দাঁড়কাক
দাঁড়কাক


ভোরবেলা একটা ভয়ার্ত চিৎকার করে ঘুম থেকে জেগে উঠল মিতালী।পাশে নবীন ঘুমিয়ে ছিল।এবার তারও ঘুম ভেঙ্গে গেল।ঘুমজড়ানো গলায় সে জিজ্ঞেস করল,”কী হল?আজকেও আবার তুমি ওইসব হাবিজাবি স্বপ্ন দেখেছ?”
চাপা গলায় মিতালী বলল,”হ্যাঁ,জান এবারে ওটা আরো প্রকট,আমার আরো কাছে এগিয়ে এসেছে,ঠোঁট দুটো রক্তপিপাসু,আমার বুক ঠুকরে ঠুকরে রক্ত বার করে খেতে চায়...”
নবীন ঘরের আলোটা জ্বেলে মিতালীর হাতটা ধরে বলল,”মিতা,তুমি কেন বুঝতে পারছ না এসব তোমার মনের ভুল। তোমার মনের ভিতরের ভয়টার জন্যই তুমি এইসব আজগুবি জিনিস স্বপ্নে দেখ।কোন চিন্তা নেই,তুমি ওষুধগুলো কন্টিনিউ কর,ডাক্তার যেরকম বলেছে সেরকম ভাবে মেডিটেশন গুলো কর,দেখবে ভাল হয়ে যাবে।“
“নবীন,আমি আর বেশিদিন বাঁচব না।“
“কি মুশকিল,এসব ফালতু জিনিস কেন বিশ্বাস করে বসে আছ আমি বুঝি না।আমি বললাম তো,তোমার কিচ্ছু হয়নি,কিচ্ছু হবে না।আর সামনের সপ্তাহে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে তোমাকে নিয়ে যাব বললাম তো।“
“আর ডাক্তার দেখিয়ে কোন লাভ আছে বলে তোমার মনে হয়?”ফুঁপিয়ে উঠল মিতালী,”দুজন ডাক্তার দেখালে,তারা কেউ কিছু করতে পারল?জানো আগের থেকেও কত ভয়াবহ হয়ে উঠেছে ওই আপদগুলো?রাতে আমার ঘুম হয়না,চোখ বুজলেই মনে হয় ওরা আমার জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে। ওরা আমায় শেষ করে দেবে নবীন,আমি বলছি তোমায়,তুমি কেন বিশ্বাস করছ না?উল্টে আমায় পাগল ভাবছ?তাই সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যেতে চাও।“
“তাহলে তুমি কি বলতে চাও,তুমি এইভাবে ভুল্ভাল স্বপ্ন দেখে অকারণ মৃত্যুভয়ে কাঁটা হয়ে থাকবে আর আমি হাত গুটিয়ে বসে থাকব আর এর চরম পরিণতির জন্য অপেক্ষা করব?মিতা,এর একটা তো বিহিত হওয়া দরকার।তুমি ডাক্তারের কাছে যেতে চাও না,বেশ তাহলে তুমিই বলে দাও আমি কী করব যাতে তুমি সুস্থ হয়ে উঠতে পার?”
“আমি বলছি তোমায়,এসব ডাক্তারদের আওতার বাইরে,এসব তাদের কাজ নয়।স্বপ্ন অলৌকিক ব্যাপার,একমাত্র সাধক বা তান্ত্রিক রাই এর সমাধান করতে পারেন।জান আন্দুলের কাছে একজন বড় তান্ত্রিকের চেম্বার আছে..”
“রাবিশ!”বলে উঠে বাথরুমে চলে গেল নবীন।
ব্যাপারটা শুরু হয়েছে প্রায় দশদিন আগে।আই টি সেক্টরে চাকরি নবীনের,এক একদিন বাড়ি আসতে অনেক রাত হয়ে যায়।সেদিনও তাই হয়েছিল। খাওয়াদাওয়া শেষ করে দুজনেরই শুতে শুতে প্রায় রাত দেড়টা বেজে গিয়েছিল।কিন্তু হঠাত ভোর চারটের সময় আজকের মতই ঘুম ভেঙ্গে উঠে বসে মিতালী।নবীন কে ধাক্কা মেরে জাগিয়ে বলেছিল,
“আচ্ছা,স্বপ্নে দাঁড়কাক দেখলে কি হয় বলতে পারো?বিশেষত ভোরের স্বপ্নে?”
নবীন চোখ কচলাতে কচলাতে ঘুম ঘুম গলায় বলেছিল,
“কি বললে?দাঁড়কাক?হোয়াট ইজ দ্যাট?”
