আমি ফকির

Thriller

4  

আমি ফকির

Thriller

অন্ধকারে যেও না

অন্ধকারে যেও না

14 mins
552


পর্ব এক

সন্ধ্যে সাতটা বাজতে চললো, এখনো দুর্গাদেবী বালিকা বিদ্যালয়ের মেইন গেট খোলা। কাল সরস্বতী পুজো, আর তারই তোড়জোড় চলছে এখনও। প্রধান দায়িত্বে নিয়োজিত ছাত্রীরা এখনো কাজে ব্যস্ত। আজ রাতের মধ্যেই সব কাজ শেষ করতে হবে। ঠাকুরের পেছনের চালচিত্রটাই এখনও শেষ হয়নি। সবটাই হয়েছে ওই রূপসার জন্য। এসব বাজে আইডিয়া ওরই। সবাই বললো আর্ট পেপার গুলো একসাথে জুড়ে ওর ওপর কুমোর পাড়ার ছবিটা এঁকে রং করে দিলেই হয়। কিন্তু নাহঃ তাতে নাকি নেহাত মামুলি লাগবে! এটাও আবার কানাঘুষো শোনা গেছে পাশের রানীবালা গার্লস স্কুল নাকি মাটির ভাঁড় দিয়ে কিসব কারুকার্য করেছে। এটাও তো ঠিক ওদের জিততে দিলে চলবে না। সেই জন্যেই রূপসার আইডিয়া তেই সব আয়োজন করা হয়েছিল। খড় বিচুলি পাট কাঠি সব জোগাড় করে গরুর গাড়ি টা বানানো হয়েছিল। কিন্তু এসব তো আর পাকা হাতের কাজ নয়, সবই তো ওই ক্লাস নাইন এর মেয়েদের হাতে তৈরী। ব্যাস আরকি, আজ বিকেলে ঠাকুর আনার পর ঠাকুরটা ঠিক করে বসাতে গিয়েই গেলো গরুর গাড়ির চির সমাধি হয়ে। শেষ মুহূর্তে আবার সেই আর্ট পেপার এর ওপরই কোনোমতে গ্রামের একটা দৃশ্য পুকুর গাছ ফুল এসব এঁকে রং করা হচ্ছে। এবারের থিম ছিল সহজ পাঠ। তাই চালচিত্রে কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ি। এই আইডিয়াটা স্নেহার। কিন্তু ওই আসল গরুর গাড়ির এফেক্টটা দিতে গিয়েই যত সমস্যা হয়ে পড়লো একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে। এখন আর গরুর গাড়ি কুমোর পাড়া ভাগ্নে মদন কিছুই আঁকার সময় নেই। অবশেষে তাই চলচিত্রের থিম "কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ি"র থেকে হয়েছে "দীঘি ভরা জল করে ঢল ঢল, নানা ফুল ধারে ধারে"। রূপসার ওপর সবাই অল্পবিস্তর রেগে আছে। যদিও মেয়েটা তখন থেকে একনাগাড়ে ছবি এঁকেই চলেছে। টিফিন টাও পড়ে আছে, খায়নি এখনও।

মৌমিতা দি এর মধ্যে ক্লাসে ঢুকলেন কাজ কত দূর সেটা দেখার জন্য। বাকি সবকিছুই মোটামুটি রেডি, শুধু চালচিত্রের একটু রং বাকি আছে। রং করছে রূপসা, প্রীতি, কাজল আর প্রিয়া। দেয়ালে দু একটা ছবি লাগানো এখনও বাকি , সেগুলো করছে শ্বেতা আর রিমি। বাকি সব গোছানোর কাজে স্নেহা,পারমিতা, রঞ্জিনী, সুলেখা। ঘরে মোট রয়েছে মৌমিতা দি কে নিয়ে আট জন। স্টাফ রুমে বোধ হয় রত্না দি আর মানসী দি এখনো রয়েছেন। আর বাইরে একজন দারোয়ান।

এখন বাজে আটটা বেজে দশ। রঞ্জিনীর মা এসে হল ঘরে প্রবেশ করলেন। মৌমিতা দি কে জানালেন ওনাদের বাড়ি টা অনেকটা দূরে তাই এখন ই রওনা না দিলে রাত হয়ে যাবে অনেক। রিমিও রঞ্জিনীর সাথেই রোজ স্কুলে আসে তাই রিমি আর রঞ্জিনী দুজনেই বিদায় নিলো।

