The Stamp Paper Scam, Real Story by Jayant Tinaikar, on Telgi's takedown & unveiling the scam of ₹30,000 Cr. READ NOW
The Stamp Paper Scam, Real Story by Jayant Tinaikar, on Telgi's takedown & unveiling the scam of ₹30,000 Cr. READ NOW

Indrani Bhattacharyya

Abstract Classics Thriller

4.7  

Indrani Bhattacharyya

Abstract Classics Thriller

মিসিং লিঙ্ক

মিসিং লিঙ্ক

26 mins
35.6K



(১)


আজ রবিবার। গির্জার প্রার্থনা সভা এই মুহূর্তে প্রায় ফাঁকা। সকালের অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে অনেকক্ষন হলো। ফাদার বইগুলো গুছিয়ে তাকে তুলে দিয়ে শেষ মোমবাতিটি নিভিয়ে এগিয়ে গেলেন দরজার দিকে। 

বেরোনোর ঠিক মুখেই দেখলেন প্রতিদিনের মতোই ছেলেটি ঘাড় গোজ করে বসে আছে। কতই বা বয়স হবে। দেখে তো কোনো ভাবেই এগারো কি বারো বছরের বেশি মনে হয় না। পাশেই রাখা ক্যানভাস ব্যাগে উকিঝুঁকি দিচ্ছে একটি স্কেচ বুক। ইদানিং প্রায়ই আসে গির্জায়। বেশির ভাগ সময়েই চুপচাপ বসে থাকে শেষের দিকে একটা বেঞ্চে। ফাদার আজ ছেলেটির মাথায় হাত রাখতেই চোখ তুলে তাকালো ছেলেটি। চোখ দুটো বড়ই গভীর, যেনো লুকিয়ে আছে এক সমুদ্র জল। অদ্ভুত রকমের মন কেমন করা, উদাস কিন্তু অতল দৃষ্টি সেই চোখে। ফাদার ধীরে ধীরে দরদী স্বরে জানতে চাইলেন - "কি হয়েছে তোমার? এখানে তুমি তোমার মনের সব দুঃখ যন্ত্রণা প্রভুর সামনে নিঃসংকোচে বলতে পারো। প্রভু সকলের কথা শোনেন"। ছেলেটির থেকে কোনো উত্তর না আসায় তিনি আবার বললেন - "তুমি ইচ্ছে হলে কনফেশন রুমে গিয়েও বলতে পারো। প্রভু যীশু , মাতা মেরি তোমার সকল দুঃখ দূর করে দিন এই কামনা করি।" ছেলেটি এবার আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো। তারপর সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে প্রভু যীশুর উদ্দেশ্যে প্রথামাফিক প্রণাম জানিয়ে কোনো কথা না বলে বেরিয়ে গেলো প্রার্থনা সভা ছেড়ে।


মধ্য পশ্চিম আমেরিকার একটি ছোট্ট শহর ডাবলিন। এখানে লোকজন বেশিরভাগই জন্মসূত্রে আমেরিকান। ফলে নিউইয়র্ক, শিকাগো, ফিলাডেলফিয়া বা লস অ্যাঞ্জেলসের মত এখানে ভিনদেশিদের উপস্থিতিজনিত মিশ্র সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ছাপ প্রায় নেই বললেই চলে। এহেন শহরের এক প্রান্তে একটি মধ্যবিত্ত আবাসনে দুই ছেলেকে নিয়ে একা থাকেন পিটার। তার স্ত্রী বা বলা ভালো প্রাক্তন স্ত্রী তার এক মেয়েকে নিয়ে অন্য শহরে আলাদা থাকেন। খুব সম্প্রতি সেই শহরেরই এক ব্যাংক ম্যানেজারকে বিয়ে করেছেন। পিটার পেশায় ক্যাব ড্রাইভার। তবে সময় সুযোগ মত কাছের একটি ক্লাবে গিটারিস্ট হিসেবেও টুকটাক কাজ করেন।তাতেই বেশ স্বচ্ছন্দে কেটে যায় তিন জনের। বড়ো ছেলে বব এখন কলেজে পড়ছে। সেই সাথে মাঝে মাঝে একটি পিৎজা সংস্থার আউটলেটেও বসে ছুটির দিনগুলো। তার থেকে যা আয় হয় তাই দিয়ে কলেজের টিউশন ফিস দিয়েও তার নিজের জন্য বেশ কিছু হাত খরচের টাকা থেকে যায়। ছোট ছেলে প্যাট্রিক। তাকেই আমরা কিছুদিন যাবত নিয়মিত গির্জায় যেতে এবং ঘন্টার পর ঘন্টা একা একা বসে থাকতে দেখছি। প্যাট্রিক কাছেই একটি স্কুলে ফোর্থ স্ট্যান্ডার্ডের ছাত্র। ছোটবেলা থেকেই আঁকাঝোকার প্রতি খুব ঝোঁক। পিটার সেসব দেখে প্যাট্রিককে একটি ভালো আঁকা শেখার স্কুলে বছর দুই আগে ভর্তিও করেছিলেন। কিন্তু হঠাৎই মাস ছয় হল, প্যাট্রিকের এই আঁকা নিয়ে বেশ সমস্যা দেখা দিয়েছে। চিন্তার ভাঁজ পড়েছে পিটারের কপালেও । 

মাস ছয়েক আগে ঘটনাটি প্রথম নজরে আসে লিজা মানে প্যাট্রিকের ড্রইং স্কুলের টিচারের। সেদিন ভুল করেই মোটা স্কেচ বুকটা সেই আঁকার স্কুলে ফেলে রেখে গিয়েছিল প্যাট্রিক। লিজা ম্যাডাম সেটা তুলে রাখতে গিয়েও কি মনে হতে হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখে বেশ অবাক হয়ে যান। প্যাট্রিক পরপর পাতার পর পাতা জুড়ে একজন বিবস্ত্রা দীর্ঘাঙ্গী কৃষ্ণকায় কোনো নারীমূর্তি আঁকার চেষ্টা করেছে। আজানুলম্বিত উন্মুক্ত ঘন কালো তার কেশ রাশি, রক্ত বর্ণের বিস্ফারিত তিনটি চোখ এবং মুখ থেকে বেরিয়ে আসা জিভ মুহূর্তে যেন ভয় ধরিয়ে দেয় মনে। এমন একটা ছবি কেনো আঁকলো প্যাট্রিক? ভাবতে ভাবতে খাতাটা রাখতে গিয়েও রাখতে পারে না লিজা। বারবার খুলে খুলে দেখে ছবিগুলো। কেমন যেনো একটা ভয়মেশানো অদম্য আকর্ষণ বারবার ছবিগুলো দেখার জন্য তৃষ্ণার্ত করে তুলছিল লিজার চোখের পাতা। 

পরদিন প্যাট্রিক আঁকার স্কুলে এলে লিজা কিছু না বলে খাতাটা ফেরত দিয়ে দিল প্যাট্রিককে। সেই সাথে প্যাট্রিককে এও জানিয়ে দিল যে যদি পরদিন ক্লাসে সে তার বাবাকে সঙ্গে করে না নিয়ে আসে তবে এই স্কুলে তাকে আর আঁকা শেখানো হবে না। প্যাট্রিক লিজা ম্যামের মেজাজ দেখে কিছু একটা হয়েছে অনুমান করে অপরাধীর মত মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে।


পরদিন পিটার আঁকার স্কুলে আসতেই লিজা পিটারকে খুলে বললো গোটা ঘটনা । জানালো প্যাট্রিক কি ভাবে লিজার অজান্তে দিনের পর দিন , পাতার পর পাতা একটা ডেমনের ছবি এঁকে গেছে। পিটারও খুব অবাক হলেন ছেলের এই কীর্তি শুনে। সেদিন সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরে এ বিষয়ে বারবার তিনি জেরা করেছিলেন প্যাট্রিককে। প্যাট্রিক উত্তরে শুধু একটাই কথা বলে গেছে প্রত্যেকবার -' আমি আঁকবো বলে পেন্সিল ধরলেই এই ছবিটাই বেরিয়ে আসে। অন্য কিছু আঁকতেও ইচ্ছে করে না আর।'