“আরে তুমি দাঁড়কাক চেনো না?হ য ব র ল পড়নি?যাই হোক,আমি স্বপ্নে দেখলাম,সূর্য অস্ত যাচ্ছে,নদীর জলে তার ছায়া পড়েছে।আর নদীর পাড় বরাবর কতগুলো কালো কুচকুচে পাখি,কাকের মতন তবে সাইজে একটু বড়,ঘোরাফেরা করছে।কয়েকবার আমার দিকেও তাকাল,নিশ্চল চাহনি তাদের।কিরকম ভয় ভয় লাগল।“
“তো?”
“আমি বলতে চাইছি,এই স্বপ্নটা কোন কিছুর ইঙ্গিত নয় তো?আমি শুনেছি এই ধরনের স্বপ্ন অনেক সময় কোন অমঙ্গলের বার্তা বয়ে আনে।“
নবীন অবহেলার সাথে বলেছিল,”দেখ সোনা,আমি সারাদিন ডিউটি করেছি,খুব টায়ার্ড। আমি সকালবেলা উঠে তোমার সব কথা শুনব।তুমিও ঘুমিয়ে নাও,আর ঐ স্বপ্ন টপ্ন গুলোকে ভুলে যাও।“বলে ঘুমিয়ে পড়েছিল নবীন।
কিন্তু মিতালী নিশ্চিন্ত হতে পারেনি।তখনই সে মোবাইলে নেট ঘেঁটে দেখা শুরু করে এই ধরনের স্বপ্ন দেখলে কী পরিণতি হতে পারে।শেষমেষ তার আশঙ্কাই সত্যি হল।সমস্ত ওয়েবসাইটে বলা আছে,স্বপ্নে দাঁড়কাক দেখার অর্থ মৃত্যু আসন্ন। কিছুকিছু জায়গায় উদাহরণসহ ও এর ব্যাখ্যা করা আছে।
এই ছিল ঘটনার শুরু।পরের দিন নবীনকে সবটা খুলে বলেছিল সে।কিন্তু নবীন ব্যাপারটাকে বিশেষ পাত্তা দিতে চায়নি,হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিল।বলেছিল,”সারাদিন কাজ নেই,একা একা ঘরে বসে থাকো,এমন উদ্ভট খেয়াল তো আসবেই।বাইরে বেরিয়ে লোকেদের সাথে দুটো কথা বললেও মনের পরিবর্তন হয়,কিন্তু তোমার মত লাজুক মেয়েকে সে আর কে বোঝাবে।ও তুমি চিন্তা কোর না,আমি না হয় তোমার জন্য অফিস থেকে পেনড্রাইভে করে ভাল ভাল মজার মুভি আর ওয়েবসিরিজ আনব,দেখবে তোমার মন ভাল হয়ে যাবে আর ওসব আজগুবি স্বপ্ন দেখবে না। আরে বোকা স্বপ্নটা স্বপ্নই,এই স্বপ্ন দেখলে রাজা উজির হব আর ঐটা দেখলে মরে যাব এসব কোন কাজের কথা হল?খামোকা ভয় পাচ্ছ তুমি।“
কিন্তু মিতালীর মন থেকে ভয় যায়নি।যায়নি স্বপ্নটাও।প্রতিদিনই স্বপ্নে মিতালী দেখতে পায় তার দাঁড়কাকবেশী মৃত্যুদূতকে।একটা জিনিস মিতালী লক্ষ্য করেছে,প্রতিদিনই যেন স্বপ্নটা তার কাছে আরো প্রকট হয়ে ধরা দিচ্ছে।মনে হচ্ছে দাঁড়কাকগুলো আরো জীবন্ত হয়ে উঠছে দিন দিন,তার কাছে এগিয়ে আসছে আর এইভাবেই একদিন ঘাতক হয়ে উঠবে তারা।
ফলে মিতালীর চোখে ঘুম নেই।এই কদিনে সে একবারও শান্তিতে দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি।শেষরাতের দিকে যাও বা ঘুম আসে,ভোর হতে না হতেই আবার সেই একই ভয়াল ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে।ডাক্তারের কাছে গিয়েও কোন ফল হয়নি।দুজন ডাক্তারই গৎবাঁধা সেই একই কথা বলেছেন যে দুঃস্বপ্নের মূল কারণ হল ডিপ্রেশন,আর তা আসছে একাকীত্ববোধ থেকে।কোথাও থেকে ঘুরে এলে বেটার হবে।
