লক্ষ্মী লাভ
লক্ষ্মী লাভ


বীরশিবপুরে বিপিন হালদার এক মস্ত বিপদে পড়েছেন। আসছে মঙ্গলবার এই সময় ঘরে ঘরে সকলে ব্যস্ত হয়ে পড়বে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোয় আর এরই মধ্যে কিনা হালদার বাড়ির পাঁচ- পাঁচটি নারকেল গাছ থেকে সমস্ত নারকেল একেবারে বেমালুম হাওয়া !!এমনকি কচি কচি ডাবগুলো পর্যন্ত চুরির হাত থেকে রেহাই পায়নি ! সকলের নাকের ডগা দিয়ে এই এত্ত নারকেল বেপাত্তা হয়ে গেলো আর কিনা কাক পক্ষীতেও টেঁর পেলো না কিচ্ছুটি। বিপিন হালদারের বারবার মনে হলো নারকেল তো নয়, যেনো তার মান সম্মানখানাই চোরবাবাজীবন ছ্যাঁদায় বেঁধে নিয়ে চম্পট দিয়েছে।
বীরশিবপুরে হালদার বাড়ীর লক্ষ্মীপুজো প্রতি বছরই বেশ ধুমধাম করে সাড়ম্বরে পালন করা হয় , বা বলা ভালো তেমনটাই ফি বছর হয়ে আসছে আর কি। গ্রামের বাড়িতে তার এই লক্ষ্মীপুজোয় শহর থেকে মেয়ে, জামাই, নাতি-নাতনি সবাই চলে আসে বিজয়া দশমীর দিন । এখানেই গাঁয়ের আর পাঁচ ঘর মানুষের সাথে বিজয়ার মিষ্টিমুখ সেরে কোমর বেঁধে সকলে নেমে পড়ে মা লক্ষ্মীর আবাহনে। বিপিন বাবু মানে পাড়ার আর সকলের হালদার দাদুর অর্ধাঙ্গিনী হালদার দিদার নারকেল নাড়ু শুধু পরিবারের মধ্যে নয় পাড়ার সকলের কাছেই যাকে বলা যায় একেবারে 'মোস্ট ওয়ান্টেড ' জিনিস । সেই দেবভোগ্য নারকেল নাড়ু তৈরীই হয় হালদার বাগানের ৫টি গাছের নারকেল দিয়ে। লক্ষ্মীপুজোর দিন দুয়েক আগে লোক লাগিয়ে পাড়ানো হয় গাছ ভর্তি সব ঝুনো নারকেল। বাজারের নারকেল বিপিন দাদুর বিচারে পুজোয় দেবার উপযুক্তই নয়। আর সত্যি বলতে কি পাড়ার সকলে তার সঙ্গে এই বিষয়ে একমত যে হালদার বাগানের নারকেলের জাতই আলাদা। যেমন তালমিছরির মত মিষ্টি জল তেমনই ক্ষীরের মত মিষ্টি নারকেলের শাঁস । বয়সের দরুন দিদা এখন আর একা হাতে নাড়ু পাকিয়ে উঠতে পারেন না। তাই দিদার তদারকিতে আর রেসিপি মেনে গ্রামের মেয়ে-বৌদের হাতে হাতে তৈরী হয় এই মহাপ্রসাদ। লক্ষ্মীপুজোর একদিন আগে থেকেই বাড়ির চারপাশ নারকেল পাক দেবার সুবাসে ম-ম করতে থাকে। গন্ধে গন্ধে ভিড় জমায় বাড়ির সুমুখে রথতলার মাঠে খেলতে আসা কচি-কাচার দলও। এবার কিনা সেই নারকেলের ভান্ডারেই চুরি। একে তো চুরি বললেও কম বলা হয় । এ যেন একেবারে গলা কেঁটে ডাকাতির মতোই জঘন্য অপরাধ । নেহাত বিপিন বাবু শান্তিপ্রিয় মানুষ। তাই এসব নিয়ে পুজোর মধ্যে থানা পুলিশ করে আর ঝামেলা বাড়াতে চাননি । এ যাত্রা তাই বাজারের গুটি কতক কেনা নারকেল দিয়েই নমঃ নমঃ করে পুজোর কাজ সারবেন ঠিক করেছেন।