চালচিত্রের একটু রং বাদে সব কাজ ই শেষ, তাই স্নেহা, পারমিতা, শ্বেতা, প্রীতি আর প্রিয়া একে একে বাড়ি চলে গেলো। কাজল আর রূপসা এখনও রং করছে। আর সুলেখার কাজ শেষ হয়ে গেলেও ও গেলো না। সুলেখা রূপসার বেস্ট ফ্রেন্ড, তাই বন্ধুর জন্য সেও বসে রইলো। স্টাফ রুম এর দিদিরাও চলে গেছেন অনেক্ষন হলো। এখন শুধু সারা স্কুলে রূপসা, সুলেখা , কাজল, মৌমিতা দি আর বাইরের দারোয়ান কাকা।

রূপসা ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল আর কাজল সেকেন্ড গার্ল। রূপসা ক্লাস ফাইভ থেকে এই স্কুলে ভর্তি হয়েছে তবে থেকেই ও ফার্স্ট হয়। রূপসা আসার আগে কাজল ছিল বরাবরের ফার্স্ট। সুলেখা স্টুডেন্ট হিসেবে খুব অ্যাভারেজ। মোটামুটি ছবি আঁকতে পারে। কাজল আর সুলেখার বন্ধুত্ব সেই ক্লাস ওয়ান থেকে। রূপসা ভর্তি হওয়ার পরের বছর একবার সুলেখার টিফিন পড়ে যায়। সেই থেকে খাবার শেয়ার করতে গিয়ে রূপসার সাথে সুলেখার বন্ধুত্ব। ওরা ধীরে ধীরে বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে ওঠে। ওদের মধ্যে খুব বন্ধুত্ব, ঝগড়া ঝাটি হয়না বললেই চলে। শুধু গতবার পরীক্ষার হলে চীট পেপার নিয়ে সুলেখাকে দেখে ফেলে রূপসা আর তখনি রূপসা ওগুলো জোর করে কেড়ে ছিঁড়ে ফেলে দেয়। সুলেখা ওই একটা পরীক্ষায় ফেল করেছিল। গার্ডিয়ান কল হয়েছিল সুলেখার। তখনই কদিন সুলেখা রাগ করে রূপসার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। এরপর রূপসা গিয়ে ওকে বোঝাতে যে এরম করা উচিত নয়, সুলেখা বুঝতে পারে যে ও ভুল করেছে। এরপর থেকে সব একই রকম চলছে। রূপসা গতবারও ফার্স্ট হয়েছিল ক্লাস এ।

পনেরো মিনিট পর কাজল ও ব্যাগ গুছিয়ে চলে গেলো। কাল আবার ভোর বেলা স্নান করে শাড়ী পরে স্কুলে আসতে হবে।

"এই রূপ বাড়ি চ' এবার, অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে কিন্তু। সব তো প্রায় হয়েই গেছে। ওই দুটো পাখি কাল সকালে এসে করে দিলেই হবে"।--সুলেখা বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো।

"হ্যাঁ হ্যাঁ এই তো দাঁড়া না একটু খানিই তো এখুনি হয়ে যাবে, বেকার আবার কালকের জন্য এটুকু রেখে কি হবে"।

এদিকে মৌমিতা দি ও তাড়া দিচ্ছেন। অগত্যা রূপসা কে মৌমিতা দির কথা শুনতেই হলো। রং করতে গিয়ে সারা হাতে রং মাখামাখি। তুলি গুলোও ধুতে হবে।

সুলেখা ব্যাগে সব জিনিস পত্র গোছাতে গোছাতে রূপসাকে বললো ও যাতে গিয়ে হাত ধুয়ে আসে, ও এদিকে আঁকার সরঞ্জাম সব গুছিয়ে নেবে। সুলেখার কথা মতো রূপসা তুলি গুলো নিয়ে বাথরুমের দিকে রওনা দিলো।

পুজোটা ওদের স্কুলের এক তলার হল ঘরে হয়। এক তলারই বাকি ক্লাসরুম গুলো সাজানো হয়। ওপরের তলায় পুজোর সময় বাইরের লোকেদের প্রবেশ নিষেধ। রূপসাদের স্কুলের হল ঘরটা স্কুলের মেইন গেট দিয়ে ঢুকেই একদম সামনে প্রিন্সিপালের ঘরের উল্টো দিকেই। এরপর সামনের দিকে চলে গেছে লম্বা করিডোর আর করিডোরের একদম শেষ প্রান্তে বাথরুম। ওদের মেইন গেটের পাশেই ওপরে যাওয়ার সিঁড়ি; আবার বাথরুমের পাশ দিয়েও আর একটা সিঁড়ি ওপরের দিকে চলে গেছে। ওদের স্কুলটা তিন তলা।

