ঘুম চাইগোওও ... ঘুম চাই
ঘুম চাইগোওও ... ঘুম চাই


#ঘুম চাইগোওও .. ঘুম চাই
#শেলী ভট্টাচার্য
সকাল সকাল স্টেশন হতে ঢোকার রাস্তায় বেশ ভিড় হয়েছে। তারপর ধীরে ধীরে মিছরি কেন্দ্রিক পিপড়ের জটলার মতো সেটা স্থান পরিবর্তন করেছে চায়ের দোকানের বেঞ্চের দিকে। এমনিতেই মর্ণিংওয়াক ফেরত বয়স্ক লোকেদের একটা অঘোষিত আড্ডার জায়গা বিশুর এই চার দশকের পুরানো চায়ের ঠেক। দুবেলা প্রধানতঃ রিটায়ার্ড লোকেদের ভিড় হয় এখানে। আজ তাদের সাথে গুটিকয়েক মাঝবয়েসী এমনকি অল্পবয়সী ছেলেদের মাথাও জেগে উঠতে দেখা যাচ্ছে।
"আরে বাবা, মুখার্জির বৌকে আমি বহুবার বটতলার কালি মন্দিরের পেছনের সাধকবাবার কাছে যেতে দেখেছি।" সন্দেহের প্রকাশ বাক্য জুড়ে।
"শুধু বটতলা কেন, ওরাতো বছরে একবার করে তারাপীঠেও যায়। ওই ভাদ্দরমাসের অমাবস্যার সময়টাতে বড়ছেলে, বৌ, নাতি নাতনি মিলে পুরো পরিবার সহ মুখার্জি কর্তা মায়ের পীঠে পুজা দিতে যায়।" আরেকটু বেশি সন্দিগ্ধতা কথার প্যাঁচে।
"সেতো ও বরাবরই কালিভক্ত। ছোটোবেলায় দেখেছি, ও বাড়িতে ঘটা করে মায়ের পুজা হত। পরে বড়কর্তার মৃত্যুর পর তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ..." ভক্তিপূর্ণ কথাকে মাঝপথে থামিয়ে দিল।
"আরে থামো তো বাপু। কালিভক্ত না বুঝরুকি!" বেশ বিদ্রুপ কথার ইঙ্গিতে।
"আমার তো মনে হয়, মুখার্জির ছোটো ছেলে বিদেশ থেকে বড় বিজ্ঞানী হয়ে এসেছে। আর কিসব টাইম মেশিন টেশিনের ব্যাপারে কথা বলে!" অল্পবয়সী সৌরভের এই কথায় বয়স্ক লোকেদের এতোক্ষণের সন্দেহ ও সম্ভাবনাময় কথোপকথনটা হঠাৎ করে থেমে গেল। সবার চোখেমুখে এই আজব বিষয় নিয়ে আরো কিছু জানবার তীব্র কৌতুহল ফুটে উঠেছে।
"তাহলে সৌরভ তুমি বলতে চাইছো যে, ওদের অফিস ঘরে সুশোভন মুখার্জি টাইম মেশিন বসিয়েছে। আর তাতে করে চেপে বসেই ভবিষ্যতের সুখচিন্তালোকে প্রবেশ করে এমন নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে সব?" মাঝবয়েসী অনিমেষের খোঁচা দেওয়া প্রশ্ন।
"দেখুন, আমিতো নিজে যাই নি সেখানে। তবে যারা এখন অবধি গিয়েছে, তাদের অভিজ্ঞতায় যা বুঝলাম যে, এক শান্তিময় স্নিগ্ধ ঘুমে ওরা একরাতের জন্য হলেও কাটাতে পেরেছে। আর পরেরদিন তাদের চোখেমুখেও একটা দারুণ প্রশস্তির ছাপ দেখেছি আমি। তাই ..."
'ঐ ঐ আসছেন মনিকর্তা।' বলে সমস্বরে বলে উঠলেন অনেকেই।
দেখা গেল বেশ ফিটফাট চেহারার ষাট পয়ষট্টি বছর বয়স্ক একজন ভদ্রলোক আসছেন এই চায়ের দোকানের দিকে।
"উনি তো কাল গিয়েছিলেন ওই ঘুমের দোকানে। শিক্ষিত বিচক্ষণ ব্যক্তি উনি। দেখি কি বলেন ..." বলে উঠল জটলা মধ্যস্থ জনৈক ব্যক্তি।
মুচকি হেসে এগিয়ে এলেন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুর ভদ্রলোকটি। তারপর এক এক করে প্রশ্নের তীর আসতে লাগল তাকে উদ্দেশ্য করে। মণিকর্তা সমাজের এক গণ্যমান্য ব্যক্তি। খুব বেশি কথা কোনোকালেই বলেন না। স্বল্পভাষী ও স্বল্পহাস্যে নিজের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় বহন করেন। সবার প্রশ্ন এক এক করে শুনে উনি ধীর কণ্ঠে বলতে শুরু করলেন "আমার তো মনে হয়, তোমাদের সবারই একরাত হলেও ওখানে কাটিয়ে আসা উচিত।"
মণিকর্তার প্রথম বাক্যেই সবাই বুঝে গেল যে, খরিদ্দার হিসাবে তিনি এই ঘুমের দোকান থেকে তৃপ্ত হয়েই ফিরে এসেছেন।
"আমরা সবাই কেউ এসি চালিয়ে, কেউ ফ্যানের তলায় রাতে নিজের ঘরে ঘুমাই। জীবনের কত চাওয়া পাওয়ার হিসাব করতে থাকি ওই বালিশে মাথা দেওয়ার সাথে সাথে। যদি, এমন হয় যে একদিন সেই হিসাবকিতাব সব মুলতুবি থাকে, যদি মনের সব প্রাপ্তি মুহূর্তের জন্য আমাদের এসে ছুঁয়ে যায় ... তবে তো আমরা সেই স্নিগ্ধ ঘুমের দেশে এক রাতের জন্য হলেও ঘুরে আসতে পারব। তাই নয় কি?" সবার মুখের দিকে চেয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন মণিকর্তা।
কেউ বুঝে কেউ না বুঝে এ ওর মুখের দিকে চাওয়াচাওয়ি করছে তখন। একজন বলে উঠল
"একি ম্যাজিক নাকি? এমন করবে কিকরে?"
