শহীদ
শহীদ
#শহীদ
#রাণুশীল
আজ শুক্রবার,সুদীপের হঠাৎই মনে পড়লো, আজ তার আসার কথা।
অফিসে যাওয়ার আগে আর একবার বাগানে গেল, ফুলগুলোকে আদর করে, কথা বলে, টা টা করে গাড়িতে উঠলো। ওর জীবনে গাছ আর
ভজু-ই সব কিছু।
দু তিন সপ্তাহ ধরে একজন ফুলের চারা নিয়ে বসছে গেটের কাছে। লোকটাকে আগে কখনও দেখেনি। চোখের তারা দুটো সবুজ! কি অদ্ভুত দৃষ্টি---যেন ষড়যন্ত্র চলছে ভেতরে।
ঢোকার পথে তাকে দেখলো না। লাঞ্চ টাইমে দেখতে হবে। কাজের মধ্যেও লোকটার চোখদুটো মনে পড়ছে, সুখলাল তো গেটেই থাকে, ওকে ডাকলো সুদীপ,
--------সুখলাল, আগর উয়ো আদমি গাছ লে কে আয়েঁ তো মুঝে বাতানা..
জোর করে কাজে মন দিলো সুদীপ।
লাঞ্চ টাইমে সুখলাল খবর দিলো,
---জী সার! উহ্ আদমি বৈঠা হ্যায়।
সুদীপ গেটের কাছে এলো। দেখলো, লোকটা কিছু গাছের চারা নিয়ে বসে আছে মুখটা নিচু করে, একটা সবুজ রঙের স্কার্ফে মাথা আর মুখের নিচের অংশটা ঢাকা। সুদীপ এসে দাঁড়াতেই চোখ তুললো লোকটা। সবুজ মণিদুটোয় যেন এইমাত্র সূর্য শুষে নিয়েছে!! অনেকটা----অনেকটা গাছের মতো।
লোকটা যেসব গাছ নিয়ে বসে আছে, সেগুলো একটু অদ্ভূত আকৃতির, তবে কিসের সঙ্গে যেন মিল আছে, কোথায় যেন দেখেছে ওগুলো সুদীপ।
যাই হোক, সুদীপ একটা গাছ দেখিয়ে বললো,
-----এটায় ফুল হয়?
লোকটা যেন স্কার্ফের তলায় হাসলো, ঘরঘরে গলায় বললো,
-----হয়!
-----কতো বড়ো হয় গাছটা?
-----পাঁচ ফুট মতো।
-----কি সার লাগে?
-----শুধু এক মগ জলের মধ্যে এই ওষুটা রোজ দুবার।
---- দাও তবে--
লোকটা হাত তুলে থামতে বললো, হকচকিয়ে গেল সুদীপ, লোকটার হাতের রঙ বেশ খয়েরি মতো,খুবই আশ্চর্যজনক ---যতো কালোই হোক, ঐ রকম রঙ? মুখটাতো ওরকম নয়?লোকটা বললো,
----আপনার বাড়ি না ফ্ল্যাট?
----বাড়ি
----বাগান না টব?
----বাগান
----নিজেই করবেন, না মালি?
----নিজেই, তবে আমার কাছে ভজু থাকে
ও--ও দেখে, কিন্তু কেন?
রহস্যজনক দৃষ্টি স্থির হলো সুদীপের মুখে।
------দত্তক নিচ্ছেন, আর বাবা খোঁজ নেবে না?
তবে এটার সাথে আরো দুটো অন্য গাছও দোবো।
চোখদুটো সরু করে বললো, ----ফ্রি----
সুদীপ হতবম্বভাবটা কাটিয়ে উঠে বললো,
-----কেন? ফ্রি দেবে কেন?
----আপনাকে নয়,বাগানকে।
কি আশ্চর্য কথাবার্তা, ও একটু গাম্ভীর্য দিয়ে অবাক ভাবটা ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা করলো।
-----শোনো, বাগানটা আমার, সুতরাং গাছটাও আমিই বাছবো।
লোকটা সবুজ চোখে আয়না লাগিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। ঘরঘরে স্বরটা এবার আরোও কর্কশ---বললো,
------মাটি আমার, সুতরাং কোথায় কোন গাছ থাকবে সেটা আমিই বাছবো।
সুদীপের ভেতরে একটা ভয়ের অনুভূতি শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেলো। এবার লোকটার দিকে একটু ভালো করে তাকিয়ে দেখলো ওর গায়ে শুকনো পাতার মতো একটা আলখাল্লা --কি অদ্ভূত পোশাক রে বাবা! তাড়াতাড়ি গাছ নিয়ে বললো,
----দাম কতো দোব?
----আর একজন খরিদ্দার---যার বাগান আছে।
************************
সুদীপদের বাড়িটা থেকে দুটো রাস্তা চলে গেছে। একটা পশ্চিমে, একটা দক্ষিণে। উত্তর দিকে একটা পার্ক আর পূর্ব দিকে রায়দের বাড়ি ও একটা মাঝারি পুকুর। এখানে জলের লেবল্ বেশ ভালো, মাটিও ভালো। সব বাড়িতেই ছোটোখাটো বাগান আছে। এ রাস্তায় ফ্ল্যাট খুব কম। একটু রাত হতেই কলকাতার উপকণ্ঠের ছোট্টো শহরটা সুনশান হয়ে যায়।
গাড়ি থেকে নামতে নামতে সুদীপ -----ভজু----বলে ডাক দিলো। ভজু ----হ্যাঁ দাদা---বলে বেরিয়ে এলো। ওকে গাছগুলো দিয়ে বললো ভালো করে লাগিয়ে দিস।
বাড়িতে এসে গাছগুলো দেখে খুব অবাক লাগছিলো, অফিসের অনেকেই "আর একজন খরিদ্দার" এর ঠেলা সামলেছে। তাদেরই একজনকে ফোন করলো সুদীপ,
----শুভ !গাছগুলো দেখেছিস? কেমন যেন চেনাচেনা না? কোথায় দেখেছি
বলতো?
----সেই!! মনে হয় প্রাগৈতিহাসিক।
বলামাত্রই মনে পড়ে গেলো,
-----ঠিক ! ঠিক বলেছিস, সেদিন বিরল প্রজাতির,লুপ্তপ্রায় এবং অবলুপ্ত গাছ সম্বন্ধে একটা বই কিনেছিলাম। তাতেই দেখেছি। কিন্তু কিকরে ওর কাছে এলো এগুলো! বলতো??
-----কি অদ্ভূত লোক, আমাদের পাঁচজনকে খদ্দের দিতে বললো, ষষ্ঠ জনকে কিছু বললোনা।
----দেখাই যাক, গাছগুলো কি হয়! পরের দিন জিগেস করতে হবে, ওষুধ ফুরালে আবার পাব তো?
অবশ্য পরেরদিন থেকে আর তাকে দেখা যায়নি।
গাছগুলো যত্ন করেই লাগানো হলো। লোকটির কথামতো ওষুধ জল ইত্যাদি দেওয়া হতে থাকলো, গাছেরা বাড়তে থাকলো দ্রুত গতিতে।
যারা গাছ নিয়েছিলো, তারা সবাই অদ্ভুত একটা মৃদু শিষ শুনেছে। বাগানে কে যেন রাতবিরেতে হেঁটে বেড়ায়। ভিজে মাটিতে ছাপ পড়ে একঠেঙে অতিকায় পাখির পায়ের মতো। যেন কোনো খুব বড়ো পাখির তিনটে আঙুল সমেত একটা পা টানতে টানতে ঘুরে বেড়িয়েছে সারা বাগান।
খুবই আশ্চর্য! ওরা ঠিক করলো রাত জাগবে,সুদীপের বাগানটা বেশ বড়ো, আর বাড়ির সামনে দিকে হওয়ায় দেখার সুবিধেও আছে। তাই সুদীপ আর শুভ ঠিক করলো ছাদ থেকে লক্ষ্য রাখবে, সঙ্গে ভজু।
ওরা খাওয়াদাওয়া সেরে যে যার পজিশন নিয়ে নিলো। এবার প্রতীক্ষা। অপূর্ব মায়াময় রাত, ল্যাম্প পোস্টের ম্লান আলো জ্যোৎস্নায় মিশে গেছে। অল্প হাওয়ায় গাছেরাও এ ওকে ছুঁয়ে দিচ্ছে আলতো করে--ওরাও আরামে আপ্লুত--
ছাদে পায়চারি করতে গিয়ে পাঁচিলের কাছে এসে চমকে উঠলো শুভ, ডাকলো,
-----সুদীপ! দেখ!
সুদীপ আর ভজুর দুজোড়া চোখ একসাথে বিস্ফারিত--- সেই গাছওয়ালা লোকটা না?
একই পোশাক, ও এতো লম্বা!