এই ঘটনার পর কেটে গেছে অনেকগুলো মাস। প্যাট্রিক আস্তে আস্তে নিজেকে আরো গুটিয়ে নিয়েছে। স্কুলে যাওয়াও অনেক কমিয়ে এনেছে। এমনিতে সে বরাবরই শান্তশিষ্ট । তার মধ্যে স্কুলের অফ পিরিওডে হঠাতই একদিন বন্ধুরা তাকে খেলার জন্য ডাকতে এসে তাকে একা একা চেরি গাছের নিচে আপনভোলা হয়ে ওই একই ছবি আঁকতে দেখে। সেই থেকে প্যাট্রিক ডেমনের ছবি আঁকছে বলে তার সম্পর্কে বন্ধুদের মনে অদ্ভুত রকমের একটা আতঙ্ক তৈরি হয়ে যায়। প্যাট্রিক এ বিষয়ে নিজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো শুনেও চুপ করে থাকায় ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে আতঙ্কটা । এর পাশাপাশি তাকে নিয়ে অমূলক ভয় আর গুজবও ছড়িয়ে পড়ে বাকি পড়ুয়াদের মধ্যে। সহপাঠীদের সঙ্গে ক্রমেই দূরত্ব বাড়তে থাকে প্যাট্রিকের। খবরটা ছড়াতে ছড়াতে এরপর এমন একটা সময় আসে যখন ওকে দেখে ভয় পেতে শুরু করে ওর এলাকার সমবয়সি বন্ধুবান্ধব এবং তাদের অভিভাবকেরা। প্যাট্রিক বাধ্য হয়ে বন্ধ করে দেয় বাইরে বেরোনো। মাঝে মাঝে চুপ করে সবার অলক্ষ্যে গিয়ে বসে থাকে গির্জায়। 

ওদিকে পিটারও প্যাট্রিককে আবার আগের মত জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য কম চেষ্টা করে নি।এই কয় মাসেই তিনি ডাবলিনের তিনজন মোটামুটি নামকরা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়েছেন।কিন্তু তাতে লাভের লাভ হয় নি কিছু। লিজার আঁকার স্কুলও বদলে যাওয়া পরিস্থিতির চাপে এবং অন্যান্য অভিভাবকদের অনুরোধে প্যাট্রিককে আর আঁকা শেখাতে চায় নি। প্যাট্রিক সারাদিন বাড়িতেই থাকে আর আগের মতোই সেই ভয়ংকর মহিলার ছবি আঁকে। এখন বরং ছবিটা আগের থেকে অনেক বেশি পরিণত, অনেক বেশি নিখুঁত। দেখলে শুধু ভয় নয়, কেমন যেন একটা ভক্তি মিশ্রিত সম্ভ্রমও জাগে মনে মনে।


পিটার গত সোমবার ওহিও এয়ারপোর্ট থেকে এক ভারতীয় দম্পতিকে নিয়ে ফিরছিলেন ডাউনটাউনে। তখন স্থানীয় সময় অনুসারে প্রায় মধ্যরাত। সওয়ারি দুই প্রৌঢ় যাত্রী জানালেন তাঁরা ভারত থেকে আসছেন। তাঁদের ওখানে এই সময় দিন। তাই তাঁদের চোখে ঘুম নেই মোটেই । অগত্যা গল্প চলতে লাগলো টুকটাক। পিটারকে তাঁরা জানালেন , মূলত তাঁরা ডাবলিনে তাঁদের ছেলে, পুত্রবধূ এবং নাতির সাথে সময় কাটাতে এসেছেন তিন মাসের জন্য। পিটার ও কথায় কথায় খুলে বললেন তার পরিবারের কথা।এমনকি প্যাট্রিককে নিয়ে তার চিন্তার কথাও জানালেন মোটামুটি সবিস্তারে। 

পিটারের মুখে প্যাট্রিকের আঁকার বিষয়ের বর্ণনা শুনে দুই দম্পতিই নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন প্রথমে। তারপর প্রৌঢ়ার নীরব সম্মতি নিয়ে প্রৌঢ় ভদ্রলোক ইচ্ছে প্রকাশ করে বললেন যে তারা একদিন সময় করে প্যাট্রিকের আঁকা ছবি দেখতে যেতে চান ,যদি তাতে পিটারের আপত্তি না থাকে। পিটার তাদের প্রস্তাবে সানন্দে সম্মতি জানিয়ে আসছে রবিবারই তাদের অ্যাপার্টমেন্টে যাওয়ার জন্য নিমন্ত্রণ করলেন।

রবিবার দিন সেই প্রবীণ দম্পতি অর্থাৎ মি: দেবব্রত ভট্টাচার্য্য এবং দোলনচাঁপা ভট্টাচার্য্যের ছেলে সুমন্ত তাঁদের ড্রপ করে দিলো নির্দিষ্ট লোকেশনে। পিটারকে দেওয়া কথা মত যথা সময়ে হাজির হলেন তাঁর ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে। প্যাট্রিক ততক্ষনে গির্জা থেকে সবে বাড়ি ফিরে এসেছে। বব যদিও সকাল সকালই যথারীতি কাজে বেরিয়ে গেছে। পিটার ভট্টাচার্য্য দম্পতিকে দেখে দারুণ খুশি হলেন। সে সত্যি ভাবতে পারেনি যে তাঁরা আসবেন তার বাড়িতে। গাড়ি চালাতে গিয়ে এরকম তো কত লোকের সাথেই আলাপ পরিচয় হয়। কিন্তু ভাড়া মিটিয়ে লোকেশনে নেমে যাবার পর সবই ভুলে যায় সবাই । পিটার তাঁদের আপ্যায়ন করে নিয়ে গিয়ে বসালেন সামনের বৈঠকখানা ঘরে। প্যাট্রিককে ডেকে আলাপ করিয়ে দিলেন তাঁদের সাথে। তারপর তিনজনের কথা বলার ফাঁকে পিটার চট করে বানিয়ে আনলেন গার্লিক ব্রেড আর ব্ল্যাক কফি ।


টুকটাক কথাবার্তা চালাতে চালাতে প্যাট্রিককে উদ্দেশ্য করে পিটার একসময় বলে উঠলেন - "তোমার স্কেচবুকটা একবার নিয়ে এসো তো। " প্যাট্রিক খানিক ইতস্তত করে বিনা প্রশ্নে সেটা এনে পিটারের হাতে দিলো। পিটার খাতাটা খুলে দেখাতেই চমকে উঠলেন দুজন। দোলনচাঁপা দেবীর দুহাত আপনা থেকেই জড়ো হয়ে উঠে এলো কপালে। চোখ বুজে বলে উঠলেন - "জয় মা "। দেবব্রত বাবুও সাংঘাতিক অবাক হয়ে স্বগতোক্তি করলেন - "স্ট্রেঞ্জ, এমনটা কি করে হল।" পিতা পুত্র দুজনেই তাদের অভিব্যক্তি দেখে বেশ কৌতূহলী হয়ে উঠলো। কিন্তু তাদের কাউকে প্রশ্ন করার আগেই দেবব্রত বাবু সরাসরি প্যাট্রিককে উদ্দেশ্য করে বললেন - "তুমি কি এই ছবি আগে কোথাও দেখেছো? এই ধরো যেমন টিভিতে বা নিউজপেপারে বা ধরো ইন্টারনেটে? বা কোনো গল্প শুনেছ কারুর মুখে বিশেষ করে তোমার কোনো ভারতীয় বন্ধু বা চেনা পরিচিতর মুখে? " প্যাট্রিক মাথা নিচু করে দুপাশে ঘাড় নাড়িয়ে বললো - " মন থেকেই আঁকি স্যার। চেষ্টা করি হুবহু এক রকম আঁকতে ঠিক যেমনটা রোজ রাতে স্বপ্নে দেখি। " শুনে মুখ হা হয়ে গেল দেবব্রত বাবুর। 