ঘটনাটি ঘটেছে গতকাল মানে বিজয়া দশমীর দিন। পাড়ার দুর্গাঠাকুর যাত্রা করিয়ে বেশ রাত করে ক্লান্ত দেহে ফিরেছিলেন পাড়ার সকলে। আজ শুক্রবার সকালে বিপিন হালদার মাঠ থেকে প্রতিদিনের মতই প্রাতঃভ্রমণ সেরে ফিরে আসার পথে রীতিমত ডেকে দাঁড় করিয়ে বিষয়টা নজরে আনেন পাশের বাড়ির কালিবাবু অর্থাৎ কালীপ্রসন্ন চক্কোত্যি । ঠোঁটের কোণে এঁটো হয়ে ঝুলে থাকা তেরছা হাসিখানা দেখলে ভালই মালুম হচ্ছিলো যে তিনি মনে মনে বিপিন বাবুর নারকেল বিলুপ্তির ব্যপারটা বেশ আয়েশ করে উপভোগ করেছেন যদিও মুখে বেজায় দুঃখ প্রকাশ করলেন এমন মর্মান্তিক ঘটনার জন্য ।
বীরশিবপুরের লক্ষীপুজো সেই বাপ ঠাকুদ্দার আমল থেকেই প্রতি বছর হালদার আর চক্কোত্যি - এই দুই পরিবারকে কেন্দ্র করে দারুণ ভাবে জমে ওঠে। আগে চক্কোত্যিদের পুজোয় জাঁক জমক কিছু কম হলেও হালের কিছু বছরে দেখতে দেখতে হালদার গিন্নির নারকেল নাড়ুকে জোর টক্কর দিতে শুরু করেছে ঘোষাল গিন্নির তুলাইপাঞ্জি চালের ভুনি খিচুড়ী । তবে ধারে ভারে এখনও জনপ্রিয়তার নিরিখে টলমল করতে করতে হলেও সেরার শিরোপাটুকু ধরে রেখেছে বা বলা ভালো রেখেছিল এই হালদার বাড়ির নারকেল নাড়ুই । এই সত্যটা মন থেকে কোনো দিনই মেনে নিতে পারেননি কালি চক্কোত্যি আর তার পরিবার ।
যথারীতি প্রতি বছরের মত এবছরও বিজয়া দশমীর পরদিন অর্থাৎ শুক্রবার সন্ধ্যে বেলা হালদার বাড়িতে সপরিবারে শহর থেকে মেয়ে জামাই এলো । সেখানে নারকেলের জন্য শোক স্বত্তেও ছিল ভালো আয়োজন। মনের দুঃখ মনেই চেপে বিপিন বাবু সকাল সকাল ফর্দ মিলিয়ে থলে ভরে বাজার করে এনেছিলেন । হালদার গিন্নিও জামাইয়ের পছন্দ মত একে একে তৈরি করেছিলেন চালকুমড়োর পুর ভাজা, ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে কচুর শাক, চিংড়ি দিয়ে মোচার ঘণ্ট, চিতল মাছের মুঠ্যা, গোপালভোগ আর পায়েস। সেদিন রাতে তিন তলার ঘরে বসে পাত পেড়ে কব্জি ডুবিয়ে জামাই বাবাজীবন এত সব লোভনীয় খাবার-দাবার খেতে খেতে একসময় বেজায় হাঁপিয়ে উঠলো । তারপর যেই না পায়েস ভর্তি জাম বাটিতে মুখ দিতে গেলো হঠাতই তারস্বরে কানে ভেসে এলো একদম ছোটো কোনো বাচ্চার পরিত্রাহি কান্নার আওয়াজ। আচমকা সেই আওয়াজ শুনে জামাই বাবাজীবন ঘাবড়ে গিয়ে বেমক্কা বিষম খেয়ে গেলেন । হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল জামবাটি ভর্তি পায়েস। বাড়ির আর সকলে ব্যস্ত হয়ে উঠলো অবস্থা সামাল দিতে। সকলেই একমত হল যে এমন বেয়াক্কেলে আওয়াজটা বেশ কাছ থেকেই হয়েছে । যদিও এত রাতে আওয়াজটা কোথা থেকে হয়েছে সেটা বোঝা গেল না কিছুতেই। নাতি-নাতনিরা সামনেই ছিল। তারা অত ছোটো নয় আর কাঁদলে তো দেখতেই পেত সবাই। বাইরে আলো নিয়ে বাড়ির চারপাশেও কজন মিলে খুঁজে দেখলো কিন্তু কোনো বাচ্চাকেই চোখে পড়লো না কারুর। এরপর গোটা তিন দিন ধরে এইরকম বিভিন্ন সময় একইভাবে বারবার সদ্যোজাত কোনো বাচ্চার কান্নার আওয়াজ পাওয়া যেতে লাগলো হালদার বাড়িতে । কিন্তু বারবার বাড়ির সকলে মিলে চিরুনি তল্লাশি চালালেও কে কাঁদছে কিছুতেই বোঝা গেল না সেটা। হালদার বাড়ির সকলেই এরকম একটি অলুক্ষণে অদ্ভুতুড়ে ঘটনায় বিমর্ষ হয়ে পড়ল। কখনো মাঝরাতে তো কখনো ভোররাতে, কখনো ফুল তুলতে গিয়ে বা কখনো বাসন মাজতে গিয়ে, কখনো ঘুমের মধ্যে তো কখনো কাজের ফাঁকে আচমকা একটানা কিছু মুহূর্ত কান্নার আওয়াজ বারবার দিশাহারা করে দিতে লাগলো হালদার পরিবারের সদস্যদের। উৎসবের মরসুমেও পরপর দুটো এমন ধারার ঘটনা ঘটতে দেখে চিন্তায় ভাবনায় নাওয়া খাওয়া মাথায় উঠলো সবার। লক্ষীপুজোর আগে এমন সব আজব ব্যপার গ্রামের কেউই শুভ লক্ষণ বলে মেনে নিলেন না। গ্রামের প্রবীন মানুষ বলাইবাবু বা হালদার দাদুর বন্ধু গোবিন্দবাবু পরামর্শ দিলেন যে অসুয়া কাটাতে যাগ- যজ্ঞ করার।
এইরকম ভাবেই মাঝের কটা দিন তালে গোলে কেটে গেল সকলের। লক্ষীপুজোর দিন এবার হালদার দাদুর পুজো কোনরকমে সম্পন্ন হলো । গ্রামে অভিবাবকদের নিষেধের কারণে কচি-কাচার দলও ভয়ে ভয়ে ভিড় বাড়ালো না হালদারবাড়িতে। যদিও নাড়ু হয়েছিল প্রায় পরিমাণ মতোই কিন্তু বাড়ির কিছু লোক, আত্মীয় স্বজন আর দু-চার ঘর প্রতিবেশী ছাড়া খাবার তেমন লোক হল না মোটে। পুজোতে নিয়মমাফিক করা হয়েছিল সব কিছুই কিন্তু এতো সব কিছু ঘটে যাবার পর হালদার বাড়ির উৎসবের সুরটাই যেন কেটে গিয়েছিল । বীরশিবপুরের এবারের লক্ষীপুজোর অঘোষিত বিজয়ী পরিবার তাই চক্কোত্যি বাড়ি। সেখানে এ বছর আরো বড় আকারে হই-হই করে পালিত হয়েছিল লক্ষীপুজো। কালিবাবুর ছেলে লোকাল মিডিয়াতে তাদের বাড়ির পুজো নিয়ে অনুষ্ঠান সম্প্রচারের ব্যবস্থাও করেছিল। কালি বাবুর গিন্নির হাতে তৈরি খিচুরী ভোগ মাতিয়ে দিয়েছিল গোটা পাড়া। খিচুরির রেসিপি এবং পুজোর ফটো ফলাও করে বাড়ির নতুন প্রজন্ম প্রচার করেছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়। প্রসাদের বড় বড় থালা পৌছে গিয়েছিল পাড়ার সকলের বাড়ি। এক বড় কাঁসার থালা ভর্তি খিচুড়ি ভোগ এসেছিল হালদার বাড়িতেও। এবার সেই সাথে নতুন একটা মিষ্টি যোগ হয়েছিল তাদের বাড়ির ভোগের মেনুতে - কেশর নারকেল বরফি। আবির্ভাবেই নাকি বাজিমাত করে দিয়েছিল সেটি। প্রসাদের থালায় রাখতে না রাখতেই নিমেষের মধ্যে ফুরিয়ে গেছিল তা। পাড়ার অনেকেই দেরি করে যাওয়ায় বরফি না পেয়ে দুঃখ করেছিলেন বেশ।
যাই হোক! লক্ষ্মী পুজো কেটে গেছে দিন দুই হল। হালদার বাড়িতে কান্নার শব্দ এখন আর পাওয়া যায় না । পাড়ায় এখনও কান পাতলেই শোনা যায় চক্কোত্যি পরিবারের সুখ্যাতি।
বিপিন বাপু বাজারে যাচ্ছিলেন সেদিন। হঠাত তাকে দেখে দৌড়তে দৌড়তে এসে হাজির হল পাড়ার কালু মল্লিক। কালু ছোটখাটো ইলেকট্রিক দোকানে টুকটাক কাজ করে। বাকি সময় পয়সার গন্ধে গন্ধে পাড়ায় রাজনীতি থেকে শুরু করে ক্লাব এর পুজো, ফুটবল খেলা সবেতেই অংশ নেয় সে। অল্পসল্প হাত টানেরও দোষ আছে তার। আর সেই কারণে হাজতবাসও হয়েছে কয়েকবার। অভাবের সংসার তার। বাবা গত হয়েছে সেই কোন ছোট বেলায়। আপন বলতে আছে শুধু মা আর ছোটো বোন। কালুই কষ্টে-শিষ্টে দেখে তাদের। বাজারে সেদিন বিপিন বাবুকে দেখেই একটা ঢিপ করে প্রণাম করে বলল কালু –‘ দাদু একটা দরকারি কথা ছিল। যদি অভয় দেন তো বলি '। বিপিন বাবু বুঝলেন নিশ্চয়ই কোনো মতলব আছে ব্যাটার । তাই শ্যামলের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ফুলকপি পছন্দ করতে করতে দায়সারা ভাবে বললেন - বলো কি বলতে চাও। ' কালু খানিক আমতা আমতা করে মাথা চুলকে বললো – ‘আসলে হয়েছে কি, আমার মোবাইলটা আপনার বাড়িতে ফেলে গেছি গত হপ্তায়।’ এমন দেশি কথা শুনে অবাক হয়ে বিপিন বাবু সবে শুধোতে যাবেন ব্যাপারখানা সেই সুযোগ তাকে না দিয়েই বিপিন বাবুর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে কালু আবার বলতে শুরু করলো- 'তাহলে আর বলছি কি দাদু! আমি তো না পেয়ে পেত্থমে নিজের জিনিসপত্তর নেড়েঘেঁটে খুঁজে খুঁজে হাল্লা হয়ে গেলাম। সেদিনের কেনা এসমার্ট ফোন বলে কথা! এখনো সব টাকা শুধতে পারিনি। এরই মধ্যে হারিয়ে ফেললে বড্ড বেপদ হয়ে যাবে । তারপর একদিন রাত্তির বেলা ফ্যানের দিকে তাকিয়ে শুয়ে শুয়ে হঠাৎ মনে পড়ল আরে , সেখানা তো সেদিন আপনার বাড়ির দক্ষিণ দিকের একদম শেষ নারকেল