ক্ষুধা
ক্ষুধা


হাঁড়িতে ভাত ফুটছিল। উনুনের সামনে শূন্য দৃষ্টিতে বসে ছিল হরি। সামনের ঘর থেকে হরির মা অনুচ্চ স্বরে বলে উঠলেন,
“হরি, ভাত হল রে? আমার বড্ড খিদে পেয়েছে রে বাবা।“
“এই যা মা, হয়ে এসেছে গো। আর মিনিটদশেক সবুর কর, আমি নিয়ে আসছি।“ গলা তুলে বলল হরি।
সামনের ঘর থেকে তখনো জোরে জোরে নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল। মা হাঁপাচ্ছে। ইদানীং এই প্রবণতাটা খুব বেড়ে গেছে। দু একটা কথা বলার ধকল ও মায়ের সয় না। হাঁপাতে থাকে। এমনিই হাজারটা রোগে প্রায় শয্যাশায়ী, তার উপর এখন লকডাউনের সময়, ডাক্তার বদ্যি কোথাও কেও বসছে না। তাদের বাড়ি যাও তো দূর দূর করে তাড়িয়ে দিচ্ছে। ওষুধপত্র যে গুটিকতক ছিল, তাও শেষ। পয়সা দিয়ে যে ওষুধ কিনবে, তার জো নেই। রোজগার থাকলে তবে তো না পয়সাটা আসবে ঘরে।
ভাত হয়ে গিয়েছিল। কানা উঁচু থালাটায় মায়ের জন্য ভাত সাজাল হরি। ছড়িয়ে দিয়েও অর্ধেক ও ভরল না থালার। এই পরিমাণ খাবারে মায়ের পেট ভরে কিনা, তা হরি জানে না। কিন্তু পেট ভরতে হবেই।
মায়ের সামনে থালা নিয়ে গেল হরি। চাদরে ঢাকা একটা কঙ্কাল উঠে বসল, কোটরে ঢুকে যাওয়া চোখগুলো একবার জ্বলে উঠল।
“এনেছিস, দে বাবা দে।“
খাবারের আয়োজন যৎসামান্যই। নুন দিয়ে আলুসেদ্ধ ভাত। মা খাওয়া শুরু করতে তার পাশে এসে বসল হরি। খেতে খেতেই মা বললেন,”হ্যা রে, রোজই বলিস খাবার নেই, খাবার ফুরিয়ে এসেছে, রেশন থেকে এত কম জিনিস দিচ্ছে নাকি রে? কিন্তু কালই তো দেখলাম রতুর বাবা বস্তা করে চাল ডাল নিয়ে বাড়ি ফিরছে।“
হরি ঝাঁঝিয়ে উঠল,”তা আমি কি মিথ্যে কথা বলছি নাকি? চলতে তো পারো না, নাহলে বলতাম যাও গিয়ে দেখে এস গে, ভাঁড়ারে কত চাল পড়ে আছে। রোজ এক ভ্যানতাড়া ভালো লাগে না আমার। খেতে হবে তো খাও, নয়তো টান মেরে রাস্তায় ফেলে দেব, কুকুরগুলো খেয়ে যাবে। হেঁপো রুগীর আবার চারবেলা গেলার শখ।“
মা আর কিছু বললেন না। চুপচাপ খেতে লাগলেন। খাওয়া হয়ে গেলে হরি থালাটা নিয়ে রান্নাঘরে এল। হাঁড়ির দিকে তাকিয়ে একবার আপনখেয়ালে হেসে উঠল হরি। আর যে ভাত অবশিষ্ট আছে তা দিয়ে একটা বিড়ালেরও পেট ভরবে না, হরি তো একটা যুবা ছেলে। কিন্তু হিসেব করে না চালালে সত্যিই খুব বিপদ এখন। আর দুটোদিন কোনমতে চালাতেই হবে, যে করেই হোক। কিন্তু এটাও জানে হরি, যা খাবার আছে তা দিয়ে বড়জোর একবেলা একটা মানুষই খেতে পারে, তাও পরিপূর্ণ আহার নয়। ভাগ্য ভাল রহমতের বিবি মুড়ির প্যাকেট টা দিয়ে গেছিল, সেটা এখনো বেশ কদিন চলবে।
হরি গত বহুদিন ভাল করে ভাত মুখে তোলেনি। মায়ের শরীরের যা হাল, তাতে ভয় হয়, কোনদিন টেঁসে গেল বুঝি। তাই ঠেকা হিসেবে যতদিন পারা যায়, ভাতটা খাইয়ে যাচ্ছে ঠিকঠাক। হরি নিজে মুড়ি খেয়ে দিন কাটিয়েছে এই কদিন।
ভাতের ফ্যানগলা জল আর পড়ে থাকা ভাতটুকু কাঁচিয়ে নিয়ে মায়ের ঘরে গেল হরি।
“নাও, এটুকু বেঁচে গিয়েছিল,খেয়ে আমায় উদ্ধার কর।“
“তুই খাসনি?”
