Sheli Bhattacherjee

Drama

3  

Sheli Bhattacherjee

Drama

ভারসাম্য

ভারসাম্য

4 mins
1.7K


"সকালের প্রকৃতিতে যেন তাজা সবুজ তুলির টান আঁকা থাকে। তাই না শ্যাম?"

"হুম। তার উপর আবার যদি ভোরের বৃষ্টিতে সোদা মাটির গন্ধ উড়তে থাকে ... আহা, অপূর্ব আমেজ লাগে।"

"মনে হয় এই প্রকৃতির কোলে যদি চোখ বুজে শুয়ে পড়ি তো কত গভীর ঘুম হবে। যতই বলো, ঘরের দামী এসির কৃত্তিম হাওয়ার চেয়ে তা অনেক অনেক বেশি তৃপ্তির। তা দেরিতে হলেও বুঝেছি আমরা।"


মিত্রার কথায় ওর দিকে চেয়ে মৃদু হাসল শ্যাম। আর জলের বোতলটা ওর হাতে দিয়ে জগিং করতে নেমে গেল পার্কের সবুজ ঘাসের মধ্য দিয়ে আঁকাবাঁকা চিত্রের মতো ইঁট বিছানো সরু পাকা রাস্তা ধরে। মিত্রা বোতলটা সিমেন্টের বেঞ্চের উপর রেখে কিছু ফ্রিহ্যান্ড এক্সারসাইজ করছে তখন। এমন সময় স্যান্যাল কাকু এসে বসলেন সেই সিমেন্টের বেঞ্চে। আর মিত্রাকে উদ্দেশ্য করে বললেন

"এখন কেমন আছো তোমরা?"

স্যান্যাল কাকুর বয়স সত্তর পাড় হলেও, মাথা হতে পা অবধি একটা টানটান ফিটনেস ওঁর শারীরিক কাঠামোকে মজবুত করে দিব্যি পঞ্চাশের ঘরের মানুষের মতো ধরে রেখেছে। মিত্রা জেনেছিল, একসময় লোকাল ক্লাবে ফুটবল কোচ ছিলেন তিনি। এমনিতে সরকারী চাকুরে ছিলেন। 

মিত্রা মৃদু হেসে উত্তর দিল "অনেকটা ভালো আছি কাকু।"

"তাহলে এই বুড়োর টোটকা কাজে লেগেছে বলো?"

ছোট্ট টাওয়াল দিয়ে ঘাড়ের আর গলার ঘাম মুছতে মুছতে স্যান্যাল কাকুর পাশে এসে বসল মিত্রা। তারপর পরিতৃপ্তির সাথে কাকুর দিকে চেয়ে বলল "ওল্ড ইস গোল্ড কাকু। পুরানো যেকোনো কিছু, সে ধ্যানধারণা হলেও ... তার উপকার সুদূরপ্রসারী হয়। আমরা বড্ড বেশি আধুনিক হতে গিয়ে দ্রুততার সাথে হারিয়ে ফেলছিলাম বহু মূল্যবোধকে। সেদিন আপনি আমাদের শুধরে দেওয়াতে, আজ মানসিক ও শারীরিকভাবে নিজেদের সুস্থ করতে পেরেছি।"

কথাটা শুনে মিঃ স্যান্যাল সস্নেহে মিত্রার মাথায় হাত রেখে উঠে গেলেন হাঁটার জন্য।


অত:পর জলের বোতল থেকে জল পান করতে করতে মিত্রার মনে পড়ল পাঁচ মাস আগের কথা। সেদিন কলকাতার ফ্ল্যাট কালচারে সংসার গড়ে তোলা আধুনিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত বিবাহিত দম্পতি মিত্রা আর শ্যাম অফিসের তাড়াহুড়োতে ছিল। দুজনে একসাথে সকালে বাইকে করে অফিসের পথে যাচ্ছিল স্টেশন রোড ধরে। তখন হঠাৎই মাথা ঘুরিয়ে যায় শ্যামের। আর বাইকটা ঘুরে গিয়ে পড়ে পাশ্ববর্তী এক চায়ের দোকানে। সেখানে স্যান্যাল কাকুরা কিছু বর্ষীয়ান পার্টিকর্মীর সাথে বসে ভোটের রাজনীতিগত আলোচনা করছিলেন। ঘটনা দেখা মাত্র সেদিকে ছুটে এলেন ওঁরা। পাশাপাশি ব্যস্ত সকালের চিত্রটা কিছুক্ষণের জন্য ছত্রভঙ্গ হয়ে ত্রস্তপদে এগিয়ে এলো মিত্রাদের দিকে। তারপর প্রায় ধরাধরি করে শ্যামকে বসানো হয়েছিল একটা দোকানে। মিত্রার পায়ে লেগেছিল গভীর চোট। 


সেদিন থেকে শুরু হয়েছিল হাসপাতাল-ডাক্তার-টেস্ট-ওষুধ-বিশ্রাম। অ্যাসিডিটি, ব্যাক পেইন, সাফোকেশন সহ শ্যামের একাধিক অসুস্থতার নিরাময় চলতে থাকে। মিত্রারও অনেকরকম কারণে দুর্বলতা বেড়েছিল। তাই দুজনের সুস্থ হতে ডাক্তার আর ওষুধের পেছনে প্রচুর টাকা খরচা হয়ে যায়। প্রায় তিন সপ্তাহের এই টানাপোড়েনে নিজেদের বড্ড অসহায় লাগছিল ত্রিশ পেড়োনো মিত্রা আর শ্যামের। তখন একদিন স্যান্যাল কাকু এসেছিলেন মিত্রাদের ফ্ল্যাটে। তারপর ওদের জীবনযাত্রা রূপরেখার মৌখিক বয়ান শুনে বলেছিলেন "তোমরা কি মনে কর কোনো শিশু মায়ের দুধের চেয়ে গুঁড়ো দুধে বেশি পুষ্ট হয়? মায়ের হাতের যত্নের বাইরে হস্টেলে থেকে বেশি স্নেহের ছত্রছায়া পেতে পারে?"