গাছের কোটরে গুজে রেখে চলে এসেছি। তা যদি আজ্ঞা হয় তো একবার উঠে পেড়ে আনি সেখানা ?' কথাটা শুনে চমকে উঠলেন বিপিন বাবু। কালুর মুখের দিকে চেয়ে কড়া ভাবে জিজ্ঞেস করলেন - ' তা তুমি বাপু আমার বাড়ির নারকেল গাছে উঠে কি করছিলে শুনি? আমি তো নারকেল পাড়ানোর জন্য তোমাকে কখনো ডেকেছি বলে মনে পড়ছে না।' কালু প্রশ্নের এমন বাউন্সার সামলাতে সামলাতে মিনমিন করে বলল-‘এই তো দাদু। আপনাদের না মনে বড্ড সন্দ । এত কিছু জেনে কি করবেন বলুন তো। আপনারা পাড়ায় আছেন এদ্দিন। কোনোদিন কি পর ভেবেছি আপনাদের? জন্ম ইস্তক আপনার বাড়ির গাছগুলোকেও তো নিজের বলেই ভেবে এসেছি। তাই তো এবারেও লক্ষ্মীপুজোয় আর কেউ তেমন না গেলেও আমি কিন্তু পেট ভরে খেয়ে এসেছি মাসিমার হাতে পাকানো নাড়ু।...' হাত পা নেড়ে আরো অনেক কিছুই উষ্টুম ধুস্টুম বকছিল কালু। এদিকে বিপিন বাবুর কাছেও নারকেল চুরির ব্যাপারটা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। । বিপিন বাবু ফের একবার হাতের লাঠিখানা উঁচিয়ে ধমকে উঠলেন কালুকে।
ইতিমধ্যে হাটের মাঝে গোলমাল শুনে ধীরে ধীরে লোক জমতে শুরু হয়েছে । সকলের সামনে বিপিন বাবুর জেরার মুখে পড়ে অবস্থা বেগতিক বুঝে কালু কেঁদেকেটে বলে উঠলো - 'মায়ের নামে দিব্ব্যি করেছিলাম । আপনেরা রাখতেও দিলেননি সে কথাখান । এখন হালদার কত্তা যদি দুটো নাড়ু দেন খেতে , তবে ভরসা পেয়ে দিব্ব্যি ভাঙ্গি। শুনেছি মায়ের প্রসাদ খেয়ে প্রিতিজ্ঞে ভাঙলে নাকি পাপ হয় না ’। বিপিন বাবু সজ্জন ব্যক্তি। কালুকে বললেন পিছু পিছু তার বাড়ি আসতে। তারপর তাকে বাড়ির দাওয়াতে বসিয়ে নাড়ু, জল খাওয়ালেন। ততক্ষনে রগড় দেখতে এক পাড়া লোক হুমড়ি খেয়ে জড়ো হয়েছে হালদার বাড়ির উঠোনে।
খান বিশেক প্রসাদী নাড়ু আর এক ঘটি জল খেয়ে লম্বা একটা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে কালু বলা শুরু করলো-‘ আসলে দোষখানা সম্পূর্ণ আমার নয় । আপনার প্রেতিবেশী চক্কোত্যি বাবু দুই হাঁড়ি চাল দিয়ে মহালয়ার দিন সওদা করেছিলেন আপনার বাড়ির ওই পাঁচ গাছ নারকেল পাড়িয়ে নেবার । নবমীর রাতে আমি সেই মত কাজও করি। কিন্তু ভুলের ফেরে মোবাইল খানা ট্যাঁক থেকে খুলে সেই যে কোটরে গুজেছিলাম সেটা নামার সময় ওখানেই ফেলে রেখে চলে আসি। সত্যি বলতে সেই সময় চিন্তায়, ভয়ে আর তাড়াহুড়োতে মোবাইলের কথা খেয়ালও ছিলনি । তারপর দশমীর দিন চক্কোত্যি বাবুর নির্দেশ মত