হল ঘরের বাইরে বেরোতেই একটা কনকনে ঠান্ডা হাওয়া এসে রূপসার সারা শরীর কাঁপিয়ে দিয়ে গেলো। ঘরের ভেতর জানলা গুলো বন্ধ তাই বেশ গরম; সোয়েটার টা তাই রূপসা খুলে রেখেই কাজ করছিলো। করিডোরে এসে দাঁড়াতেই ওর সারা গা শিরশিরিয়ে উঠলো ঠান্ডায়। সারা হাতে রং মাখানো, তাই হাত না ধুয়ে সোয়েটার টা পরাও যাবে না। অগত্যা রূপসা বাথরুমের দিকে হাঁটা শুরু করলো।

শুধু হল ঘরটার সামনের আলোটাই জ্বলছে। ওই আলো বাথরুমের শেষ প্রান্ত অবধি পৌঁছোচ্ছেনা। করিডোর দিয়ে যাওয়ার সময় রূপসা খেয়াল করলো দুপুরের সেই স্কুলের সাথে এই স্থানটির যেন কোনো মিল নেই। মনে হচ্ছে কত বছর এখানে কোনো মানুষ জন আসেনি। অন্ধকার ক্লাসরুম গুলো যেন হা করে গিলে খেতে আসছে। রূপসা ভীতু নয়। ও সোজা বাথরুমের দিকে চলে গেলো। বাথরুমের সামনে হাত ধোয়ার বেসিন; রাস্তার আলোয় মোটামুটি আন্দাজ করে নেয়া যাচ্ছে। তুলি গুলো ধুতে ধুতে হঠাৎ একটা আওয়াজে চমকে পেছনে তাকালো রূপসা। পেছনেই ওপরে যাওয়ার সিঁড়ি। সিঁড়ির ওপরের দিকে তাকাতেই বুকটা ধক করে উঠলো, তুলি গুলো হাত থেকে পরে এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে গেলো। ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইলো রূপসা সেই গাঢ় অন্ধকার সিঁড়ির দিকে।

পর্ব দুই

আজ সরস্বতী পুজো। ভোর পাঁচটায় উঠে হলুদ মেখে স্নান করে শাড়ী পরে স্কুলে যাওয়ার জন্য একদম রেডি বীথি। মোবাইল ফোন টা নিয়ে একবার দেখলো ও। বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করে বললো "সাড়ে আটটা বাজে কোনো টাইম জ্ঞান নেই, ধুর!" বলেই ফোন টা বিছানায় ছুঁড়ে ফেললো। বীথির নিজের ফোন নেই। ও ওর মায়ের ফোনেই হোয়াটস্যাপ ফেইসবুক এসব করে। বীথির বাবা জানিয়ে দিয়েছে যাই হয়ে যাক মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট না করলে ওকে ফোন দেওয়া হবে না। শুধু আজকের জন্য বীথি মায়ের কাছ থেকে স্পেশাল পারমিশন আদায় করেছে ফোনটা নিয়ে বেরোনোর জন্য। ওর সব বন্ধুদের কাছে ফোন আছে। আর তাছাড়া শাড়ী পরে হাতে একটা ফোন না নিলে মানায় নাকি! এর মধ্যেই কলিং বেল বেজে উঠলো। বীথি দৌড়ে দরজা খুলেই বলতে শুরু করলো- "এই কি রে কটা বাজে! তোরা নাকি আটটায় আসবি!"

"আরে শাড়ী পরতে সময় লাগবে না? আর দেখনা এই সুমনা টা হীল জুতো পরে হাঁটতেই পারছে না, ওর জন্যই বেশি দেরি হলো"- পেখম কথা গুলো শেষ করতেই ওরা তিন জনেই হেসে উঠল। তারপর মা কে জানিয়ে বীথি ওর দুই বন্ধু সুমনা আর পেখমের সাথে বেরোলো স্কুলে।

প্ল্যান মতো ওরা প্রথমে ওদের নিজেদের স্কুলে যাবে সেখানে অঞ্জলি দেবে তারপর অন্য স্কুল গুলোতে ঘুরতে বেরোবে। শুধু এবার ওরা ঠিক করেছে প্রত্যেক বারের মতো না করে এবার একটু দূরের স্কুল গুলোতেও ঘুরবে।