কিন্তু নবীনের হাতে ছুটি নেই এই মুহূর্তে।বাবা মার কাছেও গিয়ে থাকার উপায় নেই,পালিয়ে বিয়ে করা ইস্তক তাদের সাথে মুখ দেখাদেখি বন্ধ।অতএব সে গুড়ে বালি।আবার একজন ডাক্তার বললেন,একবার নিজেদের ফার্স্ট ইস্যুর কথা ভেবে দেখতে ক্ষতি কি?এতে মনের একটা পরিবর্তন হতে পারে।
মিতালীর খানিকটা ইচ্ছা ছিল।কিন্তু নবীনের একদমই মত নেই।সে সাফ জানিয়ে দিয়েছে,যতদিন না মিতালী পুরোপুরি সুস্থ হচ্ছে,ততদিন পর্যন্ত ওসব আউট অফ সিলেবাস।
ফলে ওষুধ আর মেডিটেশনেই কাজ চালাতে হচ্ছে।কিন্তু তাতে কোন উপকার হয়নি।ইদানীং শুধু স্বপ্নে নয়,জেগে থাকা অবস্থা চোখ বুজলেও যেন মিতালী ঐ দাঁড়কাক গুলোকে দেখতে পায়।কালো কালো চেহারার কতগুলো বীভৎস পাখি,বাড়ির কার্নিশে বসে আছে আর একদৃষ্টে তাকে লক্ষ্য করছে,ক্রমশ এগিয়ে আসছে,ওরা মৃত্যু চায় শুধু, আর কিচ্ছু না,শুধু মৃত্যু....
সেদিন সন্ধ্যায় নবীন বাড়ি ফিরে এলে মিতালী তাকে বলল,”নবীন,প্লিজ আমার কথাটা একবার ভেবে দেখ।তুমি চাও না আমি এ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাই?“
“কি ভাবার কথা বলছ?”
“ঐ যে আন্দুলের তান্ত্রিক...”
“মিতালী তুমি ভালো করেই জান,আমার এসবে বিশ্বাস নেই,তাও কেন জোর করছ বলত?বরং তোমাকে যে জিনিসগুলো ফলো করতে বলা হয়েছে সেগুলো ঠিক করে কর।“
“কিন্তু কাজ তো কিছু হচ্ছে না।চেষ্টা করে একবার দেখিই না…যদি কিছু মিরাকল হয়।“
“শোনো মিতালী,মানুষের রোগব্যাধির বিজ্ঞানসম্মত সমাধান হল চিকিৎসা।তুমি যাদের কথা বলছ সেসব যারা করে তারা বুজ্রুক,এদের কাজই হল সমাজে অন্ধবিশ্বাস ছড়ানো।আমায় ভুল বুঝোনা মিতালী।এভাবে তোমায় দেখতে কি আমার খুব ভালো লাগছে?চেহারার কি অবস্থা করেছ দেখেছ?কিন্তু কি করব বল,ছুটি পাচ্ছিনা,নাহলে কোথাও কাছেপিঠে ঘুরে আসা যেত।এখানে তোমার কোন বন্ধুবান্ধবও নেই।আমি নিরুপায় মিতালী।তাও তো যথাসাধ্য চেষ্টা করছি।শুধু তোমার দিক থেকে একটু কোঅপারেশন দরকার।অনেক সময় এসব ক্ষেত্রে মোটিভেশন আর সঠিক গাইডেন্সই ঠিক কাজ করে।মিতালী জগতে এত কিছু ভাল জিনিস আছে,তুমি তাদের কথা চিন্তা কর না।পাহাড় নদী উপত্যকা সমুদ্র জঙ্গল কত সৌন্দর্য ছড়িয়ে আছে দুনিয়াতে।শুধু তাই নয়,কতরকম পশু পাখি আছে কত রঙ কত বৈচিত্র তাদের।আর সেসব ছেড়ে তুমি এই দাঁড়কাক নিয়ে পড়ে আছো?কি একটা পাখি,তোমার মুখেই শুনলাম,যার না আছে কোন রূপ,না আছে কোন গুণ।ছিঃ!”
“আমি কি আর ভাবি।আমার স্বপ্নে ওরা আসে।“
“আর আসবে না।এই তো আমি আছি তোমার পাশে।ভয় পেও না। দাঁড়কাক তোমার কিচ্ছু করতে পারবে না।তোমার জন্য একটা খুব সুন্দর জিনিস এনেছি” বলতে বলতে পেনড্রাইভটা বের করে নবীন।
নবীন ঠিক করেই রেখেছিল,আজ সে ঘুমোবে না।যত কষ্টই হোক না কেন,মিতালীর যতক্ষণ না ঘুম আসে,ততক্ষণ সেও দুচোখের পাতা এক করবে না।
কিন্তু একসময় দুজনেই ঘুমিয়ে পড়ল।আর ভোররাতে মিতালীর পরিত্রাহি চিৎকারে সারা বাড়ি কেঁপে উঠল।
“কি হল সোনা,কি হয়েছে?”
