দাগ
দাগ
১।।
“শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে?
আঘাত হয়ে দেখা দিল, আগুন হয়ে জ্বলবে।
সাঙ্গ হলে মেঘের পালা, শুরু হবে বৃষ্টি ঢালা,
বরফ জমা সারা হলে নদী হয়ে গলবে।
ফুরায় শুধু যা তা ফুরায় শুধু চোখে
অন্ধকার পেরিয়ে দুয়ার যায় চলে আলোকে।“
“বাবা তুমি এই কবিতাটা কেন এত ভালোবাসো? কি আছে এই কবিতায়?”
“তুই এখন অনেক ছোট রে, তুই ভালো বুঝতে পারবি না। শুধু জানবি এই কবিতায় আছে এমন কিছু যা এখন প্রতিমুহূর্তে আমার জীবনীশক্তিকে প্রেরণা যুগিয়ে চলেছে।“
“বাবা তুমি কেমন অন্যরকম হয়ে যাচ্ছো। আমার সাথে আর ভাল করে কথা বল না, খেলো না। সারাদিন রবীন্দ্রনাথের বই খুলে কবিতা পড়। রবীন্দ্রনাথ খুব দুষ্টু, বাবা।“
“ওরকম কথা বলতে নেই বাবা। এখন তো তাঁর এই কথাগুলোই আমার জীবনের সম্বল…” বলতে বলতে বাবার গলা ধরে আসত।
“কি হয়েছে তোমার বাবা? তোমার চোখে জল কেন?”
“আমি হয়ত আর বেশিদিন নেই রে খোকা।“
“কেন বাবা, কোথায় যাবে তুমি?”
“জানি না রে। সে জায়গাটা কেমন, কেউ জানে না। কারণ যে যায়, সে আর ফিরেও আসে না। বিশ্বাস কর, আমার তোকে ছেড়ে, এই সংসার এই পৃথিবী ছেড়ে কোথ্থাও যাবার ইচ্ছে নেই, কিন্তু...কিন্তু যেতে আমাকে হবেই, কারণ এ ডাক অমোঘ।“
“বাবা, তুমি আর আসবে না?”
“আসব। নিশ্চয়ই আসব। আসতে যে আমাকে হবেই, রবিবাবু যে তারই নির্দেশ দিয়ে গেছেন, তার লেখায় লেখায়। দুনিয়ার অন্তহীন এক চক্রজালে আবদ্ধ আমরা, শেষ হয়ে পালিয়ে যাবার ফুরসত কারো নেই। সুখের পরেই দুঃখ আসে, আবার দুঃখের পরেই সুখ, অন্ধকারের পরেই আলো আবার আলোর পরেই অন্ধকার তেমনি জীবনের পরে মৃত্যু আবার মৃত্যুর পরে আসে জীবন। রবীন্দ্রনাথের অমূল্য দর্শন কখনো মিথ্যে হতে পারে না। তাই আবার আমি ফিরে আসবই তোর কাছে, তোদের কাছে, তুই মিলিয়ে নিস। শুধু এই বিশ্বাসেই তো আজকাল দিনগুলো কাটে আমার“ বলে বাবা চোখ বুজে ফেলতেন।
২।।
অপারেশন থিয়েটারের বাইরে বসে বাবার কথা খুব মনে পড়ছিল। আজ অহনার ডেলিভারি, তাই ভিতরে ভিতরে একটা টেনশন ছিলই, কিন্তু হঠাত বাবার কথা মনে পড়তে টেনশনের সঙ্গে একটা উদাসী ভাব মিশে মনের ভিতরে কেমন একটা বিমিশ্র ভাব তৈরী হয়েছিল।