স্কুলের সামনে পৌঁছতেই বীথি দেখলো সম্রাট ওর বন্ধুদের নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সম্রাট পাশের বয়েজ স্কুলে পড়ে। বিথীকে দেখেই পাঞ্জাবি ঠিক করতে করতে ওর দিকে এগিয়ে আসতে গেলেই বীথি ওর দিকে তাকিয়ে মুখ ভেঙ্গিয়ে নিজের বন্ধুদের সাথে সোজা স্কুলের ভেতর চলে গেলো। বীথি শুনতে পেলো সম্রাটের বন্ধুরা হোহো করে হেসে উঠলো। এই ছেলেটা রোজ ছুটির সময় দাঁড়িয়ে থাকে বীথির স্কুলের বাইরে। বীথি সবটাই বুঝতে পারে আর মনে মনে খুব খুশিও হয়। যাই হোক বীথি ওর বন্ধুদের সাথে অঞ্জলি দিতে এগিয়ে গেলো।

স্কুল থেকে বেরিয়ে ওরা তিনজন ঠিক করলো কোনকোন স্কুল গুলো আগে যাবে আর কোন গুলো বিকেলে। এর মধ্যেই অনেক ছেলে এসে বীথিকে বলে গেছে যে ও ওদের সাথে ঘুরতে যাবে কিনা। বীথি মুখের ওপর না করে দিয়েছে। হঠাৎই কে যেন পেছন থেকে বীথি বলে ডাকলো। বীথি পেছন ঘুরে দেখে সম্রাট ক্যাবলার মতো ভাব নিয়ে একটা গোলাপ ফুল নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। সম্রাটের বন্ধুরা এক ধাক্কা মেরে সম্রাট কে বীথির দিকে এগিয়ে দিলো। বীথি দেখলো সুমনা আর পেখম হাসতে হাসতে দু দিক দিয়ে ওকে কনুই দিয়ে ঠেলছে। এতো লোকের সামনেই সম্রাট দুম করে হাঁটু গেঁড়ে বসে গোলাপ ফুল টা বীথির দিকে বাড়িয়ে ধরতেই লজ্জায় রাগে বীথির মুখ লাল হয়ে উঠলো। কিন্তু ফুল টা বাড়িয়ে দিয়ে ক্যাবলার মতো বসেই রইলো সম্রাট, কিছুই বললো না। "কি রে তোকে কি শেখানো হলো বল সেগুলো। ওরম ক্যাবলার মতো বসে না থেকে বল রে"- সম্রাটের একটা বন্ধুর এই কথা শুনে হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠলো বীথি। সম্রাটের কিছু বলার আগেই বীথি নিজেও বসে পরে ফুল টা ওর হাত থেকে নিয়ে বললো "অনেক বলেছে ও, আর কিছু বলতে হবে না, আমি সব বুঝে গেছি"। বীথির কথা শেষ হতেই পাশ থেকে সবাই হাততালি দিতে শুরু করলো। বীথি তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে একবার দেখে নিলো আশেপাশে কোনো টিচার বা কারোর গার্ডিয়ান আছে কিনা। কাউকে না দেখতে পেয়ে একটু আস্বস্ত হলো বীথি। ও বললো "আমরা এখন ঘুরতে যাবো"। সম্রাটের একটা বন্ধু বলে উঠলো "আমরাও তো যাবো চলো তাহলে একসাথেই যাওয়া যাক"। ওরা সবাই একসাথে হাসাহাসি করতে করতে হাঁটতে শুরু করলো।

পর্ব তিন

মোট সাতটা স্কুল ওদের ঘোরা হয়ে গেছে। এখন বাজে ঘড়িতে দুটো। ওরা একটা রেস্টুরেন্ট এ ঢুকলো খেতে। সবার আবদারে সম্রাট খাওয়াতে রাজি হলো। আজ একবছর ধরে চেষ্টার পর ওর সাফল্য লাভ। সেলেব্রেশন তো হতেই হবে। বীথি প্রথমে আপত্তি করলেও পরে রাজি হতেই হলো। সম্রাটরা ক্লাস টুয়েলভে পড়ে। সম্রাট টিউশন পড়ায়, তাছাড়াও সম্রাটদের একটা বাংলা ব্যান্ড আছে। সেখান থেকে কিছু রোজগার হয়েই থাকে। তাই আর বেশি আপত্তি জানালো না বীথি। রেস্টুরেন্টে ভালোই ভিড়। অনেক্ষন বাইরে ওয়েট করে অবশেষে ওদের ডাক পড়লো। খাওয়া দাওয়া করে বেরোতে বেরোতে ওদের পৌনে পাঁচটা বেজে গেলো। আজকে রাত আটটা ন'টা হলেও অসুবিধা নেই বীথির। সাথে ফোন আছে আর এই একটা দিনই ওকে বন্ধুদের সাথে একা বেরোতে পারমিশন দেওয়া হয়।

