Sheli Bhattacherjee

Drama

3  

Sheli Bhattacherjee

Drama

প্রফিট-লস সূত্র

প্রফিট-লস সূত্র

6 mins
1.2K


গিন্নীর সাথে সকালের টুকটাক খোঁটাখুঁটি চায়ের চিনি জল দুধের মিশ্রণের সাথে গুলে সেরে নিয়েছেন প্রমিতবাবু। ছেলেকে আস্কারা দিয়ে মাথায় ওঠানো ছিল তার বিষয়বস্তু। তারপর নিজের ক্ষারীয় মেজাজকে একটু নিউট্রালে আনতে মনে পড়ে গেল ছোট্টবেলার বন্ধু সুবিমলকে। আর তখনই ভেতরের ক্রোধগুলোর রাশ টেনে, ব্যলকনির ইজিচেয়ারে গাটা এলিয়ে দিয়ে ফোন লাগালেন পুরাতন সখাকে। মনের সিচুয়েশনগুলোকে একটু এসোসিয়েশন করে বন্ধুর মতামতের টেবিলে দরখাস্ত করবেন বলে। এই হচ্ছে গিয়ে বৃদ্ধ বয়স, সে এক জ্বালাই বটে। না নিজের জীবনের মূল্যবোধে টেকা যায়, না ছেলেপিলের জেনারেশনে লংজাম্প মারা যায়। মাঝখান থেকে ওই না ঘরকা না ঘটকা হাল।


এসব ভাবতে ভাবতেই নাম্বারটা ডায়াল হল .... ওদিকে রিংটোন বাজছে 'বসন্ত এসে গেছে'....


"হ্যালো"


"কি রে তুই এই বয়সে ঠেকে কিনা এখন বসন্ত পালন করছিস? যুগের হাওয়া লাগলো নাকি?"


ক্ষনিক অট্টহাস্যের সাথে সুবিমলবাবুর উত্তর এলো "আরে ধুর, ছেলের ফোনের রিংটোন এটি। আমার ফোনটি দুদিন হল নার্সিংহোমে আছেন। হাসপাতাল বললুম না। কেন বল দিকি?"


'শুরু হয়ে গেল দু বন্ধুর গ্যাঁজাখুরি গপ্প। নাই কাজ তো খই ভাজ।'... পাশ থেকে স্থূলদেহের গিন্নীর টোনখানি আড়চোখে দেখে নিয়ে ফোনে আবার কনসেন্ট্রেট করলেন প্রমিতবাবু।


"বুঝেছি। বি এস এন এল নয়, রিলায়েন্স। তাই প্রাইভেটের চিকিৎসা প্রাইভেটে।"


"এই জন্যই তো তুই আর আমি ক্লাসে ফার্স্ট সেকেণ্ড হতাম। কেউ ধারে কাছে ঘেষতে পারতো না। এমন মস্তিষ্কজুটি আর কার আছে বল?" বলে আরেকটু রসিক হাসি এলো ও প্রান্ত থেকে।

অতঃপর প্রমিতবাবু বললেন "তা কলকাতায় কি এখনো বসন্ত চলছে নাকি শুধু তোর ছেলের ফোনে?"


"ছেলের বসন্তের খবর জানাটা মুশকিল বন্ধু। সেতো যখনতখন দেখি 'আমাকে আমার মতো থাকতে দাও' গানটি মন দিয়ে শোনে। সে শোনে না আমাকে শোনায় সে বিতর্কও আছে। তবে কলকাতায় বসন্ত নেই। সেতো কোকিলসহ পাত্তাড়ি গুটিয়েছে কদিনের দেখা দিয়েই। এখন তো ভাই মেইনলি জীবনের স্বাদের মতো ঋতুও দুটি, শীত ও গ্রীষ্মকাল। মানে সুখ আর দুখের মতো আর কি। মাঝেসাঝে বর্ষারানি আসেন আর যান। মৃত্যুভয় দেখিয়ে কলেরা, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, বন্যার্ত, বন্যাত্রাণ, নেতার দান, ক্লাবের চাঁদা, কবির চাঁদ এসব নিয়ে। আর শরৎকাল এখনো মায়ের কৃপায় আর মধ্যবিত্ত পকেটের ক্ষরায় বেঁচে আছে ওই মহালয়া থেকে ভাইয়ের কপাল চর্চা করা পর্যন্ত। আর বাকি পড়ে রইলো বসন্ত। সে বড়ই ক্ষণস্থায়ী, কতকটা এখনকার বাচ্চাদের শৈশব সুখের মতো। ছুঁয়ে যায়, অনুভব করা যায় না। সব ভেজাল রে। সব ভেজাল। দিনকাল, মানুষজন, খাদ্যদ্রব্য, সম্পর্ক, ঋতু, আমার কলকাতা, তোর দিল্লী ... সব, সব।"