আরেকজন বলল "ম্যাজিক ট্যাজিক কিচ্ছুটি নয়। আসলে ব্ল্যাকম্যাজিকের খেল এসব।"
শুনে চুপচাপ মৃদু হেসে নিজের বাড়ির পথে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলেন মণিকর্তা। যাওয়ার আগে শুধু বললেন "ঘরটাতে ঢুকেই হাল্কা মিউজিক সহ কি সুন্দর একটা গলায় গান বাজছিল 'ঘুম চাইগোওও ... ঘুম চাই ... ঘুম চাইগো।
মনে হচ্ছিল, আমাদের জটিল জীবনে আমরা যে অনুভূতিটা সবচেয়ে বেশি আপন করতে চাই, সেটাই দিতে এসেছে এক স্বপ্নের ফেরিওয়ালা।"
সৌরভ সব শুনে ঠিক করল আজ রাতেই ঘুমের দোকানে একটা রাতের জন্য বুকিং করাতে যাবে ও। কত টাকাই তো সম্পর্কের ভাঙাগড়ায় লুটোপুটি খেল এই কমাসে। কিন্তু তাতে শান্তির ঘুম আর পেল কই। দেখাই যাক না, ওখানে গিয়ে তা পাওয়া যায় কিনা। ভেবে হাঁটা লাগাল মুখার্জিদের বাড়ি সংলগ্ন ঘুমের দোকান নামক নতুন অফিসের দিকে। দূর থেকে দেখল বেশ বড় লাইন লেগেছে। এমন সময় সৌরভকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে এলো রিক্তা, সৌরভের সদ্য ডাইভোর্সড স্ত্রী। সৌরভ অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে চেয়ে দেখল, ওর চোখেমুখে আগের মতো ঘৃণা বা রাগের লেশমাত্র নেই। অনেক দিন আগের মতো কেমন যেন আপন আপন লাগছিল ওকে।
অত:পর, সৌরভের বুকিং ডেট অনুযায়ী একদিন ওই অফিসে এসে উপস্থিত হল ও। মনের মধ্যে উত্তেজনা ও কৌতুহলের মিশ্রিত এক অনুভূতি।
******************************
পরেরদিন সকালটা কি এক অদ্ভুত মায়াময় সুন্দর লাগছিল সৌরভের কাছে। সমস্ত শরীর মন জুড়ে এক অসাধারণ প্রশস্তি। আহা, কি আরামের সময় কাটিয়ে এলো সে।
মুখার্জি কাকুর ছোটো ছেলে যে বিদেশ থেকে এমন অসাধারণ মেন্টাল কাউন্সিলর হয়ে দেশে ফিরেছে, তা জানা ছিল নাতো। কি অদ্ভুদ দক্ষতার সাথে ও সৌরভের সাথে কথা বলে ওর জীবনের যন্ত্রণাগুলোকে একে একে জেনে প্রলেপ লাগিয়ে দিচ্ছিল তার উপর। তারপর সৌরজগতের মতো মেঘের দেশের পেইন্টিং করা একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে ওকে একটা নরম বিছানায় শুইয়ে দিয়ে খুব আপনজনের মতো আন্তরিকতা নিয়ে এমন কিছু বলল, যাতে মনে হল মুহূর্তের মধ্যে ওর মানস জগত একটা টাইম মেশিনের মধ্য দিয়ে আশাপূরণের ভবিষ্যৎ জগতে পাড়ি দিয়েছে। তারপরই ঘটল কাঙ্ক্ষিত সেই শান্তির নিদ্রাপ্রাপ্তি।
ফেরার পথে নিজেরমনে নিজেই ভাবছিল সৌরভ .... সত্যিই তো আমাদের চিন্তা, ক্রোধ, না পাওয়ার আফসোস যখন আমাদের অতীতকে বদলাতে পারে না ... ভবিষ্যতকে আমাদের ক্ষমতার বাইরে নিয়ে গিয়ে গড়তে পারে না ... তাহলে এসবের পিচ্ছিল চক্রাকার পথে বারংবার প্রবেশ করে আমরা আমাদের বর্তমান শান্তিটাকে কেন নষ্ট করছি .....?
(সমাপ্ত)