“আমি আমার মাথা খেয়েছি। বেশি জ্বালিও না তো বাপু। আমার ভাত আলাদা করার পর এইটুকু রয়ে গেছিল, তাই দিতে এলাম। প্রশ্ন না করে চুপচাপ খেয়ে নাও, নাহলে এরপরে আর এও জুটবে না।“
মাকে খেতে দিয়ে হরি বাইরে এসে দাঁড়াল। সুন্দর রোদ উঠেছে আজকে। কাল রাতে বৃষ্টির পর এখনো ওয়েদার বেশ ঠান্ডা ঠাণ্ডা। কে বলবে, এমন সুন্দর প্রকৃতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকিয়ে আছে বিষ। কখন কিভাবে সে বিষ প্রভাব বিস্তার করবে, সে কতটা সুদূরপ্রসারী, তা কেউ বলতে পারে না। শুধু মানুষ মেরেই ক্ষান্ত নয় সে, মানুষের জীবনযাত্রার আমূল পরিবর্তন ঘটাতেও তার মত পারদর্শী কেউ নেই।
হরির জীবনটাই ধরা যাক। ব্যান্ডেল টু হাওড়া লাইনের কুখ্যাততম পকেটমার হরির আগে ভাতের চিন্তা করার দরকার পড়ত না। তাঁর মত হাতের কাজ গোটা তল্লাটে বা লাইনে তো ছার, গোটা দেশেও বোধকরি ছিল না। একবারও পুলিশের কাছে না ধরা পড়ার রেকর্ড সে অক্ষুণ্ণ রেখেছে দীর্ঘ সময় ধরে। তাঁর দাপটে লোকেরা ভিড় ট্রেনে উঠতে ভয় পেত। এমন হাতের কাজ নিপুণ ছিল তাঁর, যে যার পকেট মারা হচ্ছে সে বা তাঁর আশেপাশের লোক ঘুণাক্ষরেও আন্দাজ করতে পারবে না কি হতে চলেছে, টের পাবে একমাত্র পকেটে হাত দিলে,যখন আর কিচ্ছু করার নেই।
হরির রোজগার মন্দ হত না। বেশিরভাগ লোকেই প্যান্টের পকেটে টাকা রাখে, কেউ কেউ তো আবার খোলাই রেখে দেয়, মানিব্যাগ টানিব্যাগের বালাই নেই। প্রতিদিন কম করে পাঁচশো ছশো কামিয়েই নিত।গ্রামে সবাই জানত হরি শহরে পাটের কলে কাজ করে, মাকেও তেমনটা বলে রেখেছিল সে। লকডাউনের পর সব কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, বহু শ্রমিক কাজ হারাতে বাধ্য হয়েছে। অতঃপর হরিরও কাজ বন্ধ। এই পর্যন্ত হলে সেরকম কোন সমস্যা হত না। কারণ গ্রামে অনেক লোকেরই কাজ গেছে, তাদের জন্য সরকার রেশন দিচ্ছে, সবাই বিনে পয়সায় চাল ডাল পাচ্ছে। হরিও পেত তা, যদি ছোট্ট একটা গন্ডগোল না হত।
আগেই বলেছি, হরির হাতের কাজ এতটাই নিপুণ ছিল যে তাকে সন্দেহ অবধি করার জো ছিল না। পুলিশ নাজেহাল হয়ে গিয়েছিল এটা খুঁজে বার করতে,যে আসলে এই পকেট্মারির নেপথ্যে লোকটা কে? ফলে হরি বেশ নিশ্চিন্তে ছিল।
কিন্তু অতি পাকাপোক্ত মানুষেরও ভুল হয়। একবার ভিড়ে ঠাসা বর্ধমান লোকালে উঠে সে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা এক ভদ্রলোকের পকেট মারতে যায়। সব ঠিকঠাক গুছিয়ে এনেছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে কি করে ভদ্রলোক বুঝে যান। খপ করে হরির হাতটা চেপে ধরেছিলেন। কিন্তু হরিও ঝানু লোক। মানকুন্ডু ষ্টেশন ঢুকছিল তখন, হরি কোনরকমে হাত ছাড়িয়ে এক লাফে উল্টোদিকের দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনটায় উঠে পড়ে, তারপরে সেটা থেকে প্ল্যাটফর্মে নেমে চোঁচা দৌড়। শোরগোল উঠেছিল এটা তাঁর কানে গিয়েছিল, কিন্তু নিশ্চিন্ত ছিল যে তাঁর চেহারা কেউ দেখেনি। কেউ বুঝে ওঠার আগেই সে হাওয়া।
কিন্তু বাড়ি ফেরার পর তাঁর খেয়াল হয়, যে ভদ্রলোকের পকেট সে আজ মারতে গিয়েছিল, সেই ব্যাক্তিকে তাঁর খুব চেনা চেনা লাগছে। একটু ভাবতেই তাঁর মনে পড়ল, আর সেই সঙ্গে শিউরে উঠল সে। আরে, লোকটা আর কেউ নয়, তাদের গ্রামের রেশন ডিলার ভবতোষ জানা। একই গ্রামে থাকে, আর যদি কেউ তাঁর মুখ সামান্য হলেও খেয়াল করে থাকতে পারে, তবে সেটা তিনিই। যদি মনে রেখে দেন, তাহলে আর রক্ষে নেই, গ্রামে প্রেস্টিজ লিক তো হবেই, সাথে উত্তম মধ্যম ক্যালানিও জুটতে পারে। সেই ভয়ে তো কাজে বেরোনোই বন্ধ করে দিয়েছিল কদিন।
এরপরেই পড়ল লকডাউন, আর বিপদটা এল তখনই। ট্রেন বন্ধ বাস বন্ধ, ফলে হরির রোজগারও বন্ধ। জমানো টাকায় বাজার হাট করে চলল কদিন, তারপর তাও যখন ফুরোতে বসল, তখন রেশন কার্ড নিয়ে লাইনে দাঁড়ানো ছাড়া উপায় রইল না। ভেবেছিল,বেশ কয়েকদিন কেটে গেছে, ভবতোষ জানা নিশ্চয়ই তাকে মনে রেখে বসে নেই।
কিন্তু বলে না,যেখানে বাঘের ভয় সেখামে সন্ধে হয়। মাস্ক পড়া বাধ্যতামূলক, তাই মুখ লুকোনোর সুবিধা ছিলই, তাঁর উপর আরো সাবধানতার জন্য হরি একেবারে কান মাথা জুড়ে গামছাটা পেঁচিয়েছিল। কিন্তু ভবতোষ জানা ঘাগু লোক। কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকে জরিপ করে ভবতোষ বলল,” এই তোর মাস্ক খোল।“
“কেন বাবু? মাস্ক তো...”