বাবা তারপরে আর বেশিদিন বাঁচেননি। ব্লাড ক্যান্সার যখন ধরা পড়েছিল, তখন থার্ড স্টেজ। ডাক্তার বলেই দিয়েছিল, আশা আর নেই, এখন ওষুধ খেয়ে যতদিন টিকিয়ে রাখা যায়। তখন আমার বয়স পাঁচ কি ছয়। মায়ের মুখেই শুনেছিলাম, ডাক্তারের জবাব শুনে বাবা মনেপ্রাণে খুব বেশিরকম ভেঙ্গে পড়েছিলেন। মা আর আমাকে নিয়েই তো বাবার জীবন ছিল, যাবতীয় সব স্বপ্ন ছিল আমাকে ঘিরে। আমাদের ছেড়ে এত তাড়াতাড়ি চলে যেতে হবে, তা বাবা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। জীবনকে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছিল বাবা।
বাবা কবিতা পড়তে খুব ভালোবাসতেন। বিশেষত রবীন্দ্রনাথের কবিতা। ছোটবেলায় বাবার কথা বুঝতে পারতাম না, কিন্তু এখন বুঝি, যখন সব অবলম্বন শেষ হয়ে যেতে বসেছিল, যখন জীবনের প্রদীপ টিমটিম করতে করতে প্রায় নিভে যেতে বসেছিল, তখন রবীন্দ্রনাথ বাবাকে প্রেরণা যোগাতেন। তিনি তার লেখায় লেখায় বুঝিয়ে দিতেন,ভয় পেয়ো না বন্ধু, যাকে তুমি শেষ বলে ভাবছ তা আসলে শেষ নয়, যাকে তুমি শুরু বলে ভাব সে আসলে শুরু নয়। জীবন হল শক্তির সংরক্ষণ সূত্রের মত, যা সৃষ্টিও হয়না, ধ্বংসও হয় না, হয় শুধু যা তা হল রূপান্তর। এক রূপ থেকে আরেক রূপে, এক জগত থেকে আরেক জগতে। তখন বাবাকে অদ্ভুত এক প্রশান্তি লাভ করতে দেখেছিলাম।
যখন বড় হলাম, বাবার চিন্তাধারাগুলোকে বুঝতে শিখলাম, তখন সেই সাথে একটা কথা ভেবে কেবলই খা
রাপ লাগত, যে বাবা রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়ে যে মানসিক শান্তি পেতেন, তা ছেলেভোলানো আশ্বাস ছাড়া কিচ্ছু নয়। বিজ্ঞান নিয়ে পড়ার ফলেই হয়ত সাহিত্যের মূর্ছনাকে অতটা তোয়াক্কা করিনি, খালি মনে হত, রবীন্দ্রনাথ একজন বড় সাহিত্যিক হতে পারেন, তাঁর লেখা মহার্ঘ্য হতে পারে, কিন্তু সর্বোপরি তিনিও তো একজন মানুষই ছিলেন। তাঁর পক্ষে কি জীবন মৃত্যুর খুঁটিনাটি সমস্ত কিছু উদ্ঘাটন করা সম্ভব? তাঁর এরকম লেখায় সাহিত্যজগতে আলোড়ন পড়তে পারে, দু একটা ভারী ভারী আলোচনাসভা বসতে পারে, পাঠকের দুটো প্রশংসা কোড়াতে পারে, বাবার মত কিছু মৃত্যুপথযাত্রী সান্ত্বনা খুঁজে নিতে পারে, শুধু সত্য না মিথ্যে তা প্রমাণ হতে পারে না। কারণ জীবন মৃত্যুর এই কুহেলিকা ভেদ করা কোনদিন কারো পক্ষে সম্ভবপর নয়।
চিন্তায় ছেদ পড়ল। অপারেশন থিয়েটারের বাতি নিভে গেছে। চিন্তার জগত থেকে বর্তমানে ফিরে এলাম,সেই সাথে মনের মধ্যে আবার উৎকণ্ঠাটা জেগে উঠল অহনার জন্য। সব ঠিক আছে তো?
