ভালোবাসার টান
ভালোবাসার টান
-"মা ভালো করে আশির্বাদ করো, যেনো জিতে ফিরতে পারি। অ্যাই দিদি কাঁদছিস কেনো রে? হাস বলছি। হাস। না হলে কিন্তু সুড়সুড়ি দেবো।"
-"না রে ভাই, কাঁদছি না। তুই দেশের সম্মান বাঁচাতে লড়াই করতে যাচ্ছিস, সেটা আমাদের পক্ষে কত সম্মানের বিষয় বল তো। এতদিন তো আমরা এই স্বপ্নই দেখে এসেছি। এখন আবার ভয় পাবো কেনো? ভয় তো পাবে শত্রুরা।" তারপর স্নেহলতা ভাইকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো," একদম চিন্তা করিস না ভাই। আমরা জানি তোরা ঠিক জিতবি। সেদিন আমরা সবাই ফুল মিষ্টি নিয়ে অপেক্ষা করব তোদের জন্য। "
-" মনে থাকে যেন। আর একটা কথা। জিতে ফিরলে কি আনবো বল দেখি। "
-" ধুর কি আবার আনবি। তোকে কাছে পেলেই হবে। "
-" আরে বাবা, সে তো পাবিই। কিন্তু আর কি আনবো বল। তুই যা চাইবি তাই আনবো।"
-" বলছিস? "
- " হ্যাঁ বলছি। তিন সত্যি।"
-" বেশ তবে রসগোল্লা আনিস। অনেকদিন রসগোল্লা খাইনি। ব্ল্যাক আউটের জন্য তো বেরোতেই পারি না বাইরে। বাড়িতে মা র সুগার। তাই মিষ্টি বানানোও হয় না। "
-" ব্যাস এই। আচ্ছা ,তাই হবে দিদি। হাঁড়ি ভর্তি রসগোল্লা আনবো আর দুজনে জমিয়ে খাবো।"
তারপর মা দিদিকে বিদায় জানিয়ে বন্ধুদের সাথে হইহই করতে করতে ভারতের সামরিক বাহিনীর তরুণ প্রতিভাবান যোদ্ধা লেফটেন্যান্ট সুদীপ চাকলাদার বেরিয়ে গেলো নিজের গন্তব্যে।
কয়েক মাস পরের ঘটনা।
শেষ হয়েছে রক্তক্ষয়ী মুক্তি যুদ্ধ। ভারতের বীর ছেলেরা ঘরে ফিরেছে একে একে, কেউ নিজের পায়ে, আর কেউ কেউ কফিন বন্দী হয়ে। আজ রাতে নিজের গ্রাম হরিশাপোতায় ফিরছে সুদীপও। বীর বরণের জন্য মুখিয়ে আছে সারা গাঁ। সুদীপের বাবা ছোটবেলাতেই পরিবারকে ছেড়ে অকালে চলে যান। তারপর থেকে মা আর দিদিই আদরে সোহাগে বড় করেছেন সুদীপকে। তাঁকে মানুষের মত মানুষ করে তুলেছেন। ছেলের জন্য আজ তাঁরা গর্বিত। আজ তাঁদের ঘরে বহুদিন পর খুশির চাঁদ উঁকি দিয়েছে।
আজ তো রাখি পূর্ণিমা আর আজকের দিনেই যুদ্ধ জয় করে ভাই ফিরছে ঘরে। সারাদিন ধরে যত্ন করে স্নেহলতা বানিয়েছে ইলিশ মাছের নানা পদ, নারকেলের মিষ্টি। কে জানে কতদিন পেট ভরে খেতে পারে নি ভাইটা।
ফুল, মালা, উত্তরীয় জড়িয়ে সুদীপ একসময় ঢুকলো ঘরে। তাঁকে তখন বেশ ক্লান্ত আর বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল। তবু একটুকরো হাসি যেন লেগেছিল তাঁর শুকনো ঠোঁটের কোণায়। স্নেহলতা যেন সেটা বুঝেই আসন পেতে হাওয়া করতে করতে বললো - "আয় ভাই। জিরিয়ে নে আগে। অনেক ধকল গেছে সারাদিনে। সোনা আমার।"
সুদীপ তবু হেসে বলল ,"মনে আছে তোকে কথা দিয়েছিলাম, জিতে ফিরবো? "
স্নেহলতা প্রাণ খুলে হেসে বললো-"মনে আছে রে মনে আছে।"
-"আর জিতে ফিরলে কি আনতে বলেছিলি মনে আছে?"
স্নেহলতা এবার লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে বলল - "আগে বোস দেখি। রাখীটা বেঁধে দিই। তারপর দিস।"
কথাটা শুনেই জোরে হেসে উঠলো সুদীপ - "হাত? হাত কোথায় রে? সে দুখানা তো মাস কয়েক আগেই ভারতমাকে উৎসর্গ করে দিয়েছি। সেদিন বোমাটা যে ওরা গাড়ির বনেটেই রেখেছিল বুঝতে পারিনি বুঝলি। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেছি। আমি বেশ বুঝতে পারি জানিস, তোর ভালোবাসাই টেনে এনেছে আমায়। ছাড় সেসব কথা। রাখীটা বরং আমার এই জামার পকেটে ঢুকিয়ে দে। সারা জীবন যাতে উর্দির ব্যাজগুলোর মতই এটাও যাতে রাখতে পারি সাথে।"
স্নেহলতা মুখ বুজে কাঁদতে কাঁদতে রাখীটা পকেটে রাখতেই সুদীপ বললো ," দিদি এতক্ষণে বোধ হয় রান্নাঘরে রসগোল্লার হাঁড়িগুলো চলে এসেছে। আমি বলে দিয়েছিলাম ওখানেই রাখতে। নিয়ে আয় দেখি একটা হাঁড়ি। আমার সামনে মুখে দে একটা।.."