Somtirtha Ganguly

Thriller

3.3  

Somtirtha Ganguly

Thriller

মিজু 水

মিজু 水

13 mins
1.8K


2017

ভারতবর্ষ কলকাতা শহর


ধূর্জটি বাবু লোকটা খুব সাদা মাটা।সাদা মাটা বললে ভুল হবে খুব নিরীহ। শান্ত শিষ্ট স্বভাবের।কারো সাতে পাঁচে থাকেন না। সেল ট্যাক্সের আপিসে কেরানির কাজ করেন। আপিস করে বাড়ি চলে আসেন। বিয়ে থা করেননি ।শখ বলতে গল্পের বই পড়া আর সিনেমা দেখা। একটি কাজের মেয়ে আছে সকালে এসে ঘর মুছে বাসন ধুয়ে দিয়ে তিন বেলার জন্য রান্না করে দেয়। নির্ঝঞ্ঝাট জীবন ধূর্জটি বাবুর দিব্বি চলছিল। হটাৎ ফাপরে পড়েছেন ভদ্রলোক...


কিছুতেই জল খেতে পারছেন না। শুধু খেতে পারছেন না নয় জল দেখে রীতিমতো অস্বস্তি হচ্ছে ওনার। আপিসের বেয়ারা ওনার টেবিলে জলের গ্লাসটা রাখতেই ধূর্জটি বাবুর চোখ মুখ ভয়ে কাঠ। জলাতঙ্ক হলো নাকি কিন্তু কুকুর বেড়াল তো ছাড় কোনো পিঁপড়ে পর্যন্ত কামড়ায়নি ধূর্জটি বাবুকে।তাহলে কি হলো ওনার, স্নান করতে পারছেন না শাওয়ার খুলে জলের আওয়াজ শুনলেই ওনার শরীরের সব লোম গুলো খাড়া হয়ে যাচ্ছে গায়ে জল পড়লেই । যেন তীক্ষ্ণ সুচ বিধছে গায়ে। জল নয় যেন এসিড।না এবার বেশি বাড়াবাড়ি হতে শুরু করলো ।জল খাওয়া বা চান করা দূরে থাক জল সমন্ধ্য কেউ কিছু বললেই বমি হওয়ার উপক্রম হচ্ছে ধূর্জটি বাবুর। 

এই জলাাতঙ্ক ছাড়া ইদানীং আরো একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে ধূর্জটি বাবুর। মাঝে মাঝেই খুব ঘেমে উঠছেন আর ঘাড়ে এক অসম্ভব জ্বালা বোধ করছেন তিনি। কেউ যেন কানে কানে কি যেন ফিস ফিস করে বলছে। খুব অস্পষ্ট কথাটা মাছি না মৌমাছি না মাঝি। একটা অদ্ভুত গলায় শোনা যায় ফিস ফিসটা। গলাটা পুরুষালিও নয় আবার মেয়েলিও নয়। তবে জলাতংকের মতো ফিস ফিসটা সব সময় হয় না। হটাৎ হটাৎ শুনতে পান।

জল না খেয়ে শরীর ভাঙতে শুরু করেছে। বন্ধুদের কথায় প্রচুর ডাক্তার দেখিয়েছেন।কিন্তু কোনো ফল হচ্ছে না। কানে ফিশ ফিশ শব্দ শুনছেন শুনে এক ডাক্তার তো শেষ মেষ পাগলের ডাক্তারকে রেফার করে দিলেন।তার ওষুধ খেয়েও যখন রোগ কমলো না তখন ধূর্জটি প্রসাদ বর্মা মোক্ষম সিদ্ধান্তটি নিলেন।


..........................................................................................................................................................................................


শহর তলীর দিকটায় বেনটিক স্ট্রিট আর ধরণী সেন রোডের সংযোগ স্থলে এই বাড়িটা।


বড় রাস্তা থেকে নেমে একটা ছোট রাস্তা দিয়ে এগিয়ে এলেই এই সংযোগ স্থল 


বড় রাস্তায় বাস থেকে নেমে টিউব ওয়েল টার দিকে তাকাতেই গা গিন গিন করে উঠলো ধূর্জটি বাবুর 

আবার সেই জল

একটা ছোট্ট বাচ্চা মেয়ে একতারা বাজাচ্ছে কল পারে। পাশ দিয়ে যেতেই একটা সুন্দর গন্ধ পেলেন ধূর্জটি বাবু। ছোট্ট মেয়েটা কি আতর টাতোর মেখেছে নাকি।