ডাক্তার হাসিমুখেই বেরিয়ে এলেন। আমার সঙ্গে দেখা হতেই বললেন, “কংগ্রাচুলেশনস মিঃ সেন। আপনার ছেলে হয়েছে। মা আর বেবি দুজনেই ঠিক আছে, আপনি ভিজিটিং আওয়ারে এসে দেখা করে নেবেন, ওকে।“
মনের মধ্যে দুঃশ্চিন্তার মেঘটা কেটে গেল। প্রসন্নমনে ভগবানের উদ্দেশ্যে একটা প্রণাম জানিয়ে তখনকার মতন আমি বেরিয়ে গেলাম।
৩।।
অহনার পাশে বসেছিলাম। একটু আগেই আত্মীয়দের দেখাসাক্ষাৎ পর্ব শেষ হয়েছে, ভিজিটিং আওয়ারের আর মিনিট দশেক বাকি আছে, এই সময়টুকু ওদের সঙ্গে একান্তে কাটিয়েই ফিরব।
অহনা চোখটা আধবোজা করে শুয়ে ছিল। আমি পরম স্নেহে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। বাবার ছোটবেলাকার একটা ছবি দেখেছিলাম, তার সঙ্গে মুখের অনেকটাই মিল।
“মিথ্যা নয়, মিথ্যা নয়। আমি যা বলেছিলাম সেদিন একবর্ণও মিথ্যা না। রবিবাবু মিথ্যা হতে পারেন না।“
কে,কে বলল কথাটা? ঘরে আমি, অহনা আর আমাদের সন্তান ছাড়া আর কেউ নেই।
আমি চমকে উঠলাম। পরক্ষণেই আমার চোখে পড়ল একটা সাদা কাগজ, ওষুধের র্যাকের উপর রাখা আছে। এতক্ষণ তো ওটা দেখিনি। কোথা থেকে এল ওটা?
অহনা জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করল,”কি গো, কি হয়েছে? ওরকম চমকে উঠলে যে?
“কিছু নয়। তুমি ঘুমোও।“
আমি এগিয়ে গিয়ে কাগজটা হাতে তুলে নিলাম। খুলে পড়তেই আমার বিস্ময়ের শেষ রইল না। এ যে অবিকল বাবার হাতের লেখা।
“ “ফুরায় শুধু যা তা ফুরায় শুধু চোখে
অন্ধকার পেরিয়ে দুয়ার যায় চলে আলোকে।“
মনে আছে তোর, এই লাইন দুটো পড়লেই কেমন বিভোর হয়ে যেতাম আমি। মনে হত, রবিবাবু তার সমস্ত জীবনদর্শনটুকুকে নিংড়ে এই লাইন দুটোর মধ্যে ঢেলে দিয়েছেন। অদ্ভুত ছিল তার লেখনী। প্রতি মুহূর্তে যখন মৃত্যুর দিকে এক পা এক পা করে এগিয়েছি, এক অসীম শূন্যের দিকে,তখন মনে হত, শেষ হয়ে যাব এইভাবে? আমার অস্তিত্ব, আমার আমিত্ব এইভাবে বিলীন হয়ে যাবে? আর কোনদিন, আমার কাছের মানুষগুলোকে অনুভব করতে পারব না, ছুঁতে পারব না তাদের? হয়ত তাই, চিতাতেই তো সব শেষ হয়ে যায়। কিন্তু রবিবাবুর কথাগুলোকে জানিস তো, কখনো ভুলিনি, মৃত্যুর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত সেগুলোকে আঁকড়ে ধরেই মৃত্যুর কোলে মাথা রেখেছি। তোদের চোখে সেদিন আমার অস্তিত্ব বিলীন হয়েছিল, কিন্তু সত্যিই ফুরিয়ে যাইনি আমি। জীবন আর পরাজীবনের সুদীর্ঘ বৃত্ত অতিক্রম করে আবার ফিরে আসতে পেরেছি জীবনের পথে, তোদের কাছে। তোর ছেলে হয়ে আবার আমি ফিরে এসেছি। বিশ্বাস হচ্ছে না তোর, তাই না? দেখে নে তোর ছেলের কনুইয়ের কাছটা। তাহলে হয়ত বুঝতে পারবি, আমি কি বলতে চাইছি?”
পড়া শেষ হলে কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলাম। বাবার কনুইয়ের কাছে ছড়ে গিয়েছিল একবার অনেকটা, দাগটা মনের মধ্যে গেঁথে ছিল। নবজাতকের কনুইয়ের কাছেও সেই দাগ দেখে শিউরে উঠলাম আমি।