Sheli Bhattacherjee

Tragedy Thriller

4.0  

Sheli Bhattacherjee

Tragedy Thriller

কিস্তিমাৎ

কিস্তিমাৎ

18 mins
3.8K


#কিস্তিমাৎ

#শেলী ভট্টাচার্য


বাংলা গানের সুরে গমগম করছে কলকাতার আকাশ বাতাস। কোথাও কোথাও আবার মাইকে ধ্বনিত হচ্ছে অঞ্জলির সময়সূচি বা পূজার মন্ত্রোচ্চারণ। সবমিলিয়ে খুশির আমেজে যেন সকাল সকাল নেয়ে ধুয়ে টিপটপ করে তৈরি হয়ে উঠেছে সিটি অফ জয়। দুর্গাষ্টমীর হুল্লোড়ে লুটোপুটি খেয়ে এ শহর এসময় চরম উচ্ছ্বসিত প্রাণবন্ত। তাই হয়তো দেশী হোক বা প্রবাসী, সবারই এসময়টাতে নিজের ঘরে ফেরার একটা আলাদা তাড়া থাকে। থাকে একটা আনন্দঘন উত্তেজনা। বাসের জানলায় বসে কথাগুলো ভাবছিল বছর একচল্লিশের কুন্তল সেনসুপ্ত। তার আজ মোটেই বাড়ি থেকে বেরোবার ইচ্ছা ছিল না। নেহাত নয় বছরের পুরানো ল্যাপিটার বেশ ভালো দাম পাচ্ছে এক খরিদ্দারের কাজ থেকে। তাই বেরোনো। খরিদ্দার ছেলেটি অবাঙালী, প্রবাসী। আজ দুপুরেই কলকাতা ছাড়বে। তাই অগত্যা এই অষ্টমীর সকাল মাটি করে শোভাবাজার ছুটতে হচ্ছে কুন্তলকে। আসলে এখন আর বড় স্ক্রিনের ভারী ল্যাপি নিয়ে কলকাতা পুনে যাতায়াত করাটা পোষায় না কুন্তলের। এমনিতে বৌ মেয়েকে নিয়ে বছরে দুবার কলকাতা ফিরতে বড় বড় ল্যাগেজ হয়েই যায়। তার উপর এটার চাপ আননেসেসারি বলে মনে হয় ওর। যেখানে একটা দামী স্মার্টফোনেই আজকাল সব কাজ হয়ে যায়, সেখানে এই ঢাব্বা ইলেক্ট্রনিকস আইটেম ব্যাকডেটেড। আর এভাবে ঘরের কোণে অবহেলার ধূলোয় গড়াগড়ি খেয়ে ল্যপিটার বয়সও বেড়ে যাচ্ছে দিন কে দিন। আধুনিকতায় পিছিয়ে পড়ছে ওটা টেকনোলজির দাঁড়িপাল্লায়। তাই ওটাকে ফেলে রাখাটা মূর্খামি। যা দাম পাওয়া যায়, তাতেই ছেড়ে দিতে হবে ভেবেই এবার কুন্তল কলকাতায় এসেছিল। তবে এই খরিদ্দার ওকে সেই অনুপাতে অনেকটা বেশিই তুষ্ট করেছে। এই আকর্ষণীয় অফারটা হাত থেকে যেতে দিতে চায়না কুন্তল। ফোনে জানিয়েছে খরিদ্দার ছেলেটি নাকি কলকাতা খুবই কম চেনে। দেখা করার জন্য শোভাবাজার মেট্রো সংলগ্ন একটা ল্যান্ডমার্ক দিয়েছে। সেখানেই লেনদেনের কাজ সম্পন্ন হবে। তাই বাড়ির পূজা ছেড়ে সকাল সকাল ল্যাপটপটা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে কুন্তল। শিগগির ফিরে এসে দুপুরেই আবার ফ্যমিলির সাথে বেরোবে দক্ষিণ কলকাতার দিকে ঠাকুর দেখতে। এতোবছর তো মেয়ের স্কুলের শীত আর গরমের ছুটিতেই কলকাতায় আসা হত। এ বছর শীতে ওদের একটা ট্যুর প্ল্যানিং হয়েছে। তাই প্রায় আট বছর পর ও কলকাতার পূজায় সামিল হতে পারছে। মেতে উঠতে পারছে সেনগুপ্ত বাড়ির পূজাতেও। যদিও সে পূজাতে এখন আর দেড় যুগ আগের মতো গমগমে আনন্দের আঁচ নেই। তখন ওর বাবারা তিনভাই ভিন্ন ঘর এক উঠোনে ছিলেন। বড় জ্যেঠু দুর্গাষ্টমীতে ঘটা করে মায়ের পূজা করতেন। সারা বাড়িটা লোকজন আর ধূপধূনোর গন্ধে মো-মো করত। আজ প্রায় বারো বছর হল জ্যেঠু মারা গেছেন আর তারপর থেকে সে পূজার বুড়ি ছুঁয়ে রেখেছে মেজ জ্যেঠু। বাড়িটির চৌহদ্দিতে কাঁটাছুরি চালিয়েছে অংশভাগের নিজস্বতা। তবু এখনও পূজার অঞ্জলি দিতে সেনগুপ্তবাড়ির সকল উপস্থিত সদস্যরা একসাথে হয় পূজাস্থানে। সেদিনের মতো সব রান্নাবান্না হয় মেঝ জ্যেঠুর ছাদে। সবার ক্ষনিকের ক্ষুদ্রসংখ্যার মাথার সমষ্টি আজও এইদিনটাকে অন্যদিনের চেয়ে আলাদা আঙ্গিকে রাঙিয়ে তোলে। বাসের জানলায় বসে কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই কুন্তলের পকেটে ফোনটা বেজে উঠল। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নাম্বারটা দেখে কুন্তলের মুখে একটা অল্পবয়সী কুটিল হাসি খেলে গেল। অত:পর ফোনের ওপার থেকে বাল্যকালের বন্ধু রাণা জানাল নবমীর রাতের প্ল্যানিং। সবরকম 'ম' - জাত শব্দসম্ভার সহযোগে ফুলটুস ফূর্তির আয়োজন করে রেখেছে বন্ধুরা। শুধু প্রবাসী বন্ধুর যোগদানের অপেক্ষা সেখানে। ফোনটা কান থেকে রাখতে রাখতে কুন্তলের চোখ পড়ল ওর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি অল্পবয়সী মেয়ের দিকে। মেয়েটির প্রায় অনাবৃত চিকণ কোমরের সরুরেখার মতো ভাঁজগুলো যেন তার যৌবনকে সোচ্চার করে রেখেছে। দুটোচোখ দিয়ে তা নির্লজ্জ্যভাবে চেটেপুটে নিয়ে কুন্তলের মাঝবয়সী মন হঠাৎই উত্তেজনায় টগবগিয়ে উঠল। রাণার বলা আয়োজনগুলোর কাল্পনিক স্বাদ আহরণের তৃপ্তি যেন ওকে দ্রুতবেগে আগের স্বভাবগত খোলসে ঢুকিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মনে পড়ে যাচ্ছে অতীতের অসভ্য আনন্দগুলোকে। এমন সময় কুন্তলের কানে পৌঁছালো কন্ডাকটারের তীব্র ঝংকার 'দমদম ... দমদম ... সামনে এসে দাঁড়ান'। কুন্তল সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। হাতঘড়িতে দেখল প্রায় সাড়ে দশটা বাজে। ছেলেটাকে বারোটা সময় দেওয়া হয়েছে। পূজা উপলক্ষ্যে যশোরোডে সকাল সকাল জ্যাম। ঠাকুর দেখার উচ্ছ্বাসে ভেসে যাচ্ছে সমস্ত কলকাতাবাসী। অষ্টমী বলে কথা। বাঁকড়া থেকে দমদম স্টেশন পৌঁছাতে তাই বাসটা প্রায় একঘন্টার বেশি সময় লাগিয়ে দিল। এখন নতুন ফ্ল্যাটটার জন্য প্রোমোটারের দমদমের বাড়িতে গিয়ে বুকিং এর টোকেন মানিটা দিয়েই মেট্রো ধরতে হবে। দমদম থেকে মেট্রোতে আশা করি আর বেশি সময় লাগবে না। মনে মনে ক্যালকুলেট করে নিল কুন্তল। তারপর পাদানিতে দাঁড়ানোর আগে পকেট থেকে ফোনটা বের করে বাঁ হাতে মুঠোবন্দী করল। বলা যায় না, ঠাকুর দেখার এই ভিড়ের মধ্যে হয়তো অনাবশ্যকীয় ভিড়ও মিশে আছে পকেট হাতড়াতে। তারপর বাস থেকে নামতে নামতেই কুন্তলের খেয়াল হল পেছনের ধাক্কাধাক্কিতে ওর বাঁ হাত থেকে মোবাইলটা পড়ে গেছে। তৎক্ষণাৎ নিজের দামী মোবাইল ফোনটাকে হুড়মুড় করে খুঁজতে শুরু করে দিল কুন্তল। এমন সময় একটি অল্প বয়সী ছেলে ওর হাতে তুলে দিল ওর মাত্র তিন মাস বয়স্ক দামী ফোনটাকে। কুন্তল মোবাইলটা হাতে পেয়ে একটা লম্বা স্বস্তির শ্বাস নিয়ে ছেলেটাকে উচ্ছ্বসিত হয়ে ধন্যবাদ জানাবে বলে ফিরে তাকাল। কিন্তু কই সে ছেলে? কুন্তল দেখল সে দ্রুত পায়ে ক্রমশ কুন্তলের থেকে দূরত্ব বাড়িয়ে চলেছে। ব্যাপারটা কেমন যেন লাগল ওর।


যদিও পরবর্তী দুমিনিটেই ওর কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল এ ঘটনার কার্যকারণ সম্পর্ক, যখন ভিন্ন রিংটোনে কুন্তলের হাতের ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠল। কতকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কুন্তল দেখল স্ক্রিনে অচেনা নাম্বার। কিছুক্ষণ স্তম্ভিত থেকে হাতের ফোনসেটটাকে বাহিরগতভাবে পর্যবেক্ষণ করার পর কোনো অমিল না পাওয়ায় ফোনটা প্রায় কেটে যাওয়ার মুখে রিসিভ করল কুন্তল। ফোনের ওপার থেকে ভেসে এলো এক অচেনা বলিষ্ঠ পুরুষ কন্ঠ "হ্যালো মি: কুন্তল সেনগুপ্ত বলছেন তো?"

"হ্যাঁ, আপনি কে?" বিষ্ময়মিশ্রিত কণ্ঠে রেসপন্স করল কুন্তল।

"আমি যেই হোই না কেন, সেটা আপনার কাছে এখন জানাটা ইম্পরট্যান্ট নয়। তাতে সময় নষ্ট হবে। আপনার কাছে এখন সময়ের চেয়ে মূল্যবান কিছু নয়।" অচেনা কণ্ঠস্বরে রহস্য স্পষ্ট। 

"মানে?"

"আপনার মেয়ে মিলিকে কিছুক্ষণ আগে এক নম্বরের কাছে শিখা টেলার্সের সরু পথ থেকে একটা গাড়ি কিডন্যাপ করেছে। ও আপনার বৌয়ের সাথেই ছিল।" ঠান্ডামাথায় জানাল সেই পুরুষ কণ্ঠ।

"হোয়াট?" বিষ্ময়, আতঙ্ক, উত্তেজনা সব মিলেমিশে একাকার কুন্তলের প্রশ্নে।

"হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন আপনি। আর একটা কথা মাথায় শুরু থেকেই গেঁথে নিন আপনি। আমার এক সাথী আপনার সাথে সেই বাসে ওঠার সময় থেকেই ছিল। আপনার সমস্ত গতিবিধি আমার সেই সঙ্গীর নজরাধীন। তাই কোনোরকম চালাকি না করে আমার কথাগুলো মন দিয়ে শুনুন।"

"এসব কী হচ্ছেটা কী? আমার ফোননাম্বারে এই রিংটোন কে ঠিক করল? আর মিলিকেই বা কে তুলল? কেন তুলল? আমি আপনাদের কী ক্ষতি ...।" কুন্তলের একগুচ্ছ হুড়মুড়িয়ে পড়া আলগোছ প্রশ্নগুলোকে মাঝপথে গুঁড়িয়ে দিয়ে কমান্ডিং টোনে বলে উঠল অচেনা কণ্ঠ "চুপ করুন। এখনি এতো উত্তেজিত হবেন না। ওটা আপনার নয়, আমার ফোন। তবে সেটদুটো একই বলে আপনার তা মনে হচ্ছে। বাস থেকে আপনার ফোনটা পড়ার আগে আপনাকে পেছন থেকে ধাক্কা দেওয়া ছেলেটিই ওটিকে বদলে আপনার হাতে তুলে দিয়ে গেছে। এবার মন দিয়ে শুনুন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নাগেরবাজারের কাছে একটা লোকেশনে এক লাখ টাকা নিয়ে চলে আসুন। বাকি শর্তের কথা ওখানেই হবে। কথামতো চলবেন। নইলে ...।"