মেয়েটা হাসছে ধূর্জটি বাবুকে দেখে।

সময় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ধূর্জটি বাবু এগিয়ে গেলেন


বিকেলের আলো প্রায় নিভে এসেছে ধূর্জটি বাবু ছোট রাস্তা দিয়ে এসে বাড়িটার কাছে চলে এলেন । জায়গাটা খুবিই নিরিবিলি আসে পাশে কোনো দোকান পাট নেই। বাড়িটা পুরোনো ধাঁচের সাবেকি বাড়ি। ধূর্জটি বাবু খোলা দরজা দেখে ঢুকে পড়লেন।স্যাঁতস্যাঁতে সরু প্যাসেজ দিয়ে এগিয়ে গেলেন পাসেজের শেষ প্রান্তে ঝুলছে অনেকগুলো উইন্ড চাইম যা হালকা টুং টাং আওয়াজ করে যাচ্ছে । এইটা পেরিয়ে যেই ঘরে ঢুকলেন সেখানে একটা গোল টেবিল তার উপরে বড় একটা মোমবাতি জ্বলছে। মোমবাতির অপর প্রান্তে বড় একটা সোফায় বসে আছেন তন্ত্র সাধিকা রেখা গুপ্ত।ঘরময় বীভৎস সব মুখোশ। বা দিকে তাকের উপরে ছোট ছোট অনেকগুলো পুতুল। 

হরেক রকম পুতুলের মধ্যে চোখে পড়ার মতো একটা সামুরাই আর একটা গেইশা দুটোই জাপানি। গেইশাটি একটা নীল রঙের কিমনো পরে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আর সামুরাইটি তীর ধনুক নিয়ে তাক করে আছে সামনের দিকে। চোখ গুলো খুদি খুদি। মুখে একটা হিংস্র অভিব্যাক্তি।

রেখা গুপ্তর ঠিক পিছনে বড় একটা তারা আঁকা। তাঁরা টার ভিতরে ভিভৎস একটা ছাগলের মুখ আঁকা। ছাগল টার চোখ গুলো যেন ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে আছে ধূর্জটি বাবুর দিকে।

"আসুন আসুন মিস্টার ধূর্জটি প্রসাদ শর্মা।"

খুব দৃঢ় বলিষ্ঠ নারী কণ্ঠস্বর।

রেখা গুপ্তর বেশ বড় সর চেহারা। সাধারণত বাঙালি মেয়েদের গড়ন এত বড় হয়না। একটা কালো রঙের সিল্কের শাড়ি পড়েছেন, লম্বা খোলা কালো চুল। কপালে বিশাল বড় একটা লাল টিপ।চোখগুলো খুব নিষ্ঠুর ঈগল পাখির মতো। হাতগুলো বড় বড় আঙ্গুলগুলো বেশ শক্ত। ডান হাতে পড়েছেন মোটা কালো ব্যঙ্গেল।খেয়াল করতেই ধূর্জটি বাবু দেখলেন রেখা গুপ্তর হাতের আঙ্গুলের ওগুলো ঠিক আংটি নয়, আংটির মতো দেখতে তামা বা সোনা দিয়ে বানানো ছোট ছোট কঙ্কালের মাথা।"আজ্ঞে আমিই ফোন করেছিলাম আপনাকে" কাঁপা কাঁপা গলায়

বললেন ধূর্জটি বাবু

"হ্যা ফোনে তো সবটাই শুনেছি তাহলে আপনি প্রস্তুত তো

মানে ভয়ের কিছু নেই তো"

মাথা নেড়ে না জানালেন ধূর্জটি বাবু"ভয়ের যে একেবারেই কিছু নেই তা নয়। প্রক্রিয়াটার সময় আপনার জ্ঞান হারানোর সম্ভাবনা আছে বই কি এমন কি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।"ঘামতে শুরু করেছেন ধূর্জটি বাবু।তবে কি ফিরত চলে যাবেন। না এত দূর যখন এসেছেন একটা হেস্ত নেস্ত করেই যাবেন।"আমি প্রস্তুুুত আপনি শুরু করুন "

খুব ভয় ভয় বললেন ধূর্জটি বাবু।

"সামনের চেয়ার টাতে বসুন। "