থরথর করে কাঁপছিল মিতালী। নবীনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল সে।
“আমি আর সহ্য করতে পারছি না…কিছুতেই না..প্লিজ আমায় বাঁচাও আমাকে ওরা মেরে ফেলবে…”
“একই স্বপ্ন?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ কিন্তু এবারে কি দেখলাম জান?তুমি সন্ধ্যাবেলায় যে পাখিরালয়ের ভিডিওটা দেখাচ্ছিলে,ঐ সবকটা রঙবেরঙের পাখি নিমেষের মধ্যে পাল্টে গিয়ে দাঁড়কাক হয়ে গেল,এক মুখ এক চেহারা আর প্রত্যেকের সেই এক চাহনি।আমি একটা মরুভূমিতে শুয়ে আছি…মৃত….কতগুলো শকুন আমার মাংস খেতে আসছিল,তারাও সবাই পালটে গিয়ে দাঁড়কাক হয়ে গেল।প্রায় হাজার হাজার দাঁড়কাক আমার দিকে এগিয়ে আসছে..এগিয়ে আসছে…ওদের দৃষ্টিতে মৃত্যু….”
বলে জ্ঞান হারাল মিতালী।
নবীন ব্যাস্ত ভাবে মিতালীর নাম ধরে ডাকল,দুবার গালে থাপ্পড় মারল আস্তে করে,তারপর একগ্লাস জল এনে ছিটিয়ে দিল তার চোখে মুখে।
খানিকক্ষণ বাদে মিতালী চোখ মেলল। নবীন ব্যাগ্রভাবে তার মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে বলল,”মিতালী,ঠিক আছো?”
মিনিটখানেক পর মিতালী আস্তে আস্তে ঘাড় নাড়ল।তারপর ধীরে ধীরে বলা শুরু করল,”তুমি এখনো ব্যাপারটা বুঝছ না…এ সমস্যার সমাধান স্বাভাবিকভাবে সম্ভব নয়।আমার যে কি পরিমাণ যন্ত্রণা হচ্ছে তা তোমায় বলে বোঝাতে পারব না।তাও তুমি তোমার ইগো আঁকড়ে পড়ে আছো,কিছুতেই তান্ত্রিকর দ্বারস্থ হবে না।ঠিক আছে,ভালো।যদি আমার জীবনের থেকে তোমার ইগোর দাম বেশি হয়,তাহলে তোমায় আর কিছু বলব না।কিন্তু আমি তো বাঁচতে চাই নবীন।আমাকে তো বাঁচতে হবে।আমি একাই তাহলে তার কাছে যাব।তোমায় আর কষ্ট করতে হবে না।“
“কি মুশকিল তুমি আমাকে ইগোর কথা বলছ?তুমি জান এই কদিন তোমার মতন আমিও কতটা যন্ত্রণায় ভুগছি?কিন্তু সমস্যার সমাধান হচ্ছে না বলে কোন ভুল রাস্তায় যাওয়াটা তো বোকামো তাই না?তুমি জান এই ধরনের সাধক,তান্ত্রিকেরা মানুষের সমস্যা সমাধান করার নাম করে ছলে বলে মানুষকে বশ করে নেয়?এদের কতরকম দুরভিসন্ধি থাকে তা তুমি চিন্তা করতে পারবে না।আর মহিলা কাস্টমার পেলে তো কথাই নেই,জাদু মন্ত্রবলে কব্জা করে কতরকম নোংরামি করতে পারে,তা তোমার ভাবনার বাইরে।তোমায় বললাম তো পরের উইকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে তোমায় নিয়ে যাব।এই উইকে এপয়েন্টমেন্ট পাইনি,কি করব বল।“
“যে যন্ত্রণা পাচ্ছি,তার থেকে বশ হয়ে থাকাও ভালো।তিলতিল করে মরতে তো হবে না।“
তারপরই ব্যকুল ভাবে নবীনকে আঁকড়ে ধরে মিতালী বলল,”একবার শেষ চেষ্টা করে দেখ না। আমি কথা দিচ্ছি তোমায় যদি কাজ না হয়,তাহলে যা বলবে সব মেনে নেব…যে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে তার কাছে যাব…প্লিজ একবারটি নিয়ে চল লক্ষ্মীটি…প্লিজ..”
মিতালীর কাতর কাকুতি মিনতিতে শেষ পর্যন্ত রাজি হল নবীন।্নীচু গলায় বলল,”ঠিক আছে,এতবার বলছ যখন,নিয়ে যাব তোমায় তখন।আফটার অল তোমায় সুস্থ করে তোলাটাই যখন লক্ষ্য।খোঁজ নাও উনি কখন বসেন,কবে কবে বসেন।“
পরের দিনই এপয়েন্টমেন্ট মিলল সেই তান্ত্রিকের।মিতালী আর নবীন এখন বসে আছে চেম্বারের বাইরে,সার করে রাখা বেঞ্চিগুলোর একটাতে।মিতালী আর নবীন ছাড়াও আরো প্রায় জনাপনেরো লোক বসে আছে বেঞ্চ গুলোতে।মিতালীদের নাম রয়েছে তিন নম্বরে।
দু নম্বর জন বেরিয়ে আসতেই ভিতর থেকে কম্পাউন্ডার সদৃশ একজন তান্ত্রিকের চেলা মিতালীর নাম ধরে ডাকল।মিতালী আর নবীন ভিতরে ঢুকল।একটা নোংরা ঘুপচি মতন ঘর,খুব লো পাওয়ারের একটা বাল্ব জ্বলছে।ঘরের মাঝে একটা দেস্কের উপর কিছু পুঁথি আর কিছু যজ্ঞের জিনিসপত্র রাখা।তার পাশে বসে আছেন তান্ত্রিক ঠাকুর।
তান্ত্রিক ক্ষিতীন্দ্র নারায়ণ বর্ম্ণের নামের মতন চেহারাটিও জম্পেশ।বসা অবস্থাতেই দেখে মনে হয় প্রায় সাড়ে ছ ফুট উচ্চতা,কাঁধ পর্যন্ত নেমে আসা চুল,ইয়া মোটা গোঁফ। নবীন চুপিচুপি মিতালীর গা টিপল।নীচু গলায় বলল,”সাবধান।একে দেখে সুবিধার লোক মনে হচ্ছে না।“
মিতালী চোখের ইশারায় নবীনকে চুপ করতে বলল।তান্ত্রিক মশাই গমগমে গলায় তাদের দুজনকেই বসতে বললেন।তারপর স্থির দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন দুজনকে।
স্বপ্ন দেখার ভয়ে আগের দিন সারারাত ঘুমোয়নি মিতালী।জোর করে জেগে থেকেছে।কিন্তু এখন খুব ঘুম পাচ্ছে তার,সোজা হয়ে বসতেই পারছে না।এর মধ্যেই ঢুল খেয়ে তিনবার তার মাথা নবীনের কাঁধে গিয়ে পড়ল।
তান্ত্রিক বললেন,”সমস্যা,ঘোর সমস্যা।“
এত জোর গলায় বললেন,যে মিতালীর চটকা ভেঙ্গে গেল।চোখ খুলে সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।
নবীন মনে সুখ পাচ্ছিল না।তার মধ্যে এই বিটকেল আওয়াজ আরো মেজাজ বিগড়ে দিল তার।তাই বেশি ভণিতা না করে আসল কথাটা বলতে উদ্যত হল সে।
কিন্তু তার আগেই তান্ত্রিক বলে উঠলেন,”তোর সমস্যা বড় গুরুতর মা,সে আমি বুঝতে পেরেছি।তুই তার থেকে মুক্তি পেতে চাস,তাই আমার কাছে এসেছিস,ঠিক?”
মিতালী কোনরকমে বলল,”হ্যা,বাবা আপনি তো সবই জানেন,আমায় উদ্ধার আপনিই করতে পারেন বাবা।“
“তবু তুই নিজের মুখে একবার সবটা বল মা। তোরও মন হালকা হবে,আমারো কাজের সুবিধা হবে।“
মিতালী সবকিছু খুলে বলল।বলতে বলতে তার গলা কেঁপে যাচ্ছিল দু একবার।
তান্ত্রিক মশাই সবটা শুনলেন।তারপর বিড়বিড় করে বললেন,”দাড়কাক।ঘোর অমঙ্গল,ঘোর অমঙ্গল।তোর উপর অশুভ শক্তির ছায়া পড়েছে মা।মৃত্যু তোকে শোষণ করে নিতে চাইছে।“
“কিন্তু আমি থাকতে তোর কোন ভয় নেই মা।“বলে গর্জে উঠলেন তান্ত্রিক বর্মণ। “তোর সকল সমস্যার সমাধান আমার হাতে।তুই তাকা আমার দিকে।“
মিতালী তাকাল।আগুন চোখে তার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন তিনি।তারপর তিনি বাঁ হাতের কড়ে আঙ্গুলটা দিয়ে মিতালীর দুই ভ্রূর মাঝে স্পর্শ করে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়তে লাগলেন তিনি।মাঝেমধ্যে ডেস্কের উপর রাখা একটা কুশীর মতন বাটি থেকে একটা লালচে রঙের দ্রবণ অন্য হাতের আঙ্গুলে ডুবিয়ে মিতালীর কপালে লেপে দিতে লাগলেন।
ক্রমে মিতালীর চোখ জড়িয়ে এল,সে তাকিয়ার উপর এলিয়ে পড়ল।
তান্ত্রিক মশাই এবার একটা নতুন মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে একটা বাটিতে রাখা বেশ খানিকটা থকথকে জিনিস তুলে নিয়ে ঘুমন্ত মিতালীর কপালে লেপে দিলেন।তারপর নবীনের দিকে ফিরে বললেন,”এবার আপনি বাইরে গিয়ে বসুন।ও এখন ঘুমোচ্ছে।এই সুযোগে অশুভ আত্মাকে মন থেকে বার করতে হবে।“
“মানেটা কি?আপনি বন্ধ ঘরে আমার স্ত্রীয়ের সঙ্গে একা থাকবেন আর আপনি...”
“অবুঝ হোয়ো না বৎস।আমি যা করছি তা তোমাদের মঙ্গলের জন্য।কেসটা খুব ই জটিল আর ঐ দাঁড়কাককে বের করে আনার মাহেন্দ্রক্ষণ এখনই।কাজেই যা বলছি তাই কর।“
নবীন তবু জোরাজুরি করতে যাচ্ছিল,কিন্তু তান্ত্রিক ঠান্ডা গলায় তাকে বললেন,”তোমার বৌয়ের কোন ক্ষতি হবে না।আজ পর্যন্ত কোন নারী আমার হাতে আক্রান্ত হয়নি।কিন্তু তুমি এখন যদি অবুঝের মত কাজ কর,তাহলে তোমার বৌয়ের বিপদ বাড়বে বই কমবে না।ও এখন খুব সংকটময় অবস্থায় রয়েছে।তুমি বাইরে গিয়ে বস।“
বাধ্য হয়ে বাইরে বসল নবীন।রাগে ফুঁসছিল সে।মাঝেমধ্যে উঁকি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিল ভিতরে কি চলছে।কিন্তু ভালভাবে ঠাহর করতে পারল না।
প্রায় একঘণ্টা পরে নবীনের ডাক পড়ল।নবীন দৌড়ে ভিতরে ঢুকে মিতালীর কাছে উবু হয়ে বসে তার মাথা ধরে ঝাঁকিয়ে বলল,”মিতা,তুমি ঠিক আছো?”
মিতালী ধীরে ধীরে চোখ মেলল।তারপরে অবাক হয়ে তাকিয়ে চারদিকটা দেখল।তান্ত্রিক বললেন,”ও ভালো আছে।মা একটু কথা কও তো দেখি।“
মিতালী খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল,”আমি কোথায়?”
তান্ত্রিক মিতালীর কাছে একটু ঝুঁকে পড়ে বললেন,”মা,তোমার এখন কেমন লাগছে?”
“ভাল লাগছে।অনেকটা স্বাভাবিক বোধ করছি।“
“ওরা আর আসেনি তো- তোমায় ভয় দেখাতে?”
“না আসেনি।“
তান্ত্রিক প্রসন্নমুখে বললেন,”এবার উঠে বোস মা।“
মিতালী উঠে বসল।তান্ত্রিক এরপর বললেন,”মা তোমার মনের ভিতর থেকে আমি শয়তানকে মুছে দিয়েছি।তবে তুমি এখনো বিপন্মুক্ত নও। আমার বিশ্বাস সে যে উদ্দেশ্য নিয়ে তোমার ভিতর প্রবেশ করেছিল,সেই উদ্দেশ্যে তাকে সফল না হতে দেওয়ার জন্য সে প্রবল রুষ্ট হয়েছে।তাই সে অনতিবিলম্বে আবারো তোমার ক্ষতি করার চেষ্টা করতে পারে।তবে তোমায় আমি এই শেকড় আর এই ভেষজ দিলাম,রোজ রাতে খাবার পর সেবন করে শোবে।স্বপ্ন গুলো আর আসবে না।আর শয়তান যাতে তোমার কাছে ঘেঁষতে না পারে,তাই এই কবচ দিলাম,সর্বদা ধারণ করবে।সাতদিন পর আবার আসবে আমার কাছে দেখাতে।এই কদিন সাবধানে থাকবে,সমস্ত রকম গোলমাল এড়িয়ে চলবে।সাতদিন পেরিয়ে গেলে আর চিন্তার কোন কারণ নেই।“
তান্ত্রিকের পারিশ্রমিক মিটিয়ে দিয়ে মিতালী আর নবীন গাড়িতে চাপল।নবীন দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞেস করল,”শয়তানটা তোমার গায়ে হাত দেয়নি তো?একা ঘরে?”