"নইলে মানে? কী বলতে চান আপনি? আমার কাছে এখন এতো টাকা নেই।" কুন্তলের মেকি সাহসী কণ্ঠস্বর।

"ফোনটা দেখুন। হোয়াটসেপে একটা ছবি যাচ্ছে।"


কুন্তল এবার তাড়াহুড়ো করে হোয়াটসেপ চেক করে দেখল একটা লাল রঙের প্রিন্সেস ফ্রক পরা বাচ্চা মেয়ের ছবি। ছবিটা পেছন থেকে নেওয়া, যেখানে স্পষ্ট দৃশ্যমান যে বাচ্চাটি একটি কাঠের চেয়ারে বসে, যেখানে ওর হাত দুটো দড়ি দিয়ে পিছমোড়া করে বেঁধে রাখা আছে। তবে এই জামাটা কুন্তলের খুব চেনা। গত পরশুই ওরা শপিং করতে গিয়ে এটা কিনেছিল মিলির জন্য। এবার যেন কেমন একটা অস্থির লাগতে লাগল কুন্তলের সমস্ত শরীর। কেন কেউ ওর মেয়েকে এভাবে টার্গেট করেছে? এ শহরে বিগত দশ বছরে ওরা তো প্রায় থাকেইনি। কয়েকটা ছুটির সময় বাদে, আর বাকিটা সময় তো পুনেতেই ছিল। ওর মেয়ে মিলিকেও তো কেউ ফ্যামিলির বাইরে তেমন চেনে না। তবে হ্যাঁ, আজ সকালে ও যখন বাড়ি থেকে বেরচ্ছিল, তখন ওর স্ত্রী বনিও রেডি হচ্ছিল। বলছিল একফাঁকে গিয়ে মায়ের জন্য বানাতে দেওয়া ব্লাউজগুলো আনতে শিখা টেলার্সে যাবে। মিলিকেও কি নিয়ে বেরিয়েছিল তাহলে? আর যদি তা হয়ও তো, এসব পরিকল্পনার খবর তো ঘরের চারদেওয়ালের বাইরে যাওয়ার কথা নয়। অন্য কেউ কীভাবে তা ... ভাবতেই ফোনে আবার ভেসে উঠল সেই অচেনা নাম্বার।

"কী কুন্তলবাবু? জীবনপথেও কোনো মোক্ষম দাবার চাল খুঁজছিলেন নাকি? তা অভ্যাসবশত করতেই পারেন আপনি। ভালো দাবাড়ু বলে কথা।"

কী আশ্চর্য, লোকটা ওর দাবা খেলায় দক্ষতার কথাও জানে। অবাক হয়ে ভাবে কুন্তল। ফোনের ওপার থেকে আবার ভেসে আসে দৃঢ় কণ্ঠস্বর "আপনার কি ধারনা, আপনি একাই দাবার বাজিমাতের চাল দিতে পারেন? আরে মশাই, আরো অনেকেই কিস্তিমাৎ করতে জানে। শুধু সময় রূপী গুটিগুলোকে সাজাতে গুছাতে অপেক্ষা করতে হয়। তারপর এক এক করে ছক কষে জাল পাততে হয়। আর হ্যাঁ, ভালো কথা আপনার কাছের ওই 'সময়' শব্দটা কিন্তু এখন আমার ঘড়ির কাটায় টিকটিক করে মাপকাঠির দিকে এগিয়ে চলেছে। বেশি সময় নিলে বোধ হয় আপনার বিপদই বাড়বে। এমনিতে মিলিকেতো আমরা দারুণ দামে অনায়াসে পাচার করে দিতে পারব। আপনিতো জানেনই, এই দশ - এগারো বছর বয়সটা বড্ড আকর্ষণীয় অনেকের কাছে।" লোভাতুর গলায় বলে উঠল অচেনা কণ্ঠস্বর।

"শ্যাটাপ স্ক্রাউন্ডেল" গর্জে উঠল কুন্তল।

"শান্ত হোন কুন্তল সেনগুপ্ত। মাথা ঠান্ডা রাখুন। সবেতো সাদাকালো কর্ম ছকে গুটি সাজানো হয়েছে। খেলার এখনো অনেক বাকি আছে। মানছি আপনার সব গুটিকেই এখন এক এক করে আমার চতুর চালের গুটিগুলো খেয়ে নিচ্ছে। তবু একটা সুযোগ দিচ্ছি আপনার রাজার ইজ্জত বাঁচানোর। আধা ঘন্টার মধ্যে আমার কথামতো টাকা নিয়ে চলে আসুন।"

"কিন্তু এতো টাকা এখন আমার কাছে নেই।" নেতিয়ে পড়া গলায় বলে উঠল কুন্তল।


"প্রথমেই বলেছি, কোনোরকম চালাকি করবেন না। তাতে ফল ভালো হবে না।"

"আমি মিথ্যা বলছি না। আপনার যে সঙ্গী আমার কাছেপিঠে আছে, তাকে বলুন আমার কার্ড চেক করে নিতে। আমি তার হাতে তুলে দিচ্ছি।"

"মি: সেনগুপ্ত আপনার মগজাস্ত্রকে নিরস্ত্র করুন। আপনি যদি মনে করে থাকেন যে, আপনি এভাবে আমার নজরাদারীকে ধরে ফেলবেন। তো ভুল ভাবছেন। আপনার রুপম সোসাইটিতে আলিশান ফ্ল্যাট বুকিং এর পরিকল্পনাটা আমাদের জানা আছে। আর আজ দমদমে প্রডিউসারের বাড়িতে যে আপনি টোকেন মানি দিতে এসেছেন, তাও জানা আছে। এই ফ্ল্যাট বুকিং পারপাস আপনার সবকটা একাউন্ট মিলে এই মুহূর্তে কতটা ক্যাশ টাকা আছে, তা আন্দাজ করাটাও আমাদের পক্ষে খুব একটা কঠিন কাজ নয়। যাইহোক, এতো বাক্যব্যয় করা আমার পছন্দ না। আপনার কাছে যে ফোন আছে, পাঁচ মিনিটের মধ্যে সেখানে আমি একটা ঠিকানা পাঠিয়ে দিচ্ছি। চলে আসুন ক্যাশ নিয়ে। আর হ্যাঁ, নজরে আছেন আপনি। মনে রাখবেন, একটু বেচালকুচালে আপনার ছোট্ট কন্যাসন্তানটি বারোয়ারি হয়ে যেতে পারে।"