এবার এক রকম হুকুমু করলেন রেখা গুপ্ত।ধূর্জটি বাবু বসলেন। এবার রেখা গুপ্ত সোফা ছেড়ে উঠে পড়েছেনএকটা কড়া ধুপ জালিয়েছেন মহিলা। মিষ্টি মিষ্টি কোনো বনফুলের গন্ধের মতো। ধূর্জটি বাবু বুঝতে পারলেন রেখা গুপ্ত ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছেন।একটা আধ তন্দ্রা অবস্থায় ঝিমিয়ে পড়ছেন ধূর্জটি বাবু, রেখা গুপ্ত এখন ওনার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন।ডাগর ডাগর চোখগুলো মেলে ধরেছেন ওনার সামনে লম্বা মোটা আঙ্গুলগুলো দিয়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন ওনার কপালেফিশ করে বলছেন"ঘুমিয়ে পড়ুন....ঘুমিয়ে পড়ুন...রিলাক্স করুন...আরো রিলাক্স করুন"রেখা গুপ্তর চোখগুলো যেন বশ করে ফেলেছে ধূর্জটি বাবুকে হাতের আঙ্গুলগুলো যত বার কপালে বুলচ্ছেন ততবার সারা শরীর অবশ হয়ে আসছে। একটা অদৃশ্য দড়ি দিয়ে যেন রেখা গুপ্ত বেঁধে ফেলছেন ওনাকে।দাশ হয়ে পড়ছেন রেখা গুপ্তর আদেশের কাছে।রিলাক্স করুন ঘুমিয়ে পড়ুন ফিশ ফিশ হলেও সেটাই একমাত্র শুনতে পারছেন ধূর্জটি প্রসাদ বর্মা।আর কোনো শব্দ শুনতে পারছেন না"গভীরে যান.....আরো গভীরে যান.....আরো আরো গভীরে"

ঘাড়ের জ্বালাটা যেন আবার শুরু হলো ধূর্জটি বাবুর গভীরে যান, প্রশান্ত সাগরের গভীরতার চেয়েও গভীরে নামতে থাকলেন ধূর্জটি বাবু পুরোপুরি ঘুমে ঢলে পড়লেন

এবার আগের শোনা ফিস ফিসটা শুনতে পাচ্ছেন মাছি নয় মৌমাছি নয় মাঝি নয় ফিসফিসটা স্পষ্ট

মিজও মিজও

ঘাড়ের জ্বালাটা একটু কমেছে কিন্তু তাও যেন কি রকম ধরে আছে

একবারে বাইস্কোপের মতো পরিষ্কার দেখতে পেলেন ধূর্জটি বাবু.........

.................................................................................................................................................................................


1307 সাল

জাপানের জেলা হকাইদ্দওতার এক প্রান্তে টোকিটুর গ্রাম।গ্রামটা আর পাঁচটা গ্রামের থেকে আলাদা। তিন দিকে পাহাড় এক দিকে সমুদ্র। পাহাড় বেয়ে নেমে এসেছে তাকিসু নদী যার উৎস একটা বিশাল জলপ্রপাত থেকে। এই তাকিসু নদীই হচ্ছে টোকিটুরর প্রাণ প্রতিষ্ঠাতা।

জেলার দাপুটে জোতদার তাকাশিমো কে ভয় পায় না এমন একটা গ্রাম নেই । সবকটা গ্রাম ঠিক সময় মতো খাজনা জমা করে দিয়ে আসে তাকাশিমোর প্রাসাদে গিয়ে।

কেউ খাজনা না দিতে পারলে তাকাশিমো প্রথমেই তাকে প্রাণে মারে না..... তার গর্দান নেয় না ...তাকে এক রকমের পাশবিক শাস্তি দেয়। যার নাম হচ্ছে অকাউরু।

এখানে সেই মানুষটা কে প্রচুর খাবার দাবার দেওয়া হয়। খুব সুখ স্বাচ্ছন্দ আতিশয্যে রাখা হয় সর্বক্ষণ আনন্দ দেওয়ার জন্য চার চারজন গেইশা আর কাবুকি নর্তকীদের দেয়া হয় কিন্তু এক ফোটা জল খেতে দেওয়া হয় না।

প্রথম দুদিন ঠিক থাকলেও পরের দিকে মানুষটি অসুস্থ্য হতে থাকে এবং জলের অভাবে তিলে তিলে যন্ত্রনা পেয়ে মরতে থাকে। 

মাস দুয়েক হলো টোকিটুরো গ্রাম থেকে কোনো খাজনা আসছে না। এক সপ্তাহ হয়ে গেল দূত পাঠানো হয়েছে অথচ সে এখনো ফিরে এসে পৌঁছলো না। 