এইবার সম্রাটদের চলে যেতে হবে। একটা পাড়ার ফাংশানে ওদের গাওয়ার কথা সন্ধ্যে বেলা। ওরা বিথীদেরও বললো ওদের সাথে যেতে। কিন্তু অতোদূরে গেলে বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হয়ে যাবে তাই সম্রাটদের বিদায় দিতেই হলো।

"এই তাহলে চল আমরা দুর্গাদেবী টা ঘুরে আসি। একটা বাস নিলেই পৌঁছে যাবো আধ ঘন্টায়। দুর্গাদেবী আগের বার ফার্স্ট হয়েছিল, ওদের পুজো কোনোদিন দেখিনি চ' এবার যাই।"- পেখমের কথায় ওরা দুজনেই রাজি হয়ে গেলো। ওরা রাস্তা চেনে না। ভুল করে তিনটে স্টপেজ পেরিয়ে নামলো| হেঁটে আসতে গিয়ে অনেকটা সময় চলে গেলো। পথে রানীবালা গার্লস স্কুল। "এসেই যখন পড়েছি চ' দেখেইনি"- বীথি বললো " দেখ গেটটা বেশ ভালোই সাজিয়েছে"।

রানীবালা স্কুলে তখন একটা প্রোগ্র্যাম হচ্ছিলো। ওরা তিনজনেই বেশ মেতে গেলো ওতে। এর মধ্যে বীথির ফোন বেজে উঠলো। মা ফোন করেছে। কোথায় আছে কি করছে কি খেয়েছে সারাদিনে তাড়াতাড়ি যেন বাড়ি চলে আসে এসব বলে ফোন টা রাখলো মা। বীথি বললো " এই চ' এবার বেরোই আমরা। সন্ধ্যে হয়ে গেছে। দুর্গাদেবী টা দেখেই সোজা বাস ধরে বাড়ি। আর কোত্থাও না"।

ওরা যখন দুর্গাদেবীর গেটে ঢুকতে যাবে এমন সময়-"এই বীথি এই সুমনা" শুনেই ওরা পেছন দিকে তাকালো। ত্রিপর্ণা ওর মা আর দিদির সাথে দাঁড়িয়ে ওদের ডাকছে। ত্রিপর্ণা দু বছর আগে ওদের স্কুলে ছেড়ে দুর্গাদেবীতে ভর্তি হয়েছে। তারপর থেকে কোনো যোগাযোগ নেই ওর সাথে| ত্রিপর্ণা কে দেখেই ওরা তিনজন ছুটে গেলো ওর কাছে। এরপর পুরোনো কথা এটা সেটা বলতে বলতে অনেকটা সময় আরও পার হয়ে গেছে। ত্রিপর্ণা কে বিদায় দিয়ে ওরা ঢুকলো দুর্গাদেবী বালিকা বিদ্যালয়ে। সন্ধ্যে হয়ে অন্ধকার নেমে এসেছে অনেক্ষন হলো। শীতটা ভালোই করছে এবার। শাড়ীর সাথে আজ আর কোনো গরম জামা চলে না তাই শীত সহ্য করেই চললো ওরা প্রতিমা দর্শনে। স্কুলের একতলাটা আলোয় ঝলমল করছে। মোটামুটি লোক রয়েছে এখনও।

ঠাকুর প্রণাম করার সময় একটা মেয়ে, মনে হয় ওই স্কুলেরই, এসে ওদের হাতে প্রসাদ দিয়ে গেলো। আসে পাশে লোক জনের সংখ্যা কমে আসছে। পেখম বললো " এই অনেক দেরি হয়ে গেলো রে চল এবার বেরোই, আমার দাদা অলরেডি পাঁচ বার ফোন করেছে"। সুমনাও পেখমের কোথায় সায় দিলে বীথি বললো-" তোরা একটু দাঁড়া আমার হাতে মিষ্টির রস লেগে গেছে, আমি একটু বাথরুম থেকে হাত টা ধুয়েই এখুনি আসছি।" সুমনা বীথির সাথে যেতে চাইলে বীথি জানিয়ে দিলো যে ও যাবে আর আসবে, ওর যাওয়ার দরকার নেই।