“খোল বলছি।“
হরি কিছুতেই খুলবে না। ভবতোষ ও ছাড়বে না। একরকম জোরাজুরি করেই হরির মাস্ক খোলাল ভবতোষ।
চুলের মুঠি ধরে ভবতোষ চেঁচিয়ে বলল,
“হাতে কাটা দাগ দেখেই সন্দেহ হয়েছিল। বেটা চোট্টা, ট্রেনে পকেট কেটে আমার মানিব্যাগ ফাঁক করে দিয়েছিল। মালটা কোথায় থাকে জানতাম না, চেহারাটা একটু একটু মনে ছিল। আজ তোকে বাগে পেয়েছি। কেলিয়ে তোকে আগে আধ্মরা করব, তারপরে পুলিশে দেব।“
তারপর আর বিস্তারিত বলার দরকার নেই। গোটা গ্রাম জানল হরির আসল পরিচয়, সেই সাথে উপর্যুপরি মার। মারার পর যখন পুলিশে খবর দেওয়ার ব্যাবস্থা হচ্ছিল, তখন হরি ভবতোষের হাতে পায়ে পড়ে যায়। মায়ের শারীরিক অবস্থার কথা বলে অনেক কাকুতিমিনতির পর ভবতোষ বলে, যদি সে তাঁর টাকাসমেত মানিব্যাগ ফেরত দেয়, তবে সে মাফ করতে পারে। কিন্তু হরি টাকা কোথায় পাবে? সে তো এখন কপর্দকশূন্য। শেষমেশ হরিকে ভবতোষ পুলিশে দিলনা ঠিকই, কিন্তু সে সাথে এও বলে রাখল, হরিকে যেন তিনি তাঁর রেশন দোকানের ধারে কাছেও না দেখেন। তাহলেই সঙ্গে সঙ্গে পুলিশে দেবেন। এই মর্মে তাঁর রেশন কার্ডও কেড়ে নেওয়া হয়, সেইসাথে লাইন দেওয়া সকল গ্রামবাসীকে জানিয়ে দেওয়া হয়, যদি কেউ কোনদিন কোনভাবে নিজেদের রেশনের মাল দিয়ে হরি ও তাঁর পরিবারকে সাহায্য করে, তাহলে তাকেও রেশন নেওয়া থেকে বঞ্চিত করা হবে।
ভবতোষের ক্ষমতা নেহাত কম নয়। পুলিশের সাথেও তাঁর ওঠাবসা আছে। তাই কেউ রা কাড়তে সাহস করেনি।
সেই থেকে হরির এইভাবেই জীবন কাটছে। ঘরের জমানো চাল ডাল বাকি খাবার শেষ আগেই হয়ে গিয়েছিল, ভবতোষের হিসেব মতন চললে পরে এতদিনে তাকে আর তাঁর মাকে না খেয়ে মরতে হত। মরতে হয়নি প্রতিবেশী রহমতুল্লার কল্যাণে। গাঁয়ের সবাই নিজের খাওয়ার জোগাড় করতে ব্যস্ত, হরির খবর জানার সময় কারোর নেই, সে পকেটমার জানার পর তো আরোই নয়। সকলেই তাকে এড়িয়ে চলে। কিন্তু রহমত হরির ছোটবেলার বন্ধু। একদিন রাত্রিবেলা রহমত লুকিয়ে লুকিয়ে তাদের বাড়ির বাইরে এসে হরির সঙ্গে দেখা করে বলেছিল,
“দেখ হরে, তর কাজ কাম জানার পর তোরে বন্ধু বলতে শরম লাগে, একথা সত্য। কিন্তু তর আম্মুর আমি বহুত ইজ্জত করি। তর কাজের সাজা উনি পাবেন, তা হতে দেওয়া যায় না। তুই চিন্তা করস না, আমি আমার বখরা থেকে খানিক মাল এনে তরে দেব। সাবধান জানাজানি যেন না হয়। খেয়ে দেয়ে চাচির পরাণডা বাঁচুক।“
ওইরকম অবস্থায় রহমতের ওই প্রতিশ্রুতি হাতে চাঁদ পাওয়ার মত মনে হয়েছিল হরির। রহমতদের অবস্থাও খুব ভাল নয়। চটকলে সামান্য মাইনের শ্রমিক ছিল, এখন বেকার। ঘরে্র লোক বলতে তাঁর বিবি আর অসুস্থ বাপ। সরকারী রেশনে নিজের সংসার সামলে আবার আরেকটা পরিবারকে সাহায্য করা রূপকথার গল্পের মতন। আবার তাতে যদি মাঝের লোক হিসেবে ভবতোষ জানা আর তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা থাকে, তাহলে তো গোদের উপর বিষফোঁড়া। এদিকে লোক না খেতে পেয়ে ধুঁকছে, ওদিকে ভবতোষের গুদাম ফুলছে। বলার কেউ নেই। আর প্রতিবাদ করলেই তো হল না। যার কাছে প্রতিবাদ জানাবে তাদেরও তো প্রতিবাদ বোঝার মানসিকতা থাকা দরকার। রেশনের মাল তো আর শুধু ভবতোষের গুদামে ঢুকছে না, দারোগা এম এল এ বড় ছোট সব লিঙ্ক করা আছে। এসবের পরে কিছু বাঁচলে তবে তা গ্রামবাসীর। কেউ কিছু বললে দোষ সরকারের। সাপ্লাই কম, তাই ডেলিভারিও কম। সোজা হিসেব।
রহমতের মুখে তাই এমন কথা শুনে সেদিন তাঁর হাতদুটো জড়িয়ে ধরে ভেউ ভেউ করে কেঁদেছিল হরি। রহমত বলেছিল,” ছাড় ছাড় করস কি, দূরে থাক দূরে থাক। আমি তোরে কাল রাতে এসে মাল দিয়ে যাব। বাড়ির পেছনে তৈরী থাকস।“
রহমত কথা খেলাপ করেনি। পরের দিন রাত্রিবেলায় এসে চুপিচুপি দিয়ে গিয়েছিল চাল ডাল আরো দরকারি জিনিসপত্র, সাথে মুড়িও দিয়েছিল। পরিমাণটা অবশ্য পর্যাপ্ত ছিল না, কিন্তু ওই অনেক। কে বা আজকালকার দিনে এমন ভাবে সাহায্য করে, আরো বিশেষ করে যখন এই দুর্ভিক্ষের দিনে গরীবরা সব মরতে বসেছে। রহমতেরও তো সংসার আছে!
খুব কষ্টেসৃষ্টেই দিনযাপন শুরু করেছিল হরি। মাসের মাল বলে কথা, সপ্তাহান্তে ফুরোলে তো রহমত আবার দিতে আসবে না। নিজে ভাত খাওয়াই ছেড়ে দিয়েছিল প্রায়, মুড়ি খেয়ে দিন কাটাত। কিন্তু একদিন হঠাত চমক দিল রহমতই। রাত্রিবেলায় এসে বাইরে থেকে বলল,” ভাই রে হরি, মাল এনেছি। দরজার বাইরে রেখে গেলাম, হাত ধুয়ে স্যানিটিজ করে নিস।“
হরি তো অবাক। জিজ্ঞেস করল,”রহমত, তুই মাল দিতে এলি কেন? নিজের ভাঁড়ার থেকে এত মাল দিলে তোর সংসার কি করে চলবে?”
“আরে না না, এ রেশনের মাল নয়। কি হয়েছিল জানিস তো? পাশের গাঁয়ে একদল লোক আসছিল গত পরশু। বলে কিনা খাবার দেবে। কানাঘুষোয় শুনছিলাম কোন এক স্কুল না কলেজের তরফ থেকে ফান্ড খুলেসে। তারাই দেবে। গরিব গুরবো, যাদের রেশন কার্ড নেই, চালচুলো নেই তাদের তলব করেছিল।লুকিয়ে চলে গেছিলাম আমিও, মাল নিয়ে আসছি। তারই খানিকটা তোকে দেব বলে আইলাম। আগের মাল ফুরায়েসে নিশ্চই?”
“বাঁচালি ভাই, আমি ভয় পাচ্ছিলাম মাসের শেষ অবধি টানব কেমনে?বুঝিসই তো...”
“বুঝি বুঝি রে, কিন্তু কিছু করনের নাই। সবই আল্লাতালার খেল। কায়ামতের সময় আসছে, আর খুব দেরি নেই।“
“কিন্তু রহমত, ভবতোষের কানে যদি যায় এ কথা?”
“সে ডর তো আছেই। কিন্তু কেউ কিচ্ছু জানেনি। চিন্তা করস না।“
“রহমত, এবার থেকে কোথাও কোন খবর পেলে আমাকে জানাস ভাই। তাহলে আর আমায় ভিক্ষা করে খেতে হয় না তোর থেকে।“
“হা হা সেই কথাটাই তোরে বলতে আছিলাম। চলে যাস কাল রথীনপুর গাঁয়ে, শুনে এলাম সেখানে আবার কারা জনসেবা করতে লেগেছে। সকাল দশটার মধ্যে যাবি।“
হরি গেছিল। কিন্তু সুবিধা হয়নি। রহমত এটা বলেনি যে ত্রাণ যে কেউ পেতে পারে না, তার জন্য নাম লেখা টোকেন লাগে। অথচ সে নিজে কি করে জিনিস নিয়ে এল সেদিন, সেটাই বিস্ময়ের ব্যাপার। পরে রহমতকে জিজ্ঞেস করতে বলেছিল, সবই আল্লার দোয়া। এ কথার মানে বোঝেনি হরি।
রথীনপুর গাঁয়ের জনসেবকরা একেবারে হতাশ করেনি। অল্প কিছু ত্রাণ দিয়ে বিদায় করেছিল তাঁকে। হরি ভেবেছিল, যাক তাও তো কিছু জুটল।
ফেরার সময় আরেক মজা হয়েছিল। কোন এক পার্টির ছেলেদের বোধকরি জনসেবার হিড়িক চেপেছিল, তাই একটা ফাঁকা কমপ্লেক্সের সামনে আসর জমিয়েছিল। কিছু হতদরিদ্র লোক সেখানে লাইন দিয়েছে ত্রাণের আশায়।
হরি তাদের কাছাকাছি আসতেই একজন মাস্ক পড়া অল্পবয়েসি ছেলে এসে তাঁকে বলল,”আপনি নিশ্চয়ই...”
আরেকজন চেঁচিয়ে বলল,”আরে জিজ্ঞেস কি করছিস, নিয়ে আয়, নিয়ে আয়। দরিদ্রসেবা হল নারায়ণসেবা। তাতে বাছবিচার করতে আছে?”
ছাড়ল না হরিকে, ভেতরে নিয়ে গিয়ে বলল,”আপনি এই গোলটার ভিতরে দাঁড়ান। সোশাল ডিস্ট্যান্সিং, বোঝেনই তো।“
কিছুক্ষণের মধ্যে তারা প্যাকেটে প্যাকেটে চাল, ডাল আলু নুন পেঁয়াজ তেল নিয়ে এসে হাজির করল। একজন গ্লাভস পরে হরির হাতে জিনিসগুলো দিয়ে তাঁকে ওগুলো ধরে দাঁড়াতে বলল। ভারি প্যাকেট গুলো হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে কালঘাম ছুটে গিয়েছিল হরির। একজন মোবাইল নিয়ে এসে ফটাফট তাদের কয়েকটা ছবি তুলল। তারপরে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিল, “অমুক জায়গায় অত ত্রাণ গ্রাহকের কাছে পৌছে দেওয়া হল...ইত্যাদি ইত্যাদি।“ তারপরে সব হয়ে গেলে একজন বলল,”ব্যস হয়ে গেছে, প্যাকেটগুলো রেখে চলে যান। সাহায্যের দরকার হলে অবশ্যই বলবেন কিন্তু দাদা, আমরা সবসময় পাশে আছি।“
কিন্তু যতই হোক,আগের মাসটা এভাবে কোনরকমে কেটে গিয়েছিল। কিন্তু সমস্যাটা বেড়েছে এই মাসে। এবারে রহমতও খুব বেশি সাহায্য পাঠায়নি। মাসের শুরু হতে না হতেই ভাঁড়ারে টান পড়েছে। তবে রহমতের দোষ দেওয়া যায় না। আগের মাসে সাহায্য করে হয়তো বুঝতে পেরেছে, তাদের মত লোকেদের এভাবে ঘরের লক্ষ্মী বিলিয়ে সাহায্য করাকে বিলাসিতা বললেও খুব কম বলা হবে। আবার আরেকটা কারণ হতে পারে, হয়তো ভবতোষ জানার কানে কিছু খবর গিয়ে পৌঁছেছে। সেই লোক পাঠিয়ে রহমতকে শাসিয়েছে। কে জানে!
এ গ্রামে কোন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও আসে না, যারা বিনামূল্যে ত্রাণ বিলি করবে। যত রমরমা আশেপাশের গ্রাম গুলোতে। তবে হরির আর আশেপাশের গ্রামে গিয়ে খোঁজ নেবার কোন শখ নেই। পরিশ্রম করেও যখন নীট ফল শূন্য হয়, তাঁর থেকে বেশি যন্ত্রণার আর কিছু নেই।
বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এইসব কথাই হরি ভাবছিল। তাঁর শিয়রে শমন এখন। দুদিন পর যে কি হবে, ভাবলে হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছিল তাঁর। হয়ত আবার রহমতেরই হাতে পায়ে গিয়ে ধরতে হবে। কিন্তু রহমতের উপর এতটা অত্যাচার করাটা হয়ত ঠিক হবে না। তাহলে কি করবে সে? আবার ভবতোষের কাছে যাবে? কিন্তু ভবতোষের মন কি গলবে? সে তো শাসানি দিয়েই রেখেছে,রেশন দোকানের চৌহদ্দির মধ্যে তাঁকে দেখলেই হাজতে পুরে দেবে।
চিন্তায় ছেদ পড়ল। দুজন লোক এসে বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়েছে। কর্কশ গলায় তাদের একজন হরিকে উদ্দেশ্য করে বলল,”এই রহমত তোকে কি মাল পাঠিয়েছে বের কর।“
হরি আকাশ থেকে পড়ল। আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করে বলল,”আ-আপনারা কারা?”
“তোর বাপ। আমরা জানি তোর ঘরে যা মাল আছে সব রহমতের দেওয়া। এতদিন কি করে আমাদের নাকের ডগায় কাঁচকলা দেখিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ, তা বুঝি না আমরা সোনা? প্রথম প্রথম ভাবতাম তোর চোরাই টাকা দিয়ে চালাচ্ছিস, পরে যখন জানলাম যে...এখন ভালোয় ভালোয় বল, রহমতের সাথে কতদিন এসব চলছে তোর?”
“বিশ্বাস করুন…”
“চোপ! আর একটাও কথা নয়। দেখ ভালোয় ভালোয় ঘরে থাকা খাবার দাবার বের করে আন। এখন বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলছি, বেশি তেড়িবেড়ি করলে ঘরে ঢুকে বের করে আনব।“
হরি কাদতে কাঁদতে বলল,” বাবু আমার মা টা খুব অসুস্থ, দুবেলা দুটি খেতে পায় না, খাবার না পেলে বাঁচবে না গো বাবু, তোমরা এবারকার মতন ক্ষমা করে দাও। কিন্তু মুখের খাবার কেড়ে নিও না গো।“
“সুরেশ, এ ভাল কথায় বোঝবার লোক নয়। চল আমারাই নিয়ে আসি।“
দুজনে হরিকে ঠেলে ঢুকে গেল রান্নাঘরে। মিনিটখানেকের মধ্যেই ভাঁড়ার খালি করে নিয়ে বাইরে এল তারা। হরি দিশেহারার মতন তাদের পেছন পেছন ঘুরতে লাগল।
“আমি মরে যাব গো বাবু, ঘরে অন্ন নাই, মা আর বাঁচবে না গো বাবু...”
ক্রূর হাসি হেসে সুরেশ বলল,”কেন রে, এতদিন তো গাঁট কেটেছিস হাজার লোকের, এখন তাই দিয়ে চালা। বাজারে পয়সা ফেলে যত খুশি মাল কেন গিয়ে আমরা কিছু বলছি না...কিন্তু ভবতোষ জানার গুদামের মালে হাত দিয়েছিস কি ঠ্যাং খোঁড়া করে রেখে দোব। তোর সাগরেদ রহমতকেও কড়কে এসেছি, কি করে তুই ওর থেকে আবার মাল নিস আমরা দেখব, চল সুখেন।“
চলে গেল ওরা। ভিতরঘর থেকে হরির মা বলছিলেন,”কি রে হরি, ও কারা এসেছিল? ঘরে ঢুকেছিল কেন?”
হরি উত্তর দিল না। ভাঁড়ার পুরো নিঃস্ব করে দিয়ে গেছে ওরা। ঘরে একটা চিনির দানাও নেই।
আজ তিনদিন অতিক্রান্ত হয়েছে। হরি পাগলের মত এদিক ওদিকে ঘুরে বেড়িয়েছে অভুক্ত অবস্থায়, একমুঠো খাবার যদি কোথাও পাওয়া যায়। বাজার গুলোর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেছে বারেবারে।
ঘরে মায়ের অবস্থা দেখা যায় না। আধপেটা খেয়ে যাও বা টিকেছিল এই কদিন, এই তিনদিনের অনাহারে পুরোপুরি মুমূর্ষু হয়ে পড়েছে। হরিরও শরীর ভেঙ্গে পড়েছে উপবাসে। গ্রামের কোন লোক তাদের দয়া করবে না, একমাত্র সবেধন নীলমণি ছিল রহমত, সেও আর যোগাযোগ করছে না।
হরি এখন বুঝতে পারে, ছোটখাট চুরিচামারি করাটা কতটা বড় অপরাধ, যার জন্য এখন তাঁকে মাশুল গুনতে হচ্ছে। করতে হলে বড় মহৎ কিছু করতে হয়, ভবতোষ জানাদের মতন। বড় কোন পার্টিকে হাত করে নাও, তারপর মজাসে জোচ্চুরি চালিয়ে যাও। কেউ কিচ্ছু বলার সাহস করবে না। ছুটকোছাটকা চুরিবিদ্যের জন্য ওই আপ্তবাক্যই ঠিক আছে,”চুরিবিদ্যা বড় বিদ্যা যদি না পড়ে ধরা।“
ওদের কোনদিন শাস্তি হবে না। হরিরা মোটামুটি সবাই জানে, ভবতোষের বাড়ির পেছনে ওর নিজস্ব গুদামে পেটি পেটি জিনিসপত্র স্টোর করা আছে, যা সে গোপনে বাজারে বিক্রি করে। দুর্নীতির খাদ্য বন্ধ গুদামে হেলায় গড়াগড়ি খাচ্ছে, আর ক্ষুধার্ত পেটে তাঁর জায়গা হয় না। অদৃষ্টের পরিহাস!
সন্ধ্যার সময় হরির মায়ের অবস্থা চরমে উঠল। এই দুদিন খেতে না পেয়ে হরিকে নানা কথা শুনিয়েছে তাঁর মা, কিন্তু আজ একটা শব্দ উচ্চারণ করার ক্ষমতাও তাঁর নেই। অনেক সময় নিয়ে হাফাতে হাফাতে কোন মতে তিনি হরিকে বললেন,”হ-হ-হরি ও আমার লক্ষ্মী সোনা হরি রে, আমায় একটুখানি ভাত দে, বিশ্বাস কর আর তোর কাছে কিচ্ছুটি চাইব না, একটু খেতে দে, আমার শ্বাস ফুরিয়ে আসছে...”
হরি বিচলিত হয়ে পড়ে। অমানুষিক ক্ষিদেয় কষ্ট সেও পাচ্ছে, সে সহ্য করে থাকতে পারে, কিন্ত মায়ের সে ক্ষমতা একেবারেই নেই। কাল পেটে পিত্ত পড়ে বমি করেছে। হাঁপানির সমস্যাটাও বেড়েছে, সেই সাথে জুড়েছে আরো নতুন উপসর্গ। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে প্রধান হল ক্ষুধার জ্বালা। তাঁকে রোধ করার সাধ্যি কারো নেই।
হরি মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, “চিন্তা কোর না, আমি যাই দেখি রহমতদের বাড়ি গিয়ে, ওকে একটু বুঝিয়ে বললে ও নিশ্চয়ই আমাকে ফেরাবে না।“
হরি ছুটল রহমতদের বাড়ি। ক্ষুধায় দুশ্চিন্তায় দুর্ভাবনায় তাঁর মুখটা বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। পথঘাট শুনশান তাও যথাসম্ভব নজর বাঁচিয়ে দ্রুতপদে এগোতে লাগল হরি।
রহমতদের বাড়ির সামনে এসে হরি দাঁড়াল। নীচু গলায় ডাকল,”রহমত ভাই।“
প্রথমবারে শুনতে পেল না কেউ। তাই সামান্য গলা চড়াতে হল তাঁকে।
রহমতের বিবি ভেতর থেকেই বলল,”কে?”
“ভাবি, আমি হরি, রহমতের বন্ধু। ভাত নেই ঘরে, তাই এসেছি। মা মরতে বসেছে, কিছু মুখে না তুলে দিলেই নয়। যদি কিছু দিয়ে দেন এবারকার মত, বড় মেহেরবানি হয়।“
এবার রহমতের গলা শোনা গেল,”ফরিদা, তুমি ওরে বলে দাও, আমি অরে চিনি না। আর কখনো যেন ও এদিকে না আসে। তাহলে খুব খারাপ হবে।“
“রহমত ভাই, একবার বাইরে আসো। ভবতোষের লোক আমার সব জিনিসপত্র লুটেপুটে নিয়ে গেছে। ঘরে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। এইবারকার মত তুমি দিনকয়েকের খাবার দিয়ে বাঁচিয়ে দাও। কথা দিচ্ছি, এরপর আমি কিছু না কিছু একটা ব্যবস্থা করে নেব, আর তোমায় বিরক্ত করব না। শুধু এইবারকার মত আমায় রহম করে দাও।“
এবার রহমত বাইরে এল। হরির সাথে দূরত্ব রেখেই সে বলল,”তোর কারণে আমার সংসার লুটতে বসেছে। তোকে চাল দিলে আমার বাড়ি হাঁড়ি চড়া বন্ধ হবে। আমার পরিবার আছে আমি তাদের ডুবতে দিতে পারি না। তুই চলে যা হরি। আমি তোকে কোনভাবেই মদত করব না।“
হরি আরো কয়েকবার মিনতি করল, কিন্তু রহমত মানতে রাজি হল না।
খিদের কষ্ট ছিলই, তাঁর সাথে হতাশার যন্ত্রণা মিশে হরির মধ্যে কি একটা হয়ে গেল। হঠাত তাঁর চোখদুটো জ্বলে উঠল, প্রবল আক্রোশে সে রহমতকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে ঘরে ঢুকে সামনে রহমতের বিবিকে পেয়ে তাঁকে জাপটে ধরে মুখ চেপে ধরল। তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে লাগল,”রহমত, চাল দে। নয়তো আজ তোর বিবির ইজ্জত লুটব।“
ফরিদা ছটফট করছিল। একমুহুরতের জন্য রহমত অবাক হয়ে গিয়েছিল, তারপর সে গর্জে উঠল,”হরি, ফরিদাকে ছেড়ে দে। তুই আমার বিবিরে ছুস, এত স্পর্ধা তোর হয় কি করে? এখনি ছাড় অরে, নয়তো আজ তোরে কোতল করে ফেলব।“
হরিও কর্কশ গলায় চিৎকার করে বলল,”সাবধান আমার কাছে ছুরি আছে, এগোনোর চেষ্টা করলে...”
কিন্তু হরির মতন অনাহারক্লিষ্টের পক্ষে বেশিক্ষণ লড়াই চালানো সম্ভব নয়। রহমত সহজেই ফরিদাকে মুক্ত করে, তারপর হরিকে ডান্ডা দিয়ে বেধড়ক মারতে মারতে ঘর থেকে বের করে দিয়ে বলে,”বেরিয়ে যা! ফের যদি দেখি আমার চৌকাঠ মারিয়েছিস, তো জ্যান্ত পুঁতে ফেলব! নেহাত তোর আম্মুকে ইজ্জত করি, তাই তোকে প্রাণে মারলাম না, পুলিশেও দিলাম না। কিন্তু এরপর দেখলে আর মাফ করব না।“
হরির তখন প্রায় আধমরা অবস্থা। কপাল, ঠোঁট হাত কেটে রক্ত গড়াচ্ছে। চলার শক্তিটুকুও শরীরে অবশিষ্ট নেই। কিছুক্ষন জিরিয়ে নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলতে শুরু করল সে। নাহ, ভাত তাঁকে জোগাড় করতেই হবে, যে করেই হোক। মায়ের প্রাণটা বাঁচাতেই হবে। কিন্তু আর কার কাছে যাওয়া যায়? গ্রামের লোকেরা তো তাদের একরকম এড়িয়েই চলে, আর তাছাড়া আর কোন জায়গায় গিয়ে হুজ্জতি করার শক্তি বা সামর্থ্য কোনটাই তাঁর অবশিষ্ট নেই। তাহলে উপায়?
হঠাত হরির চোখে পড়ল কিছু দূরে দেখা যাচ্ছে ভবতোষ জানার বাড়ি। তাঁর লাগোয়া একটা ঘরের মতন কিছু। সম্ভবত ওটাই ভবতোষের চোরাই গুদাম।
মনে মনে একটা সম্ভাবনা উঁকি মারে হরির। কেমন হয়, যদি ওখান থেকে কিছু মাল সরানো যায়। ওখানে নিশ্চয়ই অনেক চাল ডাল থাকে। তাঁর খানিকটা পেলেও আজ সে তাঁর মায়ের প্রাণটা বাচাতে পারবে।
এগোতে গিয়ে হরি ভাবল, যদি ভবতোষের প্রহরীরা তাঁকে দেখে ফেলে? তাহলে তো আর তাঁকে আস্ত রাখবে না। চোরাই গুদামের সামনে নিশ্চয়ই প্রহরী বসিয়ে রাকে সে।
কিন্তু ওসব ভেবে আর লাভ নেই। খাবার তাঁকে জোগাড় করতেই হবে, যেখান থেকেই হোক, সুতরাং এস্পার নয়তো ওস্পার।
বাড়ির পেছন দিকের দেওয়ালের পর থেকে খানিকটা অংশে ফাঁকা। হরি ঠিক করল, সেই পাশ দিয়ে সে পাচিল বেয়ে নামবে, কিছু প্যাকেট সরিয়ে আবার সেই পথেই ফিরে যাবে। গুদামঘরের পেছন দিকটা জংলা, চট করে সেখান দিয়ে কেউ এসে তাঁকে দেখে ফেলার সম্ভাবনা কম।
বাড়ির পেছন দিক দিয়ে এসে গুদামঘরের দেওয়ালের সামনে এসে দাঁড়াল সে। তারপর অনাহারে শীর্ণ শরীরটা নিয়ে অতিকষ্টে পাঁচিলের উপর উঠল সে। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। পাঁচিলের উপর ঠিকমতন ব্যালান্স রাখতে না পেরে সে হুড়মুড়িয়ে ভেতরে পড়ে গেল।
পড়তেই বুঝতে পারল এবার আর তাঁর রক্ষা নেই। বেশ জোরে আওয়াজ হয়েছে। বাইরে কেউ দাঁড়িয়ে থাকলে নির্ঘাত শুনেছে।
হরির অনুমান মিথ্যে হলনা। বাইরে দুটো দারোয়ান দাঁড়িয়ে ছিল, শব্দ হতেই তারা গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ভবতোষকে ডেকে আনল।
ভবতোষ চাবি দিয়ে গুদামঘরের দরজাটা খোলে। তারপর টর্চ জ্বেলে আশপাশটা দেখতেই একটা চালের বস্তার উপর খুঁজে পায় হরিকে।
প্রচন্ড বিস্মিত হয়ে ভবতোষ চেঁচিয়ে উঠল,”হরি!”
হরির আর সাড়া দেবার ক্ষমতা নেই। পড়ে পড়ে গোঙ্গাচ্ছিল সে।
বিস্ময় সামলে নিয়ে গর্জন করে ওঠে ভবতোষ,”তবে রে! তোর এত বড় সাহস হয়েছে তুই আজ আমার ঘরে ঢুকেছিস চুরি করতে? আজ আর তোর রক্ষা নেই। এই দরোয়ান ওকে ধরে রাখো, আমি পুলিশে খবর দিচ্ছি, যা করার ওরাই করবে! আমারই ভুল হয়েছিল তখনই তোকে পুলিশে না দিয়ে।”
দারোয়ানেরা হরিকে ধরতে এল। কিন্তু শেষমুহুর্তে হরির মধ্যে শক্তি ফিরে এল। দারোয়ানেরা তাঁকে ধরবার আগেই সে কোনরকমে এক ঝটকা মেরে উঠে দাঁড়াল, তারপরে প্রাণপণ শক্তিতে পাঁচিলে উঠে নেমে পড়ল উল্টোদিকে। তারপর ছুটতে লাগল দিগ্বিদিক হারিয়ে।
দারোয়ানেরা হায় হায় করে উঠল। দূর থেকে হরি শুনতে পেল ভবতোষের গলা,”পালাল? আচ্ছা পালিয়ে যাবে কোথায়?”
হরি দৌড়ায়, হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়, আবার দৌড়ায়। এত হতাশা, এত দুঃখের মধ্যেও তাঁর এখন ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। হয়নি, তাঁর অভিযান একেবারে ব্যর্থ হয়নি। চালের বস্তাটা ফুটো ছিল, একটু একটু চাল বের হয়ে আসছিল দেখে সামনে একটা পলিথিনের প্যাকেট বের করে ধরেছিল সে। যা পেয়েছে তাই নিয়েই সে লাফ মেরেছিল। এরপরে কি হবে তা তাঁর অজানা,কিন্তু এটুকু ভেবেই সে স্বস্তি পাচ্ছে যে এবেলার মত সে মাকে খাওয়াতে পারবে।
বিধ্বস্ত অবস্থায় হরি ফিরে এল। তাঁর ধারণা ছিল মা হয়তো এতক্ষণে বিছানা থেকে হাঁক পেড়ে হন্যে হয়ে তাঁকে খোঁজার চেষ্টা করছেন। কিন্তু বাড়ি পৌঁছে দেখে সব চুপচাপ। এমন কেন? মায়ের তো এখন হরিকে ঘরে না পেয়ে হাঁকডাক করার কথা।
হরি ডাকল,”মা”
কোন সাড়া নেই। একটু ভয় ভয় ধরে আসছিল প্রাণে, পা টিপে টিপে সে মায়ের শোয়ার ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়।
“মা চাল এনেছি মা, দেখ। আর চিন্তা নেই, এই আমি ভাত বসালাম বলে। অনেক চাল আছে, আজ তুমি পেট ভরে খাবে।“
কোন উত্তর নেই। হরি ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গিয়ে বলে,
“মা, কিছু বলছ না কেন মা?”
সব চুপ। এবারে হরি আর থাকতে পারল না। ছুটে গিয়ে মায়ের সামনে যেতেই দৃশ্যটা পরিস্কার হয় হরির। মায়ের চোখ খোলা, দৃষ্টি শূন্য। কোন স্পন্দন নেই।
হরি চিৎকার করে ওঠে।
“মা, কথা বল মা। তুমি এমন করে চুপ থাকতে পার না মা। ওঠো উত্তর দাও।“
পাগলের মত করতে থাকে হরি, বারবার ঝাঁকাতে থাকে মায়ের শরীরটা নিয়ে। কিন্তু হরির মা স্তব্ধ। জাগতিক ডাকে সাড়া দেওয়ার অতীত হয়ে গেছেন তিনি।
দূর থেকে গাড়ির আওয়াজ আসছিল। পুলিশের গাড়ি। হরির বাড়ির সামনে এসে সেটা থামল।
গাড়ি থেকে নামলেন ভবতোষ জানা আর পুলিশ ইন্সপেক্টর শেখররাজ সান্যাল। ভবতোষ তাঁকে বলল,”বলেছিলাম না স্যার, ও পালিয়ে যাবে কোথায়। ওর যাবার জায়গা একটাই।“
ইন্সপেক্টর ঘরের বাইরে থেকে বললেন,”হরি, ভবতোষের বাড়ি চুরি করার চেষ্টার অপরাধে তোমায় গ্রেফতার করা হল। তুমি বাইরে এসে ধরা দাও, নয়তো আমরা বাধ্য হব তোমায় জোর করে গ্রেফতার করতে। পালাবার চেষ্টা কোর না”
হরি তখনো মাকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মত বিলাপ করছিল। ভবতোষ বললেন,”স্যার ও ভালো কথায় মানবে না। আপনারাই ধরে আনুন ওকে।“
ইন্সপেক্টর বললেন,”অগত্যা।“ তারপরে কনস্টেবলদের নির্দেশ দিলেন,”এই তোমরা ওকে ধরে আনো। গ্লাভস আর মাস্ক পড়ে যাও, ওকেও মাস্ক পড়িয়ে আনবে।“
কনস্টেবলরা ভেতরে গিয়ে হরিকে বল্ল, “ তোমার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা আছে। উঠে পড়, মাস্ক পড়ে নাও। আমরা তোমাকে এরেস্ট করতে এসেছি।“
হরি এবার চোখ তুলে তাকাল। হতবুদ্ধির মত তাকিয়ে বলল,”পুলিশ!”
“ওঠ, আর দেরি কোর না।“
হরি চিৎকার করে বলল,”না, আমি আমার মাকে ছেড়ে কোত্থাও যাব না। আপনারা আমাকে গ্রেফতার করতে পারেন না……”
কনস্টেবলরা হরিকে নিয়ে বাইরে এল। ইন্সপেক্টর বললেন,”এবারে ওকে গাড়িতে তোল।“
একজন কনস্টেবল বললেন,”স্যার হরির মা এর ডেডবডি পড়ে আছে ভিতরে। কি করব?”
একরাশ বিরক্তির সাথে ইন্সপেক্টর বললেন,”এম্বুলেন্সে খবর দিতে হবে। তোমরা একে নিয়ে যাও, আমি দেখছি।“
হরিদের ঝুপড়ির ভেতর পড়ে রইল হরির মায়ের নিথর দেহ, আর পুলিশের গাড়িতে থাকা হরির আর্ত চিৎকার ও কান্না রাস্তার শুনশান পরিবেশে কোথায় মিলিয়ে গেল।