মিতালী অবাক হয়ে বলল,”কই না তো।অবশ্য আমি ঘুমিয়ে ছিলাম।কিন্তু কোনকিছু হলে আমি তো বুঝতাম।“
“শোন,আমার কিন্তু এসবে কোন ভরসা নেই।কাজেই যা যা করণীয় তোমাকেই মনে রেখে করতে হবে।আমি কোন দায় নিতে পারব না।“
“তোমায় কিছু করতে হবে না।যা করার আমি বুঝে নিয়েছি।তবে একটা জিনিস কিন্তু তোমাকেও মানতে হবে,আজ যে প্রায় একঘন্টা ওখানে ঘুমিয়ে ছিলাম,তার মধ্যে কোন খারাপ স্বপ্ন আসেনি।এমনকি এতদিন যেরকম বিষণ্ণ আর উইক লাগছিল,এখন সে ভাবটাও নেই।বেশ ঝরঝরে লাগছে।বাবাজির ক্ষমতা আছে।“
“ঐ একই কাজ যুক্তি দিয়ে আর বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে করলে বুঝতে ওটা একটা সাইকিয়াট্রিস্ট ও করতে পারে।তবে পার্থক্য একটাই,এদের কাজটা বুজরুকি আর মানুষকে বোকা বানানোর জন্য।যাই হোক,দেখ তোমার কোন ক্ষতি না হলেই মঙ্গল।“
পরের দিন সকাল আটটায় ঘুম ভাঙ্গল মিতালীর।উঠেই সে দেখল,নবীন অফিস যাওয়ার তোড়জোড় নিজেই শুরু করেছে।মিতালী যখন নবীনের সামনে এল,তখন আর তার মুখে হাসি ধরে না।
“কি ডার্লিং,ঘুম হল?”
“সেই কথাই তো বলব বলে এলাম।জান ফুল ঘুম হল কতদিন পর।নো স্বপ্ন।অনেকদিন পরে আবার শান্তিতে ঘুমোলাম,খুব ফুরফুরে লাগছে।“
“সিরিয়াসলি?”
“হ্যাঁ গো হ্যাঁ। তাহলে এবার মানবে তো যে বিশ্বাসে মিলায় বস্তু,তর্কে বহুদূর।“
“খানিকটা মানব,পুরোটা নয়।তার কারণ উনি বলেছেন তোমার বিপদ এখনো কাটেনি।“
“সে তো ঠিকই।তবে সাতটা তো দিনের ব্যাপার,ওনার কথাগুলো মেনে চললেই তো হয়।আর কোন বিপদ হবে না।“
“হ্যাঁ। এই কটাদিন একটু সাবধানে থেকো।বাই দ্য ওয়ে,তোমাকে আবার আগের মতন দেখতে পেয়ে আমি যে কি খুশি হয়েছি বলে বোঝাতে পারব না।কি চেহারা হয়েছিল তোমার।তবে যাই বল না কেন,ওনার এপয়েন্টমেন্ট টা হয়ে গেলে আমি তোমাকে একবার সাইকিয়াট্রিস্ট কেও দেখাব।পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারব তাহলে।বোঝোই তো,এইসব তন্ত্রসাধকদের উপর কি আর পুরো ভরসা করা যায়?”
“আচ্ছা বাবা বেশ।এখন বল,এত দেরিতে উঠলাম,তোমার অফিসের দেরি করিয়ে দিলাম তো।ব্রেকফাস্ট করতে হবে তো?”
“ও তুমি চিন্তা কোর না।কতদিন পর আরামে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমোচ্ছ দেখে আর ডাকিনি তোমায়।আমি আমার ব্রেকফাস্ট বানিয়েছি,সাথে তোমারটাও।যাও বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসো,তারপর একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট করব,তারপর অফিস যাব।“
মিতালী বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো।খেতে খেতে মিতালী নবীনের দিকে তাকিয়ে বলল,”জানো আবার সবকিছু আগের মতন লাগছে।সহজ,স্বাভাবিক,সুন্দর।আচ্ছা নবীন,আমার একটা কথা রাখবে?”
“কি বল?”
“আমার এই ব্যাপারটা মিটে গেলে আমরা আমাদের বেবির কথা ভাবতে পারি না?যেমনটা ডক্টর বোস বলছিলেন।তাহলে...”
“চিল,মিতালী,চিল।“হেসে ফেলল নবীন,”এখনো একদিনও কাটেনি,আগেই অত ভেব না।টাইম দাও একটু আমায়।পাগলী একটা।“বলে আলতো করে একটা চুমু খায় ওর কপালে।
অফিস যাওয়ার সময় আবার বৌকে একটু আদর করে দিল নবীন।বলল,”সাবধানে থেকো,আর ঐ বুজ্রুক বাবা যেমন বলল,মেনে চল তেমনটা আর কি বলব।একা বেরোতে যেও না,বা অপরিচিত লোকের সাথে কথা বোল না।টেক কেয়ার।বাই।“
“তুমিও সাবধানে যেও।আর তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এস।“বলে মিতালীও নবীনকে চুমু দেয় একটা।
নবীন রওনা হয়ে গেল।মিতালী প্রসন্ন মনে ভিতরে এসে ঢুকল।যাক,তান্ত্রিকের চিকিতসা ভাল কাজ দিয়েছে।নবীনটা শুধু শুধু চিন্তা করছিল।
কিন্তু একী?শরীর টা একটু গুলিয়ে উঠল না?মাথাটাও কিরকম ঝিমঝিম করে উঠল।মিতালী অবাক হয়ে ভাবল,কি হচ্ছে তার?
পরক্ষণেই আবার নিজেকে প্রবোধ দিয়ে বলে,এতদিন এত দুশ্চিন্তা আর ভয় নিয়ে কাটিয়েছি,তারই আফটারশক হয়তো হবে।আরো একটু শুয়ে নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।ভেবে বিছানায় গিয়ে টান হল মিতালী।
গাড়িটা সিগনালে থেমে ছিল।হঠাত ্নবীনের একটা ফোন এলো।নাম্বার আর নামটা দেখেই নবীন সচকিত হয়ে উঠল,তারপর ফোনটা ধরল।তারপর বলল,
“হ্যালো,পিউ বলছ?হ্যা, শোন একটা জরুরি কথা আছে।তুমি যে ওষুধটা খাওয়াতে বলেছিলে,ওটা দিয়েই কাজ চলছিল,আর কদিন চললেই কাজ হাসিল করে নিতাম,কিন্তু কে এক তান্ত্রিক এসে সব মাটি করে দিল।।...না কোন কাজই হল না কাল,ওভারডোজ দেওয়া সত্ত্বেও।।....সে যাই হোক,সত্যি কথা বলতে কি আমার আর এই ধানাইপানাই ভাল লাগছিল না।তাই আজ ওর ব্রেকফাস্টের মধ্যে সামান্য একোনাইট মিশিয়ে খাইয়ে দিয়েছি।।..মোটামুটি দু ঘণ্টার মধ্যেই কাজ শুরু করে দেবে,একদম নিশ্চিত মৃত্যু।।...না না কোন হঠকারিতা করিনি আমি,আমার আর ভাল লাগছিল না ব্যাস।।...কি বলছ ধরা পড়ব কিনা?..হা হা অত কাঁচা কাজ আমি করি ভেবেছ?এই বিষ ফরেন্সিকেও ধরা পড়ে না,সবাই ভাববে নেচারাল ডেথ।….না না এবারে আর কোন তান্ত্রিকের জাদু টাদু খাটবে না,পুরো সিওর।বিষ পেটে গেলে কি আর জাদু করে মানুষকে বাঁচানো যায়?…হ্যা,একটু ঝক্কি হয়তো পোয়াতে হবে,তবে এটুকু মোটামুটি সিওর যে আমাদের দুজনের এক হতে আর কোন বাধা থাকবে না।ওকে বাই সুইটহার্ট,অফিসে দেখা হবে,এখন রাখছি কেমন? টাটা।“
ফোনটা কেটে দিল নবীন।দাঁড়কাক মৃত্যুর দূত আর মিতালীর বলা বিশ্বাসে মিলায় বস্তু এই দুটো কথা মনে পড়তেই তার সারা মুখে একটা কুটিল হাসি খেলে গেল।