"তা যা বলেছিস। আমাদের সময়ে ছেলেপিলেদের কতো নীতিবোধ ছিল। সংসারে বাপ মায়ের আলাদা সম্মান ছিল। এখন সেসব লাটে উঠেছে। সব শুধু প্রফিট লস হিসেব করছে। আমার ছেলে এখন বলছে মোটা মায়নার জন্য বিদেশ যাবে। ছেলের জন্য দামী স্কুলের স্ট্যান্ডার্ড শিক্ষা কেনার অনেক খরচ। তাই সব সামলাতে এই ব্যবস্থা। বৌ দিল্লিতে চাকরি পেয়েছে। আমাকে দেখাশোনা করাটা বলতে পারিস এদের কাছে একরকম অতিরিক্ত বোঝা বা দায়। তাই আমার জন্য বৃদ্ধাশ্রমের ব্যবস্থা হতে পারে বলে কানাঘুষা শুনছি। ওই নাতিই এসে বলছে আর কি! আমি ভাবি, কত হিসেব করে চলে এরা? এতো হিসাব করে কি একগাদা বেহিসাবি ভুল করছে না এরা? তবে সেসব বোঝাবে কে? আর বোঝালেও যে সেটা 'বোঝা'ই হবে উপর দিয়ে, ভেতরে কিচ্ছুটি ঢুকবে না।"


"বন্ধু, এক্কেবারে খাঁটি কথা বলেছো। 'প্রফিট - লস' প্রিন্সিপালে এখন সারা পৃথিবী চলছে। এমনকি নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্রও আজকাল প্রতিস্থাপিত হয়ে গেছে এই নিয়মের দ্বারা। প্রফিট হলে কাছাকাছি ঘেঁষা, একটু তৈলমর্দন করা। আর লস হলেই দূরত্বে ছিটকে যাওয়া।"


"তার মানে বলছিস, আমি এখন বেরোজগেরে বলে ছেলের কাছে সম্মানের মাধ্যাকর্ষণ হারিয়েছি?"


"কথাটা আংশিক ঠিক।"


"মানে?"


"মানেটা হল, বেরোজগেরে হয়েই যে তুই লসের খাতায় নাম তুলেছিস সেটাই একমাত্র কারন নয়। আমিও বেরোজগেরে, কিন্তু শীতে আমাকে ছাদে আচারের তেলের শিশির সাথে তোলা হয়। আম, আমলকী, কুলের তেলে ডুবে রোদ খাওয়ার সাথে সাথে আমিও তেল মালিশ উপভোগ করি। গরমে দক্ষিণখোলা বারান্দার ঘরে এসি চলে। বসন্তে টুকটাক শান্তিনিকেতন যাই। কারনটা কি? অথচ আমার বুড়ো বাপকে নিয়ে আমাদের দুভাইয়ের প্রায় ঠেলাঠেলি অবস্থা।"


অপরপ্রান্ত নিশ্চুপ দেখে কঠিন সত্যখানা সুবিমলবাবুই বলতে থাকলেন। 


"আমিই বলি তবে উত্তরখানা। তার আগে একটু শক্ত হয়ে এঁটে বোস দেখি। আর হাতের কাছে জলের বোতলটা রাখ। এসময় আবার বুকের বাঁদিক যখনতখন কমজোরি হয়ে যায়। তারপর না শেষে তোর ইমোশনে লোশন দিতে গিয়ে আমিই ফেঁসে যাই। "


"আহ, তামাসা রাখ। গিভ মি এন এক্সপ্ল্যানেশন।"


"ওই তো! দু চারখান ইঞ্জিরি ঝেড়ে তুই সরকারি চাকরির পরীক্ষাটা পায়ে দলে চলে গেলি ক্যাপিটালে। কি না প্রাইভেটে অনেক ইনকাম। কিন্তু ভাই, প্রাইভেটে পেনশন নেই। মানে তোর বেঁচে থাকার সমানুপাতে কিছু প্রফিট নেই। যা আছে, তা নমিনিসূত্রে এমনিই থাকবে। যেমন আমার বাবা কারখানার কর্মী ছিলেন। তার কদর জলমুড়িতে। কিন্তু আমি রেলে কাজ করেছি। মোটা পেনশন পাচ্ছি। ব্রেকফাস্টে নাতনির সাথে এপেল ব্যানানা ওট কর্ণফ্লেক্স খাই। টিফিনে প্রায়শই ফুলকো লুচি পাই। খিটিরমিটির কম, আর খাতিরদারি বেশি হয়। মানে আমি হলুম গিয়ে কতকটা মিউচুয়াল ফান্ডের মতো। বাজারগত থুরি আয়ুগত বড়সড় ঝুঁকি সামলে নিলে, প্রফিটই প্রফিট। আর তুই হলি গিয়ে সরকারি ব্যাঙ্কের এফ ডি। এখনকার বাজারে ডাহা বলদও ইনভেস্টমেন্ট পলিসিটা ভালো বোঝে বন্ধু।"


"বলিস কি? এই জেনারেশন এরকম হিসাব কষে? ওদের এতো ভালোভাবে প্রতিপালন করে যে বড় করলাম, তার কোনো মূল্যায়ন নেই?"


