উত্তর পাইনি
উত্তর পাইনি
হে মহান পাঠকগণ,
স্বাধীনতার সংজ্ঞা যে কি !!সেটা মাঝে মাঝে অস্পষ্ট হয়ে যায়।হয়তো সেটা আমার ই অজ্ঞতা বা নির্বুদ্ধিতা। কিন্তু পাঠকগণ,এটা নিশ্চয়ই বুঝতে অসুবিধে হয়না, যে,মনের গভীর অনুভূতিকে স্বীকৃতি দেওয়ার অধিকারই স্বাধীনতার আর এক নাম!! সেই রকমই একটা অনুভূতি আজ স্বাধীন হলো আপনাদের দরবারে,----
-যার উত্তর পাইনি---
ইংরেজ আমলেও হুগলির কিছু অংশ ছিল ডাচ্ আর ফরাসীদের অধীনে। হুগলী-চুঁচুড়া-চন্দননগর অঞ্চলের ডাচ আমলে তৈরি ঐ প্রাসাদোপম অট্টালিকাগুলো আমায় খুব টানে।
শুনেছিলাম ধীরে ধীরে (জায়গা গোপন রাখলাম) এই রকমই একটি বাড়ি মা গঙ্গায় আত্মাহুতি দিচ্ছে----তাই এক শীতের দুপুরের মিষ্টি রোদ্দুর গায়ে মেখে চলে গেলাম ঐ জমিদার-বাড়ির সামনে।পাথরের ফলকে লেখাছিল,-- "আঢ্য ভিলা"---সঙ্গে ছিল এক বন্ধুর চিঠি, আমার ঢোকার ছাড়পত্র।
ওটা এখন যাঁদের অধিকারে,তাঁরা একসময়ের নামকরা জমিদার বংশ । বাংলা বিহার উড়িষ্যার বেশকিছু অংশের জমি ছিল তাঁদের অধীনে। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর অনেকটা চলে গেলেও ছিল অনেকটাই। তবে এই বাড়িতে তাঁরা কেউ থাকতেন না।
গেট পেরিয়ে ঢুকে গেলাম কোনো বাধা ছাড়াই, একজন বাগানে কি যেন তুলছিলো।, সম্ভবতঃ শাক। তাকে চিঠি দেখাতে,-- নিয়ে গেলো একটা ভারী দরজার সামনে, দরজাটা ক্যাঁ-এ্যাঁ-চ্ শব্দে খুলতে হলো। বার্ণিশ করা দরজাটার পেতলের হাতল দুটো কালো হয়ে গেছে।
একটা সুবিশাল হলঘরে এসে দাঁড়ালাম।হালকা ধুলোর আস্তরণের তলায় ধূসর মেঝে, মাঝখানে, শ্বেত পাথর বসানো গোল আলপনা। কোণে কোণে বার্নিশ করা সুদৃশ্য কাঠের থামের ওপর পেতলের মিনে করা মূর্তি, কোনোটা ময়ূর, কোনোটা নটরাজ। একটা বুদ্ধ মূর্তি --নজর কাড়লো। এখনও কালো হয়নি, কি অপূর্ব কাজ তার---
মাথার ওপর তাকিয়ে দেখি ছাদ প্রায় দেখাই যায় না, এতো উঁচুতে!! সেখান থেকে ঝুলছে একটা কাপড়ের পুঁটুলি, কেয়ার টেকার ভোলাদার দৃষ্টি আকর্ষণ করি,
------ওটা কি?
------ঝাড়বাতি ! যখন কোনো অনুষ্ঠান হতো তখন জ্বালানো হতো।
কলকাতা যখন বাবু কালচারে জর্জরিত তখন বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে ছিলেন এরাও। তারই একটা দুটো নিদর্শন এবাড়িতে এখনও রয়ে গেছে।একটা ঘরে দেখলাম, কিছু বাদ্যযন্ত্র, তার মধ্যে রয়েছে রাজকীয় একটা রুদ্রবীণা।
এটা বারবাড়ি। অন্দরে যেতে হলে পার হতে হয় একটা লম্বা দালান, সাদা-কালো চকমিলানো।এতো বড়ো যে ওদিকটা খুব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। মনে হলো একটা ছোটো মতো দরজা রয়েছে।
কাছে গিয়ে দেখি সত্যি---- একটা দরজা, ইয়াবড়ো একটা মরচে ধরা তালা লাগানো।
দরজাটা আমার খুব চেনা লাগলো,খুব চেনা চেনা--- হঠাৎই কেমন গুলিয়ে উঠলো গা টা ---একটা দম আটকানো অনুভূতি। তাড়াতাড়ি চলে এলাম। ভোলাদাকে বললাম,
----আজ কাজ আছে, কাল আবার আসবো।
বাড়ি এসে বমি হয়ে গেল খানিকটা। খেতেও পারলাম না। একটু সরবত খেয়ে শুয়ে পড়লাম। মাথাটা ভারী, রোদ লেগে গেছে বোধহয়। কিন্তু ---যাকগে!! একটা অস্বস্তি লেগেই রইলো।ঘুম এলো অনেক রাতে।
***********************
ঐ ছোট্টো কাঠের দরজাটা খুলে প্রদীপ হাতে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। একজন স্ত্রীলোক,--যতটুকু দেখা যায়,অভিজাত,ব্যক্তিত্বপূর্ণ চেহারা, অলংকার ঝলমল করছে, কিন্তু চোখে জ্বলন্ত দৃষ্টি। দরজার পরেই ধাপে ধাপে নেমে গেছে সিঁড়ি, প্রায় সুড়ঙ্গের মতো। তিনি ডাকলেন,
--------এসো,
এবার তার পিছনে দেখা গেল একটি মেয়েকে, বয়স কম,--নিরাভরণ, সাদা শাড়ি পরনে। সে অস্ফুটে বললো,--
----এ কোথায় যাচ্ছো জ্যাঠাইমা?
----তুমি পূর্ণিমায় গঙ্গা স্নান করতে চেয়েছিলে না?
----হ্যাঁ হ্যাঁ।
----আমরা তো যে সে বংশ নই, তাই সবার সামনে স্নান শোভা পায় না। এ আমাদের নিজস্ব ঘাট, নিশ্চিন্তে স্নান করো।
----তুমি থাকবে তো?
----থাকবো
----আচ্ছা, কি অন্ধকার, প্রদীপটা ধরো!!
মেয়েটি এবার জ্যেঠাইমাকে পাশ কাটিয়ে নেমে এলো। নামলেন জ্যেঠাইমাও। মেয়েটি ঠান্ডা জলে পা ডুবিয়ে আরাম করে বসলো সিঁড়ির শেষ ধাপে। হাত দিয়ে জলকে যেন আদর করল একটু।
এবার জ্যাঠাইমা প্রদীপটা সিঁড়ির ধাপে রেখে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়লেন। একপা একপা করে সন্তর্পনে পেছোতে থাকেন, মেয়েটি পরমানন্দে স্নান করছে। জ্যাঠাইমা সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে এসে ভারী কাঠের দরজাটা সশব্দে বন্ধ করে দিলেন।
--------রমেন,দরজায় তালা লাগিয়ে দাও----
মেয়েটি চমকে ওঠে, -----কাতর কন্ঠে চেঁচাতে থাকে,--- জ্যাঠাইমা -----জ্যাঠাইমা----যেওনা গো--- বড্ডো অন্ধকার ----আমার ভয় করছে-----জ্যা---ঠা---ই---মা-------
জ্যাঠাইমা কর্কশ কন্ঠে ওপর থেকে বললেন,
-------এক্ষুণি জোয়ার আসবে, সব সিঁড়ি ডুবে যাবে, তোমার ইহজন্মের জ্বালা জুড়োবে,----আর একটুখানি সবুর কর সর্বনাশী----
মেয়েটি ঠক্ ঠক্ করে কাঁপতে থাকে, গঙ্গার কালো জল যেন একটু একটু করে বাড়তে থাকে, ছোটো ছোটো ঢেউ আছড়ে পড়ে সিঁড়িতে। জলের শব্দটা যেন গর্জন হয়ে ওঠে, অন্ধকারকে আরো ভয়ঙ্কর করে তোলে----
*********************
আচমকাই ঘুমটা ভেঙে গেল.--এই শীতেও ঘেমে গেছি,--কেমন দম অটকানো অনুভূতি --ঐ দরজাটা-- আশ্চর্য--এ কেমন স্বপ্ন!!
----সারাদিন ধরে মনটা খারাপ লাগছিল, চৌধুরী ভিলার ঐ দরজাটা কেন দেখলাম?? কেনই বা চেনা লেগেছিল?
পরের দিন দুপুরে আবার হাজির হলাম,
আজ সরাসরি ভোলাদাকে বললাম,
----ঐ তালাটা খোলা যাবে?
----না দিদিভাই!!হুকুম নেই।
----কার হুকুম? কেন?
----মালিকের। কেন,--তা-- জানিনা।
----আচ্ছা ওটার ওপাশে কি আছে?
----গঙ্গায় যাওয়ার রাস্তা,------
চমকে উঠলাম, বললাম,
---- কালো সিঁড়ি? গোল খিলানের মধ্যে স্নানের জায়গা?
ভোলাদা অবাক হয়ে তাকালো,
-----একবার বাবুকে খুলতে দেখেছিলাম। ঐরকমই তো ছিল, আপনি কি করে!!!
----- তোমার মালিক কোথায় থাকেন?
ওর কাছ থেকে ঠিকানাটা জোগাড় করে পৌঁছে গেলাম একদিন।
এদের এখনকার বাড়িটাও মন্দ নয়, উত্তর কোলকাতার উল্টোডাঙা আঞ্চলে পুরোনো বাড়ি। আমার উদ্দেশ্য জানাতে,-- ওরা একজন পঁচাত্তর-ছিয়াত্তর বছরের বৃদ্ধের কাছে নিয়ে গেলেন। অত্যন্ত রাশভারী ও সুপুরুষ মানুষ, আমাকে বসতে বলে জানতে চাইলেন,
-----কেন? আমাদের ইতিহাস জেনে কি হবে?
-----না মানে --আমি একটা স্বপ্ন দেখি,ঐ বাড়িটার--- দালানের ছোট্টো দরজাটার!!
শুনেই যেন মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। বললেন,
----কি স্বপ্ন??
আমি সংক্ষেপে এবং সাবধানে জানালাম,উনি বোধহয় মুখটা লুকোনোর চেষ্টা করলেন,
----- জানিনা অতোদিন আগের ঘটনা কি করে তুমি স্বপ্নে দেখলে, তবে ঐ ঘটনা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি,---
আমার বাবার জ্যাঠাইমা ছিলেন উনি। আর ঐ মেয়েটি আমাদের আশ্রিতা ছিল। বিধবা। জ্যাঠাইমার ছোটোছেলে ভালোবেসেছিল ওকে-----উনি জানতে পেরে---মেয়েটিকে----ঐ বাড়িতে জ্যাঠাইমার ছবি আছে, তেলরঙে আঁকা।
বললাম, যদি ঐ দরজাটা খোলার অনুমতি দেন একবার!!
কি ভেবে রাজি হয়ে গেলেন----বললেন,
----এ আমাদের কলঙ্কিত ইতিহাস----
পরেরবার যখন গেলাম,--- ঐ দরজাটা খুলে নিচের সিঁড়িতে পা রাখলাম --- কেমন ভয়ে শিউরে উঠলাম যেন। একটা ঠান্ডা হাওয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে গেল, সুড়ঙ্গটা যেন ভারী হয়ে উঠলো----ভয়ে ভয়ে দেখলাম,---কেউ বন্ধ করে দিলো না তো!! গঙ্গা এখন আরো কাছে,জোয়ার বোধহয়, জল আছড়ে পড়ছে ভাঙা ঘাটে,ভোলাদা সাবধান করে,
------বেশি কাছে যেওনা দিদিভাই, পাড় ভাঙছে।
পায়ে পায়ে উঠে এলাম। দরজাটায় আবার তালা লাগানো হলো।
আজ ঘরগুলো ঘুরে দেখলাম। একটা ঘরে অনেক অয়েল পেন্টিং, তার মধ্যে একটিতে---
---সেই স্বপ্নে দেখা জ্যাঠাইমা।
তবে কি আমার সাথে কোনো না কোনো ভাবে যুক্ত এই পরিবার??কোনো জন্মের সম্পর্ক আজও রয়ে গেছে মনের সুগভীর অবচেতনে??
উত্তর পাইনি।