বীরশিবপুর ছেড়ে পাশের গাঁয়ে মামাবাড়ীতে গিয়ে গা ঢাকা দেই। দিন পাঁচেক পর লক্ষ্মীপুজোর দিন আমি বাড়ি ফিরি । মোবাইলটার কথা ততোদিনে মনে পড়তেই খুঁজেছি অনেক। প্রথম প্রথম অন্য কোনো ফোন থেকে নম্বর লাগালে ওদিকে শব্দ শোনা যেত । এখন দুদিন হল তাও বাজে না । তখন বুঝলাম আসলে ওর দম শেষ ! হঠাত কানে এলো যে পাড়ায় সকলে বলাবলি করছিল যে আপনাদের বাড়িতে নাকি কদিন যাবৎ যখন তখন বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে । এদিকে আমার মোবাইলেও তো ফোন এলে তেমনই আওয়াজ হত। তখনই মনে পড়ল যন্তরটার গাছে রেখে আসার কথাখানা । এদিকে মনে পড়লেও কি ভাবে সেটা ফেরৎ পাবো, মাথায় আসছিল নি কিছুতেই। আজ আপনাকে বাজারে দেখে শেষমেষ কপাল ঠুকে সাহস করে পেড়েই ফেললাম কথাটা। ’
কালুর স্বীকারোক্তি শুনে জোর গুঞ্জন শোনা গেলো ভিড়ের মধ্যে। এদিকে কালু তখন কথা শেষ করে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হালদার দাদুর মুখের দিকে। দাদু বললেন-‘ গাছে উঠে এখনই পেড়ে আনো তোমার মোবাইল কিন্তু মায়ের নামে শপথ করে তার আগে সকলের সামনে বলতে হবে তোমাকে যে তুমি এই কাজ আর কখনো করবে না।’ কালু এবারে বিপিন বাবুর কথায় সম্মতি জানিয়ে সব নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করলো। মোবাইলটা হাতে নিয়ে বিপিন বাবুর সামনে কৃতজ্ঞ চিত্তে হাত জোড় করে দাঁড়াতেই বিপিন বাবু বললেন - ' আজ থেকে আমার লক্ষ্মীমায়ের নিত্যপুজোর আয়োজন আর বাগান দেখাশোনার ভার তোমাকে দিলাম। তার বিনিময়ে উপযুক্ত মাসোহারা দেবো তোমাকে যাতে আর কোনো অভাব না থাকে তোমাদের পরিবারে । দেখো বাবা, আমার বিশ্বাসের অমর্যাদা করো না যেন । সে আমি এই বুড়ো বয়সে আর সইতে পারবো না ।’ কালু এবার কেঁদে ফেলল আনন্দে । লোকমুখে গোটা ঘটনার খবর পৌঁছলো দেওয়াল লাগোয়া কালি চক্কোত্যিদের বাড়িতেও । এত সব কিছু জানাজানি হয়ে যাবার পর পাড়ায় তাদের আর মুখ দেখানোর জো রইলো না। ওই বাড়ির সকলে কিছুদিন কাক পক্ষীর মুখ দেখাও বন্ধ রাখলেন। তারপর এক হপ্তার মাথায় হঠাৎই একদিন কেউ কিছু টেঁর পাবার আগেই তল্পিতল্পা গুটিয়ে বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেলেন। আর এরপর থেকে শুধু পরের বছর নয়, প্রতিবারের মত লক্ষ্মীপুজোর সেরার শিরোপা জিতে নিল হালদার পরিবার। তোমরাও চাইলে সামনের বছর আসতে পারো হালদার বাড়ির লক্ষ্মী পুজোয়। সপরিবারে সকলের আমন্ত্রণ রইলো।