গেট খুলে সটান ঢুকে এলো বাগানে, ওর গাছগুলোর কাছে এসে ফিসফিসিয়ে কী যেন বলছে--- এরপর শুরু হলো একটানা মৃদু শিস্ লোকটা দুলতে শুরু করলো। আশ্চর্য তার সাথে গাছগুলোও। সে এক অদ্ভুদ আবেশ, ঝিমধরা মাদকতা। ওরাও যেন আবিষ্ট হয়ে পড়েছিল।
ভজুর অবশ্য বীর রসের মাদকতা। বুদ্ধি আর সাহস যুগপৎ থাকলে তিনি মহাপুরুষ, কিন্তু
ভজুর সাহস যতটা, বুদ্ধি ততটা নয়। ও কেউ কিছু বোঝার আগেই একটা ফলকাটা ছুরি নিয়ে তরতর করে নিচে নেমে ডাইনিং এর দরজা দিয়ে ধাঁ করে বেরিয়ে পড়লো।
বাগানে এসে ছুরিটা উঁচিয়ে চেঁচিয়ে বললো,
----এ্যাই! কে! কে তুমি?
সঙ্গে সঙ্গে সেই সবুজ জ্বলজ্বলে চোখে হিংস্র দৃষ্টি নিয়ে তাকালো লোকটা ---
ছাদ থেকে শুভ চেঁচিয়ে উঠলো,
---- পালা ভজু---
ভজু ততক্ষণে চেপে ধরেছে শুকনো পাতার পোশাক। ওরা হুড়মুড় করে ছুটে বাগানে বেরিয়ে এলো।
সুদীপ আর শুভ একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়লো ওর ওপর, ধস্তাধস্তিতে শুকনো পাতার পোশাক ছিঁড়ে যেতেই!!! ওরা ছিটকে সরে এলো।
ওই পোশাকের তলায় রয়েছে একটা মোটা গাছের গুঁড়ি, গাঢ় খয়রি রঙের।
গাছটা এক টানে খুলে ফেলেছে সবুজ স্কার্ফ, বেরিয়ে পড়েছে মাথা ভর্তি শুকনো পাতা আর সরু সরু ডালপালা। সবুজ চোখে আগুন। ওদের মাথা ঘুরে উঠলো, চোখ অন্ধকার হয়ে এলো, শুভ সুদীপের ওপর পড়ে গেল জ্ঞান হারিয়ে, সুদীপ ওকে নিয়ে মাটিতে পড়ে, মাথাটা ঠুকে গেল একটা গাছের টবে--- ভজু একটা প্রচন্ড চড় খেল গাছটার খয়রি হাতের.....
আর কিছু মনে নেই ওদের......
পরের দিন যখন জ্ঞান ফিরলো তখনও ওরা ভজু সমেত বাগানে পড়ে আছে। ওরা উঠলো, মথাটা টলছিল তখনও। ঠিক করলো, গাছগুলোকে উপরে ফেলবে। ওরা তাই করলো, বাগানের বাঁধানো শুকনো চৌবাচ্চায় ফেলে রেখে দিলো ওগুলো।
সুদীপ নিশ্চিন্ত হতে না পারলেও অফিসে এলো।ভজুকে ফোন করে জানলো কিছু হয়নি আর।তিনদিন নির্বিঘ্নে কাটলো, চার দিনেরদিন ফোনে ভজুর ভয়ার্ত কণ্ঠ শোনা গেল।
-------দাদা আমাদের রান্নাঘরের সিঙ্কে মোটা খয়রি সাপের মতো কি একটা দেখে চমকে উঠেছিলাম। তারপর দেখি জানলা দিয়ে ওই গাছের শেকর এসে সিঙ্ক থেকে জল খাচ্ছে। ওরা মরবেনা সুদীপদা-----
সেদিন হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি ফেরার পথে সুদীপ দেখলো শুকনো পাতা সমেত একটা মরা গাছ কারা যেন টেনে নিয়ে যাচ্ছে, খুব লম্বা গাছটা। মাথার দিকে কিছু শুকনো পাতা, দুপাশে দুটো শুকনো খয়েরি ডাল, যেন হাত.... তিনটে শেকর এমনভাবে রয়েছে, যেন তিনটে আঙুল।
কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় ও খুব কাছ থেকে দেখলো। জিগেস করলো, কবে কাটলে গাছটা?
ওরা বললো,
-----অনেক দিন। ওই রাস্তাটা বড়ো হবে তাই।
সুদীপ বুঝলো, গাছেরাও বিদ্রোহ করতে জানে। তারাও শহীদ হয়। এ মাটি ওদের, যার ওপর আমাদের বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, তা একদিন ছেড়ে দিতে হবে ওদের....ওরা প্রতিশোধ নেবেই....গাছেদের সমাজ থাকলে, এ গাছটার জন্য সবুজ পতাকা উড়তো.....