"বলেই দেখনা একবার সে কথা। সোজা উত্তর দিয়ে দেবে 'আমরা নিজের ইচ্ছাতে আসিনি'। কমপ্লেক্সিসিটি ইস এভরিহোয়ের বন্ধু। এ শুধু বাপ মায়ের ক্ষেত্রে নয়, এর বিপরীতায়নও হচ্ছে। মানে একাধিক সন্তান থাকলে বেশিরভাগ ঘরে এখন স্নেহের মাধ্যাকর্ষণতত্ত্ব চলে প্রফিট লসের হিসাবে। বিস্তারে বলতে গেলে, যে সন্তানের মাস গেলে পকেট তুলনামূলক বেশি ভারী হয়, সে সকালের ব্রেকফাস্ট থেকে রাতের ডিনার, এমনকি লোকের বাড়ির শ্রাদ্ধানুষ্ঠানেও মা বাপের নয়নের মণি হয়ে পরিচয় পায়। সেক্ষেত্রে বাপ মা সন্তানকে মিউচুয়াল ফান্ড মনে করেন বোধ হয়। কথাগুলো কড়াপাকের তিলের নাড়ুর মতো দাঁতে চিটচিট করলেও গিলতে হবে। আমি বা তুই যে দুনিয়া চোখ বন্ধ করে কল্পনা করি, তার অস্তিত্ব এখন বাস্তবে নেই। নিজেকে একটু এলুফ করে রাখতে শেখ। তোর তো দিল্লীতে থেকে আরো বেশি আপডেটেড হওয়া উচিৎ ছিল এ যুগের কালচারের সাথে। তাই না হয়ে তুই সেই অভিমানী বাঙালি হয়েই পড়ে রইলি বন্ধু?"


"সব মূল্যায়ন তাহলে অর্থকেন্দ্রিক বলছিস?"


"না, তা নয়। তবে পারসেন্টটেজটা বাড়ছে এই ধরণের ক্যালকুলেশনের। তাই বলে এরা মা বাপ অসুস্থ হলে নামকরা নার্সিংহোমে নিয়ে যাবে না, অন্তিমে ঘটা করে শ্রাদ্ধ করবে না, বা শ্বেতশুভ্র বসনে সোসাল সাইটে কাঁদোকাঁদো মুখে ছবি দেবে না, তা নয়। আরে ভাই সোসাইটি বলেও তো কিছু আছে নাকি। তাই চুপচাপ নিজেকে ভাসিয়ে দাও জীবনপ্রবাহে। ডুব মেরে তলিয়ে দেখতে গেলে, এ বয়সে বিপদ কমবে বৈ বাড়বে বেশি। সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহের উক্তিটি শুনেছিস তো 'যারা অধিক চিন্তা করেন, তারা জীবনকে উপভোগ করতে পারেন না।' বন্ধু আমিও তাই এখন আর পাড়ার ছেলেদের বাড়ির পাশের রাত্রিব্যাপী ফাংশন নিয়ে না পাড়তে কিছু বলি না। বরং হাসিমুখে চাঁদা দিয়ে দি। আর বছরে সাত আট রাত কানে তুলো বা বালিশ গুঁজে থাকি। সারাটা বছর কখন তাদের আপদবিপদে কাজে লাগে এই ভেবে। হাজার হোক বৃদ্ধ হয়েছি আমরা। সংসারের বটবৃক্ষ এখন মাথার উপরের ছাতা কম, খরচার খাতার হিসেবে বেশি। এ হল গিয়ে ঘোর কলিকাল।"


এবার হেসে উঠলেন প্রমিতবাবু "যা বলেছিস বন্ধু। তাইতো এই বাক্যালাপগুলোই রসদ বাঁচার বাকি কটা দিনের জন্য। রিমেইনিংটা তো এডজাস্টমেন্ট।"


"অথবা বলতে পারিস, মনের দিক থেকে 'স্ট্রাগল ফর এক্সিসটেন্স'। যাইহোক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের নতুন পিডিএফ টা পড়লি। দারুণ কিন্তু গপ্পটা। আরে কলিযুগের উন্নতির দাক্ষিণ্যে ঘরে বসেই কতো কিছু পড়তে পারি, জানতে পারি। জলের বিল, ইলেকট্রিক বিল, ফোনের বিল, কেবলের বিল, গিন্নীর শাড়ির বিল সব দিতে পারি ... এই ঢের আমাদের কাছে। বাবাদের মতো লাঠি আর ছাতা নিয়ে ঘরের বাইরে তো বেরোতে হয় না।"


"যা বলেছিস। বেশ, তাহলে এখনকার জেনেরশেনের সাথে খাপ খাইয়ে নিজেদের জন্য একখান গান বানাই বরং 

'আমাকে সবার মতে থাকতে দাও। 

আমি নিজেকে নিজের কোণে হারিয়ে ফেলেছি,

যেটা ছিলো না, ছিলো না, 

সেটা না পাওয়াই থাক

সব পেলে নষ্ট জীবন'।"


অত:পর বন্ধুত্বের মাধ্যাকর্ষণতত্ত্ব মৃদু হাসি ভাসিয়ে আনলো ফোনের অপরপ্রান্ত হতে।


(সমাপ্ত)


Rate this content
Log in