তাকাশিমো ভাবছে আরেকজন দূত পাঠাবেন ।হটাৎ এক সন্ন্যাসীর আগমন। সন্ন্যাসী এসেছেন টোকিটুরো র পাশের গ্রাম শিমগা থেকে।সন্ন্যাসী এসে যা খবর দিলেন তাতে তাকাশিমোর চক্ষুচড়ক গাছ।

এই দুই মাস নাকি গ্রামটা থেকে কেউ বেরোয়নি। এই দুই মাসে যারা ওই গ্রামে গেছেন তারাও ফিরে আসেনি। তবে কি কোনো মহামারি হলো

সবাই বলে সুন্দর গ্রামটায় কিছু একটা আছে,প্রতি বছর ওই গ্রামে সবার একই সাথে জ্বর হয়। 

তবে কোনদিন তার জন্য খাজনা আটকে থাকেনি। দূত গিয়ে খাজনা নিয়ে এসেছে। এই প্রথম বার যে দূত ও ফিরছে না।

তবে কি অন্য কিছু.....

তাকাশিমো সৈন্য সামন্ত নিয়ে টোকিটুর যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন।


...........................................................................................................

একটা অদ্ভুত জায়গায় অবস্থিত এই টোকিটুর গ্রাম চারিদিকে হকাসাকি পর্বত মালা। জাপানের একদম দক্ষিণ প্রান্তে এই গ্রাম

গ্রামটির দক্ষিণে প্রশান্ত মহাসাগর 

উত্তর পুব পশ্চিম ঘিড়ে আছে হকাসাকি পর্বত মালা পশ্চিমে হকাসাকি পর্বত মালা থেকে একটা টিলা উপরে উঠে গেছে। এই টিলা টার নাম ভয়ের টিলা

টিলা টা সোজা নেমে গেছে প্রশান্ত মহাসাগরের নীচে ।


সূর্যদয়ের পর পাহাড়ি জঙ্গল পেরিয়ে তাকাশিমো সৈন্য যখন হকাসাকি পর্বতমালার উপরে পৌঁছলো তখন সূর্যের আলো নিভু নিভু। উপর থেকে ওরা দেখতে পেলো সুন্দর সাজানো গোছানো ছোট্ট টোকিটুর গ্রামটাকে।তাকাশিমোর মনে পরে যায় দশ বছর আগে এক আন্দোলনের ঔদ্ধত্বে মেতে ওঠে এই টোকিটুর গ্রাম। খাজনা না দেওয়ার আন্দোলন। তখন তাকিসুমর সৈন্যরা অত্যাচার চালায় এই গ্রামটার উপর। বড় বড় পাথর আর মাটির বাঁধ তৈরি করে আটকে দেয় তাকিসু নদীর প্রবাহ কে। গোটা গ্রাম কেই অকাউরু শাস্তি দেয় ওরা। দিন দশ পরে অত্যন্ত বিপাকে পরে খাজনা দিতে ফের রাজি হয় এই গ্রাম।তাকাশি নদীর কুল করে বয়ে যাওয়া জল দেখে সেই পাশবিক অত্যাচারের কথা মনে মনে ভেবে আনন্দ পায় তাকসিম।এবারও কি সেরকম কিছু করতে হবে। পৈশাচিক একটা আনন্দ মনের মধ্যে দমন করে মিটি মিটি হাসে তাকসিম।আস্তে আস্তে সন্ধ্যে হলে গ্রামে ।একে একে জলে উঠলো প্রদীপের আলোযাক কিছু লোক তাহলে এখনও বেঁচে আছে মনে মনে নিজেকে আস্বস্ত করলো তাকসিমসৈন্য দের উদ্দেশ্যে বললো প্রথমেই আমরা সবাই নীচে ওই টোকিটুর গ্রামে যাবো না। আমি ষোলো জন সামুরাই কে পাঠাতে চাই। ষোলো জন সামুরাই এগিয়ে এলেন। তাকসিম তাদের উদ্দেশ্যে বলেন আপনারা গ্রামে গিয়ে খোঁজ খবর নিন। কোন বিপদ দেখলে মশাল জালিয়ে নিচ থেকে ইঙ্গিত দিলেই আমরা সবাই কে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বো। আর যদি দেখেন মহামারি আছে তাহলে আতশবাজি জালিয়ে আমাদের বুঝিয়ে দিন আমরা তারও ব্যবস্থা নেব।

ষোলো জন দক্ষ সামুরাই কিছুক্ষনের মধ্যেই ঘোড়া ছুটিয়ে নীচে টোকিটুর গ্রামে নামতে আরম্ভ করলেন।পাহাড়ের উপরে বসে গ্রামের উপরে নজর রাখলেন তাকসিম আর তার সৈন্যরা।খুব হালকা অথচ মিষ্টি একটা গন্ধ নাকে এসে লাগলো ওদের কোনো পাহাড়ি ফুল টুল হবে বোধহয়।চাঁদের আলোয় নিচে টোকিটুর গ্রাম টাকে দেখা যাচ্ছে। সন্ধ্যে গড়িয়ে এখন রাত। অজস্র তারা জ্বলছে আকাশে পূব দিকে কালো গভীর শান্ত সমুদ্রটা দেখা যাচ্ছে।


*******************************************************************************************************************************




প্রায় ঘন্টা চারেক কেটে গেল অথচ নিচের গ্রাম থেকে কোনো রকম সংকেত তো এলো না।

তাকশিমোর দল পাহাড়ের উপর থেকে দেখলো নীচে টোকিটুর গ্রামে এক এক করে ছোট ছোট সব আলো নিভে গেছে।

অথচ মশাল বা আতশবাজি কোনোটাই জললো না।

তাহলে কি ষোলো জন সামুরাই,..

আর দেরি না করে তাকশিমোর গোটা দল মশাল জ্বালিয়ে হুর হুর করে নেমে এলো পাহাড়ের নীচে।

রাত্রির অন্ধকারে ওরা টোকিটুর গ্রামে ঢুকে পড়লো অন্ধকারের মধ্যে সামনের বাঁশঝারটা পেরোলেই গ্রামের প্রধান নাগাসিকর বাড়ি। কিন্তু একি এত অন্ধকার কেন কোনো পাহারাদার নেই সদর দরজায় কোনো আলো নেই। তাকশিমো কয়েকজন সৈন্য নিয়ে নাগাসিকর বাড়ি ঢুকে যায়। ঘর গুলো সব অন্ধকার কোথাও কোনো জন মানবের চিন্হ পর্যন্ত নেই।দালান বৈঠকখানা ঠাকুর ঘর স্নানের ঘর অন্দর মহল। কোথাও কেউ নেই কিন্তু একি-প্রত্যেকটা ঘরে এক একটা মানুষ সমান প্রমান আকারের বড় পিতলের ঘড়া। এবং প্রত্যেকটিতে কানা অবধি ভর্তি জল।পুরো বাড়ি পরিক্রম করে তাকসিম ওর সৈন্য দের সাথে বেরিয়ে এলো,ওরা আবার সেই মিষ্টি অথচ সাম্মোহনিক গন্ধটা পাচ্ছে। কোথা থেকে আসছে এই অদ্ভুত নেশাতুর ছন্দময় গন্ধ। তাকশিমোর আদেশে সৈন্যরা আশপাশের সব বাড়ি দেখলো-

না কোথাও কোনো মানুষের চিন্থই নেই। বিকেলে গ্রামে নেমে আসা ওদের সামুরাইরা বা কোথায় গেল।

আর প্রত্যেকটা বাড়ির প্রত্যেকটা ঘরে ওরকম ঘড়া ভর্তি জলই বা কেন।বৃষ্টি পড়তে আরম্ভ করেছেএকটু একটু ঠান্ডা হওয়া দিতে শুরু করেছে। বাঁশ বন হওয়ায় দুলছে জোৎসনা যেন আরো তীব্রতর হতে শুরু করেছে। পূর্ণিমায় ঠান্ডা স্নান সেরে নিচ্ছে টোকিটুর গ্রাম। যেন বহুদিন ধরে অপেক্ষারত উপেক্ষিত পরিতক্তা রহস্যময়ী নারী। 

এবার সবার কানে একটা হালকা ছন্দে গান ভেসে এলো । ঠিক গান নয়। ঘুম পাড়ানি গান জাপানে যেটা কে বলে ইদও। শিশুকে ঘুম পাড়াতে মা রা গায়। অনেক মহিলা মিলে গাইছে খুব আস্তে আস্তে। গান আর গন্ধ একই দিক থেকে আসছে ।ওরা তাকশিমোর আদেশে ঘোড়া থেকে নেমে পড়েছে। আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছে গান আর গন্ধের দিকে টোকিটুর গ্রামের একদম মাঝখানে বড় একটা ঝিল। ওখান থেকেই গন্ধ টা আসছে। গানটা যেন আগের থেকে অনেক পরিষ্কার। চাঁদের আলোয় ঝিলটা যেন একটা রুপোর নদী। ডান দিকের বাঁশ ঝাড়গুলো এলিয়ে পড়েছে ঝিলটার উপরে। গন্ধটা যেন একটা হালকা নেশায় আছন্ন করে ফেলছে তাকসিম আর ওর সৈন্যদের।


................................................................................................................................................................................


এবার ঘুম পাড়ানি গানটা যেন আরো পরিষ্কার শুনতে পেল তাকশিমো। কোথায় যেন শুনেছে এই গান। চাঁদের আলোয় খুব স্পষ্ট না হলেও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে ঝিলের ওপারে দাঁড়িয়ে আছে সুন্দরী এক কিশোরী পরনে নীল অলংকার খচিত একটা কিমনো। শামিষেন বাজিয়ে গান করছে।

ঘুমপাড়ানি গান। শামিষেন এক ধরনের জাপানি সংগীত যন্ত্র কতকটা বিনার মতো কিন্তু আকারে খুব ছোট।নেশার মধ্যেও তাকশিমোর পাশবিক চোখ গুলো চক চক করে উঠলো কিশোরীর শামিষেন শুনে।কচি ফুল। মরুভূমির নেকড়ে যেন ওয়েসিস দেখেছে....

সুন্দর নেশাতুর গন্ধটা যেন ক্রমশ গ্রাস করছে ওদের।তেষ্টা জল তেষ্টা পাচ্ছে।এতক্ষন পায়নি তো এখন পাচ্ছে কিন্তু এই তেষ্টার রকমফের যেন আলাদা।নিজেদের সঙ্গে আনা সব জল সবাই খেয়ে শেষ করে ফেললো আস্তে আস্তে তাও যেন তেষ্টা মিটছে না।ওপরের কিশোরী কিন্তু একি ভাবে বাজিয়ে যাচ্ছে। চাঁদের আলোয় সিক্ত চারিদিক। কিশোরীটি হাসছে।


একটা স্মৃতি মাঝে মাঝে উকি মেরেই চলে যাচ্ছে তাকশিমোর। এই গান ও আগে কোথায় যেন শুনেছে। এই সুগন্ধটাও পেয়েছে কিন্তু কোথায়।না মনে পড়ছে না আবার তেষ্টা পাচ্ছে।ওরা ঝিলে নেমে পড়ে তেষ্টা মেটানোর চেষ্টা করলো ঝিলের জলটা ঠিক বিস্বাদ না হলেও কিরকম যেন একটা।

তেষ্টাটা যেন মিটল না বেড়ে গেলো ওমা জীভটা যে কি ভয়ঙ্কর রকম চুলকাচ্ছে।সবারই চুলকাচ্ছে সবাই লক্ষ করলো সবার জীবের ডগায় একটা ছোট্ট করে জরুল 

বেরিয়েছে। সেটা প্রচন্ড জ্বলছে আর লাল হয়ে ফুলে যাচ্ছে

আকাশ পাতাল তোলপাড় করে এক বিধ্বংসী আওয়াজ। ওদের নেশা কেটে গেল ওরা পিছন দিকে তাকালো।

জোৎস্নার আলোয় ওরা দেখলো তিন দিকের পাহাড়ে ধস নেমে আসছে। ভূমিকম্প হচ্ছে। পাহাড়ের বড় বড় পাথুরে চাই নীচে গড়িয়ে পড়ছে। 

মিনিট দশেক পরে যখন সব কিছু শান্ত হলো তখন ফিরে যাওয়ার পথ বন্ধ।ফিরতে হলে জল পথে ফিরতে হবে-কিন্তু জলপথে ফিরবার সামগ্রী- নৌকো জাহাজ এগুলো ওদের সাথে তো নেই। খাজনা আদায়ের পর এই গ্রাম থেকেই আদায় করতে হবে ওগুলো তাহলে।বাতাসে ধুলো উড়ছিল এখন আবার সব শান্ত। আবার সেই গন্ধ আর সেই গান।

.............................................................................................................................................................................



ওপরের কিশোরী একই ভাবে বাজিয়ে চলেছে।গান গেয়ে চলেছে।গান টার হালকা প্রতিধ্বনি হচ্ছে ।তাই মনে হচ্ছে যেন অনেকে মিলে গাইছে।

মনে পড়েছে-তাকশিমোর মনে পরেছে 

বছর দশেক আগে শুনেছে ও এই গান এই টোকিটুর গ্রামেই।সারা গ্রামকে খেপিয়ে তুলেছিল নিমি নামে এক গেইশা। সেবার ফসল ভালো হয়নি বলে ব্যবসাও ভালো হয়নি তাই খাজনা দেবে না ঠিক করেছিল পুরো গ্রাম। দূত আর খাজনাদার খাজনা নিতে এসে ফিরে গেছিল চার বার। রাগে ফেটে পড়েছিল তাকশিমো ,এবারের মতো সেবার ও গ্রামে এসে গ্রামবাসীদের উপর অকথ্য অত্যাচার চালায় তার সামুরাই সৈন্যের দল।

তখন নিমি তার একবছরের কন্যা সন্তানকে ঘুম পাড়াচ্ছিলো।একবছরের সদ্যোজাত শিশুর কাছ থেকে তার মাকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে শাস্তি দিয়েছিল তাকশিমো।যে সে শাস্তি নয় "অকাউরু"তবে নিমি যেহেতু নিজেই একজন গেইশা তাই ওর বেলায় শাস্তি টাও একটু অন্যরকম হয়।ওকে মারা হয় একশত চাবুকের ঘা। নিমির নরম শরীর ক্ষত বিক্ষত হয়ে চিড়ে যায় জায়গায় জায়গায়।এরপর ওর হাত পা বেঁধে লবন জলের চৌবাচ্চায় ফেলে দেওয়া হয়,কোনো পানীয় জল দেওয়া হয় না দিনের পর দিন। তেষ্টায় যন্ত্রনায় খিদেতে প্রাণপন আর্ত চিৎকার করছিল নিমি। মিজু মিজু .....মানে জল জল

ওর যন্ত্রণা আর কান্না দেখে আরো পাশবিক আনন্দে মেতে উঠেছিল তাকশিমো, বাড়িয়ে দিয়েছিল লবণের পরিমান।

....................................................................................................................................................................................

আজকের এই ঘুমপাড়ানি গান যেন সেই সদ‍্যোজাত শিশুকে শোনানো নিমির ঘুম পাড়ানি গান।আর এই গন্ধ খুব চেনা নিমি কে যেই কারাগারে অকাউরু দেওয়া হয় ওই খানেই বেরোত এরকম সুগন্ধ।

জীভ যেন জ্বলে যাচ্ছে এখন আর জরুল নেই এক একটা বিষ ফোড়ায় পরিণত হয়েছে।আর বীভৎস যন্ত্রণার চোটে ওরা যে কেউ মুখই খুলতে পারছে না। এদিকে তেষ্টা যেন বাড়ছে আরো বাড়ছে। 

ওদিকে কিশোরী গেইশা বাজনা বন্ধ করেছে। বাজনা বন্ধ করে সোজা তাকিয়ে আছে তাকশিমোর দিকে। কিশোরীর চোখ যেন কোনো রাক্ষসীর মতো গিলতে চাইছে ওদের।

কিরকম একটা স্তব্ধতার মধ্যে সাই সাই হওয়া বইছে।

যন্ত্রনা প্রচন্ড যন্ত্রনায় মুখ খোলা যাচ্ছে না। কিছু বিষক্রিয়া হয়েছে ওই ঝিলের জল খেয়ে। ও বাবা ওগুলো কি ষোলোটা সামুরাইয়ের ষোলোটা কাটা মুন্ডু ভেসে উঠছে ঝিলটা থেকে। চাঁদের আলোয় ওদের মুখ গুলো বেশ বোঝা যাচ্ছে।তেষ্টা ওদের সবাই কে যেন আরো কাহিল করে দিলো।কোনো অদৃশ্য চাবুক যেন ওদের উপরে এসে পরলো 


ফালা ফালা হয়ে কেটে গেল ওদের গা হাত পা পিঠ।

তৃষ্ণায় কেঁদে উঠলো সবাই একই সঙ্গে ।অভিশপ্ত গ্রামে এসে পরেছে

ওরা।যন্ত্রনায় মুখ খুলতে পারছে না। তৃষ্ণা মেটানোর জন্য জল টানতে পারছে না মুখ দিয়ে অথচ পানীয় জলের কোনো অভাব নেই। প্রত্যেক বাড়িতে মানুষ জন কেউ নেই শুধু জল আছে বিশাল বিশাল ঘড়া ভর্তি।


একটা অট্টহাসি শুনতে পেল তাকশিমো আর তার সৈন‍্যরা। আনন্দ আর কান্না মেশানো বিচিত্র পৈশাচিক মেয়েলি হাসি। আবার যেন বেজে উঠলো সামিশেন।



ঠিক তখনই চারিদিক কালো করে উঠলো বিশাল প্রলয়ঙ্করী ঝড়। প্রায় উঁচু পাহাড়ের মতো সুনামির ঢেউ আছড়ে পড়লো গ্রামটার উপর। সব তছনছ করে ভাসিয়ে উপড়ে নিয়ে ফেললো সমুদ্রর উপর। ভেসে গেল তাকসিম ভেসে গেল ওর সাহস ভেসে গেল ওর সাহসী সামুরাই যোদ্ধারা ভেসে গেল ঘোড়া গুলো। ভেসে গেল ওর অহংকার। সমুদ্রের নোনা জল ওদের শরীর থেকে যেটুকু জল আছে সব বার করে নিতে লাগল।

নিশ্চিহ্ন পুরো টোকিটুর গ্রামটা। নিশ্চিহ্ন সব কিছু। পাহাড় থেকে যে ধস নেমে এসেছিল-সেই পাথরগুলোও ভেসে যাচ্ছে সমুদ্রে।ধীরে ধীরে সব কিছু আবার আগের মতো শান্ত হয়ে গেছে।কুল কুল করে তাকিসু নদী বয়ে চলেছে। দূরে কেউ যেন সামিশেন বাজিয়ে জাপানি ঘুমপাড়ানি গান শোনাচ্ছে।

ওদিকে সমুদ্রে তলিয়ে যেতে যেতে তাকাশিমো বুঝতে পারে অনেক গুলো পিরানা মাছ ছেকে ধরেছে তাকে একটা ঘাড়ের পিছনে মোক্ষম কামড় দেয়

অসহ্য যন্ত্রনায় চিৎকার করে ওঠে

কিন্তু কোনো আওয়াজ বেরোয় না

জলের নীচে

আবার আরেকটা কামড় ঘাড়ের কাছে

সশব্দে চিৎকার করে ওঠে আবার

শোনা যায় চিৎকার

চিৎকার করে উঠেছেন ধূর্জটি বাবু

সারা চোখ মুখ ঘামে ভর্তি

সামনে সোফায় বসে ওনার দিকে এক দৃষ্টি তে তাকিয়ে আছেন রেখা গুপ্ত

দেয়ালে গেইশার পুতুল টা যেন ওনাকে দেখে হাসছে

চিৎকার করে ঘাড়ে হাত বুলিয়ে সামনে হাত টা আনলেন ধূর্জটি বাবু

হাত টা মেলে ধরতেই দেখলেন লাল টাটকা রক্ত

পিরানা মাছের কামড়।

ধূর্জটি বাবু শুনতে পাচ্ছেন সেই পাহাড় ভাঙা ভূমিকম্পের আওয়াজ

শুনতে পাচ্ছেন নিমির আর্তনাদ মিজু মিজু মিজু .......

এক মুহূর্ত নষ্ট না করে চেয়ার থেকে লাফিয়ে নামলেন ধূর্জটি বাবু তারপর দরজা খুলে প্যাসেজ ধরে চো চা দৌড় লাগলেন বাইরে রাস্তার দিকে 

বড় রাস্তার মোড়ে এসে সেই টিউব ওয়েলটার হাতল টাকে আঁকড়ে ধরলেন , সেটাকে টিপে অনেক অনেক অনেক জল খেয়ে ফেললেন ধূর্জটি বাবু

না এখন আর কোনো অস্বস্তি হলো না


শরিরের জ্বালা যন্ত্রনা সব কমে এলো

ধূর্জটি বাবু বুঝতে পারলেন কেউ যেন ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন।

সেই ছোট্ট মেয়ে টা

একতারা টা একটা হাতে ধরা

মিটি মিটি তাকিয়ে হাসছে ধূর্জটি বাবুর দিকে

একটা খুব চেনা চেনা মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ বেরচ্ছে।

খুব হালকা অথচ মিষ্টি একটা গন্ধ ....... কোনো পাহাড়ি ফুল টুল হবে বোধহয়



একটা ঠান্ডা প্রলেপ মলমের মতো ছড়িয়ে গেলো ঘাড় টাতে

ধুর্জটি বাবু টিউব ওয়েল টিপে অনেক টা জল খেয়ে নিলেন 

হাঁপাচ্ছেন আর এক দৃষ্টি তে চেয়ে আছেন মেয়েটার দিকে 

জল খেয়ে যেন ব্যথা-যন্ত্রনা গুলো কমে এসেছে 

শুধু মুখ ফুটে বেরিয়ে এলো দুটো শব্দ

মিজু ।


...............................................................................................................................................


জল (বাংলা) : মিজু 水 (জাপানীজ ).................................................................




Rate this content
Log in

Similar bengali story from Thriller