পিটার চুপ করে দুজনের কথাই শুনছিলেন। মন দিয়ে লক্ষ্য করছিলেন দুই অতিথির মুখের অদ্ভুত অভিব্যক্তি। তারপর সকলে চুপ করে গেলে পিটারই প্রথম নিস্তব্ধতা ভেঙে প্রশ্ন করল - "স্যার এগুলো কিসের ছবি? আন্দাজ করতে পারলেন কিছু? " দেবব্রত বাবু এবার একটু হেসে সহজ গলায় বললেন - "আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, পিটার। আপনার পুত্র যাঁর ছবি আঁকছে তিনি কোনো ডেমন নন। বরং হিন্দু শাস্ত্র মতে আমাদের পরম আরাধ্যা দেবী মা কালী। কিন্তু একটা জিনিস কিছুতেই ঠিক মাথায় ঢুকছে না। এই দেবীর প্রতিকৃতি এত নিখুঁত ভাবে প্যাট্রিক কি ভাবে এঁকে যাচ্ছে দিনের পর দিন , যাঁর সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই তার? এই ছবিতে আঁকা নারী তো সেই একইরকম তৃনয়না, করাল বদনা, চতুর্ভুজা, মুণ্ডমালা বিভূষিতা। গায়ের রং সেই একই রকম ঘোর কৃষ্ণবর্ণা। এই তো সেই আজানুলম্বিত মেঘবরণ কুঞ্চিত কেশরাশি। চোখে প্রলয়ের আগুন। আদ্যাশক্তি মহাকালীর এতো জীবন্ত প্রতিরূপ আমি ইতিপূর্বে কখনো দেখিনি ।' তারপর খানিক ভেবে বললেন - "যদি আপনি অনুমতি করেন তাহলে আমি এই স্কেচগুলোর কিছু ছবি আমার ফোনে তুলে নিয়ে যেতে চাইছি। এই বিষয়ে আরো কিছু জনের সঙ্গে আলোচনা করা প্রয়োজন। এখানে আমরা এখনো প্রায় মাস তিনেক থাকবো। আমি তার মধ্যেই চেষ্টা করবো এই রহস্যের কিছু একটা কিনারা করতে।"



(২)


-"অ্যাই উচ্ছে , এদিকে আয়"। 

উচ্ছে মাথা চুলকে গুটি গুটি পায়ে ম্যাপের দিকে এগোতেই যদু স্যার চশমাটা নাকের ডগায় তুলে চোখ রাঙিয়ে বললেন - "দেখা দেখি ম্যাপে, গান্ধী সাগর কোথায়"? 

নামটা কখনো শুনেছে বলে মনে করতে পারলো না উচ্ছে। তবু ম্যাপের সামনে দাঁড়িয়ে যতদূর সম্ভব আতিপাতি করে খুঁজে বেরাতে লাগলো। এদিকে যদু স্যার উচ্ছেকে কাজ দিয়ে আবার পড়াতে লাগলেন। খানিক বাদে উচ্ছের দিকে চোখ যেতেই পড়া থামিয়ে যদু স্যার বলে উঠলেন - " কি বাবাধন, খুঁজে পেলি জায়গাখানা? এতক্ষণে তো ট্রেন পাকরে পৌঁছে যেতুম সোজা।" উচ্ছে তখন ভারত মহাসাগর থেকে বঙ্গোপসাগরের দিকে সাঁতার কাটছে। কোনরকমে মাথা তুলে বললো - " একবার পেয়েছিলুম মনে হল স্যার। আপনাকে দেখাতে যাবো, ঠিক সেই সময়েই একটা বড় ঢেউ এসে মনে হল ভাসিয়ে নিয়ে গেলো।" উচ্ছের কথা শুনে সারা ক্লাস হো হো করে হেসে উঠলো। স্যার এবার আর রাগ সামলাতে পারলেন না। " তবে রে বাদর ছেলে, আমার সাথে মস্করা করা হচ্ছে! দেখাচ্ছি মজা " বলে কানটা পেঁচিয়ে ধরতে যাবেন , তখনই ছুটির বেআদব ঘন্টাটা ঢং ঢং করে বেজে উঠল। হৈহৈ করে ক্লাস ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল সবাই। সেদিনের মত অল্পের জন্য উচ্ছের কানটা বেঁচে গেলো। 


উচ্ছে, বেগুন ,পটল, মুলো ,এরা চারজনেই অভিন্নহৃদয় বন্ধু। চারজনেই কালীপ্রসন্ন বিদ্যানিকেতনের ক্লাস সিক্সের পড়ুয়া। এদের যদিও ভালো নাম আছে তবে সে নামে তাদের কেউ ডাকে না। এমনকি সেই নামগুলো নিজেরাও প্রায় ভুলতে বসার জোগাড়। ক্লাসে স্যারেরা নাম ডাকার সময় আজকাল মাঝে মধ্যেই সাড়া দিতে ভুলে যায় তারা। এদের দুষ্টুমিতে তটস্থ থাকে গোটা স্কুল। বেগুন আর পটল সেই সাথে পড়ালেখাতেও বেশ চৌকষ। উচ্ছে আর মুলো আবার স্কুলের ফুটবল টিমের দুই সেরা ডিফেন্ডার। 


এখন সমস্যাটা হয়েছে উচ্ছেকে মানে বিবস্বানকে নিয়ে। তার পড়াশোনা করতে মোটেই ভালো লাগে না। আর ইংরেজি তো এক্কেবারেই নয়। ইংরেজি স্যার বাড়িতে পড়াতে এলেই তার মাথা ঝিমঝিম করে, গা ম্যাজম্যাজ করে, চোখ টনটন করে। কিন্তু সেই ছেলেরই কিনা এমন ইংরেজি রোগে ধরলো!

ব্যপারটার সূত্রপাত হয়েছিল আজ থেকে প্রায় হপ্তাখানেক আগে। সেই সময় একদিন হঠাৎই ঘুমের মধ্যে বিশুদ্ধ ইংরেজিতে কথা বলে ওঠে উচ্ছে। উচ্ছের পাশে শুয়ে তার বাবা রঞ্জন বাবু ছেলেকে ঘুমের মধ্যে বেশ স্পষ্ট উচ্চারণ করতে শোনেন -"... let there be light and there was light" । তিনি বেজায় চমকে গিয়ে তাড়াতাড়ি ছেলেকে ধাক্কা দিয়ে তোলেন। উচ্ছে যদিও বাবার হাজার জিজ্ঞাসাতেও কিছুই বলতে পারে নি। বরং বেশ বিরক্ত হয়ে আবার চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। তারপর বাকি রাত যদিও নির্বিঘ্নেই কেটেছিল। 

তবে এখানেই মিটলো না ব্যপারটা। ইংরেজির ভুত উচ্ছের ঘাড়ে বরং বেশ ভালো ভাবেই চেপে বসলো। উচ্ছের মুখ দিয়ে তারপর থেকে মাঝে মধ্যেই উচ্ছের অজান্তে নানান ইংরেজী শব্দ আর বাক্য তুবড়ির মত বেরিয়ে আসতে লাগলো। এতে উচ্ছের বন্ধুরা তো বটেই উচ্ছে নিজেও বেশ অবাক হয়ে গেল। আর এই জন্যই তো আজ ক্লাসে যদু স্যারের কাছে কানটা খোয়া যেতে বসেছিল।

আসলে হয়েছে কি, উচ্ছে আজও যদু স্যারের ক্লাসে বসে চেষ্টা করছিল পড়ায় মন দেবার কিন্তু হঠাতই তার আঙ্গুলের ডগাটা কেমন সুড়সুড় করে উঠলো। খোলা খাতার সামনে পড়ে থাকা কলমটা ধরার জন্য হাতটা কেমন নিশপিশ করে উঠল। তারপর কলমটা হাতে নিতেই সেটা নিজে থেকেই আঙ্গুলের ওপর ভর করে ছুটতে শুরু করলো। যদু স্যার যখন ডাকলেন তখন খাতা প্রায় শেষ। স্যারের ডাকে সম্বিত ফিরে পেয়ে কোনরকমে পেনটাকে দুহাত দিয়ে চেপে ধরে থামালো উচ্ছে। কিন্তু ততক্ষণে যা বিপদ হবার হয়ে গেছে। স্যার ধরে ফেলেছেন উচ্ছে মোটেই তার পড়া শুনছে না। তাই তাকে ডেকে পাঠালেন ম্যাপ পয়েন্টিং এর জন্য। 

স্কুল ছুটির পর গোটা ঘটনাটা উচ্ছে খুলে বললো বেগুন, পটল আর মুলোর কাছে। খুলে দেখালো সেই খাতাটাও। পটল বেশ সময় নিয়ে পড়ল পাতাগুলো। তারপর বললো -" বুঝলি উচ্ছে, তুই যা বলছিস , তাতে কিন্তু ব্যাপারটা বেশ জটিল মনে হচ্ছে। তুই আর ইংরেজি এই দুজনের মধ্যে এমন হঠাৎ করে সদ্ভাব মোটেই সুবিধের ঠেকছে না।" পটলের সঙ্গে বাকিরাও সায় মেলালো। পটল আবার খাতাটা দেখতে দেখতে বললো - " আমার যদিও তোর লেখা কয়েকটা লাইন বেশ চেনা চেনা লাগছে। মনে হচ্ছে কোথায় যেনো শুনেছি। তুই যদি রাজি থাকিস তাহলে খাতাটা আমি একবার বাড়িতে নিয়ে যেতে চাই । বাবা তো ইংরেজির অধ্যাপক। বাবা হয়ত পড়ে কিছু বুঝলেও বুঝতে পারবে।" উচ্ছে তখন ইংরেজি ভূতের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। সে একবাক্যে রাজি হয়ে গেলো পটলের প্রস্তাবে। 

পটল বাড়ি ফিরে তার বাবাকে ঘটনাটা বলে দেখালো খাতাটা। পটলের বাবা তো শুনে হেসে উড়িয়ে দিলেন প্রথমে। বললেন , " তোর বন্ধু তোকে বোকা পেয়ে বানিয়ে বানিয়ে এসব গল্প বলেছে। " পটল যদিও বাবাকে বোঝাতে কসুর করলো না। শেষমেশ পটলের বাবা একপ্রকার বাধ্য হয়েই বললেন - "ঠিক আছে রেখে যা টেবিলের ওপর। আমি পরীক্ষার খাতা দেখছি এখন। দেখা শেষ হলে ওটা পড়বো।"

পরীক্ষার খাতা দেখতে দেখতে রাত হল অনেক। কিন্তু অনেক চেষ্টাতেও তারপর আর ঘুম এলো না চোখে। তখন নিছক খেয়াল বশেই সময় কাটানোর জন্য হাতে তুলে নিলেন টেবিলের ওপর পড়ে থাকা মলাট দেওয়া উচ্ছের খাতাটা। খাতাটা উল্টে পাল্টে দেখে বেশ অবাকই হলেন তপন সোম মানে পটলের বাবা। পরদিন সকালে পটলকে খাবার টেবিলে বসে নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করলেন -" তুমি আমাকে যার খাতা পড়তে দিয়েছো সেকি খ্রিষ্টান?" পটল সাথে সাথে জবাব দিল - "না তো। ওর দাদু তো পাশের গাঁয়ে সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দিরের পূজারী।" 

-" হম, তাহলে কি ও বাইবেল বা ইংরেজী বই টইয়ের পোকা? " 

বাবার এমন ধারা কথা শুনে এবার বেজায় হাসি পেলো পটলের। সে হাসতে লাগলো খাওয়া ফেলে।

তপন বাবু শুধোলেন - " হাসছো যে খুব?"

পটল এবার হাসি থামিয়ে বললো - " উচ্ছে মোটেই তেমন না। বরং উল্টোটাই বলতে পারো। ইংরেজির নাম শুনলেই এতদিন ওর জ্বর আসতো। সব পরীক্ষায় ইংরেজিতে ক্লাসে সব থেকে কম নম্বর পাবার রেকর্ড আছে ওর। ও তো বই তেমন ছুঁতেই চায় না। তার মধ্যে ইংরেজি হলে তো কথাই নেই। " বলেই আবার খুব হাসতে লাগলো পটল। তপন বাবু কিন্তু মোটেই হাসলেন না।বেশ গম্ভীর মুখে অন্যমনস্ক ভাবে চিন্তা করতে করতে বললেন - "কাল তো রবিবার। স্কুল ছুটি। তোমার বন্ধুকে নিয়ে এসো তো একবার। বলবে এখানেই দুপুরে খাওয়া দাওয়া করতে আর খাতাটাও ফেরত নিয়ে যেতে।" 

-" সে তো দারুণ হয় তবে। আমি বরং তবে আমার বাকি দুই বন্ধুকেও বলে দেই আসতে। মাকে বলবে খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজা করতে। অনেকদিন খাইনি" বলেই জিভটা চেটে নিয়ে ' মা, আসছি ' বলে দৌড় দিল স্কুলের দিকে।

পরদিন পটলের বাড়িতে সবাই খেতে বসার পর পটলের মা পটলের বাবাকেও ডেকে নিলেন চার বন্ধুর সাথে এক সাথে বসে খাবার জন্য। পটলের বাবা বসতে বসতে খানিক উচ্ছেকে শুনিয়ে শুনিয়ে আপন মনেই মৃদু স্বরে বলে উঠলেন - 

"Even to your old age and gray hairs I am he, I am he who will sustain you. "

কথা শেষ হতে না হতেই পটলের পাশ থেকে উচ্ছে চাপা কিন্তু বেশ স্পষ্ট গলায় বলে উঠলো - "I have made you and I will carry you; I will sustain you and I will rescue you." 

চমকে উঠলো সকলে। সব থেকে বেশি বোধ হয় অবাক হল উচ্ছে নিজেই। তপন বাবুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো - "কি হচ্ছে বলুন তো? আমি কি বলছি আমি তো নিজেই বুঝতে পারছি না। নিজে থেকেই কথাগুলো মুখ থেকে বেরিয়ে গেলো। নিশ্চয়ই ভূতে ভর করেছে আমার ওপর। আমি তো গত অমাবস্যায় শ্মশানের পাশের মিত্তিরদের আম বাগানে রাতের বেলা আম পাড়তে গেছিলাম। তখনই নির্ঘাত দানোয় ধরেছে আমাকে।" এমন ডাকাবুকো উচ্ছেকে ভেঙে পড়তে দেখে বন্ধুরা মিলে তখনকার মত অনেক স্বান্তনা দিল, সাহস দিল। পটলের মা অনেক কষ্টে বুঝিয়ে সুঝিয়ে উচ্ছেকে বাকি খাবার খাওয়ালেন। তপন বাবু আর কিছু না বলে চুপচাপ খাওয়া শেষ করে উঠে গেলেন।



(৩) 


এরপর কেটে গেলো আরো একমাস। উচ্ছের মধ্যে আগের তুলনায় অনেক বদল এসেছে। নিজের তিন বন্ধু আর মা ছাড়া কারুর সাথেই এখন আর তেমন কথা বলে না। রাত দিন খাতায় কিসব নিজের মনে ইংরেজিতে লেখে আর ভালো না লাগলে দাদুর সাথে মন্দিরে গিয়ে বসে থাকে। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বেশিরভাগ সময়েই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। ওদিকে তপন বাবুও এই কদিন পরীক্ষা আর খাতা দেখার চাপে ভুলেই গেছিলেন উচ্ছের কথা। হঠাৎই মনে পড়লো একদিন সন্ধ্যেবেলা টিভিতে একটা খবর দেখে।


সেদিন খবরে তখন নেট দুনিয়ায় ভাইরাল হয়ে যাওয়া বাছাই করা কিছু ঘটনা দেখাচ্ছিল। সেখানেই একটি মার্কিনী কিশোরের কথা জানা গেলো যে কিনা নিজের খেয়ালেই গত কয়েক মাস যাবৎ মা কালীর ছবি আঁকছে। অথচ খাঁটি আমেরিকান এই যুবক নাকি কোনোদিনই মা কালীর নামও শোনেনি আর ছবিও দেখেনি। কিছুদিন আগে ওই দেশে বসবাসকারী এক ভারতীয় পরিবারের সঙ্গে আলাপ হয় যুবকটির এবং তার পরিবারের। সেই ভারতীয় পরিবারই এই অদ্ভুত ব্যাপারটা জানতে পেরে তার রহস্য সমাধানের জন্য ওই মার্কিনী পরিবারের অনুমতি সাপেক্ষে ক্যামেরা বন্দী করে সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করে ছেলেটির ছবি আঁকার বিভিন্ন মুহূর্ত।

ঘটনাটি শুনেই চমকে ওঠেন তপন বাবু। তিনি বদলে যাওয়া উচ্ছের সাথে অদ্ভুত মিল খুঁজে পান ছেলেটির। যেনো দুজনেই পথ ভুল করে জন্ম নিয়েছে অন্য দেশে অন্য পরিবারে। খবরটা তাঁকে রীতিমত বাধ্য করে বহুদিন পর ফেসবুকে লগ ইন করতে। কিছুক্ষণের মধ্যে খুঁজে খুঁজে পেয়েও যান টিভিতে দেখানো ছবি আর ভিডিওগুলো। ছেলেটির হদিস পাবার জন্য যেই ভারতীয় ভদ্রলোক ফেসবুকে আপলোড করেছেন তার প্রোফাইলে যেতেই আবার আরেকটা ঝটকা লাগলো তার।

