থাকি। আমার শরীরে....সারা শরীরে ওই পশুটার সিগারেটের ছ্যাঁকা। আমায় খুব মারতো রে", ডরোথি একটানা বলে চলেছে -- "তবে বেশিদিন ভুগতে হয়নি। ঠিক ঠিক তিন বছরের মাথায় রোগটা ধরলো। নস্করবাবু কোনো দৃকপাত না করে তবুও আমার উপর অত্যাচার চালিয়ে গেছেন। রোগ নিয়ে প্রায় বিনা চিকিৎসায়ই আমাকে যেতে হয়েছে রে....।"

ঘেন্নায় গা গুলিয়ে উঠলো প্রবীরের। সেই জন্যই সোনাদায় বেডসোর নিয়ে একাই পড়ে আছে নিজের ফ্ল্যাটে। জল খাওয়াবার জন্য ও লোক নেই। কর্মের ভয়ানক কামড় -- কে খন্ডাবে?

"তোমার মারা যাবার পর তোমার ভ্যানিটি ব্যাগে যে ছবিটি দেখেছিলাম -- উনিই কি…..?"

"হ্যাঁ তোর বাবা", মা হাসলো -- "গডউইন গোমস।"

জলে ছলাৎ ছলাৎ করে আওয়াজ। নৌকা? কোনো নৌকা আসছে কি এদিকে?

ডরোথি চমকে উঠলো -- "বাবা -- আমায় যে এবার যেতে হবে রে....."

"কেন মা?"

ডরোথি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো -- "নদীর ধার বেঁয়ে ঘুরে বেড়ায় নানান ভ্ৰমিত আত্মা। এদের পাপের ভার এতটাই বেশি যে, কোনো যোনিই এদের সন্তান হিসেবে ধারণ করতে সক্ষম নয়। সময়ের শেষ পল অবধি এরা এভাবেই ঘুরে ঘুরে বেড়াবে কার কিভাবে ক্ষতি করা যায় -- এই ইচ্ছায়। শুধু তাইই না, জীবিত মানুষের মধ্যে সমস্ত রকমের বিকার, ভ্রম, অন্ধতা, অশিক্ষাও এরাই সৃষ্টি করে। পৃথিবীতে যাবতীয় রোগ-ভোগ, দুঃখ-কষ্ট, অভাব-অনটন-মড়ক ও এরাই ত্বরান্বিত করে।"

কাঁপা কাঁপা গলায় প্রবীর প্রশ্ন করলো -- "প্রেত -- পিশাচ -- শয়তান: এগুলো কি তাহলে সত্যি?"

মা হেসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো -- "যদি ঈশ্বর সত্যি হয়ে থাকেন, তবে তাঁর উল্টোটাও তো সত্যি হতে হবে, তাই না?"


*****

রাত হয়েছে। ঝিঁঝির কীর্তনে কান পাতা দায়। পাহাড়ি ঘাট রোডের কুয়াশা ভেদ করে ছুটে চলেছে জিপ। হুড খোলা জিপের সব দিক দিয়েই ধেয়ে আসছে ঠান্ডা বাতাস। সালটা টেনে বসলো প্রবীর, আড়চোখে তাকালো সৃজার দিকে। সাদা ফিনফিনে শার্ট আর জিন্স ছাড়া আর কিছুই পড়ে নেই।

ঠান্ডা লাগে না নাকি মহিলার?

"এহ, আপনাকে খুব ভোগালাম আজ -- সরি", সৃজা হঠাৎ হাসলো -- "চেষ্টা করবেন ড্রাগ আর পেডলারদের চক্কর থেকে যতটা পারবেন দূরে থাকতে। আমাদের দেশে ব্যাপারটা একদমই হাল্কা চলে নেওয়া হয় না।"

সে আর বলতে।

প্রবীরের পরিষ্কার মনে আছে। পৃথিবীতে খুব কমই দেশ আছে যেখানে ব্যাপারটা লিগাল। কিভাবে, কি রিস্ক নিয়ে যে ড্রাগ নিয়ে আনতে পেরেছে দেশে -- তা তো বলাই বাহুল্য। নেহাত এবার প্রমাণাভাবে ছেড়ে দিচ্ছে এরা -- পরের বার ধরা পড়লে চাপ আছে। প্রবীর হাসলো মনে মনে -- একটু সাবধানে খেলতে হবে, এবার থেকে।

গাড়িটা হঠাৎ থামালো সৃজা।

"কি হলো?", সৃজাকে নামতে দেখে প্রবীর জিজ্ঞেস করলো।

সৃজা গাড়ির পিছনে গেলো -- বালতি আর রেঞ্চ বের করতে -- "টর্চটা একটু ধরুন না....."

প্রবীর গাড়ির থেকে বেরিয়ে টর্চটা জ্বালালো। রাতের অন্ধকারে পাহাড়কে দেখতে খুবই সুন্দর লাগে। খাঁজে খাঁজে জোনাকি পোকার মতন দূর পাহাড়ের গায়ে গায়ে আলো জ্বলছে। খাঁদের ধারের ঠান্ডা রেলিঙে হাত রেখে এগিয়ে এলো গাড়ির পিছন দিকে প্রবীর। গাড়ির টায়ারে হাত দিয়ে দিয়ে সৃজা দেখছে।

"কি বুঝলেন ম্যাডাম? ফ্ল্যাট টায়ার?"

সৃজা উত্তর দিলো না -- মন দিয়ে কি যেন দেখছে, টায়ারটার ওপর ঝুঁকে পড়ে। অদ্ভুত একটা গন্ধ ঝুলে রয়েছে বাতাসে। কিরকম যেন বন্য প্রাণীর গায়ের গন্ধের মতন।

এগিয়ে এলো প্রবীর -- "আমি দেখবো ম্যাডাম?"

উত্তর নেই।

প্রবীর আরেক পা এগোতেই হঠাৎ ওর দিকে তাকালো সৃজা। অন্ধকারে ইঁট-ভাঁটার মতন দপদপ করে জ্বলছে ওর দুটো চোখ।

টায়ারের ওপর রাখা হাতের আঙুলে বড় বড় নখ -- ঠিক যেন অচিনপুরের কোনো শিকারী পাখি। ঠোঁটের দুই কষ বেঁয়ে বেরিয়ে এসেছে বিশাল বড়-বড় এক জোড়া দাঁত। লকলকিয়ে জিভ বের করে হাসছে।

প্রবীর পিছিয়ে গেলো কয়েক পা -- "সৃ.....সৃজা.....?"

পুরো কথাটি শেষ হবার আগেই এক লাফে ওর গলার ওপর এসে পড়লো সৃজা। খচমচ করে এক গাল রক্ত বেরিয়ে এলো, প্রবীর টের পেলো ওর জামার কলারটা ভিজছে।

মায়ের কথাটা কোনো এক অজ্ঞাত কোণ থেকে অনুরণিত হলো ওর কানে কানে -- "যদি ঈশ্বর সত্যি হয়ে থাকেন, তবে তাঁর উল্টোটাও তো সত্যি হতে হবে...., না?"

দুই ঠোঁটের মাঝে দাঁতে ধরা মাংস পিন্ডটা কামড়াতে কামড়াতে সৃজার গলা শুনতে পেলো প্রবীর -- "বড্ড বেশি জানতে পেরে গেছিলে প্রবীর গোমস....প্রেত-তত্ব এতো সহজলভ্য জিনিস নয়.....তোমার মা সেটা বলেনি?"



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror