কাকতালীয়
কাকতালীয়


চার পেগ হয়ে গেল। এবারে আস্তে আস্তে নেশাটা ধরছে। পরের পেগটা ঢালার আগে একটা সিগারেট ধরাল শৈবাল। প্রথম টানটা দিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে কিছুক্ষণ সেই ধোঁয়ার কুন্ডলীর ভিতরে বুঁদ হয়ে রইল সে।
নীলাঞ্জনার আজ ফুলশয্যা। একটু বাদেই হয়ত নিখিল এসে ঘরে ঢুকবে, আর তারপরেই তারা দুজনে নিজেদের জীবনের শ্রেষ্ঠ রাতটি পালন করবে! ভাবতেই বুকের ভিতরটা আবার জ্বালা করে উঠল শৈবালের। সিগারেটটা নেভাল না, ঠোঁটে চেপে ধরেই বোতল কাত করে খানিকটা তরল গ্লাসের উপর ঢালল সে।
কতদিনের সম্পর্ক ছিল তাঁর নীলাঞ্জনার সঙ্গে। একসঙ্গে কাটানো অনেকগুলো মুহূর্তের স্মৃতি আজও জ্বলজ্বল করে মনে। মনে হত, ভগবান নিজের হাতে যেন নীলাঞ্জনাকে গড়েছে শুধু তাঁর জন্য। পৃথিবীর কেউ তাদেরকে কক্ষনো আলাদা করতে পারবে না।
বিশ্বাস! শুধু এই একটা মাত্র জিনিস আজ আলাদা করে দিয়েছে নীলাঞ্জনাকে তাঁর থেকে। কি করেনি সে নীলাঞ্জনার জন্য? নিজের বাড়ি পরিবার সবকিছুকে ছেড়ে সে দক্ষিণ কলকাতার এই ছোট্ট ফ্ল্যাটে এসে উঠেছিল শুধু তাঁকে নিয়ে বাঁচবে বলে। কিন্তু নীলাঞ্জনা পারল, তাঁর সেই ভালোবাসা আর বিশ্বাসের দাম রাখতে?
এই পেগে আর জল মেশাল না শৈবাল। পুরো নিট খেয়ে নিল। মুখের ভিতরটা জ্বালা করে উঠল, উত্তপ্ত তরল তাঁর সমস্ত বুকে আগুল জ্বালিয়ে দিল। সে চায় তাঁর বুকের ভিতরটা পুড়ে খাক হয়ে যাক। কারণ ঐ বুকেই তো নীলাঞ্জনার স্মৃতিগুলো এখনো জমাট বেঁধে রয়েছে। বহুচেষ্টা করেছে নিজেকে সামলে নিতে, নীলাঞ্জনাকে ভুলে গিয়ে বাঁচতে, কিন্তু পারেনি।
প্রাইভেট একটা কোম্পানিতে সামান্য মাইনের চাকরি করে শৈবাল। সরকারি চাকরির জন্য পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু কিছুতেই সফল হচ্ছিল না। এর মধ্যেই একদিন শৈবালের মনে নীলাঞ্জনার প্রতি একটা সন্দেহের উদয় হয়। নীলাঞ্জনা আগের মতন নেই। তাঁর স্বভাবে, কথাবার্তায় একটা আমূল পরিবর্তন এসেছে। আগের মতন আর তাঁর সাথে মেলামেশা করে না, কথাও বলে খুব দায়সারা। আর সবচেয়ে বড় কথা হল, শৈবাল লক্ষ্য করেছিল নীলাঞ্জনা আজকাল আর তাঁর চোখে চোখ রেখেও কথা বলে না। কৌতূহলী হয়ে একদিন নীলাঞ্জনার সামান্য সময়ের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে তাঁর ফোন ঘেঁটে আবিষ্কার করেছিল রজতের নম্বর। তারপর সেই নিয়ে তুমুল ঝগড়াঝাঁটি, যার পরিণতি হয় ডিভোর্সে। ঝগড়ার সময়ে নীলাঞ্জনার তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলা কথাগুলো আজও কানে বাজে শৈবালের। কি না বলে তাঁকে অপমান করেছিল নীলাঞ্জনা! সাত বছরের সম্পর্ক যে আসলে এতটা ঠুনকো ছিল, তা শৈবালের ধারণারও অতীত।
জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে গেছিল নীলাঞ্জনা। কিছুদিনের মধ্যে ওদের ডিভোর্সটাও হয়ে যায়। এরপর প্রায় মাসচারেক কেটে গেছে। ওরা কেউ কারুর সাথে আর যোগাযোগ রাখেনি। কিছুদিন আগেই ওদের রজত আর নীলাঞ্জনার বিয়ের খবরটা কানে এসেছিল শৈবালের। রজতরা বিজনেস্ম্যান, প্রচুর টাকার মালিক। শৈবাল বেশ বুঝেছিল, অর্থের মোহে শৈবালের সমস্ত স্মৃতি ভুলে মেরে দিতে একমুহুরত সময় লাগেনি নীলাঞ্জনার।
পারছে না, কিছুতেই পারছে না সে। আজ আরো প্রবলভাবে মনে পড়ছে তাঁর নীলাঞ্জনাকে, তোলপাড় হয়ে যাছে বুকের ভিতরটা। নীলাঞ্জনা আজ অন্য একজনের সহধর্মিণী রূপে জীবন শুরু করবে তাদের এতদিনের সম্পর্ককে অর্থহীন করে দিয়ে, এই বোধটা তাঁকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। অথচ তাঁর কিচ্ছু করার নেই।
একমাত্র উপায়, নীলাঞ্জনাকে ভোলার চেষ্টা করা। ভুলতেই হবে তাঁকে। এ কষ্ট তাঁর একার, সে গুমরে মরে গেলেও কেউ তাঁকে সহানুভূতি জানাতে আসবে না। এ যন্ত্রণা থেকে বাঁচার উপায় তাই তাঁকে নিজেকেই খুঁজে বের করে নিতে হবে।
পেগের পর পেগ ঢেলে গলাধঃকরণ করতে লাগল শৈবাল। তীব্র ঝাঁঝে তাঁর মুখ বিকৃত হয়ে যাচ্ছিল, তবু সে থামল না। অন্যদিনের চেয়ে আজই তাঁর নীলাঞ্জনাকে বেশি করে মনে পড়ছে, আর কষ্টটাও সেজন্য দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
নেশা চরমে পৌছে গেছে। এবার বুকের ভিতরে আস্তে আস্তে তলিয়ে যাচ্ছে নীলাঞ্জনা। ঐ চরম মুহূর্তেও মনে মনে এক হিংস্র তৃপ্তি লাভ করে শৈবাল। যে নীলাঞ্জনার স্মৃতি এতক্ষণ তাঁকে কষ্ট দিচ্ছিল, সেই স্মৃতি যেন ক্রমশ স্তিমিত হয়ে আসছে। শৈবাল অনুভব করে, তাঁর বুকের ভিতরে থাকা নীলাঞ্জনাটাকে কেউ গলা টিপে ধরেছে। নীলাঞ্জনা নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারছে না, হাঁসফাঁস করছে। মনে মনে পৈশাচিক আনন্দ লাভ করে শৈবাল। সিগারেটের প্যাকেটটা শেষ হয়ে গেছিল, তাই দেরাজে রাখা নতুন সিগারেটের প্যাকেটটা আনার জন্য বসা অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ায় সে। কিন্তু বেশি দূর যেতে পারল না। নেশার ঘোরে হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল সে, আর উঠতে পারল না। জ্ঞান হারানোর আগের মুহূর্তে সে অনুভব করল, তাঁর বুকের ভিতরে নীলাঞ্জনার চোখ ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে, ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে একসময় নিথর হয়ে গেল সে।পরম তৃপ্তিতে সেখানেই শুয়ে পড়ল শৈবাল। এবারে তাঁর নেশা জমে গেছে।
*****
শৈবালের হুঁশ ফিরল পরের দিন বেলায়। খুব জোরে জোরে দরজা ধাক্কাচ্ছিল কে যেন।
খাড়া হয়ে দাঁড়াতে একটু সময় লাগল শৈবালের। নেশার ঘোর এখনো পুরোপুরি কাটেনি। টলতে টলতেই এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খোলে সে।
দরজা খুলে শৈবাল দেখে সুপ্রতিম, তাঁর পাড়ার একটা ছেলে। তাদের সঙ্গে ভালই আলাপ আছে। বয়েস খুব বেশি নয়, বাইশ-তেইশ। শৈবালের এই অবস্থা দেখে একটু হতচকিত হয়ে গেল। কয়েক মুহূর্ত পরে বলল,”শৈবালদা, তুমি ঘটনাটা শুনেছ?”
কথা বলার ফাঁকে হাফাচ্ছিল সে, গলার স্বরে বোঝা যাচ্ছিল সে বেশ উত্তেজিত।
শৈবাল স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল,”ঘটনা? কোন ঘটনা? কি বলতে চাইছিস তুই? আর এত হাফাচ্ছিস কেন? কি হয়েছে?”
“সেটা বলার জন্যই তো এতক্ষণ ধরে তোমাকে ডাকাডাকি করছিলাম। ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছে জান? নীলাঞ্জনাদিদি, তোমার বৌ কাল রাতে মারা গেছে।“
প্রথমে কথার অর্থটা ঠিক পরিস্কার হল না তাঁর কাছে। ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,”কি বললি?”
“যা বলছি ঠিকই বলছি। আরে কাল ওর ফুলশয্যা ছিল এটা তো জানতে নিশ্চয়ই। গোটা বিয়েতে কোন সমস্যা হয়নি, সব কাজ ভালোয় ভালোয় মিতে গিয়েছিল। শরীরে আগে থেকে কোন রোগ ছিল, এমনও নয়। ফুলশয্যার ঘরে ওর স্বামী ঢোকার কয়েক মিনিটের মধ্যে নাকি দিদি সাঙ্ঘাতিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং দশ মিনিটের মধ্যে মারা যায়। ডাক্তার এসেছিল, প্রাথমিক ভাবে পরীক্ষা করে জানিয়েছে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে স্বাভাবিক মৃত্যু। কিন্তু একটা সুস্থসবল মেয়ে এইভাবে মারা যেতে পারে, তা কল্পনারও অতীত। পুলিশকে খবর দেওয়া হয়েছে, বডির পোস্টমর্টেম হবে।“
শৈবালের মুখ দিয়ে বিস্ময়ে কোন কথা বেরোয় না কিছুক্ষণ ধরে। তারপরে ধীরে ধীরে বলল,”কি বলছিস! নীলাঞ্জনা মারা গেছে...নীলাঞ্জনা মারা গেছে...কিন্তু...কিন্তু...তুই এসব জানলি কি করে?”
সগর্বে সুপ্রতিম বলল,” সব খবর পাই দাদা, সব লাইন করা আছে। আর তাছাড়া বিজনেসম্যান রজত চৌধুরীর খ্যাতি তো আছেই, তাঁর বাড়ির খবর আমার কানে এসে উঠবে না তাই কখনো হয়? কাল নিউজপেপারেও হয়ত ছোট একটা কলামে খবরটা বেরোতে পারে। তোমায় জানাতে এলাম, কারণ তোমায় আর নীলাঞ্জনা বৌদিকে আমি চিনতাম অনেকদিন। কি কষ্টটাই তোমায় দিয়েছে শেষ দিকটায়, তাও আমার অজানা নয়। তাই ভাবলাম এই খবরটা তোমার জানা দরকার। সত্যি কথা কি বলত? খারাপ খবর ঠিকই, কিন্তু আমার মনে হয় না তোমার এতে দুঃখ পাওয়া বা ভেঙ্গে পড়া উচিত। আমার তো মোটেই হচ্ছে না। দিদি তাঁর উপযুক্ত শাস্তিই পেয়েছে। কিন্তু শৈবালদা, তোমার চেহারাটা এরকম লাগছে কেন? শরীর ভাল নেই নাকি? আর ঘরে এত মদের গন্ধ…তুমি নেশা করা ধরলে কবে?”
শৈবাল বিমূড় হয়ে রইল, কোন জবাব দিল না। হঠাত একটা সম্ভাবনার কথা তাঁর মাথায় এল, সে সুপ্রতিমের কাছে এসে তাঁর কাধদুটো ধরে ঝাঁকিয়ে বলল,” সুপ্রতিম…সুপ্রতিম একটা সত্যি কথা বলবি?”
“বল।“
“তুই নীলাঞ্জনার মৃত্যু সম্পর্কে অনেক খবর পেয়েছিস, বলতে পারবি ও ঠিক কখন মারা গেছে?”
“এই দেখ…”সুপ্রতিম একটু চিন্তা করে বলল,” যা খবর শুনলাম তাতে আন্দাজ বারোটা সাড়ে বারোটা। কিন্তু কেন?”
শৈবাল সুপ্রতিমকে ছেড়ে দিল। ধীরে ধীরে পিছিয়ে এল সে। খানিক দূরে মেঝেতে পড়ে ছিল একটা ভাঙ্গা টেবিলক্লক। কাচগুলো ভেঙ্গে মেঝেয় ছড়িয়ে আছে। সেদিকে দৃষ্টি গেল তার। ঘড়িটা বারোটা পনেরো বেজে বন্ধ হয়ে গেছে। মনে পড়ে গেল শৈবালের, সে হুমড়ি খেয়ে পড়ে জ্ঞান হারানোর সময় টেবিলের ঘড়িটাকে নিয়েই পড়েছিল, সেইসময় বারোটা পনেরো বেজে ছিল। আরো মনে পড়ল, তাঁর বুকের মধ্যে নীলাঞ্জনার গলা কেউ টিপে ধরেছিল, সে হাঁসফাঁস করছে, নিজেকে ছাড়াতে পারছে না, ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ল সে…। কথাগুলো মনের মধ্যে ভেসে উঠতেই শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেল তাঁর।