তখন অনেক রাত
তখন অনেক রাত
ঘরের ভেতরের গরমটা অসহ্য হয়ে উঠেছে। বিরক্ত হয়ে উঠে বসলাম। কটা বাজে দেখার জন্য মোবাইলটা হাতে নিতেই চোখ পড়ল আজকের তারিখের দিকে। তিন বছর আগে আজকের দিনেই তো! হ্যাঁ ঠিক এই সময়, স্পষ্ট মনে আছে। তখন অনেক রাত। প্রচন্ড গরমে সেদিনও আমার ঘুম আসেনি। তাই ছাদে গেছিলাম শরীরটা একটু ঠাণ্ডা করতে। অনেক দিন আমি ছাদে যাই না। আসলে কাজের চাপে সময় হয় না। ভ্যাপসা গরমে থাকতে না পেরে রওনা দিলাম ছাদের উদ্দেশ্যে। দম বন্ধ করা অন্ধকার সিঁড়িটায় দাঁড়িয়ে ছাদের দরজাটা খুলতেই মনে হলো দুটো হিমশীতল হাত যেন আমায় জড়িয়ে ধরলো। কোন এক অচেনা আদর অনুভব করলাম সেই স্পর্শে। শরীর মন এক নিমেষে জুড়িয়ে গেল। ধীর পায়ে উঠে এলাম ছাদে। আকাশে সেদিন চাদঁ ছিলনা। ঠান্ডা হাওয়ার মাঝে জোৎস্নাহীন অন্ধকার রাতটা যেন সেদিন তার সব অলংকার ত্যাগ করে নিজের আসল রূপটাকে উন্মুক্ত করে দিয়েছিল আমার সামনে। সেই রূপে কেমন যেন বিভোর হয়ে গেছিলাম আমি। ছাদের রেলিংএ হাত রেখে সামনের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি, এমন সময় স্পষ্ট অনুভব করলাম আমার বাঁ হাতের ওপর কেউ হাত রাখল। জানিনা কেন অবাক হলাম না, ভয়ও পেলাম না। যেন জানতাম সে আসবে। সামনের দিকে তাকিয়েই বললাম, "বল"। কোনো উত্তর এলো না। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, "কথা বলছ না কেন?" এবারও কোনো উত্তর এলো না। আমি তখনও আমার বাঁ হাতের ওপর তার শীতল হাতের স্পর্শ বুঝতে পারছি। আমিও আর কোনও কথা না বলে যেদিকে তাকিয়ে ছিলাম সেদিকেই তাকিয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ পর সেই নিস্তব্ধতা ভেঙে সে প্রথম কথা বলল, "কেমন আছো সূর্য?" জিজ্ঞেস করলাম, "এত কিছুর পরেও তুমি এখনও আমার কথা ভাবছো?" " হ্যাঁ ভাবছি, বেশ করছি ভাবছি।" সেই পুরনো চেনা ছেলেমানুষি কণ্ঠস্বর শুনে এবার প্রথমবার ওর দিকে ফিরলাম আমি। না সেখানে কেউ নেই। তবে ওর উপস্থিতি আমি পরিস্কার টের পাচ্ছিলাম। এবার কান্নায় আমার গলা আটকে এল। মনে পরে গেল অতীতের সব কথা। আমি যা করেছি সেই অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। তাই ক্ষমা চাওয়ার মুখ আমার নেই। আমিই তো তিথিকে ভালোবাসার কথাটা প্রথম জানিয়েছিলাম। কিন্তু আমি তো ওকে ভালোবাসিনি কখনওই। চেয়েছিলাম শুধু ওর শরীরটা। কিন্তু তিথি? ওর কথাটা তো কখনওই ভাবিনি আমি। মেয়েটা হয়তো সত্যিই ভালবেসেছিল আমায়। যখন হস্পিটালের বেড এ শুয়ে বারবার ফোন করে আমায় ওর পাশে চেয়েছিল আমি তো যাইনি একদিনও। কেনই বাহ্ যাবো! আমার তো একটা স্বাস্থবান নিটোল তরতাজা শরীরের দরকার। আমি তো কোনো রোগে খাওয়া দেহ চাইনি। ও শেষবারের মতো আমাকে একবার দেখতে চেয়েছিল। আমি বিরক্ত হয়ে ওর সাথে সব যোগাযোগ ছিন্ন করে আরাম খুঁজেছিলাম অন্য কোনো স্বাস্থবান নিটোল তরতাজা শরীরে। এরপর একদিন পেয়েছিলাম তিথির মৃত্যুসংবাদ। খবরটা জঞ্জালের মত গুরুত্বহীন ভাবে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম ডাস্টবিনে। তারপর কত বছর কেটে গেছে। কত শরীর নিয়ে মিটিয়েছি লালসা। আমার ব্যস্ত সুখের জীবন থেকে তিথিকে চিরতরে মুছে ফেলেছিলাম। হঠাৎ সেই কন্ঠস্বর বলে উঠলো, "কি ভাবছো?" প্রশ্ন শুনে সম্বিত ফিরে পেলাম। বললাম, " কি চাও তুমি? কেন এখনো আমার কথা ভাবো? আর কেনই বাহ্ তুমি আজ এখানে?" " আমি তো সেই কবে থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছি। শুধু একবার তোমায় দেখব বলে। আমি কিন্তু তোমার ওপর রাগ করিনি কখনও। আমি তো তোমায় ভালোবাসি। এখনও। তুমি একসময় যে শরীরটাকে ভালবাসতে গিয়ে আসল ভালবাসাটাকেই গুরুত্ব দাওনি দেখ আজ সেই শরীর নেই তোমার সামনে অথচ তার জন্য তোমার চোখে জল। আমি তো শুধু তোমার সাথে একবার দেখা করতে চেয়েছিলাম। আজ আমার ইচ্ছা পূরণ হলো। যা আমি বেচেঁ থাকতে পাইনি আজ এই রাতে আমি তা পেলাম। এবার আমি শান্তিতে এক বুক ভরা সুখ নিয়ে যেতে পারব। তুমি ভালো থেকো। আমি আসি।" বুঝতে পারলাম আমার বাঁ হাতের ওপর থেকে কোমল শীতল স্পর্শটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। এরপর কতক্ষণ ওইভাবে দাঁড়িয়েছিলাম জানিনা। হঠাৎ মনে হল আমি সেদিন তিথির পাশে থাকলে হয়তো ওকে এভাবে এত কষ্ট পেয়ে চলে যেতে হতো না। নাজানি আরও কত মেয়েকে তিথির মতো কষ্ট দিয়েছি আমি ! সিদ্ধান্ত নিলাম শেষ করে দেব নিজেকে। চলে গেলাম ঘরে। আলমারি খুলে বার করলাম ঘুমের ওষুধ। আমি চলে যাচ্ছি। নিজের এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতেই হবে। লিখলাম একটা সুইসাইড নোট- আমার মৃত্যুর জন্য শুধু আমি দায়ী। এরপর ধীরে ধীরে ঘুমে ঢলে পড়লাম।
যখন ঘুম ভাঙলো তখন প্রায় দুপুর। মনে পড়লো আগের রাতের কথা। কিন্তু এ কি করে সম্ভব! আমার তো আজ বেচেঁ থাকার কথা নয়। হঠাৎ দেখলাম পাশে ঘুমের ওষুধের শিশিটা, বোতলটা ভর্তি। আর তার পাশে আমার সুইসাইড নোট টা। ওটা তুলে পড়লাম আর একবার। আমার লেখার নীচে আরও দু লাইন লেখা- "আমি যাওয়ার আগে তোমায় ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে গেলাম। তুমি কাল রাতেই তোমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেছ আমায় অমন সুন্দর একটা রাত উপহার দিয়ে। ভালো ভাবে থেকো আর নিজের যত্ন নিও। ইতি, তোমার তিথি।" তিথির ভালবাসা আরও একবার জিতে গেল সেদিন।
এরপর তিন বছর কেটে গেছে। আমি আর কখনও কোনো শরীর খুঁজিনি। ভালোবাসা খুঁজেছি। শ্রীতমার সাথে সামনের মাসে আমার বিয়ে। আমরা দুজনেই দুজনকে খুব ভালোবাসি। মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে উঠে এলাম ছাদে। আজও আকাশে চাদঁ ওঠেনি। সবটাই ঠিক তিন বছর আগের রাতের মতই। শুধু পার্থক্য একটাই, সেই রাতে আমি ভালোবাসা কি তা জানতাম না আর আজ আমি ভালোবাসি, ভালোবাসি শ্রীতমাকে। তিথি আমায় সেই রাতে ভালোবাসতে শিখিয়েছে আর রাত তুমি তিথির শেষ ইচ্ছে পূরণ করেছ যা একদিন আমি করতে পারিনি। ঠিক সেই রাতের মতই মুগ্ধ হয়ে আমি সামনের দিকে চেয়ে ছিলাম। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো। তাকাতেই মনটা খুশি হয়ে গেল। দেখলাম ফোনের স্ক্রিনে নাম লেখা- শ্রীতমা।
সমাপ্ত