ফোনটা অফ হয়ে যেতেই কুন্তলের বোধগম্য হল যে, ওর ব্যাগ মধ্যস্থ পঁচিশ হাজার টাকার কথাটাও যারা জানে, তাদের সাথে বাক্যব্যয় করাটা সত্যি সময়ের অপচয় করা ছাড়া কিছুই নয়। তাও কুন্তলের চোখদুটো অসহায়ভাবে এদিকওদিক ভিড়ের মধ্যে একবার দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিল। উৎসবমুখর শহর আনন্দের ব্যস্ততায় হাবুডুবু খাচ্ছে তখন। সেখানে কারো তীক্ষ্ণ নজর খুঁজে বের করা বড্ড কঠিন। তারপর যথারীতি হতাশ হয়ে কুন্তল ঢুকল এটিএমে। টাকাগুলো ল্যাপটপের ব্যাগে ঢুকিয়ে এটিএম থেকে বেরতেই, ফোনে দেখল লেখা আছে পরবর্তী গন্তব্যের ঠিকানা। আর নিচে লেখা আছে, বাসে উঠে পড়ুন। কুন্তলের বুঝতে অসুবিধা হল না যে ওর উপর নজরদারীর কৌশলী দৃষ্টির ক্ষুরধার কতখানি। অতঃপর ক্রীতদাসের মতো ও পা বাড়াল বাসের পাদানিতে। কিন্তু তখনও কুন্তলের কাছে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত যে কিছুক্ষণের মধ্যে ওর সাথে আরো কী কী হতে চলেছে।


কিছুক্ষণের মধ্যেই কুন্তল নাগেরবাজারের আগের স্টপে নামল বাস থেকে। বাসের থিকথিকে ভিড়ের মধ্যে কুন্তলের সন্দিগ্ধ চোখ বহুবার চেষ্টা করেও সেই পাহারাদারকে খুঁজতে ব্যর্থ হয়েছে। শেষে সেই ঠিকানা খুঁজতে গিয়ে ওকে নাগেড়বাজারের দিকে বেশ কিছুটা হেঁটে রাস্তার বিপরীত ফুটের একটা নিরিবিলি কাঁচা রাস্তার নোংরা গলিতে ঢুকতে হল। আর তখনই একজন পেছন থেকে ওর কোমরের কাছে কিছু একটা ঠেকিয়ে ধরে বলল "বাঁদিকে মোড় নিন।" তারপর একরকম ঠেলেই ঢুকিয়ে দিল একটা বাড়ির দরজা দিয়ে। বাড়িটাতে চোখ বুলিয়ে কুন্তলের বাসযোগ্য বাড়ি বলে মনে হল না। একটা পুরানো আমলের ভাঙাচোরা বাড়ির কাঠামো দাঁড়িয়ে আছে যেন নড়বড়ে শরীরে। তখন কোথা থেকে একটা ভারী কণ্ঠস্বরে নির্দেশ এল 'ডানদিকের ঘরটাতে ঢুকুন।' কুন্তল সন্ত্রস্ত নজরে এদিকওদিক দেখে দরজা ঠেলে ঢুকল নির্দেশিত ঘরে। আর ঘরের ভেতরে চোখ যেতেই চমকে উঠল কুন্তল। একি? এ কেমন ঘর। সারাঘরের দেওয়াল জুড়ে প্রায় নগ্ন নারীদের বিভিন্ন আকর্ষণীয় ভঙ্গিমারত বড় বড় পোস্টার সাটা রয়েছে। আর ঘরটিতে রাখা একটি কাঠের চেয়ারে সাজগোজ করে বসে আছে এক মহিলা। তবে সে কুন্তলের দিকে পেছন দিক করে বসে রয়েছে, তাই তার বয়স আন্দাজ করাটা মুশকিল। এসব দেখে কুন্তলের মনের আশঙ্কা আরো দৃঢ় হল। তবে কি সত্যিই কিডন্যাপাররা বড় কোনো পাচার চক্রের সাথে যুক্ত? আর টাকা না দিলে ওর মেয়েকেও ওরা... ভাবতে ভাবতে কুন্তলের সারাটা শরীর ঘর্মাক্ত হয়ে উঠল। চেয়ারে বসা মহিলা ততক্ষণে ছলনাময়ী হাসি হেসে বলছে 'কেমন আছো কুন্তলদা?'

গলাটা যেন খুব চেনা পরিচিত মনে হল কুন্তলের। কিন্তু ওর সমস্ত চিন্তাজগত তখন হাজার দুশ্চিন্তা আর টেনশনের জাঁতাকলে ফেঁসে আছে। কিছুতেই যেন সেগুলোকে বশে আনতে পারছে না এককালীন যাদবপুরের ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট কুন্তল সেনগুপ্ত। এমন সময় ফোনটাতে ম্যাসেজ টোন বেজে ওঠাতে খাঁচায় বদ্ধ পাখির ডানার মতো কেঁপে উঠল কুন্তলের বুকের বাঁদিকটা। পকেট হাতড়ে ফোনটা বের করে দেখল হোয়াটসেপে লেখা আছে 'সহাস্যবদনে মহিলার হাতে টাকাটা তুলে দিন। মাথায় রাখবেন, আপনার মুখে হাসিটা থাকা চাই। নইলে কিন্তু ...।

বিরক্তিতে কুন্তলের মাথায় একগুচ্ছ কথা তখন ঘোরপাক খাচ্ছে। কিডন্যাপার কি আদৌ মানসিকভাবে সুস্থ? এসব বলার মানেটা কী? নাকি নিজে সামনে না এসে এই মহিলার মধ্য দিয়েই টাকার লেনদেনটা সারতে চাইছে। কিন্তু, তাতে ও কিকরে শিওর হবে যে, ওর মেয়েকে ওরা ছেড়ে দেবে। থমকে দাঁড়িয়ে একমনে ভাবছিল কুন্তল কথাগুলো। ঠিক তখনই হাতের মুঠোয় ফোনটা বেজে উঠল। ওপার থেকে ভেসে এলো "কী ভাবছেন এতো? মেয়ের কথা?"

"না মানে। আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার মেয়ে কোথায়?" কুন্তলের কিংকর্তব্যবিমূঢ় প্রশ্ন।

"আপনি আমাদের বাধ্য হলে মিলিকে ঠিক সময়ে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হবে। আপনাকে যেটা বলা হচ্ছে সেটা করুন।" ফোনের ওপারের কড়া নির্দেশ।

"আমি এক লাখ আনতে পারিনি। মানে এটিএমের কিছু রেসট্রিকশন আছে তো। তাই সবমিলিয়ে নব্বই হাজার ..." কুন্তলের অসহায় কথাটা মাঝপথে থেমে গেল একটা বাচ্চার করুণ কণ্ঠস্বরে। 'ছেড়ে দাও আমায়'।

কুন্তলের অস্থিরতা তখন চরমে। কিন্তু এটুকু বুঝল এটা মিলির গলা নয়। তবে কি আরো বাচ্চাকে এখানে ওরা ... কুন্তলের ভাবনার জালকে ছিন্নভিন্ন করে গর্জে উঠল অচেনা কণ্ঠ।

"আপনার কি মনে হচ্ছে, আপনার কাছে এ অবস্থায় আমার কথা না শুনে অন্যকোনো উপায় আছে? যখন নেই তো, যা এনেছেন তাই হাসিমুখে মহিলার কাছে দিয়ে আসুন" কৌতুকের প্রলেপ সে কণ্ঠস্বরে।

কোনো উত্তর না দিয়ে চোয়ালদুটো শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল কুন্তল। ওপার থেকে আবার ভেসে উঠল "মনে থাকে যেন, হাসিমুখে টাকাটা দেবেন"।

ফোনটা বন্ধ হওয়ার পর উপায়হীন চোখে তাকিয়ে দেখল কুন্তল মহিলার দিকে। আর কাঁধে রাখা ল্যাপটপের ব্যাগ থেকে বের করল টাকার নোটগুলো। তারপর সেগুলো নিয়ে মহিলার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই কুন্তলের পায়ের তলার মাটি কেঁপে উঠল। এ কাকে দেখছে ও? তবে কি প্রতিশোধ নিতেই ...

"হাসিমুখে দেওয়ার কথা ছিল" কুন্তলের ভাবনাকে নির্বিকার মাড়িয়ে হেসে বলে উঠল কুন্তলের এককালীন অতিপরিচিতা সেই তরুণী। কুন্তলকে বাধ্য ছেলের মতোই করতে হল কাজটা। অতঃপর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই কুন্তলের পকেটে রাখা ফোনে এলো হোয়াটসেপ ম্যাসেজ 'ফোনটা এখানে রেখে আর কোনো দিকে না চেয়ে বাড়ি চলে যান। খেলা শেষ। ফলাফলটা বাড়িতে গিয়েই পাবেন। তবে সিধা বাড়িতেই যাবেন।'


কুন্তলের হাতে আর কোনো উপায় নেই। ফোনটা রেখে সুবোধ বালকের মতো ও বেড়িয়ে এলো ওই বাড়ি থেকে। তারপরই পুরানো ঘটনা মধ্যস্থ হিসাবনিকাশ ছিন্নভিন্ন করে মনে হঠাৎ একটা তাড়া অনুভব করল কুন্তল। বাড়ি ফেরার তাড়া। মিলিকে দুচোখ ভরে দেখার তাড়া। দুচোখের পর্দায় ঘনঘন ভেসে উঠতে লাগল নিজ আত্মজার কোমল মুখটা। কানে বাজতে লাগল আদরভরা ভরসা রাখা সেই ডাকটা 'পাপ্পা'। তারপর দ্রুত পায়ে বড় রাস্তায় উঠেই বাস ধরল কুন্তল। বাড়ি ফেরার পথটা যেন অনাবশ্যক লম্বা মনে হচ্ছিল কুন্তলের। বাঁকড়াতে নামতেই একটা বাচ্চা ছেলে ওর হাতে একটা ফোন দিয়ে বলল "একজন আমায় এটা আপনাকে দিতে বলল।"


কুন্তল ফোনটার দিকে চেয়ে দেখল, স্ক্রিনে ওর আর মেয়ের আদরঘন ছবি। আর ভেবে অবাক হল যে, এই কঘন্টার উত্তেজক টানাপোড়নে ও নিজের ফোনের কথা একেবারে ভুলেই গিয়েছিল। সমস্ত মাথা জুড়ে একটা চিন্তা যেন তাড়া দিচ্ছিল ওকে ... শীঘ্র নিজের বাড়িতে ফিরতে হবে। কিন্তু তখনও কুন্তলের জানা ছিল না যে কী ভবিতব্য ওর নিজের বাড়িতে অপেক্ষা করে রয়েছে।


সেনগুপ্ত বাড়ি বাসস্ট্যান্ড থেকে মিনিট চারেকের হাঁটাপথ। দ্রুত পায়ে তা পেড়িয়ে যখন বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে কুন্তল, তখন ভেতরের সব আত্মীয়স্বজন হঠাৎ ওর দিকেই ফিরে তাকাল। যেন ওর আসার অপেক্ষাই করছিল সবাই। কুন্তলের চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছিল মিলিকে। আর চারদিকের চোখগুলো এক অদ্ভুদ দৃষ্টিতে তখন মাপছিল ওকে। মিলিকে দেখেই একছুটে ওর দিকে হুড়মুড়িয়ে পড়ল কুন্তল। আর তৎক্ষণাৎ বনি এসে মেয়েকে একরকম টেনে হিচড়ে সরিয়ে নিল ওর কাছে থেকে। কুন্তল খেয়াল করল বনির ভেজা চোখে তীব্র ঘৃণার হুঙ্কার। কিছু বলতে যাওয়ার আগেই বনি একগুচ্ছ ছবি ছুঁড়ে দিল কুন্তলের মুখের উপর। আর গর্জে উঠল "আর কত নীচে নামবে তুমি? বিয়ের পর থেকেই একটু একটু করে বুঝেছিলাম তোমার নোংরা মনটাকে। আর অনুভব করেছিলাম তোমার নোংরা চাহিদার চোখদুটোর নজরকে। বেশ কয়েকবার কলকাতা এসে টেরও পেয়েছিলাম তোমার বাল্যবন্ধুদের সাথে সময় কাটানোর উত্তেজনাটা আদতে কী? তাও ভেবেছিলাম, মেয়ে বড় হতে হতে শুধরে যাবে। কিন্তু বলে না কুকুরের লেজ বারো বছরেও সিধা হয় না। তুমিও তাই আজও ফোন সুইচ অফ করে নোংরা ফূর্তিতে মেতে উঠেছিলে সকাল সকাল ...'