স্কুলটার হল ঘরটা আর প্রিন্সিপাল এর রুম এর পাশের দুটো ঘর সাজানো হয়েছে। তারপর থেকে আর সাজানো না হলেও আলো জ্বালানো রয়েছে পুরো একতলাতেই। পেখম আর সুমনা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো সাজানো ঘর গুলো।

বীথি লম্বা করিডোর পেরিয়ে চললো বাথরুমের দিকে হাত ধুতে। এদিকে এখন কেউ নেই। যেকজন আছে তারা সবাই হল ঘরের কাছে। বীথি হাঁটতে হাঁটতে অনুভব করলো শীতটা হঠাৎ খুব বেড়ে গেছে। মায়ের কথা শুনে একটা চাদর অন্তত আনা উচিত ছিল। ঠান্ডা হাওয়াটা যেন আরও বেড়ে গেলো। বীথি বাথরুমের কাছে পৌঁছতেই দেখলো বেসিনের সামনের আলোটা কম পাওয়ারের। কল টা খুলে ঠান্ডা জলটা হাতে পড়তেই বীথির সমস্ত শরীর কেঁম্পে উঠলো। হাত ধুয়ে ফেরার সময় হঠাৎ ওপরে যাওয়ার সিঁড়ির দিকে তাকাতেই বীথির মনে হলো সমস্ত আলো যেন কোনো একটা অন্ধকার দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে আর এগোতে পারছে না। কোন গভীর অজানা যেন লুকিয়ে আছে ওই অন্ধকারে। কিন্তু কি যেন আছে ওখানে। কি যেন বীথিকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। বীথি ওই অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে ওপরে উঠতে লাগলো।

 

শেষ পর্ব 

বীথি যেন কোন এক ঘোরের মধ্যে হাঁটছে, নিজের ওপর যেন ওর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। কিন্তু ও সব কিছুই বুঝতে পারছে। দোতলার নকশাটা একতলার মতনই। বীথি দোতলার বাথরুমের পাশ দিয়ে উঠে এলো। কনকনে ঠান্ডায় হাত পা যেন অবশ হয়ে আসছে। দোতলাটা দেখে মনেই হচ্ছে না নীচে এতো আলো, আজ সরস্বতী পুজো। হঠাৎ বীথি শুনতে পেলো কে যেন গুনগুন করে কি একটা গান গাইছে। একটু এগোতেই ও দেখতে পেলো একটা মেয়ে, ওর দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে বাইরের দিকে তাকিয়ে। বীথি আর একটু এগোতেই বুঝতে পারলো মেয়েটা স্কুল ড্রেস পরা।

"কে তুমি? এখানে এতো অন্ধকারে একা দাঁড়িয়ে আছো কেন?" বীথির প্রশ্নে মেয়েটা মুখ ফেরালে বীথি বুঝতে পারলো মেয়েটার বয়েস ওর মতনই হবে।

মেয়েটা বলতে শুরু করলো- "আমি এখানেই থাকি। একা। কিন্তু আমার একা থাকতে ভালো লাগে না একদম"।

মেয়েটার কথায় ভ্রূ কুঁচকে বীথি বলে উঠলো -" একা থাকো মানে? আর এখানে থাকো তুমি? মজা হচ্ছে আমার সাথে? কি করছো তুমি এখানে সত্যি করে বলো। আমি এক্ষুনি নীচে গিয়ে সবাইকে বলে দেব তোমার কথা"।

বীথির কথা শুনে মেয়েটা খিলখিল করে হেসে উঠলো। "তুমি বললেই সবাই বিশ্বাস করে নেবে তোমার কথা! কেউ করবে না। কোনোদিন করবে না"।

"দেখবে করবে কিনা? দাঁড়াও আমি এখুনি নীচে গিয়ে সবাইকে বলছি। এই বলেই বীথি দৌড়ে নীচে নেমে গেলো অন্ধকার ওই সিঁড়ি দিয়ে। কিন্তু সিঁড়ির শেষে এসেই আর এগোতে পারছে না বীথি, যতই এগোতে যাচ্ছে সামনে যেন কিসে ধাক্কা খাচ্ছে বারবার। বীথি শুনতে পাচ্ছে ওপর থেকে একটা পৈশাচিক হাসি ভেসে হাসছে। বীথি দৌড়ে ওপরে যেতেই দেখে করিডোর ফাঁকা, সেখানে কেউ নেই। আবারো বীথি নীচে নেমে বেরোনোর চেষ্টা করলো। বারবার ব্যর্থ হয়ে বীথি দোতলায় এদিক ওদিক দৌড়োতে লাগলো। ঐদিকের সিঁড়িটা দেখতে পেয়েও সেদিক দিয়ে নামতে গেলো বীথি। কিন্তু যেখানেই অন্ধকার নেই সেখানেই যেন বীথি কিছুতেই যেতে পারছে না। হঠাৎ বীথি দৌড়ে তিনতলা পেরিয়ে ছাদে চলে গেলো। ছাদের দরজা খোলা। কোনো স্কুলের ছাদের দরজা সাধারণত খোলা থাকে না। কিন্তু এখন বীথির ওসব ভাবার সময় নেই। বীথি দৌড়ে ছাদে প্রবেশ করলো। ছাদ থেকে পাইপ বেয়ে যদি কোনোভাবে নামা যায়। বীথি কার্নিশের কাছে যেতেই লক্ষ্য করলো মেইন গেট দিয়ে সুমনা আর পেখম হাত ধরে বেড়িয়ে যাচ্ছে। ওদের হাসাহাসি করতে দেখে বীথির মনে হলো ওরা যেন বীথির কথা ভুলেই গেছে। বীথি চিৎকার করে ছাদ দিয়ে ডাকতে লাগলো ওদের নাম ধরে। কিন্তু বীথির গলার আওয়াজ যেন নীচে অন্ধকারে ধাক্কা খেয়ে ওর কাছেই ফিরে এলো। নীচের ঝলমলে আলোর মাঝে সুমনা পেখম অবধি পৌঁছলো না বীথির চিৎকার। বীথি পেছন ঘুরতেই দেখলো সেই মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে ওর দিকে তাকিয়ে।

বীথি কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়লো। বললো-"কি হচ্ছে এসব আমার সাথে? ছেড়ে দাও আমায়। প্লিজ বলো না এসব কি হচ্ছে?"

মেয়েটি আবার হেসে উঠলো। তারপর গম্ভীর হয়ে বলা শুরু করলো-"আমি রূপসা। ঠিক তোমার মতনই আমি ওই অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে এসেছিলাম ঠিক পাঁচ বছর আগে। ওই সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আমাকে কেউ ডাকছিলো ইশারায়। অন্ধকারেও চিনতে অসুবিধা হয়নি আমার। ওটা ছিল সুলেখা, আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। ও তখন হল ঘরে আমার ব্যাগ গোছাচ্ছিল। কি করে তখন ও ওখানে আসবে! আমি ওকে দেখে কিছুক্ষন হতবাক হয়ে যাই, ও ওই অন্ধকারে এখানে কি করছে একা! আমি ঠিক দেখছি তো! ভয় পেয়েছিলাম বেশ তখন। নিজেকে একটু ধাতস্থ করতেই সুলেখা বলে উঠলো 'এই রূপ এদিকে আয় শিগগিরি, তোকে একটা সিক্রেট জিনিস দেখাবো বলেছিলাম না সকালে আয় এদিকে'। আমার মনে পড়ে গেলো হ্যাঁ ও তো কি একটা দেখাবে বলেছিলো সকালে। আমি সুলেখার কথা মতো অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে লাগলাম ওর পেছন পেছন। দোতলার ওপর উঠতেই হঠাৎ কেউ একটা পেছন থেকে আমার গলা চেপে ধরলো। আমি দুহাত দিয়ে কোনোমতে তার হাত ছাড়িয়ে পেছন দিকে তাকাতেই দেখি কাজল। কাজল তো অনেক্ষন হলো বেড়িয়ে গেছিলো। নাকি ও যায়নি! অপেক্ষা করছিলো স্কুলেই কোথাও? নিশ্চয়ই সময়ের অপেক্ষা করছিলো।

"কাজল তুই?"এই বলে পেছনে সুলেখা কে খুঁজতে পেছন ঘুরতেই সুলেখা এক সেকেন্ডও সময় না দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো আমার ওপর। ওই অন্ধকারে দোতলার সিঁড়িতে ধারালো একটা পেপার কাটার দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছিলো আমার সারা শরীরটা।

পরের দিন আমার মৃত দেহ খুঁজে পায় সবাই ওই দোতলার বাথরুমের পাশের সিঁড়ির শেষ ধাপে, রক্তাক্ত। কেউ নিশ্চয়ই কাজল আর আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের দিকে আঙ্গুল টা তোলেনি। কেই বা ভাবতে পারে সুলেখা তার রূপকে কিছু করতে পারে। আর কাজলকে তো ধরার মধ্যেই পরেনা। ওরা মনে হয় কেউই আমার খুনের কিনারা করতে পারেনি, আর এতদিনে আমার কথা ভুলেও গেছে সবাই। আমি তারপর থেকে অন্ধকার ছাড়া বেরোতে পারিনা জানো। কিছুতেই পারিনা। এই অন্ধকার কিছুতেই আমায় যেতে দেয়না। তাই তো আমি অপেক্ষায় ছিলাম এতদিন। রাতের বেলা তো স্কুলে কেউ আসেনা। তখন শুধু আমি থাকি, একা, এই অন্ধকারে। একদম একা"।

মেয়েটার কথা শুনে বীথির দম বন্ধ হয়ে এলো। মনে হলো শরীর যেন অবশ হয়ে আসছে। বীথি অনেক কষ্টে ঢোক গিলে বললো-"কীসের অপেক্ষা করছিলে তুমি ?"

“এমন একজনের যে অন্ধকারের সঙ্গী হবে আর আমি তখন অন্ধকার ছেড়ে আলোয় বেরোতে পারবো। যেতে পারবো আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের কাছে। ওকে তো আমায় জিজ্ঞেস করতে হবে ও কেন এমন করলো আমার সাথে? আমি তো এখনও জানিনা কারণটা। আমায় তো জানতে হবেই। কিন্তু অন্য কাউকে না পেলে যে অন্ধকার আমায় যেতে দেবে না। তুমি এবার থেকে অন্ধকারের সাথে থাকো। আমি আজ মুক্ত। আমি আজ যাবো, জানতে যাবো আমার দোষটা।" - এই বলে পেছন ফিরে হাঁটতে শুরু করলো রূপসা।

বীথি কিছু বলার আগেই রূপসা পেছন ফিরে আরও একবার খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। তারপর বললো-"তুমি চিন্তা করোনা। বাইরের লোকেরা বাহ্ আপনজনেরা কেউই ভুলতে বেশি সময় নেয়না। দেখোনা আমার কথা সবাই ভুলে গেছে। তোমার কথাও ভুলে যাবে, কেউ মনে রাখবে না। তুমি এখানেই এই অন্ধকারে বন্দি হয়ে থাকবে আজ থেকে। আবার যদি কেউ কখনো আসে তুমি সেদিন মুক্তি পাবে। কারণ অন্ধকার যে একা থাকতে চায়না। আর আমায় যে যেতেই হবে।" - এই বলে হাসতে হাসতে এগিয়ে যেতে লাগলো রূপসা ছাদের দরজার দিকে। দৌড়ে গিয়ে রূপসাকে আটকানোর চেষ্টা করলো বীথি। আর তখনই ছাদের দরজার চৌকাঠে হোঁচট খেয়ে...

পরের দিন সকালে ভোর বেলা পুলিশ এসে বীথির বডি নিয়ে গেলো।

দশ বছর কেটে গেছে। কাল সরস্বতী পুজো। এখন রাত ঠিক আঠটা। বীথি সেই অন্ধকার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায়। এতদিনে কেউ আসেনি আর অন্ধকারে এইদিকে। রাতের বেলা কাউকে অন্ধকারে এইদিকে আর আসতে দেওয়া হয়না। কিন্তু বীথির তো একজনকে দরকার। তা নাহলে তো ও সুমনা আর পেখমের কাছে জানতে যেতে পারবে না কেন তারা সেইদিন তাদের বন্ধুর দেরি দেখেও তার কোনো খোঁজ না করেই তাকে ফেলে চলে গেছিলো!

হঠাৎ বীথি শুনতে পেলো পায়ের আওয়াজ। ধীরে ধীরে ওর দিকেই এগিয়ে আসছে। তাহলে কি এতদিন পর অবশেষে বীথি.....


                                                                                                                               সমাপ্ত



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Thriller