Unmask a web of secrets & mystery with our new release, "The Heel" which stands at 7th place on Amazon's Hot new Releases! Grab your copy NOW!
Unmask a web of secrets & mystery with our new release, "The Heel" which stands at 7th place on Amazon's Hot new Releases! Grab your copy NOW!

Red Eclipse

Classics Crime Thriller

4.9  

Red Eclipse

Classics Crime Thriller

দ্বৈপায়নের নেশা

দ্বৈপায়নের নেশা

11 mins
540


অনুপ্রেরণাকারী বিষয়বস্তু- মানব মনস্তত্ত্ব (হিউম্যান সাইকোলজি)


      _______________________


দ্বৈপায়ন অনেকক্ষণ ধরে কাঁচের স্লাইডটাকে লেন্সের সঠিক লেভেলে আনার চেষ্টা করছিল। ল্যাবের দরজা খুলে বিভাসকে ঢুকতে দেখে মাইক্রোস্কোপ থেকে চোখ না তুলেই বলে,”কি ব্যাপার! আজকাল টিফিন করতে গিয়ে ভালোই ফোনে গল্প হচ্ছে শুনছি।”

বিভাস এক বছর হল পার্ক সার্কাসের সেন্ট্রাল ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে জয়েন করেছে।আঙুলগুলো সঞ্চালন করে গ্লাভসটাকে হাতের সঙ্গে ঠিকভাবে এডজাস্ট করতে করতে হেসে বলে, “কি করব বলো দ্বৈপায়নদা, আমার বাড়িতে তো আর তোমার মত সুন্দরী বউ নেই। চেষ্টা করছি অন্তত ফোনে যদি কাউকে পটাতে পারি।”

--"সরকারি চাকরি বলে পার পেয়ে যাচ্ছিস। বেসরকারী হলে এতদিনে তোর স্যালারিতে কাঁচি পরে যেত।”কথাটা বলতে বলতে দ্বৈপায়ন মাইক্রোস্কোপ থেকে চোখ সরায়। ওর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে নিজের কাজে বেশ সন্তুষ্ট।



দ্বৈপায়নের খোঁচাটা গায়ে না মেখে বিভাস চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বলে, “যাই বলো দ্বৈপায়নদা, তোমার মত কাজের প্রতি ডেডিকেট হওয়াটা কিন্তু মুখের কথা নয়। তোমার মত যদি আমার বাবার ওরকম সম্পত্তি থাকতো, তাহলে আমিতো ভুলেও এই লাইনে আসতাম না। রাতদিন কাটাছেঁড়া, ঘন্টার পর ঘণ্টা ধরে মাইক্রোস্কোপে চোখ লাগিয়ে বসে থাকা, পুলিশ কেস, আরও হ্যানা-ত্যানা কত ঝামেলা; সুখে থাকতে কে এসবে জড়ায় বলতো?”


বিভাসের কথাগুলো শুনে দ্বৈপায়নের চোখে একটা উত্তেজনার ঝলক খেলে যায়। মুখে হালকা হাসি টেনে বলে, “যখন আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি,আমরা বন্ধুরা মিলে খেলতে গিয়ে পাথরের উপর পড়ে গিয়েছিলাম। এক বন্ধুর পায়ে ছটা সেলাই পড়ে। হাসপাতলে ওর পায়ের রক্ত দেখে বাকি বন্ধুরা কেউ সহ্য করতে পারেনি। কিন্তু সেদিন ওর পায়ের ক্ষত, সেখান থেকে বেরিয়ে আসা রক্ত, ভিতরের সাদাটে মাংস, আরো ভিতর থেকে উঁকি দেওয়া দুধ সাদা হার,…আর এইসবের সঙ্গে মিলিয়ে ওর মুখে তৈরি হওয়া অভিব্যক্তি- সবকিছু আমার কাছে একটা নতুন দিক খুলে দিয়েছিল। তোরা অফিসে আসিস ডিউটি করার জন্য, কিন্তু আমার কাছে এই কাটা ছেঁড়া ব্যাপারটা একটা নেশার মত। কেস যত বেশি ভয়ার্ত হয়, আমার ইন্টারেস্টও ততবেশি হয়। যেরকম ভাবে একটা জটিল উপপাদ্য ম্যাথ টিচারকে আকর্ষণ করে, ঠিক সেরকমই আমি এই বিষয়টার প্রতি টান অনুভব করি।”

বিভাস চোখ বড় বড় করে দ্বৈপায়নের দিকে তাকিয়ে বলে, “বাব্বা! তোমার রিটারমেন্টের পর তোমার ছবি বাঁধিয়ে রেখে দেবো অফিসে। অদ্ভুত নেশা মাইরি! তবে যাই বলো, তুমি যেরকম গুছিয়ে রিপোর্ট লেখো, আমরা কিন্তু ওমনি পারবো না।”

বিভাসের কথা বলার ধরনে দ্বৈপায়ন শব্দ করে হেসে ওঠে।

দ্বৈপায়ন আবার মাইক্রোস্কোপে চোখ লাগিয়ে নিজের কাছে ফিরে যাচ্ছে দেখে বিভাস তাড়াতাড়ি বলে, “এইসব কথা বাদ দাও দ্বৈপায়নদা।”

ল্যাবের চারিদিকটা ভালো করে দেখে নিয়ে গলাটা একটু নামিয়ে আবার বলে, “ এবার বল দেখি, ওই কেসটা যে সুইসাইড, সেটা এত সিওর কি করে হচ্ছ?”

বিভাস কোন কেসের কথা বলছে সেটা বুঝতে দ্বৈপায়নের সময় লাগে না।এই মুহূর্তে পুরো অফিসে এটারই আলোচনা চলছে।

তাছাড়া,কেসটার প্রথম দিন থেকেই দ্বৈপায়নকে দিনে অন্তত পাঁচ-ছ বার করে, কিছু না কিছু বিভাস জিজ্ঞাসা করেছেই করেছে।

দশ দিন আগে কেসটা ওদের হাতে এসেছিল। মূলত সিনিয়র বিভাগের উপরই দায়িত্ব ছিল। বিভাসের মতন জুনিয়ররা যা খবর পেয়েছে সবটাই পরোক্ষ। ইতিমধ্যে মোটামুটি একটা ফরেনসিক রিপোর্ট পুলিশের কাছে পাঠিয়েও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখনও বিষয়টা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা সমানে চলছে।

আসলে যে লোকটি মারা গিয়েছেন, শহরে তার বিস্তর নাম ডাক।


--"দেখ ভাই, আমাদের কাজ আমরা করে দিয়েছি। বাকিটা পুলিশ বুঝে নেবে। তবে আমার পার্সোনাল মতামত এখনো এটাই যে– কেসটা সুইসাইড।”

--"কিন্তু সবাই তো ওর বিজনেস পার্টনারকেই সন্দেহ করছে। তাছাড়া ওরকম ভাবে কেউ নিজের হাতে নিজের গলাতে ছুরি বসাতে পারে নাকি?” উত্তেজনায় বিভাসের গলা কিছুটা জোরে হয়ে যায়।

দ্বৈপায়ন খুব সাবলীলভাবে বলে, “হয়তো ছুরি চালানোর সময় ভদ্রলোক নিজেও শিওর ছিলেন না। যে পরিমাণে অ্যালকোহলের উপস্থিতি শরীরে পাওয়া গেছে তাতে বোঝা যায় মৃত্যুর সময় উনি প্রকৃতস্থ ছিলেন না। হত্যা না সুইসাইড সেটা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। আমার জানার ইচ্ছে ওই মুহূর্তে তিনি ঠিক কি অনুভব করেছিলেন? যখন ক্যারোটিড আর্টারির ভিতর দিয়ে ছুরিটা গেল, তখন ওই ব্যক্তির মুখে ঠিক কী রকম অভিব্যক্তি এসেছিল জানতে ইচ্ছে করে!”


দ্বৈপায়নের শেষ কথাগুলো শুনে বিভাসের গা গুলিয়ে ওঠে। ওর আর কথা বাড়ানোর ইচ্ছে হয়না। নিজের কাজ করতে করতে বেখেয়ালে কেসটা নিয়েই ভাবতে থাকে।

‘একটা মধ্য চল্লিশের ব্যক্তি। গলার সামনের দিকে ডান সাইডের উপরদিক থেকে একটা ছুরি তীক্ষ্ণ ভাবে গলার মাঝ পর্যন্ত ঢুকেছিল। রাইট ক্যারোটিড আর্টারি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার দরুন মৃত্যু হয়েছে। এখনো পর্যন্ত পুলিশের ধারণা ব্যবসায়ীক গোলযোগের কারণে মৃত ব্যক্তির বন্ধুই ওনাকে হত্যা করেছে।’

বিভাসের চিন্তার মধ্যে টান পড়ে। একটা পুলিশ কেস আসার জন্য সবাই ব্যস্ত হয়ে যায়। সব ফর্মালিটি পূরণ করে ডেড বডি ওদের সামনে আসতে আসতে আরও এক ঘণ্টা সময় লাগে।


খুব একটা গুরুতর বিষয় না। হার্টের মধ্যে দিয়ে বুলেট গিয়েছে। মৃত্যুর কারণ মোটামুটি ক্লিয়ার। পুলিশের কথাবার্তা থেকে বোঝা যায় লোকটা সেরকম গুরুত্বপূর্ণ কেউ না। উপর থেকে প্রেসার না থাকায় বিষয়টা নিয়ে সিনিয়ররা অতটা মাথা ঘামায় না।


বাকিরা গুরুত্ব না দিলেও দ্বৈপায়ন খুব মনোযোগ দিয়ে মৃতদেহটাকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। ওর নজর মৃতদেহের বুকের বামদিকে তৈরি হওয়া বুলেটের গভীর ক্ষতের দিকে নয়।দ্বৈপায়ন মৃতদেহের ডান পায়ের জঙ্ঘায় তৈরি হওয়া প্রায় দুই ইঞ্চি গভীর ক্ষতটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে।

অফিস আওয়ার মোটামুটি শেষ। মৃত দেহকে কোল্ড রুমে রাখার ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই।


দ্বৈপায়নকে নিজের চিন্তার মধ্যে ডুবে থাকতে দেখে পাশ থেকে বিভাস বলে, “আজকে কি এখানেই থেকে যাবে নাকি?”

কিছু কলিগ ইতিমধ্যে বেরিয়ে গিয়েছে,বাকি কিছু জন নিজেদের ব্যাগ পত্র গুছিয়ে নিচ্ছিল।


বিভাসের কথা শুনে মজার ছলে তাদের মধ্যেই একজন বলে, “বৌদির মতো সুন্দরী বউ থাকলে আমিতো প্রত্যেকদিন আধ ঘণ্টা আগেই বাড়ি চলে যেতাম।”

কথাটা শুনে বাকিরা একসাথে হেসে ওঠে।


দ্বৈপায়ন জানে ওর কলিগরা রেনুর জন্য ওকে হিংসা করে। রেনু ওর থেকে প্রায় সাত বছরের ছোট। দেখে কোনো মডেলের থেকে কম মনে হবে না। অন্যদের হিংসা করাটাই স্বাভাবিক।


দ্বৈপায়ন কোনো উত্তর না দিয়ে নিঃশব্দে হাসে।

এরই মধ্যে বিভাস বিষয়টাকে ঘুরিয়ে বলে, “তোমরা তো দ্বৈপায়নদাকে চেনোই না। ওর নেশার কথা শুনলে অবাক হয়ে যাবে!”

দ্বৈপায়ন বরাবরই একটু চুপ থাকতে পছন্দ করে। লোকের ব্যাপারে যেমন বেশি খবর নেওয়া পছন্দ নয়, তেমনি নিজের ব্যাপারেও সবাইকে জানাতেও পছন্দ করেনা।

বিভাস ওর অদ্ভুত নেশার কথা অন্যদের বললে দ্বৈপায়নের অস্বস্তি বোধ হয়।

কলিগদের মধ্যে এই বিভাস ছেলেটার সাথেই দ্বৈপায়নের সখ্যতা একটু বেশি। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার বিভাসকে বাড়িতে নিমন্ত্রণও করেছে।

ভীষন টকেটিভ একটা ছেলে। চাইলেও ওর উপর রাগ করা যায় না।

কলিগদের অবাক হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে একটু লাজুক হাসি দিয়ে, দ্বৈপায়ন অফিস থেকে বেরিয়ে যায়।

বাড়ির পথে পুরো রাস্তাটাতে দ্বৈপায়নের মন জুড়ে থাকে শুধু -'দু-ইঞ্চি ক্ষত'।


         ***************************


দ্বৈপায়নের বাবা গত হয়েছেন প্রায় দুই বছর হলো। মা তো সেই ছোটবেলাতেই মারা গেছেন। বেশ কিছুদিন একা থাকার পর হঠাৎ একদিন পরিচয় হয় রেনুর সাথে। ঠিক পরিচয় না বলে, রেনুকে দেখতে পায় বলাটা বোধ হয় বেশি সঠিক হবে।

‘সেফ হোম'-এর প্রায় সত্তর পার্সেন্ট খরচ দ্বৈপায়ন বহন করে। একদিন এই ‘সেফ হোম'-এই রেনুকে দেখতে পায় ও। চোখ ধাঁধানো রূপের থেকেও ওকে বেশি আকর্ষণ করেছিল রেনুর চোখের ভিতর চেপে রাখা কষ্ট। কারো চোখ যে এত নিপুণভাবে কষ্টকে প্রকাশ করতে পারে, সেটা দ্বৈপায়ন আগে কখনো ভাবতে পারেনি।

যেদিন দ্বৈপায়ন ‘সেফ হোম’-এর দায়িত্বে থাকা কৃষ্ণাদির কাছে রেনুকে বিয়ে করার প্রস্তাবটা দিয়েছিল, সেদিন ওখানকার প্রত্যেকটা বাসিন্দার চোখে দ্বৈপায়নের জন্য সম্মান কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছিল।



দ্বৈপায়ন ঘরে ফিরে ফ্রেশ হয়ে নিউজ চ্যানেলটা অন করে গুছিয়ে বসে। রেনু এই সময়টা রাতের খাবার তৈরি করতে ব্যস্ত থাকে।

ওরা প্রত্যেকদিন আটটা থেকে সাড়ে আটটার মধ্যে ডিনার করে নেয়।

খাবার সময় বেশি কথা বলা দ্বৈপায়নের পছন্দ নয়।দ্বৈপায়নের ঠিক উল্টোদিকের চেয়ারে রেনু খেতে বসেছে।কিছুক্ষণ নিঃশব্দে খাবার খাওয়ার পর দ্বৈপায়ন বলে, “আজকে কৃষ্ণাদি ফোন করেছিল। তোমাকে নিয়ে একদিন যেতে বলছে ওখানে।”

কৃষ্ণাদির নাম শুনে রেনুর চোখে একটা খুশির আভাস ফুটে উঠে।দ্বৈপায়নের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে আবার সঙ্গে সঙ্গে চোখ নিচের দিকে নামিয়ে নেয়। খুব মৃদু কণ্ঠে রেনু উত্তর দেয়, “তুমি যেদিন বলবে, আমি আগে থেকে তৈরি হয়ে থাকবো।”

রেনুর এরকম ভীতসন্ত্রস্ত ব্যবহার দ্বৈপায়নের একদম ভালো লাগেনা। হাতের রুটিটা থালার উপর রেখে দিয়ে বলে, “রেনু, তুমি কি আমাকে ভয় পাও?”

রেনু আরো ভয় পেয়ে যায়। কথা বলতে গিয়ে ওর গলার স্বর কেঁপে ওঠে।

--"কই নাতো!”

দ্বৈপায়ন চেয়ার থেকে উঠে রেনুর দিকে এগিয়ে যায়।

রেনুর পিঠের ওপর একটা হাত রেখে বলে, " তুমিতো জানো আমি তোমাকে কত ভালবাসি। আমি এমন কিছু করবো না যাতে তোমার জীবনের কোনো ক্ষতি হয়।"

দ্বৈপায়নের স্পর্শে ভয়ে রেনুর সারা শরীর কাঁপতে থাকে।

কোনরকমে সাহস সঞ্চয় করে বলে, “আমাকে…আমাকে প্লিজ ছেড়ে দাও। কথা দিচ্ছি, আমি কাউকে কিচ্ছু বলব না।”

দ্বৈপায়ন নিষ্ঠুরভাবে রেনুর চুলের মুঠিটা হাত দিয়ে চেপে ধরে শীতল কণ্ঠস্বরে বলে,"আমাকে ছেড়ে তুমি কোথাও যেতে পারবে না। আশা করি বিয়ের প্রথম দিন যে কথাটা বলেছিলাম, সেটা এখনো মনে আছে।”

বিয়ের প্রথম দিনের সেই কথাটা রেনুর মনের ভিতর ভেসে ওঠে। বিয়েতে দ্বৈপায়নের একটাই শর্ত ছিল-যদি রেনু কোনদিন দ্বৈপায়নকে ছেড়ে চলে যায়, তাহলে ও ‘সেফ হোম'-এ টাকা পাঠানো সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেবে। সেদিন নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করা রেনু, ভাবতে পারেনি এই ছোট্ট শর্ত ওর জীবনে কত বড় অভিশাপ হয়ে নামবে।

‘আমি কিছুতেই নিজের জন্য ‘সেফ হোম’-এর অতগুলো মানুষের জীবন সংশয়ে আনতে পারব না।’

রেনু মনে মনে নিজেকে শক্ত করে দ্বৈপায়নের অন্য হাতটা ধরে বলে, “আমি তো এমনিই বলছিলাম। কথা দিচ্ছি, তোমার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তোমার সাথে থাকবো।”

দ্বৈপায়ন খুশি হয়ে রেনুর চুল থেকে হাত সরিয়ে বলে, “ জলদি খাওয়া-দাওয়া সেরে নাও। আজকে একটু তাড়াতাড়িই গ্রিনরুমে যাব।”

দ্বৈপায়নের চোখ উত্তেজনায় চকচক করতে থাকে। ওর সমস্ত মন জুড়ে আবার ফিরে আসে দু ইঞ্চির ক্ষত।


         *********************



রেনুর নাইটিটা জঙ্ঘার বেশ খানিকটা উপরের দিকে তুলে রাখা। ওর জঙ্ঘায় আলতো একটা চুম্বন করার পর, দ্বৈপায়ন হাতে ধরা স্ক্যাল্পেল্-টা (শল্য ছুরিকা) দিয়ে দক্ষতার সাথে ঠিক দুই ইঞ্চি গভীর একটা ক্ষত তৈরি করে ওখানে। যতটা দীর্ঘ ক্ষত মৃতদেহের শরীরে ছিল, ঠিক ততটাই দীর্ঘ। রেনুর চোখে ফুটে ওঠা ব্যথার প্রত্যেকটা অভিব্যক্তি দ্বৈপায়নের ভিতর একটা আলাদা উত্তেজনা এনে দেয়। জীবিত থাকাকালীন পায়ের ক্ষতটার সময়, অফিসের ঠান্ডা ঘরে ঢুকিয়ে রাখা মৃতদেহটি ঠিক কি রকম অনুভব করেছিল, সেটা ও কল্পনা করতে থাকে।

রেনুর শরীরের প্রত্যেকটা অংশ নতুন পুরনো কাটাছেঁড়ায় ভর্তি। ও যেন দ্বৈপায়নের কাছে একটা জীবন্ত লাশ।প্রত্যেক রাতে ওর যন্ত্রণার চিৎকার মিলিয়ে যায় প্রায় শব্দরোধী এই গ্রিনরুমের চার দেয়ালের মধ্যে।


    *********************



সকাল দশটা বাজে।ইতিমধ্যেই দ্বৈপায়নের বাড়িতে পুলিশ এসে গেছে। বিভাস সমেত ওর ডিপার্টমেন্টের বেশ কয়েকজন সহকর্মীও এসেছে।

রেনু এককোনে একটা চেয়ারে বসে আছে। চোখমুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে এখনো ভয়ের রেশ কাটেনি।

পুলিশ অফিসার রেনুর জবানবন্দি নিচ্ছিলেন। ডায়েরি আর পেনটাকে গুছিয়ে ধরে একটু সন্দিগ্ধ সুরে বলেন, “তাহলে আপনি বলছেন যে, আপনার স্বামী মিস্টার দ্বৈপায়ন বসু, নিজে হাতে আপনার শরীরে এই ক্ষতগুলো তৈরি করেছেন!”

রেনু কোনো কথা না বলে শুধুমাত্র মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করে।

--"কাল রাতে যা যা হয়েছে আপনি সবটা ঠিক করে বলুন।”পুলিশ অফিসারটি ভারিক্কি গলায় রেনুকে অর্ডার করেন।

রেনু একবার কান্নাভেজা চোখে পুলিশ অফিসারের দিকে তাকিয়েই সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে নিয়ে খুব নিচু স্বরে বলতে শুরু করে।

--“কাল রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর দ্বৈপায়ন যখন আমাকে গ্রিনরুমে যাওয়ার কথা বলে, তখনই বুঝে গেছিলাম আবার আমার শরীরের উপর কাটা ছেঁড়া করবে। আসলে এটা ওর প্রতিদিনেরই রুটিন ছিল। যখন পায়ের থেকে ছুরিটা সরায় তখন সেই রাতের মতো ওখানেই শেষ ভেবেছিলাম। কিন্তু আমার পায়ের ক্ষতে ব্যান্ডেজ করার পরে, দ্বৈপায়ন যখন পাশের ড্রয়ার থেকে ফর্সেপস্ (ধারালো কাঁচি বিশেষ) বের করে, তখন আমি ভয় পেয়ে যায়। দ্বৈপায়ন এর আগে একদিনে একবারের বেশি আমার উপর এরকম এক্সপেরিমেন্ট করেনি। ও কাঁচিটা নিয়ে আমার গলার দিকে এগিয়ে আসছে দেখে আমার ভয় আরো বেড়ে যায়। দ্বৈপায়ন ইদানিং অফিস থেকে ফিরে একটা পুলিশ কেসের কথা খুব বলত। বেশ কয়েকবার বলেছিল যে,ওই কেসটাতে মৃত ব্যক্তির গলায় ছুরিটা ঢোকার সময়, ওই ব্যক্তি ঠিক কি অনুভব করেছিল, সেটা ওর খুব জানতে ইচ্ছে করে। কথাগুলো হঠাৎ মাথায় আসায় আমি আরো আতঙ্কিত হয়ে যায়। এতদিন পর্যন্ত দ্বৈপায়ন আমার উপর অনেক রকম কাটাছেঁড়া করলেও, আমাকে মারার চেষ্টা করেনি কোনোদিন। কিন্তু কাল রাতে ওর চোখ মুখের ভাষা অন্যরকম ছিল। ও সবেগে কাঁচিটা আমার গলায় বসিয়ে দেবার চেষ্টা করলে, আমি দু হাত দিয়ে ওর হাতটা চেপে ধরি। ওর শক্তির সাথে পেরে ওঠা প্রায় অসম্ভব ছিল। আমি প্রানপনে দুই হাত দিয়ে ওর হাতটা ধরে জোরে ঠেলা দিই। কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি এত বড় সর্বনাশ হয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত যে আমার হাতেই এত বড় পাপ হয়ে যাবে স্বপ্নেও ভাবিনি।আমার সাথে ও যা করেছিল আমি সবটাই মেনে নিয়েছিলাম। একটা অনাথ মেয়েকে যে পরিমাণ সম্মান ও দিয়েছে, তার জন্য আমি ওর কাছে কৃতজ্ঞ। আমার হোমের সবার কাছে ও ভগবানের সমান।”

রেনু দু'হাতে মুখ লুকিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে।

--"আপনার বক্তব্য আমার কাছে লেখা থাকলো। তবে শুধুমাত্র ধাক্কাধাক্কিতে একজনের গলায় অতটা গভীরভাবে একটা কাঁচি ঢুকে যাওয়া সহজ কথা নয়। যতদিন না মৃত্যুর কারণ সঠিকভাবে জানা যাচ্ছে, ততদিন এখান থেকে অন্য কোথাও যেতে পারবেন না।”

ইতিমধ্যেই রেনুকে কাঁদতে দেখে বিভাস ওর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। পুলিশ অফিসারের কথাতে বিভাস হঠাৎ বলে ওঠে, “নমস্কার স্যার, আমি দ্বৈপায়নদার সাথে একই অফিসে কাজ করতাম।জানিনা আমার কথা আপনার কোনো কাজে আসবে কিনা, তবুও, গতকাল দুপুরবেলা দ্বৈপায়নদার সাথে আমার কিছু কথা হয়; আমার মনে হচ্ছে আপনাকে সেগুলো বলা উচিত।….”

বিভাস এরপর পুলিশ অফিসারকে দ্বৈপায়নের বিশেষ নেশার ব্যাপারটা বলে।

উপস্থিত সহকর্মীদের দু-একজন বিভাসের কথায় সায় দিয়ে বলে, “কাল বিকেল বেলা বিভাস আমাদের কাছে দ্বৈপায়নের ওই নেশার কথাটা বলার পর, দ্বৈপায়ন কিন্তু ব্যাপারটাতে সায়ই দিয়েছিল।”

রেনু,বিভাস ও অন্যান্যদের লিখিত জবানবন্দি নেওয়ার পর, ঘরটা ভালো করে তল্লাশি চালিয়ে শেষ পর্যন্ত পুলিশ অফিসার যখন ফিরে যান, তখন দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল হতে চলেছে।


     ***********************


একমাস হলো দ্বৈপায়নের মৃত্যুরহস্য, রহস্য আকারেই পুলিশের ফাইলে চিরতরে বন্দী হয়ে গেছে। প্রথমদিকে রেনুর ওপরে কিছু সন্দেহের তীর আসলেও, পরে সেগুলো সবই অযৌতিক প্রমাণিত হয়। রেনুর অনুরোধে দ্বৈপায়নের চরিত্রের ডার্ক সাইটটা মিডিয়া থেকে দূরে রাখা হয়েছিল।

'সেফ হোম'-এর প্রাঙ্গণে দ্বৈপায়নের একটা অর্ধ মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। রেনু আজকে সেই মূর্তি উদ্বোধনের সঙ্গে সঙ্গে একটা ছোটখাটো স্মরণসভার আয়োজন করেছে।

দ্বৈপায়নের সহকর্মীদেরও নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল।

রেনু একটা গাছের তলায় বসে ছিল। বিভাস এসে রেনুর পাশে বসে।

--"দ্বৈপায়নদা তোমার সাথে এত কিছু করার পরেও, ওর সম্পর্কে বক্তৃতাতে এত ভালো ভালো কথা বলতে তোমার খারাপ লাগছিল না?”

রেনু মৃদু হেসে বিভাসের দিকে তাকিয়ে বলে, “যা হয়ে গেছে তা অতীত। সম্রাট অশোককে মানুষ কিন্তু চন্ডাশোক নয়, ধর্মাশোক নামেই চেনে। দ্বৈপায়নের ওই রূপটা ওর মৃত্যুর সাথে সাথেই চিরতরে চলে গেছে।আমি চাই এই 'সেফ হোম'-এর মানুষদের চোখে ও ভগবান হয়েই বেঁচে থাকুক। তাছাড়া, এটা ভুললে চলবে না যে, এখন 'সেফ হোম'-এর পুরো খরচাপাতি কিন্তু পরোক্ষভাবে দ্বৈপায়নের সম্পত্তি থেকেই আসছে।”

বিভাস, রেনুর হাতের উপর আলতো করে হাত রেখে বলে, “দ্বৈপায়নদার আত্মার শান্তি হোক।”

বিভাস আর রেনু একে অপরের দিকে অর্থপূর্ণ ভাবে তাকায়।

রেনু আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবতে থাকে।

বিভাস পাশে না থাকলে রেনুর পক্ষে এই সবকিছু করা কোনদিনই সম্ভব হত না। বিভাসের বড্ড ভয় ছিল যে, রেনু হয়তো পুলিশের কাছে সবকিছু গুলিয়ে ফেলবে।

বিভাস যেদিন প্রথম ওদের বাড়িতে আসে, সেদিনই রেনুর চোখ দেখে ওর কষ্টের আভাস পেয়েছিল। বিভাসের সাথে সাবলীল ভাবে মিশতে রেনুর অনেকটা সময় লাগে। প্রত্যেকটা মুহূর্তে ফোনে ওকে মানসিকভাবে সাপোর্ট করেছে বিভাস। বার বার বলতো দ্বৈপায়নকে ছেড়ে বেরিয়ে আসতে। কিন্তু নিজের সুখের থেকে নিজের হোমের চিন্তা ওর কাছে বেশী বড় ছিলো।

বিভাস যখন প্ল্যানটা দিয়েছিল, তখনও রেনু ভাবতে পারেনি শেষ পর্যন্ত কাজটা ও করতে পারবে।

সেদিন রাতে দ্বৈপায়ন যখন নিচু হয়ে ওর পায়ে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছিল, তখন পাশের ড্রয়ার থেকে ধারালো কাঁচিটা বের করার সময়েও রেনুর হাত কাঁপছিল।

চোখের সাইড থেকে দেখতে পেয়ে দ্বৈপায়ন রেনুর হাতটা চেপে ধরার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তার আগেই রেনু সজোরে কাঁচিটা বসিয়ে দিয়েছিল দ্বৈপায়নের গলায়।

বিভাস বারবার ফোনে বলে দিয়েছিল ঠিক কেমন ভাবে বসাতে হবে কাঁচিটা। গলার ডান সাইডের একটু উপর থেকে তীর্যকভাবে দুটো ক্যারোটিড আর্টারি ভেদ করে বসে গিয়েছিল কাঁচিটা। সংজ্ঞা হারাতে দ্বৈপায়নের মাত্র কিছু মুহূর্তই লেগেছিল। ওই কয়েক মুহূর্তে দ্বৈপায়নের চোখে যে বিষ্ময় ছিল, সেটা রেনু সারা জীবন মনে রাখবে।

পাক্কা দশ মিনিট দ্বৈপায়নকে ধরে বসেছিল ও। বিভাস বলেছিল এই ক্ষেত্রে দশ মিনিটের বেশি কেউ বেঁচে থাকে না। মৃতদেহ ছেড়ে ডাক্তারকে ফোন করার আগে দ্বৈপায়নের মৃত শরীরের উদ্দেশ্যে রেনু চিৎকার করে বলেছিল, “আমি কিন্তু মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তোমার সাথ ছাড়িনি দ্বৈপায়ন।”



Rate this content
Log in

More bengali story from Red Eclipse

Similar bengali story from Classics