'আরে এ যে সুমন্ত ঘোষ মানে কলেজের সেই লাটাই।' ভদ্রলোক তপন বাবুর থেকে এক বছরের জুনিয়র। ইংরেজি নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন করার পর আই .আই. এম এ চান্স পেয়ে এম বি এ করতে চলে যান । তারপরে আর তেমন যোগাযোগ ছিল না।আজ অনেক বছর পর তাকে দেখলেও চিনতে ভুল হয় নি তপন বাবুর। অনলাইন দেখে সাথে সাথে মেসেজ করলেন তাঁকে। তারপর কথা গড়ালো গভীর রাত পর্যন্ত। যতদূর সম্ভব তপন বাবু কথার ফাঁকে জেনে নিলেন প্যাট্রিক নামে ছেলেটি সম্পর্কে যাবতীয় সব তথ্য। যদিও উচ্ছের কথা গোপনই রাখলেন আপাতত। 

পরদিন কলেজে যাবার পথে উচ্ছের বাড়ি গিয়ে রঞ্জন বাবুকে জিজ্ঞাসা করে তার সম্পর্কেও তথ্য জোগাড় করলেন। তারপর ঠান্ডা মাথায় ভাবতে বসলেন ঘটনা দুটো নিয়ে। তপন বাবুর বারবার মনে হতে লাগলো পৃথিবীর দুই প্রান্তে ঘটে চলা আপাত দৃষ্টিতে দুটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা কেমন যেন একই রকম ভাবে রহস্যজনক, যেনো দুয়ের মধ্যেই রয়েছে কোন অদৃশ্য সমীকরণ।


দুদিন পরেই পুজোর ছুটি পড়ল কলেজে। তিনি সিউড়ি থেকে কলকাতা গেলেন বাড়ির সকলের জন্য পুজোর জামাকাপড় কেনাকাটা করতে। সেই সাথে সুযোগ বুঝে দেখা করে এলেন কলকাতায় কলেজে পড়াকালীন তার হোস্টেলের রুমমেট নীলাম্বর দস্তিদারের সঙ্গে। 

নীলাম্বর দস্তিদার কলেজে থাকাকালীনই তন্ত্র , মৃত্যু পরবর্তী জীবন এবং আরো বিভিন্ন ব্যাখ্যাতীত অলৌকিক আধি ভৌতিক বিষয় নিয়ে চর্চা করতেন। এখন সে শুধু কলকাতা শহর নয়, গোটা বাংলারই একজন নাম করা প্যারাসাইকলজিস্ট। কলকাতার ভবানীপুর অঞ্চলে তার বাড়ির চেম্বারে এসেই তপন বাবু বুঝলেন তার বন্ধুর পসার যথেষ্টই ভালো। আগে থেকে বলা ছিল। তাই বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না তাকে। মিনিট পনেরোর মধ্যেই ডাক পড়লো তার। বন্ধুর সাথে দেখা করে তাকে খুলে বললেন দুটো ঘটনাই যার একটা নিজের চোখে দেখা আর একটা সুমন্তর মুখে শোনা। মন দিয়ে সবটা শুনে নীলাম্বর বাবু চেয়ে নিলেন দুটি কিশোরের সম্বন্ধেই তপন বাবুর সংগৃহীত যাবতীয় তথ্য। সেই সাথে চেয়ে নিলেন এক সপ্তাহ মত সময়। 

কলকাতা থেকে ফিরে আসার পর পরই পটলকে নিয়ে তপন বাবুকে ছুটতে হয়েছিল ডাক্তারের কাছে। ফুটবল মাঠ থেকে পায়ে ভালো রকমের চোট নিয়ে ফিরেছিল সে। কলেজের ক্লাস আর পটলের চিকিৎসা নিয়েই ব্যস্ততায় কেটে গেল দিন কয়েক। 

ফোনটা এলো তিন দিন পর। সেদিন সকালবেলা ঘুম চোখে তপন বাবু রিসিভারটা কানে চেপে ধরতেই পরিচিত কণ্ঠটি বিপরীত প্রান্ত থেকে উত্তেজিত স্বরে বলে উঠলো - "ছেলে দুটোর জন্ম তারিখটা খেয়াল করেছিস তপন? একজনের তেইশে মার্চ আর আরেক জনের চৌঠা এপ্রিল। মানে এরা কিন্তু অ্যস্ট্রলজিক্যালি দুজনেই মেষ রাশি"। তপন বাবু তাড়াতাড়ি টেবিলের ওপর থেকে চশমাটা নাকে গলিয়ে নিয়ে মোবাইলে নোট করে রাখা তথ্যগুলো হাতরাতে বললেন -" দাঁড়া দেখছি।" তারপর কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্দতা। কিছু সময় পর আবার তপন বাবুই বলে উঠলেন - " ঠিকই বলেছিস নীলাম্বর ! কিন্তু সে তো হতেই পারে।"

-" হ্যাঁ পারে তো বটেই। তবে এখানেই শেষ নয় মিল আছে আরো। প্যাট্রিক আর বিবস্বাণ বছর দুয়েকের ছোট বড় বটে কিন্তু দুজনের জন্ম কুন্ডুলিতেই মিল সাংঘাতিক। জ্যোতিষ মতে বিবস্বান জন্ম সময় অনুযায়ী কর্কট রাশি সিংহ লগ্ন বিশাখা নক্ষত্রে জাত আর অদ্ভুত ভাবে প্যাট্রিকও তাই। এবার ওদের জন্ম তারিখটা লক্ষ্য করে দেখ। প্যাট্রিকের জন্ম ৩রা এপ্রিল, ২০০৮ আর ২৯ শে মার্চ, ২০১০ । দুজনেরই জন্মতারিখের সাথে যুক্ত সংখ্যাগুলোর যোগফল হল গিয়ে ১৭ বা ৮। এমনটা কিন্তু সচরাচর হয় না বুঝলি!আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি বিশেষ গ্রুপের সদস্য যারা এই ধরনের প্যারানরমাল অ্যাকটিভিটি সম্পর্কে খোঁজ খবর রাখেন এবং নিজেদের মত গবেষণা চালান। সেখানেই আমি ঘটনা দুটো জানাই সকলের অবগতির জন্য। তোর অনুমতি নেওয়া হয় নি যদিও। তাই বিবস্বানের নামটা আমি সেখানে বদলে দিয়ে যথা সম্ভব রেখে ঢেকে কথাটা বলেছি।" 

-"আচ্ছা। কিন্তু সেখানে কেউ কি কিছু বলতে পারলো?" 

-" হমমম, অনেকেই অনেক রকম মন্তব্য করেছেন বটে। তার মধ্যে একটা বেশ ইন্টারেস্টিং বুঝলি। বলতে পারিস সেই কমেন্টাই আমাকে ভাবতে বাধ্য করলো।" 

-" কি সেটা" " 

-"একজন লিখেছিলেন, দাঁড়া পড়েই শোনাই তোকে। এই যে, এখানে - 'আচ্ছা ওদের , দুজনের জন্মের সময় বিশেষ কোনো জাগতিক বা মহাজাগতিক ঘটনার সন্ধান পাওয়া যায় কি?' বললাম তেমন কিছু তথ্য নেই আপাতত। গ্রুপে তারপর কথা আর বিশেষ না এগোলেও আমি নিজের মত করে খোঁজ খবর শুরু করি। বলতে পারিস ওই পথেই আরেকটু তলিয়ে দেখার চেষ্টা করি। তোকে ফোনও করেছিলাম মাঝে একবার। কথা বলবো বলে। লাইন পাইনি। তারপর ভাবলাম তুই তো যা জানিস বলেইছিস। তোকে আর বিরক্ত করে লাভ নেই। তারপর ভেবে চিন্তে, নিজের সোর্স লাগিয়ে ওদের জন্মের সময়ের পুরনো কিছু পত্রিকা, খবরের কাগজ পত্র জোগাড় করলাম। আর অবশ্যই গুগল বাবাজির সাহায্য নিতে হল বেশ কয়েকবার। তাতে ওই দুটি তারিখের আশে পাশে তেমন কিছু বড় ঘটনা না ঘটলেও দুটো ছোট ঘটনার কথা জানতে পারলাম যা বেশ অদ্ভুত বলতে পারিস । আমার মন বলছে সেই ঘটনা দুটোই এই দুটো কেসের মিসিং লিংক। " 

-" আচ্ছা! বেশ ইন্টারেস্টিং তো। কি শুনি সেগুলো।"

- " ২০০৭ সালে ১২ই ডিসেম্বর বীরভূমের রামপুরহাট মহকুমার অন্তর্গত বৈকুণ্ঠপুর গ্রামের বহুকালের প্রাচীন ডাকাত কালীর থানে হঠাতই আরতি করার সময় আগুন লেগে যায়। আরতি চলাকালীন সেদিন উপস্থিত ছিলেন প্রধান পুরোহিত অনন্ত নাথ চক্রবর্তীর বিলেত ফেরত ছেলে ধীমান চক্রবর্তী। সেই ঘটনায় কুড়ি জন গ্রামবাসী অল্পবিস্তর আহত হন। ধীমান বাবু, অনন্তবাবু সহ তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক ছিল। বাকি সবাই প্রাণে বেঁচে ফিরলেও ধীমান বাবু শেষ পর্যন্ত জীবনযুদ্ধে হার মানেন। তার অন্তিম সৎকার যদিও এদেশেই হয়েছিল কিন্তু কিছু ভস্মাবশেষ পাঠানো হয় ওহিও প্রদেশের ডাবলিনে, তার বাড়িতে। সেখানেই তিনি তাঁর মার্কিনী স্ত্রী এবং কন্যাকে নিয়ে থাকতেন। " 

-" হ্যাঁ, এবার একটু একটু মনে হচ্ছে, ঘটনাটা যেনো শুনেছিলাম বিবেকের মুখে। বিবেক মানে বিবেক সাহা। আমার স্টুডেন্ট। ঐ গ্রামেই ওর বাড়ি। যাই হোক। তুই এবার দ্বিতীয় ঘটনাটা বল।" -" সেটাও একই রকম ইন্টারেস্টিং আর কি রকম অদ্ভুত সমাপতন দ্যাখ। ওই ঘটনাটাও ঘটে একই দিনে। কিন্তু পেনসিলভেনিয়া প্রদেশের কিং অফ প্রাশিয়াতে। যদিও এটাও ঘটনা না বলে দুর্ঘটনা বলাই ভালো। সেখানে ওই দিন খুব বরফ পড়ছিল। নিল আর্থার ,তার দীর্ঘদিনের বুজুম ফ্রেন্ড দীনেশ সান্যালের বিয়েতে বেস্ট ম্যান হিসেবে গিয়েছিল। সেদিন চার্চে বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফেরার পথেই দুর্ঘটনাটা ঘটে। প্রবল তুষারপাতে ভিসিবিলিটি একেবারেই কমে গেছিল। তার ওপর গাড়িতে থাকা সবাই কম বেশি নেশা করেছিল। হাইওয়েতে ওঠার মুখেই একটি ট্রাক ধাক্কা মারে গাড়িটিতে। স্টিয়ারিং ছিল দীনেশের হাতে । পাশে ছিল দীনেশের সদ্য বিবাহিত স্ত্রী লিজা বেল। পেছনের সিটে বসে ছিল নীল, ড্যানিয়েল আর লি চেন। দীনেশ আর ড্যানিয়েল বাদে বাকিরা ঘটনাস্থলেই মারা যায়। ড্যানিয়েলের মৃত্যু হয় হাসপাতালে। দীনেশ বেঁচে গেলেও সারা জীবনের মত পঙ্গু হয়ে যায়। " 

-" স্ট্রেঞ্জ! " 

-" হ্যাঁ সত্যিই। তবে তোর অবাক হওয়ার মত আরো একটা তথ্য দেওয়া বাকি আছে আমার। " -"আরো? " 

-" হ্যাঁ , তা বলতেই পারিস। নিলের বাবা মাইকেল কিন্তু দীর্ঘকাল আগে নিজের দেশ পরিবার পরিজন ছেড়ে ভারতে এসে আর্তের সেবায় জীবন উৎসর্গ করেন। যদিও ছেলেকে যতদিন পেয়েছিলেন, নিজের হাতে মানুষ করেছিলেন। ছেলেও বাবার মতই ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিল। মাইকেল দীর্ঘকাল কলকাতার সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালে ফাদার হিসেবে যুক্ত ছিলেন। জীবিত থাকাকালীনই তিনি তার এক মাত্র পুত্রের মৃত্যু সংবাদ পান। দেশে যাবার মত তখন তার শারীরিক বা মানসিক সামর্থ্য ছিল না। চার্চ কর্তৃপক্ষ তাই নিজেদের উদ্যোগে মাইকেলের ইচ্ছে অনুযায়ী তার পুত্রের দেহ কফিনবন্দি করে কলকাতায় নিয়ে আসার ব্যবস্থা করে। এখানেই পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রিতে সমাধিস্থ করা হয় নিলকে। চাইলে গিয়ে দেখেও আসতে পারিস। আমি দেখে এসেছি। "

- " কি আশ্চর্য ! "

-" ব্যাস, আমার এটুকুই ছিল বলার। এবার বল কি বুঝলি?"

- "হম , তার মানে তুই বলতে চাইছিস.." 

-" হ্যাঁ , ঠিক তাই। হয়ত আগের জন্মের সেই নিলই আজকের বিবস্বান ব্যানার্জী। আর আগের জন্মের ধীমান চক্রবর্তীই এই জন্মের প্যাট্রিক।"

-"মানছি তেমনটা হওয়া একেবারে অস্বাভাবিক নয় তবু একটা প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায় মনে।"

-"কি?" 

-"দুই কিশোরের সাথেই একই সময় এমনটা হবে কেনো যদি না দুজনের মধ্যে কোনো যোগাযোগ থেকে থাকে? " 

-" জানতাম তুই প্রশ্নটা করবি। তবে সেক্ষেত্রে আমিও প্রস্তুত উত্তর নিয়ে। "  

-" কি রকম?"

-" একটা তথ্য আমি এখনও তোকে দেইনি। অপেক্ষা করছিলাম তোর এই প্রশ্নটার জন্য। এবার দেবো সেটা। শোন তবে। নিল আর দিনেশের সাথে একই অফিসে একই প্রজেক্টে চাকরি করতেন ধীমান।"

-" সে কি রে? তুই সিওর?"

-" একশো শতাংশ। মনে রাখিস আমার ক্লায়েন্ট কিন্তু সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে। তাই এই খবরটা জোগাড় করতে আমাকে খুব বেগ পেতে হয় নি। নীল, দীনেশ আর ধীমান তিন জনেরই বন্ডিং ছিল খুব স্ট্রং। ধীমান না মারা গেলে হয়ত দীনেশের বিয়েতে তিনিও বেস্ট ম্যান হিসেবে নিমন্ত্রিত থাকতেন। যতটুকু বুঝেছি তাতে আমার মন বলছে দুজনের দুটি ভিন্ন দেশে ভিন্ন দেহে নবজন্ম হলেও হয়ত তাদের অবচেতন মন ভুলতে পারেনি তাদের আগের জন্মে ফেলে আসা বন্ধুত্বের সম্পর্ককে। সেই টানেই হয় তো প্রায় কাছাকাছি সময়ে তাদের জন্ম হয়"।

-" বেশ, কিন্তু তেমনটাই যে হয়েছে সেটা সিওর হব কি করে?" 

-" এসব ক্ষেত্রে অনেক সময় একটা উপায় কাজ করে যায়। সেটাই করে দেখা যেতে পারে।" 

-" খুলে বল তুই কি ভাবছিস" 

-" প্যাট্রিককে একবার আমাদের এখানে ঘটনাস্থলে ঘুরতে ঘুরতে নিয়ে আসতে হবে। আর বিবস্বানকে একই ভাবে নিয়ে যেতে হবে সেই দেশে। এই ক্ষেত্রে যদি আমার অনুমান সঠিক হয় তাহলে দুজনেরই আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা উচিত। কারণ তাদের অবচেতন মন হয়ত এখনো আগের জন্মের স্মৃতি ভুলতে পারে নি বা বলা ভালো এখনো মনে করে যে আগের জন্মেই সে আছে। এই ভুলটা ভাঙাতে হলে তাদের সেই জায়গায় নিয়ে আসতে হবে। শোনাতে হবে তাদের সেই দুর্ঘটনার কথা। তবেই অবচেতন মন থেকে সেই আগের জন্মের প্রতি টান বা সেই সংক্রান্ত অতৃপ্তির নিরসন হবে। তারা সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে। " 

-" হম। দেখি তুই যেমনটা বলছিস তেমনটা করা সম্ভব কিনা। সেক্ষেত্রে দু বাড়ির বাড়ির লোকজনকেই বোঝাতে হবে, ভিসা পাসপোর্ট ইত্যাদি জোগাড়ের ব্যপার আছে। আর দুই পরিবারের কারুরই বিদেশ ভ্রমণের মত আর্থিক সঙ্গতি নেই তেমন। ফলে টাকা পয়সা জোগাড়ের ব্যাপারও আছে। তবে সব চেয়ে বড় কথা এই দুই বাড়ির লোক তাদের ছেলেদের সম্পর্কে জন্মান্তর সংক্রান্ত এই তত্ত্ব মেনে নিয়ে তাদের অন্য দেশে পাঠাবেন কিনা। অনেকগুলো হার্ডল রয়েছে বুঝলি। তবু মাথা যখন ঘামিয়েছি তখন চেষ্টা তো অবশ্যই করবো। বিশেষ করে এই সংক্রান্ত তোর থিওরিটা ছাড়া যখন আর কোনো বেটার এক্সপ্লানেশন খুঁজে পাইনি এই গোটা ঘটনার। " 

-" হে হে" 

-" আমি বলি কি নীলু, তুই এই ব্যপারে বিশেষজ্ঞ।তুই থাক আমার সাথে। তোকে নিয়েই আমি রামপুরহাট আর স্টেটসে যেতে চাই। "  

-" আমার হবে না রে, তপন। পর পর ডেট ফেলা আছে। তুই হ্যান্ডেল কর বাকিটা। কোনো অসুবিধা হলে ফোন করিস অবশ্যই। আর যদি ছেলে দুটো আবার আগের মত স্বাভাবিক হয়ে যায় তাহলে পুরো ঘটনাটা একটু ডিটেলে লিখিস কোথাও। "  

-" হম, ঠিক আছে। তাই হবে বস। শোন , এখন রাখি বুঝলি। সামনে অনেকগুলো কাজ আছে। পরে তোকে ফোন করছি আবার।"

ফোন রেখে প্রথমেই তপন বাবু যোগাযোগ করলেন সুমন্ত ঘোষের সঙ্গে। জানালেন সব কথা। সুমন্ত জন্মান্তরের তত্ত্বে মোটেই বিশ্বাসী নয়। সে ওই ব্যপারটা সাথে সাথে নাকচ করে দিলেও একটা ব্যপারে সম্মতি জানালেন। বললেন - " বিবস্বানের বিষয়টা বলতে পারবো না। ওকে আমি দেখিনি। কিন্তু প্যাট্রিকের যে হিন্দু ধর্ম বা ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি একটা চাপা অনুরাগ রয়েছে, সেটা ওর সাথে আলাপ হবার পর আমার বারবার মনে হয়েছে। ওর এই কালী মায়ের ছবি আঁকার ব্যাপারটাও খানিকটা সে কারণেই হয় তো। ওকে দেশে নিয়ে যাবার কথা আমিও ভাবছিলাম। পিটারের সাথে আজ কালের মধ্যেই কথা বলে নেবো। যদি পিটার রাজি থাকে তবে সামনের উইকেন্ডে মা বাবা দেশে ফিরছেন। ওনাদের সাথেই পাঠিয়ে দেবো। ও ওখানে থাকুক নিজের মত কিছুদিন। ঘুরে ফিরে দেখুক। আমি তিন মাস পর সপ্তাহ খানেকের জন্য দেশে ফিরবো। তখন ওকে নিয়ে আসবো আমার সাথে।" 

-" বাঃ। তাহলে তো বেশ হয়। তবে তোরা যদি রাজি থাকিস আমি একটু ওকে তারাপীঠ আর রামপুরহাট ঘোরাতে চাই। সে কদিন ও নয় আমাদের এখানেই থাকবে। ওর ভালো মন্দের দায়িত্বও আমার ।" 

-" তোমাকে আমি চিনি তপনদা। তুমি এক সময় আমাদের কলেজের জি. এস ছিলে।শুধু তুমি বলছো বলেই রাজি হচ্ছি। তবে আমার কথায় কি এসে যায়। আগে দেখি ওকে আমাদের সাথে পাঠাতে পিটার রাজি কিনা।" 

পরদিন বিকেলেই মেল পেলেন তপন বাবু। সুমন্ত জানিয়েছে, প্যাট্রিককে দেশে পাঠাতে রাজি হয়েছে পিটার। পরের কদিন তপন বাবুর ভারি ব্যস্ততায় কাটলো। অনেক কষ্টে রঞ্জন বাবুকে রাজী করালেন দিন কয়েকের জন্য বিবস্বান মানে উচ্ছেকে আমেরিকায় তপন বাবুর সঙ্গে পাঠানোর ব্যাপারে। সেই মত জোগাড় যন্ত্র করতেই কেটে গেলো বাকি কটা দিন। 

প্যাট্রিক দেশে ফেরার পর পরই তপন বাবু কলকাতা থেকে প্যাট্রিক, দেবব্রত বাবু এবং দোলনচাঁপা দেবীকে নিয়ে আসলেন বাড়িতে।দেবব্রত বাবুই বললেন প্যাট্রিক নাকি তার এই ট্রিপের ব্যপারে প্রথম থেকেই খুব আগ্রহী ছিল। এই ক মাসের পরিচয়েই দেবব্রত বাবুদের হাত ধরে পরিবার পরিজন ছেড়ে সে একবাক্যে চলে এসেছে। তার চোখ মুখের প্রশান্তি দেখে বারবার মনে হয়েছে তাঁদের, যেন প্যাট্রিক কোনো ভিন দেশে নয়, নিজের দেশেই পা রাখতে চলেছে।


প্যাট্রিককে পেয়ে বেশ খুশিই হল বেগুন, পটল আর মুলো। উচ্ছেকে অনেক বলেও বের করা গেলো না বাড়ির বাইরে।তাই প্যাট্রিকের আর আলাপ করা হয়ে উঠলো না উচ্ছের সাথে। প্যাট্রিক এমনিতে খুব চুপচাপ। কিন্তু পটলদের দুষ্টুমি দেখে তার মুখেও মাঝে মাঝে হাসি ফুটে উঠছিল। হৈ হৈ করেই কাটলো কিছুদিন। তারপর রবিবার দেখে তপনবাবু সকলকে নিয়ে বেরোলেন তারাপীঠের উদ্দেশ্যে। সেখানে মায়ের বিগ্রহের সামনে তন্ময় হয়ে বসে রইল প্যাট্রিক। অনেক বলা স্বত্বেও ওঠার নামটি করলো না সে। পুরোহিত মশাই বললেন - "রাত দিন অনেক ভক্তই তো আসছেন । কিন্তু এই বয়সের কোনো ছেলের এত ভক্তিভাব আমি কস্মিন কালেও দেখিনি।" এদিকে দুপুর গলিয়ে বিকেল হতে চলল। সকলেরই খিদে চাগাড় দিয়ে উঠেছে পেটে। তপন বাবু এক সময় প্রায় জোর করেই প্যাট্রিককে নিয়ে এলেন বাইরে। পরদিন প্যাট্রিককে গ্রাম ঘোরানোর অছিলায় সকলকে নিয়ে এলেন রামপুরহাটের বৈকুণ্ঠপূর গ্রামে। সেখানে যেতেই প্যাট্রিক বেশ চনমনে হয়ে উঠল। বেগুন তুলসিমঞ্চের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল - "প্যাট্রিক, বলো তো এটাকে কি বলে? " 

-" তুলসী মণ্ডপ?" 

-" একশয় আশি। মণ্ডপ নয়, মঞ্চ। আর এটা কি?" 