প্রথমে কাকুর কথাগুলো শুনে মিত্রা বা শ্যাম ওঁর কথা প্রসঙ্গের দিক নির্ধারণ করে উঠতে পারেনি। আর স্বাভাবিকভাবেই মাথা নাড়িয়ে মিলিত উত্তর দিয়েছিল "না"।


তারপর কাকু এক এক করে বলতে শুরু করলেন নিজ জীবনের কথা। কিকরে উনি বাইশ বছর বয়স অবধি নিয়মিত ৩ ঘন্টা করে ফুটবল খেলে ঘাম ঝড়াতেন। পাড়ার বাচ্চাদের বিবিধ প্রলোভন দেখিয়ে সবুজ মাঠের দিকে নিয়ে যেতেন। আর সেই অভ্যাস করে একাধিক বাচ্চার বিবিধ শারীরিক অসুস্থতাও সেরে যাচ্ছিল। তারপর ধীরে ধীরে বাচ্চাদের সাথে সাথে তাদের মা বাবারা, এমনকি দাদু ঠকুমারাও আসতে শুরু করলেন মাঠে। তখনও মিত্রাদের ফ্ল্যাটের মতো আধুনিক নিউক্লিয়ার পরিবারের আশ্রয়দাতা হিসাবে চার পাঁচ তলা বিল্ডিংগুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়নি এখানে। আরও কিছু সবুজের সমারোহ ছিল এই পরিবেশে। ক্রমশ তা কমেছে। পার্ক নামক স্থানটিকে কেন্দ্র করে নির্দিষ্ট পরিসরের মধ্যে সুগঠিত সবুজের সমাহার গড়ে উঠেছে। এদিকে জনঘনত্ব বেড়েছে। ফলতঃ উল্টোদিকে বাতাসে অক্সিজেনের ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়েছে। 

এসব বলতে বলতে কাকু বেশ কৌতুক আর রাগমিশ্রিত হয়ে বলছিলেন "তার উপর আজকালকার ছেলেমেয়েরা স্মার্ট, আমাদের মতো ব্যাকডেটেড নয়। ফোনের বোতাম টিপেই ক্যাব বুকিং, বোতাম টিপেই রান্না খাবার, কাঁচা সবজি, চাল, ডাল সব আনায়। বোতাম টিপেই বিনোদন নিতে অভ্যস্ত তারা। আরে বাবা, শরীর তো একটা যন্ত্র, নাকি?। সবুজকে ধ্বংস করে তাকে না দিচ্ছো পুষ্টিকর উপাদেয়, আর নিয়মিত প্রশিক্ষণ বা অনুশীলন করে না দিতে পারছো ফিটনেস! স্মার্টফোন ইউসার হয়েছো বলেই তোমরা ভেবে নাও যে, শরীরকে সুখের সোকেজে রাখলে, শরীরও তোমাদের মনমতো সুস্থ সবল সচল থাকবে?"

কথাগুলো বলে বেশ উত্তেজনায় কাকু নিজেকে থামিয়েছিলেন সেই মুহূর্তে।


মিত্রা আর শ্যাম ততক্ষণে নিজেদের জীবনযাপন পাত্রে অজস্র ভুলগুলোকে জলের মতো স্বচ্ছ পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিল। নিজেদের শিক্ষিত ভাবতে রীতিমতো লজ্জা হচ্ছিল ওদের। সত্যিই তো ছুটিরদিনগুলোও তো মল আর মুভি কালচারেই চলে যায়। সবুজকে আর তেমন করে ছুঁয়ে দেখা হয় কোথায়? কোথায় প্রকৃতি মায়ের কোলের স্নেহচ্ছায়ায় নিজেকে মেলে ধরা হয়?


সেদিন থেকেই মিত্রা আর শ্যাম বদ্ধপরিকর হয়েছিল, নিজেদের জীবনে আধুনিকতা জনিত ব্যস্ততা আর সবুজের কোলে সময় কাটানোর মধ্যে একটা ভারসাম্য স্থাপন করতে। আজও মিত্রার মনে পড়ছে সেদিন ওদের ঘর থেকে বেড়িয়ে যেতে গিয়েও পেছনে ফিরে স্যান্যাল কাকু টানটান হয়ে বলছিলেন মিত্রাকে "স্বামীজি বলেছিলেন, একঘন্টা গীতা পাঠের চেয়ে একঘন্টা বাগানে মাটি কুপানো শরীর ও মনের জন্য স্বাস্থ্যকর। আর আমি নিজের জীবন দিয়ে বুঝেছি কেউ যদি তার জীবনের শুরুর দুই দশক মাটিতে কিছুক্ষণ হলেও খালি পায়ে নিয়মিত হাঁটে বা দৌড়ায়, আর সারাজীবনের ৫ - ১০% সময় সবুজের সাথে কাটায় ... তবেই শরীর নামক যন্ত্রটি সুস্থতার সাথে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারবে।


মিত্রারা এখন স্যান্যাল কাকুর কথাকে উপলব্ধি করে নিজেদের জীবনযাত্রাকে বদলে দিয়ে বুঝতে পেরেছে যে, শরীরচর্চা আর সবুজের সঙ্গকে আপন করলেই কর্মজীবনের সাথে সুস্থ সুন্দর ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব হয়।


(সমাপ্ত)


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama