লক্ষ্মীর পদচিহ্ন
লক্ষ্মীর পদচিহ্ন
লক্ষ্মীর পদচিহ্ন
শুভময় মণ্ডল
ঘটনাটি আজ থেকে বছর চল্লিশেক আগেকার। সুষমা তখন সদ্য বিয়ে হয়ে এসেছিলো কোরবা শহরে। বালকো নগরের সেক্টর ওয়ান-এর কোয়ার্টারগুলো তখন সদ্যই চালু হয়েছে। অর্থাৎ নতুনরূপে জীবনযাত্রা শুরু হলো দু'জনেরই - কোয়ার্টারগুলোর আর সুষমার।
এমনিতে জায়গাটা খুবই সুন্দর। কোয়ার্টারের পিছনেই শুরু হচ্ছে পাহাড়, বেশ গাছপালায় ঢাকা ছিল তখন কোয়ার্টারের ঠিক পেছন থেকেই গোটা পাহাড়টা। সুষমার স্বামী তখন বালকোর ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে সদ্য বদলি হয়ে এসেছে, তাই তাদের দুজনের কাছেই জায়গাটা ছিল একেবারে নতুন।
সুষমারা থাকার জন্য যে কোয়ার্টারটা পেয়েছিল সেটা ছিল পাহাড়ের দিকে একদম শেষের ব্লকের দোতলায়। সেই ব্লকের দোতলার আর কোনো কোয়ার্টারেই কেউ ছিলনা তখন। তাই গোটা ব্লকের দোতলাটায় একাই রাজ করতো সুষমা। শুধু তাই নয়, ওপরের ছাদটাও সে একাই ব্যবহার করতো। প্রচণ্ড গরমের জন্য নিচের তলার বাসিন্দা দুই পরিবারের কেউই ভুলেও কখনও ওপরে বা ছাদে আসতো না।
বেশ ভালোই কাটছিল দিনগুলো সুষমার। কর্তার ডিউটি বেরিয়ে যাবার পর সারাটা দিন কাটতো তার একদম নিজের মত করে। প্রকৃতির প্রতি একটা আকর্ষণ তার বরাবরই আছে, তাই নির্জনে একাকী সেই গাছপালায় ঢাকা পাহাড়ের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখতো সে সারাদিন - পাখপাখালির দল কি কর্মব্যস্ততায় দিন কাটায় রোজ, এমনকি ছোট্ট ছোট্ট জীবজন্তুগুলোরও কারোর এতটুকু যেন অবসর নেই! কত রকম পাখির ডাক শুনতে পেতো সে তখন ওখানে।
রোমান্টিক নির্জনতা তাদের নবদম্পতির জন্য যে বেশ ভালোই উপভোগ্য ছিল, সে তো বলাই বাহুল্য। কারোর থেকে কোনো ঝামেলা, ঝঞ্চাট, প্রশ্ন কৈফিয়তের বালাই নেই - যেমন খুশি থাকো, খাও, ঘুরে বেড়াও, কেউ রা টি কাড়বে না। এত রোমান্টিকতার মধ্যে তাই সুখবরটাও এসে গেল খুব শীঘ্রই তাদের জীবনে - মা হতে চলেছে সুষমা!
প্রথম মাস চারেক এখানেই কাটিয়ে, তারপর যদি মনে হয় তখন দেশের বাড়িতে যাবে; তখনই স্বামীকে একলা এখানে রেখে বাড়ি চলে যেতে রাজি হল না সুষমা। তবে এখানে থাকা না আটকালেও, তার সেই দৌড়ে বেড়ানো আর দিনে চৌদ্দবার ওপর নিচ ওঠানামা করাতে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়ে গেল!
এই নির্জনে একাকী নীরবে থাকতে গিয়েই তখন তার এমন অভিজ্ঞতা হলো, যেটা নাকি এতদিন তার যে কেন হয়নি সেটাই ভেবে বিস্মিত হতো তার প্রতিবেশীরা! ঘটনার সূত্রপাত হয় এক শনিবার দুপুরে। ঘরে বিছানায় শুয়ে বই পড়ছিল সুষমা, হঠাৎ শোনে ছাদের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত দৌড়ে বেড়াচ্ছে যেন কোন কিশোরী - এমন পায়ের আওয়াজ।
প্রথমটায় আমল না দিলেও, হঠাৎ তার মনে হয় - এই ব্লকে কারোরই তো বাচ্চা কাচ্চা নেই! তাহলে ছাদে কে দৌড়াচ্ছে এই ভরদুপুরে রোদে? তাহলে কি রান্নার জন্য ছাদে ভেঙে রাখা তার কয়লা চুরি করতে এসেছে কেউ? কিন্তু তাই বা হয় কি করে? ছাদে কাউকে যেতে গেলে তো তার থেকে গেটের চাবি নিয়ে যেতে হবে তাকে! কারণ প্রায় ন্যাড়া ঐ ছাদে ওঠার জন্য একটা জলের পাইপও নেই বাইরে দিয়ে। জলের ট্যাঙ্কের পাইপ? কিন্তু সেও তো সিঁড়ির পাশ দিয়ে ভিতরের দেওয়াল বরাবরই ছাদে উঠে গিয়েছে! তাহলে?
তখনই সাবধানে ছাদে যায় সুষমা কিন্তু কোথায় কে? পুরো ছাদ ফাঁকা, গেটের গ্রিলেও তালা দেওয়া! ছাদের কোণে যেমন থাকে তেমনি জড়ো করে রাখা আছে তার কয়লা। আসেপাশে ভালো করে নজর দিয়েও কাউকেই দেখতে না পেয়ে, অগত্যা নিজের ঘরে ফিরে আসে সে।
পরের কয়েকদিন আর সেইরকম কিছুই ঘটলো না। কিন্তু ঐ ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো মাসখানেকের মধ্যেই, এক মঙ্গলবার দুপুরে। আবারও ছাদে গিয়ে সব পরখ করে দেখলো সে, কিন্তু কোন অস্বাভাবিক কিছুই নজরে পড়লো না তার! তবে সে নিশ্চিত যে কয়লা চুরি ছাড়া আর কোনো উদ্দেশ্যেই কেউ ঐ ফাঁকা ছাদে আসবে না। তার স্বামীকেও তাই এসব আর বলবে নাকি বলবে না এই ভাবতে ভাবতে বলাও হয়ে উঠলো না তার।
কর্মহীন দুপুরের একঘেয়েমি কাটাতে একটা ডায়রিতে প্রত্যেক দিনের ঘটনাগুলো বর্ণনা সহ লিখে রাখতে শুরু করেছিল তখন সে। বার পাঁচ ছয় ঐ ঘটনার পুনরাবৃত্তির পর সে লক্ষ্য করলো - কেবল শনিবার এবং মঙ্গলবার, যদি সেদিন অমাবস্যা বা পূর্ণিমা পড়ে, সেইদিন দুপুরেই ঐ পায়ের শব্দ শোনা যায়!
একদিন বিকেলে ছাদে আটা চেলে ভুঁসিটা আলাদা করে কাগজে রাখছিল সুষমা, এমন সময় হাওয়ায় কাগজ উল্টে সব ভুঁসি ছড়িয়ে পড়ে যায় ছাদে। গোটা ছাদে ভুঁসি ছড়িয়ে যাওয়ায় একটা সাদা আস্তরণ পড়ে গেছে দেখে হঠাৎ তার মাথায় একটা অভিনব পরিকল্পনা আসে।
পরের শনিবার ছিল অমাবস্যা, অর্থাৎ নিশ্চয়ই আবার সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে। কে আসে বা আদৌ কেউ আসে কিনা জানার জন্য, সেদিন সকালেই সে তার ঘরে জমিয়ে রাখা বাকি আটার ভুঁসিটাও ছড়িয়ে দিয়ে আসে গোটা ছাদে! ওপরে ওঠার সিঁড়ির দিকেও খেয়াল রাখে সে, কেউ সেই ছাদে ওঠে কিনা দেখার জন্য।
কেউ ছাদে না গেলেও, সারা দুপুর ছাদে দৌড়ে বেড়ানো পায়ের আওয়াজ কিন্তু যথারীতি শুনতে পেল সে। সেই শব্দ থামলে, বিকেলে চুপিচুপি ছাদে গেল সুষমা। আর সেখানে গিয়ে যা দেখলো তা'তে তো চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল তার! দেখে - গোটা ছাদ জুড়ে ছুটে বেড়ানো কোনো এক ক্ষুদে কিশোর/কিশোরীর পয়ের পদচিহ্ন!
বালকোর সেই কোয়ার্টারের পুরানো বাসিন্দা, পাশের ব্লকের একজন বয়স্ক ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করে সে জানতে পারলো সেই ঘটনার আসল রহস্য। ঐ ছাদে চুরি করতে কেউ আসে না, আর সেখানে ঐরকম আওয়াজ এই প্রথম শুনল কেউ এমনটাও নয়! ঐ কাণ্ড যে করে সে কখনও কারো ক্ষতিও করেনি, শুধু শনি ও মঙ্গলবারের অমাবস্যা বা পূর্ণিমার দিন দুপুরে দৌড়ে দৌড়ে খেলে বেড়ায় ঐ ছাদে।
সেক্টর ওয়ানের সুষমাদের ব্লকের কোয়ার্টার তৈরী করার আগে ওখানে একটা ছোট পাথুরে টিলা ছিল। সেটাকেই একদিন ডাইনামাইট দিয়ে ভাঙা হচ্ছিল আর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল ভাঙা পাথরগুলো। সেখানে কর্মরত এক শ্রমিকের বাচ্চা মেয়ে, লক্ষ্মী নাম ছিল তার, খেলতে খেলতে তখন কিভাবে ওখানে এসে গিয়েছিল কেউ খেয়াল করেনি। ভাঙা পাথরের টুকরোর আঘাতে ওখানেই প্রাণ হারায় বেচারি।
সেদিনটা ছিল শনিবারের অমাবস্যার দুপুর। তারপর থেকেই ঐ ব্লকের ছাদে ঐ বিশেষ তিথিগুলোতে সে আসে, তার সেই মাঝপথে থেমে যাওয়া খেলার বাকিটুকু খেলতেই হয়তো। তাদের আগে যারাই ঐ কোয়ার্টারে থাকার জন্য এসেছে, ঐ আওয়াজ শুনে তারা কোয়ার্টার ছেড়ে চলে গেছে দু'দিনেই। শুধু সুষমারাই প্রথম যারা এতদিন ধরে নাকি থাকতে পেরেছে ওখানে!
ঐ সব শোনার পর, সুষমা অবশ্য আর এক মুহুর্তও দেরি করেনি স্বামীকে বলে তখনই কোয়ার্টার পাল্টাতে।