-" উম, নামটা মনে পড়ছে না। তবে আমি জানি এতে শস্য ভাঙ্গা হয়।" 

-" বাপরে। তুমি তো অনেক কিছুই জানো। এটা ঢেঁকি। ধান ভাঙ্গে। " তপন বাবু এদের কথা বার্তা শুনতে শুনতে বললেন - " প্যাট্রিক তুমি তো আগে কখনো এ দেশে আসনি। তাহলে এত কথা জানলে কি ভাবে? " 

-" জানি না আঙ্কেল। তবে না আসলেও এগুলো সব চেনা আমার" তপন বাবু প্যাট্রিকের উদাস মুখ চোখের দিকে তাকিয়ে আর কথা বাড়ালেন না। মোরাম বিছানো পথ ধরে ধুলো উড়িয়ে তাদের গাড়ি দুপুরের আগেই পৌঁছে গেল চক্রবর্তীদের আটচালা বাড়ির সামনে। 

পাঁচিল ঘেরা ফটকের সামনে গাড়িটা থামতেই ভিড় করলো এক গাঁ লোক। এত বড় গাড়ি নিয়ে শহর থেকে আত্মীয় কুটুমরা আসে কিনা! গাঁয়ে সবাই সবাইকে চেনে, খোঁজ খবর রাখে। তপন বাবু আগেই অনন্ত নাথ চক্রবর্তীকে জানিয়ে রেখেছিলেন তাদের আসার কথা। যদিও প্যাট্রিকের ব্যাপারে কিছুই জানাননি। বলেছিলেন শুধু বীরভূমের বিভিন্ন অঞ্চলে পূজিত ডাকাতকালী নিয়ে তিনি গবেষণা করছেন। সেই বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্যই আসবেন তিনি। 

গাড়ির আওয়াজ শুনে বেরিয়ে এলেন অনন্ত চক্রবর্তীর ভাইয়ের ছেলে কলিঙ্গ চক্রবর্তী। পরিচয় দিয়ে সকলকে নিয়ে গেলেন ভেতরে। 

তপন বাবু লক্ষ্য করলেন প্যাট্রিক এখানে আসার পর থেকে সকলের সঙ্গেই খুব স্বচ্ছন্দ সাবলীল ব্যবহার করছিল। তার হাব ভাব দেখে মনে হচ্ছিল যেন বহুকাল পর ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছে। প্যাট্রিক সকলের সঙ্গে মিশতে চাইলে কি হবে, গাঁয়ের আর সকলে কিন্তু দুর থেকেই দেখছিল তাকে। ভিনদেশী ভাষায় কথা বলা সাহেব ছোড়ার সাথে আলাপ করতে তখন তাদের ভারি সংকোচ। এদিকে প্যাট্রিক দালানে পা দিয়েই ঠিক নিজে নিজেই পথ চিনে পৌঁছে গেলো মূল ফটকের বিপরীত দিকে প্রতিষ্ঠিত কালী মায়ের মণ্ডপে। বাকি কেউ লক্ষ্য না করলেও তপন বাবু নজর রাখছিলেন সেদিকে। মায়ের সামনে জোড় হাতে দাড়ালো প্যাট্রিক। চোখ বুজে রইলো কয়েক মুহূর্ত। তারপর আচমকাই সারা শরীর খুব জোড়ে কেঁপে উঠে লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। তপন বাবু ' প্যাট্রিক ' বলে চিৎকার করে ছুটে গেলেন সেদিকে। বাকি সকলে তখন বিপদ আঁচ করে হাজির হলেন ঠাকুরের বেদীর সামনে। প্রাথমিক চিকিৎসার পরই জ্ঞান ফিরে এলো প্যাট্রিকের। সকলে ধরাধরি করে এনে শুইয়ে দিল খাটে। সকলেই বলাবলি করতে লাগলো শীতের দেশের সুখী মানুষ । নিশ্চয়ই খাবারদাবারের গণ্ডগোলের জন্য অম্বল মাথায় উঠে পড়ে গেছে। গায়ের কোয়াক ডাক্তার মন্মথ বাবু এসেও নিদান দিলেন বেশি করে জল খাবার। প্যাট্রিক কিন্তু উঠে বেশ ছটফট করতে লাগলো। তপন বাবুকে বললো - "আঙ্কেল একটু ফোনটা দিন না। ববকে একটা কল করবো"। তারপর অনেকক্ষণ ধরে দাদার সাথে কথা বললো। সেদিন গাড়িতে ফিরে যেতে যেতে প্যাট্রিক বলল - "আঙ্কেল, আমি ঠিক করেছি দেশে ফেরার আগে একবার তাজমহলটা দেখে যাবো। দাদাকে জন্মদিনে একটা তাজমহলের ছবি নিজের হাতে স্কেচ করে প্রেজেন্ট করবো ঠিক করেছি। আইডিয়াটা কেমন?"

-" খুব ভালো।" 

পাশ থেকে মুলো বলে উঠলো - "তুমি আবার দেশে গিয়ে আমাদের ভুলে যাবে না তো প্যাট্রিক।" " একদমই না । আঙ্কলের মেল আই ডি টা তো রইলই। সেখানেই কথা হবে। তবে একটা কথা স্বীকার করতেই হবে।তোমাদের দেশ কিন্তু খুব সুন্দর। ছবি আঁকার জন্য বারবার আসতেই হবে এখানে।"

প্যাট্রিক কলকাতা ফিরে যেতেই উচ্ছে আর রঞ্জন বাবুকে নিয়ে স্টেটসে যাবার তোড়জোড় শুরু করলেন তপন বাবু। উচ্ছে ততদিনে একেবারেই বদলে গেছে। বন্ধুদের সাথে আর কোনো তেমন কথা বলে না, খেলতে যায় না। স্কুলেও লম্বা ছুটি নিয়েছে। চোখে শূন্য দৃষ্টি। সারাদিন হয় চুপ করে বাড়িতে বসে থাকে আর নয় পাড়ার লাইব্রেরীতে গিয়ে চুপ করে একমনে বইপত্র ঘাটাঘাটি করে। বাড়ির সকলেই খুব চিন্তিত। এর মধ্যেই পাড়ার বয়স্ক লোকজন বাড়ি বয়ে এসে ওঝা বা গুনিন ডাকিয়ে ঝাড়ফুঁক করার জন্য উপদেশ দিয়ে গেছে। রঞ্জন বাবু তপন বাবুর ভরসায় আটকে রেখেছেন সে সব। 

মাসখানেকের মধ্যে সব ফর্মালিটিস মিটিয়ে উচ্ছে আর রঞ্জন বাবুকে নিয়ে রওয়ানা দিলেন তপন বাবু। সেখানে গিয়ে উঠলেন প্রথমে সুমন্তদের বাড়ি। তারপর সময় সুযোগ মত সুমন্তই রঞ্জন বাবু, তপন বাবু আর উচ্ছেকে নিয়ে গেলেন অকুস্থলে। প্রথম থেকে জায়গার নাম শুনেই খুব খুশি খুশি লাগছিল উচ্ছেকে। 

ওহিও থেকে সকলে প্লেনে গেলেন ফিলাডেলফিয়া। ফিলাডেলফিয়া ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়েই উচ্ছে বললো হোটেল তো বেশি দূর না। হেঁটেই চল। রঞ্জন আর তপন দুজনে সেই শুনে একবার নিজেরা দৃষ্টি বিনিময় করে নিলেন। তারপর উচ্ছের কথা মত হাঁটতে লাগলেন। মোটামুটি মিনিট কুড়ি হাঁটার পরই উচ্ছে বেশ ক্লান্ত স্বরে বললো রাস্তাটা পেরোতে হবে এবার। সেই মত উচ্ছের হাতটা ধরতে যেতেই রঞ্জন বাবুর হাত বেখেয়ালে লেগে গেলো উচ্ছের কপালে। লাগাতেই চমকে উঠলেন তিনি। "আরে, তোর গা তো জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।" সুমন্ত তাড়াতাড়ি একটা ক্যাব বুক করে হসপিটালে নিয়ে গেলেন উচ্ছেকে। 

গাড়িতে উঠেই উচ্ছে তলিয়ে গেল গভীর ঘুমে। হসপিটালে সেদিন বিনিদ্র রজনী কাটলো সকলের। পরদিন জ্বর ছেড়ে যাবার পর চোখ মেলে তাকিয়েই উচ্ছে প্রশ্নের বন্যা বইয়ে দিল - "বাবা আমার কি হয়েছিল? মাকে নিয়ে এলে না কেনো? মার সাথে কথা বলব। ফোনটা দাও না প্লিজ।" তপন বাবু বুঝলেন আর কোনো সমস্যা নেই।

দিন চারেকের মাথায় হসপিটাল থেকে সুস্থ হয়ে বেরিয়ে এলো উচ্ছে। বেরিয়েই স্বভাবসুলভ ছেলে মানুষী নিয়ে বায়না জুড়ল ডিজনিল্যান্ড ঘুরতে যাবার। সুমন্তই ব্যবস্থা করে দিল সব। তারপর তারা আবার ফিরে এলেন দেশে। 

তপন বাবু ফ্লাইটে আসতে আসতে একসময় উচ্ছের আড়ালে রঞ্জনবাবুকে জানালেন - " বুঝলেন ,উচ্ছের দেখানো ওই ক্রসিংয়েই দুর্ঘটনাটা ঘটেছিল, নিল যে গাড়িতে শেষবারের মত চেপেছিল, সেই গাড়িটির। " শুনে রঞ্জন বাবু অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন তপন বাবুর দিকে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract