বরিষ ধরা মাঝে
বরিষ ধরা মাঝে
কল্যাণী আজকাল আর হিল-শ্যু পরে হাঁটতে পারেন না। বয়সটা বাষট্টি হলেও গতবছরও তরতর্ করে হাঁটতেন। গাঢ় নীল গাউনের ওপর একটা দুধসাদা শাল জড়িয়ে নিয়ে দাঁড়ালেন আয়নার সামনে। চোখ ঢাকলেন ধোঁয়াটে চশমায়।
বাইরে থেকে ডাক ভেসে এলো,
----- মম্, লেট হো রহে হামলোগ !! চলিয়ে তো !! ড্রেস নেহি হুয়া হ্যায় আবতক ?
কল্যাণী হাসলেন,
----- আ রহি হুঁ--
বেরিয়ে এলেন কালো বড়োসড়ো লেডিস ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে।
বেরোনোমাত্রই তিন বছরের নাতি পাকড়াও করলো,
------- দিদি, আমি তোমার কাছে বোসবোওও----
মাথাটা হেলিয়ে বললো ---- ঠিক হ্যায় ?
কল্যাণী গালটিপে ওর হেলানো মাথায় আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ালেন, যাতে লিপস্টিক উঠে না যায়। বৌমা গৌরী এসে জড়িয়ে ধরলো, ও গুজরাটী মেয়ে...
------ ওহো হো ! আজ ভি সো বিউটিফুল হো শাশুমা ----
কল্যাণী বৌমার কপালেও সাবধানে ঠোঁট ছোঁয়ান
----- তু ভি কুছ কম হ্যায় ক্যায়া ?
ছেলে ঈশান হাসতে হাসতে বললো,
----- তোমাদের হয়ে গেলে বাড়িতে চাবি দিই? উই উইল মিস্ দ্য ট্রেন মা -----
সকলে তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠল। ওরা যাবে তিস্তা-তোর্সা এক্সপ্রেসে এন. জে. পি, তারপর গ্যাংটক। ট্রেনে নাতি, বৌমা আর তার শাশুমার খুনসুটি চলতে থাকুক।
************
চলুন পাঠক, আমরা আর এক যাত্রীর দিকে চোখ রাখি।
***********
মাথা ভর্তি পাকাচুল ছাড়া শরীরে কোথাও বার্ধক্যের লেশমাত্র নেই তার। উনি শুভেন্দু, তবে খুব উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে তাকে। আরো দুজন আসার কথা, ট্রেন ছাড়ার আর বেশি দেরী নেই। বারবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করছেন,
------ দু-উ-র-র্ ! নির্ঘাত কমলেশটা ডুবিয়েছে। রফিকটাও তমনই ---ফোনটাও যে কেন ধরে না !
এমন সময় একটা হাত তুলে প্রায় ছুটতে ছুটতে এসে হাজির ওরা। রফিক ওদের মধ্যে সবচেয়ে লম্বা, রোগাও। বেশ মোটাসোটা কমলেশকে আগলে নিয়ে ট্রেনে ওঠালেন, মালপত্র তুলে তিনজনে গুছিয়ে বসলেন, ওদেরও গন্তব্য গ্যাংটক।
***********
ওদের সবাইকে নিয়ে তিস্তা-তোর্সা এক্সপ্রেস এগিয়ে চলুক। আমাদের আবার দেখা হবে গ্যাংটকে।
***********
গ্যাংটকের আকাশে আজ সকাল থেকে মেঘ তো ছিলই, এখন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হলো। রাস্তার দুপাশে যেখানে পসরা সাজিয়ে বসেছে দোকানিরা, তারা সবাই এরকম বৃষ্টিতে অভ্যস্ত, তারা চটপট্ নিজের দোকানের সামনে বিশাল ছাতার ছাউনি লাগিয়ে দিয়ে জিনিস, যাত্রী দুটোই বাঁচালো।
শুভেন্দুরা এসে এরকমই একটা ছাতার তলায় দাঁড়ালেন। একটু বিরক্ত যেন ওরা, রফিকের গলা শোনা গেল,
---- কিছু নিয়ে না গেলে মেয়েদুটো আস্ত রাখবে না।
কমলেশ বললেন,
--------তবু তো তোর কেউ আছে রে ভাই, আমার বৃদ্ধাশ্রমের এক বান্ধবীর জন্য শাল নেব একটা।
ওকে চেপে ধরলো দুজনে,
--- ওঃ বৌদি মরে গিয়ে তোকে বাঁচিয়ে দিয়েছে বল ? হাঃ হাঃ হাঃ---
শুভেন্দুর দিকে তাকায় সবাই,
---- তোর আর গতি হলোনা রে ! বিয়েটাও তো করে উঠতে পারলিনা শুধু স্মৃতি নিয়েই----- এখনও কিন্তু চান্স নিতে পারিস---ঠিকই আছিস এখনও......
শুভেন্দু হাসলেন,
----
- নিতাম। যদি না আমার বুকের মধ্যে কেউ আজও -----
হঠাৎই চোখে পড়লো, একজন মহিলা ভিজে-টিজে আসছেন-- খুব বিব্রত হয়ে ছাতার দিকে তাকাচ্ছেন, খুব চেনা লাগলো যেন, কবে কোথায় যেন দেখা হয়েছিলো এমনি এক বৃষ্টির দিনে, বিদ্যুৎচমকের মতো একটা মুখ হৃদয় নিংড়ে উঠে এলো। শুকিয়ে যাওয়া ক্ষতটা থেকে আবার শুরু হলো রক্ত ক্ষরণ, অস্ফুটে উচ্চারণ করলেন,
------- কল্যাণী !!
কল্যাণী শুনতে পেলেন না। দ্রুত এসে ছাতার তলায় দাঁড়ালেন।
শুভেন্দুর বন্ধুরা পিঠ চাপড়ে সরে গেলেন।
শুভেন্দু একটু কাছে এসে বললেন,
--- কেমন আছো, কল্যাণী ?
ভীষণভাবে চমকে উঠে তাকালেন, ঠিক যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না, বুকের মধ্যে হাজার খানেক ঢেউ আছড়ে পড়লো।
গলাটা ওর এখনও তেমনি ভরাট, তেমনি প্রাণ উছল করা।
---- শুভ ! তুমি ?
উদাত্ত গলায় হাসলেন শুভেন্দু,
---- বোধহয় বৃষ্টিটা কমল একটু, চলো না ! বসি কোথাও !
সম্মোহিত কল্যাণী, আন্দোলিত কল্যাণী, উদ্বেলিত কল্যাণী----বৃষ্টির জল মুছতে গিয়ে সাধের লিপ্সটিক ধেবড়ে ফেললেন।
পা দুটো যেন চলতে ভুলে গেছে--- শুভেন্দু হাতটা ধরলেন ওর--- বুঝলেন, আজও একইরকম আছে সে, তার কল্যাণী ---
একটা ছোট্টো টেবিলে বসিয়ে
শুভেন্দু বললেন,
---- আইসক্রীম খাবে ?
কল্যাণীর চোখে এবার বাষ্প--- কোনো রকমে মাথা হেলালেন। সেদিনটাতেও আইসক্রীম খাইয়েছিলো শুভ! বলেছিল দুবছর পরে ফিরে আসবে জার্মানি থেকে, আসেনি ও---
শুভেন্দু আইসক্রীম নিয়ে ফিরতেই কল্যাণী বহুকালের জমে থাকা প্রশ্নটা করেই ফেললেন,
--- কেন এলেনা শুভ, কেন ?
--- কি করি বলো ! অসুখের জন্য আমার যে পরীক্ষাটাই দেওয়া হয়নি সেবছর। একটা বছরে তুমি হারিয়ে যাবে ভাবিনি---- চিঠি দিয়েছিলাম তোমার বন্ধুকে, বাড়িতে চিঠি দেওয়ার পারমিশন ছিলনা তোমার -----
কল্যাণীর চোখের মেঘ তখন বৃষ্টি ফোঁটায় নামছে, সম্বিত ফেরে গৌরীর ডাকে,
--- কাঁহা চলা গেয়ে থে মা ?
কেঁপে উঠে বাস্তবে ফিরলেন কল্যাণী,
--- আয় আয় ! বারিষ আ গয়ি থী তো.....
--- ইয়ে আঙ্কেল ?
--- শুভেন্দু ! মাই ক্লাসমেট,
ইতিমধ্যে ঈশান এসে দাঁড়িয়েছে,
--- গ্ল্যাড টু মিট ইউ আঙ্কেল ! আসুন না মাঝে মাঝে, মার ভালো লাগবে------
ঠিকানা ফোন নম্বর লেখা একটা কার্ড এগিয়ে দিল শুভেন্দুর দিকে।
গৌরী ওদের দুচোখের মেঘ তখন দেখে ফেলেছে, শুভেন্দুর দিকে এগিয়ে এসে হাতদুটো ধরে বললো,
---- আইয়েগা জরুর আঙ্কেলজী,
একটু হেসে বললো,
--- এক বাত কহুঁ?
শুভেন্দু তখন যন্ত্রণায় নীলকণ্ঠ, চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকান, গৌরী খুব ঠোঁট কাটা,
--- আগর থোড়াসা হিম্মৎ জুটা পাওগে আঙ্কেল, তো--- হাম আপলোগোঁকে সাথ হুঁ------
কি মুশকিল ! শুভেন্দুর চোখদুটো বিশ্বাসঘাতকতা করবে নাকি !! কোথায় লুকোবেন ?
ওকে ঢাকতেই বোধহয়, অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামলো আবার। শুভেন্দুর চোখের সামনে বৃষ্টিতে আবছা হয়ে এলো কল্যাণী----তার কল্যাণী----
ঈশানের নেমকার্ডটা, শক্ত করে ধরে
চোখের জলকে মুক্তি দিলেন এবার---বৃষ্টির সাথে।
(সমাপ্ত)