কুন্তল ততক্ষণে উল্টেপাল্টে দেখে নিয়েছে ওর দিকে ছুঁড়ে দেওয়া ছবিগুলো। ওর আর বুঝতে বাকি নেই যে, ওর ওই ঘরে থাকা সময়টাতে কিভাবে ওকে ক্যামেরা তাক করেছিল। সমস্ত পরিস্থিতির ছবিগুলোকে অসাধারণ দক্ষতায় অশালীনতার ইঙ্গিত রেখে তোলা হয়েছে। কোথাও ওর সেই পরিচিতার মুখ নেই, আছে দেহের পশ্চাৎভাগ। আর আছে কুন্তল সেনগুপ্তের সম্মুখদিক, পা থেকে মাথা অবধি। ছবিগুলোতে পেছনের দেওয়ালের দৃশ্যের সাথে সম্পূর্ণ নগ্ন লাগছিল কুন্তলের মানসম্মানকেও। ... সর্বোপরি, এক বাজারি পরিবেশে এক মহিলাকে হাসিমুখে টাকা দেওয়ার দৃশ্যটি আরো সাহায্য করেছিল কুন্তলকে খোলামেলাভাবে বেয়াব্রু হতে। তবু একবার বনির দিকে অসহায়ভাবে তাকিয়ে বলে ওঠার চেষ্টা করল কুন্তল "তুমি যা ভাবছো, তা নয় বনি। আমায় কেউ বলেছিল মিলিকে নাকি ... "

"তোমার ওই পাপ মুখে আমি আমার মেয়ের নামটা শুনতে চাই না আর কুন্তল। তুমি ওর ধারেকাছেও আসবে না কোনোদিন। নরকও বোধ হয় শুদ্ধ তোমার চেয়ে।" ঘৃণাসূচক কথাগুলো তাচ্ছিল্যভরে নিজের স্বামীর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে মেয়ের হাত ধরে ভেতরের ঘরে চলে গেল বনি। চারদিকে চোখ বুলিয়ে কুন্তল বুঝল সবার ঘৃণাভাজন হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ও এই মুহূর্তে। অবিশ্বাসী নজরগুলোতে ঘৃণার ছাপ স্পষ্ট। শুধু এককোণে দাঁড়িয়ে কাঁদছে ওর মা। এরপর মাথা নিচু করে বেরিয়ে যেতেই কুন্তলের চোখ পড়ল হাতে রাখা শেষ ছবিটার উপর। সেখানে বড় বড় করে লেখা আছে 'কিস্তিমাৎ'।


************************


কিছুদূরের আড়ালে তখন দাঁড়িয়ে রয়েছে জীবন নামক দাবার ছকে চাল দেওয়া এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিত্ব, টিউলিপ। সম্পর্কে কুন্তলের বড় জ্যেঠার নাতনি হয় সে। ওর বিজয়ী চোখদুটোতে তখন চোদ্দ বছর আগের দৃশ্য ফুটে উঠেছে। ঠিক এমনি এক অষ্টমীর পবিত্র সকালে বাড়ি জুড়ে পূজার আয়োজনের তোড়জোড় চলছিল। সকাল সকাল স্নান সেরে এসে নতুন জামা পড়ে দাদুর দালানে বসে টিউলিপের এই দিনের প্রিয় কাজ ছিল পদ্ম ফোটানো। গোলাপি রঙের কুড়িগুলোকে প্রথমে একটু ফাঁপিয়ে নিয়ে আলতো হাতে ফুটাতে হত এক একটা পাপড়িকে। মাকে দেখে দেখে শিখে গিয়েছিল টিউলিপ। মা খালি বলতেন 'আলতো হাতে কর, নইলে পাপড়ি মুষড়ে আলগা হয়ে যাবে।' কিন্তু সেদিন যে সবার অলক্ষ্যে ওর মনের কোমল বিশ্বাসের পাপড়িগুলোকে কেউ পিষে দিয়েছিল, ওকে আলগা করে দিয়েছিল জীবনস্রোতের মূলধারা থেকে ... তা কারো নজরেই পড়ে নি। আর ছোট্ট বারো বছরের টিউলিপও কাউকে বলে উঠতে পারেনি সেদিনকার সেই নিষিদ্ধ কথাগুলো। হ্যাঁ, ঠিক এই শব্দেই তো ওকে বুঝিয়েছিল ওর কুন্তল মামা। এগুলো বড়দের ব্যাপার। আমি তোকে এভাবে ছুঁয়ে আজ বড় করে দিলাম। কাউকে বলবি না, নিষিদ্ধ ব্যাপার এগুলো। বললে তোকেই সবাই খারাপ বলবে। বলবে, বাচ্চা মেয়ে বড়দের কথা নিয়ে কথা বলছে। ঘৃণা করবে তোকে। এসব শুনে দেওয়াল ধরে সিটিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ছোট্ট টিউলিপ। কাকেই বা কী বলত ও? ওর সেই প্রিয় মামা, যে কিনা ওকে দাদুবাড়ি এলেই বাইকে করে গায়ে গা লাগিয়ে এয়ারপোর্ট ঘুরিয়ে আনে, ফুচকা খাওয়ায়, বেলুন কিনে দেয়, দাবা খেলা শিখিয়ে ওকে দারুণ এক দাবাড়ু গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখায় ... সেই মামাই কিনা ওকে অষ্টমীর অঞ্জলির পর ছোটো দাদুর নতুন তৈরি হওয়া দোতলার ঘরে নিয়ে গিয়ে আদরের নাম করে নোংরা খেলায় মেতেছিল। মামার মতো একটা আদ্যোপান্ত ভদ্র ব্রিলিয়ান্ট ছেলের বন্ধ দরজার আড়ালের রূপটাকে তো কেউ বিশ্বাসই করবে না। আর টিউলিপ তো তখন সঠিক অর্থে বুঝতেও পারেনি, ওর সাথে কতটা খারাপ কিছু হয়েছিল। শুধু একটা গা ঘিনঘিন করা মনোভাব নিয়ে ছুটে চলে এসেছিল ও সেখান থেকে। ওর মাথাটাকে জাপটে ধরেছিল না বুঝে ওঠা কথা আর কাজের মধ্যস্থ জটিলতার প্যাঁচ। দাদুর দালানে তখন যজ্ঞের ধোঁয়ায় আবছা দুর্গা মায়ের মুখ। 

সেদিন থেকে দাদুবাড়িতে আসার নামেই আড়ষ্ট হয়ে থাকত টিউলিপ। তবে সঠিক ব্যাপারটা ও বুঝেছিল তারও প্রায় দুবছর পর, দূরদর্শনের পর্দায় একটা সিনেমার ঘৃণাসূচক দৃশ্য দেখে। জেনেছিল এসেবের নাম 'সেক্সুয়াল বা ইনডিসেন্ট এসল্ট'। সেদিন সারাটাদিন কেঁদেছিল টিউলিপ। ততদিনে ওর থেকে প্রায় চোদ্দ বছরের বড় ওর প্রিয় মামাটির বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। সে বিয়েতে গিয়েও এককোণে আড়ষ্ট হয়ে বসেছিল টিউলিপ। শুধু দাদু বাড়ির ভাড়াটে বাপ্পাদা এটা খেয়াল করে ওর মুড ঠিক করার বারবার চেষ্টা করেছিল সেদিন। এমনকি কারনও জিজ্ঞাসা করেছিল। কিন্তু টিউলিপ কাউকে বলেনি সে কারন। সত্যি বলতে কী বলতে পারেনি সে। তারপর তো ওর দাদু মারা যাওয়ার পর ও বাড়িতে যাওয়া প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিল ওর। আর কুন্তলও ভালো মাইনার চাকরী পেয়ে চলে গিয়েছিল ভিন্ন রাজ্যে। এই পূজাতে মেজদিদার শরীরের অবস্থা ভালো না হওয়ায়, ওদের সবার আবার এ বাড়িতে আসা হল প্রায় বছর এগারো পরে। আর এসেই কুন্তলের সাথে দেখা হতে সারাটা শরীরের রক্ত ফুটছিল টিউলিপের। ও এখন আর সেই ছোট্ট মেয়েটি নেই, ছাব্বিশ বছরের এক পরিণত বুদ্ধিসম্পন্ন মেয়ে। এ বাড়িতে আসার পথে অনেক বছর পর দেখা হয়েছিল বাপ্পাদার সাথেও। 'ওরা এ বাড়ির পূজায় কেন আসেনি' বলে টিউলিপ যখন প্রশ্ন তুলেছিল, তখনই ও জেনেছিল কুন্তলের আরেক পাপের ইতিহাসের কথা। সে বিষয়ে বিভিন্ন কথাবার্তার মধ্য দিয়ে ও জানতে পেরেছিল যে, বাপ্পাদাদের এক যুগ আগে এ বাড়ি ছাড়ার কারনটা। বাপ্পাদার দিদির সাথে কুন্তল সেনগুপ্ত রীতিমতো প্রেমের অভিনয় করে তার সর্বাঙ্গ ব্যবহারের কয়েক বছর পর জানিয়েছিল, ওর পক্ষে এ বিয়ে করা সম্ভব নয়। বাপ্পারা নিচু জাতের হওয়ায় সেনগুপ্ত বাড়ির কেউ এ সম্পর্ক নাকি মেনে নেবে না। কিন্তু আসল কারনটা বাপ্পা বুঝেছিল, তার তিনমাসের মধ্যেই কুন্তল সেনগুপ্তর হাসিমুখে বিয়ের পিড়িতে বসার দৃশ্য দেখে। কারন ছিল হয়তো, পাত্রীর বেশ চোখে পড়ার মতো সৌন্দর্যময়ী ব্যক্তিত্ব। কিন্তু তার পরে পরেই বাপ্পার দিদি নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল। বাধ্য হয়েছিল এ সমাজের সুস্থ জীবনপ্রবাহ থেকে মুখ লুকাতে। বাপ্পার মুখে কথাগুলো শোনার পর টিউলিপের যেন মনে হল, বাপ্পার ঘৃণাগুলোর সাথে কোথাও ওর ভেতরের ঘৃণাগুলোর খুব মিল পাচ্ছে। এমনিতে ছোটো থেকে দাদুবাড়িতে যখনি আসত, বাকি ঘরের ভাইবোনেদের সাথে দুবছরের বড় বাপ্পাও ছিল ওর খেলার সাথী। ওর মন ও চরিত্রগত পবিত্রতা সম্বন্ধে ধারনা ছিল টিউলিপের। এমনকি কখনও কখনও বাপ্পাদার আচরণে টিউলিপের এমনও মনে হত যেন, ওকে অন্য এক ভালোলাগার দৃষ্টিতে দেখে বাপ্পা ওরফে নব্যেন্দু দাস। তারপর কতকটা পরিকল্পনাবিহীনভাবেই টিউলিপ বলে দিয়েছিল বাপ্পাকে প্রায় দেড় যুগ আগে ওর সাথে হওয়া ঘৃণ্য ঘটনাগুলোর কথা। সেগুলো শুনবার সময় বাপ্পার স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে উঠল, কুন্তলের বিয়ের দিনে ঝলমলে বিয়েবাড়ির এককোণে বসে থাকা টিউলিপের আড়ষ্ট দৃশ্য। অতঃপর প্রতিশোধের মিলিত আগুনে ঝলসে উঠল কয়েকটা মিলিত দাবার চালের মতোই পরিকল্পনা। এই পুরো ব্যাপারটাকে সাজাতে অবশ্য বাপ্পার দুই বন্ধু খুব উপকার করেছিল ওকে। ওদের মধ্যে একজন বাপ্পার দিদির খোঁজ জানত এতো বছর ধরে। আর সেই সূত্রে বাপ্পাও যেতো ওর দিদির কাছে। কিন্তু গোপনে। সমাজের নিয়মের বাইরে একবার অসতর্ক পা ফেললে, তাকে যে আলোর জীবনে ব্রাত্য হয়ে যেতে হয়। বাপ্পার সেই বন্ধু জানিয়েছিল যে, নাগেরবাজারের কাছে ওদের একটা পুরানো পরিত্যক্ত বাড়ি আছে। আর তারপরেই পরিকল্পনা হল, এক একটা চালে একটু একটু করে অসহায় করে কুন্তল সেনগুপ্তকে অষ্টমীর দিন সেখানেই নিয়ে গিয়ে তুলতে হবে। টিউলিপই কুন্তলের ল্যাপটপ বিক্রি করার তাড়ার কথা জেনে, বাপ্পাকে জানিয়েছিল। আর বাপ্পা গলা বদল করে ভাঙা ভাঙা বাংলা বলে সেজেছিল ফোনের ওপারের অবাঙালী খরিদ্দার। তারপর সকালে মামির অর্থাৎ কুন্তলের বৌ বনির টেলার্সে যাওয়ার ব্যাপারটা কতকটা কাকতালীয়ভাবেই টিউলিপকে ওর মা জানিয়েছিল। ছেলের আলিশান ফ্ল্যাট বুকিং এর টোকেন মানির প্রসঙ্গে তো কুন্তলের মাই বলে ফেলেছিলেন। সবমিলিয়ে পরিকল্পনার অঙ্কে দুই এ দুই এ চার হয়ে যাচ্ছিল। ধর্মের কল বাতাসে নড়েই। গতকাল যখন কুন্তলের মেয়ের নতুন প্রিন্সেস ফ্রকটা কিছুক্ষণের জন্য কৌশলে সরিয়ে বাপ্পার হাতে তুলে দিয়েছিল টিউলিপ, তখন ওর বুঝতে বাকি ছিল না যে, সেই ফ্রকটা কুন্তলের প্রথম সন্তানের গায়ে উঠতে চলেছে। ওই জামা পড়িয়ে ওর পেছন থেকে একটা ফটো তোলার জন্য। যেখানে ওর হাতদুটো পিছমোড়া করে বাঁধা থাকবে। আর সেই ছবি দেখেই তো কুন্তল ভয়ে ভয়ে কিডন্যাপারের বাধ্য ছেলের মতো এক এক করে কাজ করে যাবে। সম্মান বা বিশ্বাস কখনোই অর্থের মূল্যায়নে স্থির করা সম্ভব নয়। তবুতো এক্ষেত্রে কিডন্যাপিং প্রমাণে কিছু অর্থমূল্য রাখতেই হয়। আর অসহায় জানোয়ারটাকে নিজের সামনে পদানত হতে দেখে ভেতরে ধিকধিক করে জ্বলতে থাকা আগুনটা হয়তো একটু থিতুবে বাপ্পার দিদির। এসব বুঝতে পেরেও, টিউলিপ বাপ্পার সামনে সেসব কথার বিশ্লেষণ আর তুলে ধরতে চায় নি। হয়তো বাপ্পাও বহুদিন পর নিজের দিদিকে প্রতিশোধ নিতে দেখে খুশি হবে। সে খুশির আগাম উচ্ছ্বাস বাপ্পার নীরব চাউনিতে ঝলকাচ্ছিল। 


অতঃপর অষ্টমীর সকাল থেকে কুন্তলের পিছু করতে থাকে বাপ্পার এক বন্ধু। সেই বাস থেকে নামার পথে বাপ্পার কেনা একইরকম সেটটা হাতবদল করে দিয়েছিল কুন্তলের ফোনের সাথে। আর বাপ্পা থেকে যায় ভাঙাচোরা বাড়িটির লোকেশনে। একটা ফোনে কুন্তলের সাথে ক্রমাগত যোগাযোগ করতে থাকে ভারী গলায়। আর সমস্ত পরিকল্পনামাফিক কুন্তল যখন ওই বাড়িতে ঢোকে, তখন ওর বড় মেয়ের গলায় বলা কথাগুলোর রেকর্ড শোনানো হয় ওকে। তাতেই আদতে ভয় পেয়ে গিয়েছিল ওর নিজের বাবা। তবে অন্য সন্তানের নিরাপত্তার খাতিরে। 


সবমিলিয়ে টিউলিপ আর বাপ্পার পরিকল্পিত ছকে কুন্তলকে একরকম বাধ্য করতে পেরেছিল ওরা।

টিউলিপের মনে পড়ে যাচ্ছিল কুন্তলের সাবধানবাণীগুলো 'আজকের কথা কাউকে জানাস না কিন্তু। তাতে তোকেই সবাই খারাপ বলবে। পূজার আনন্দ ছেড়ে কোন আনন্দ পেতে আমার ঘরে এসেছিলি, এটাই ভাববে সবাই। ভাব, লোকজন কী বলবে তোকে?' বলে হোহো করে কৌতুককর বিজয়ীর হাসি ঝলকাচ্ছিল কুন্তলের চোখেমুখে সেদিন। আর সব দাবা খেলার শেষে যেমন বলত ও তেমনি নিজের মনে নিজেই অভ্যাসবশত বলছিল 'কিস্তিমাৎ'। 

আজ টিউলিপও পেরেছে সেই নোংরা খেলার প্রতিশোধ নিয়ে কুন্তলের মানসম্মানকে মাটিতে মিশিয়ে দিতে। নিজের শহরে, নিজের বাড়িতে ওর ইজ্জতের ধ্বজা উড়িয়ে দিতে। টিউলিপের সাধ হচ্ছিল আজ কুন্তল সেনগুপ্তের কানের কাছে গিয়ে ঠোঁটের উপর আঙুল রেখে ফিসফিসিয়ে শাষিয়ে বলে সে 'কাউকে বোলো না এসব নিষিদ্ধ ব্যাপার।'


মধ্যাহ্নের উজ্জ্বল রবিকিরণে তখন সেনগুপ্ত বাড়ির দালানে জ্বলজ্বল করছে অষ্টমীর দুর্গামা। তার পায়ের তলায় ত্রিশূলের ঘায়ে কাতরে পরে থাকা অসুরের দিকে চেয়ে আজ নিজের মনে নিজেই আনন্দে বলে উঠছে টিউলিপ 'কিস্তিমাৎ'। 


(সমাপ্ত)


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy