অনুপ্রেরণা
অনুপ্রেরণা


বিষয় - ডায়রি
"আচ্ছা আলোকপর্ণা দি, আপনি তো বিগত দশ বছর যাবৎ এতো বেস্ট সেলার উপন্যাস পাঠকদের উপহার দিয়েছেন। তার মধ্যে আপনার বিচারে আপনার নিজের মনের কাছাকাছি কোনটি?" বেশ গুছিয়ে প্রশ্নটি রাখলো সুসময় পত্রিকার নবীন সাংবাদিক সংহিতা সেন। লেখিকা আলোকপর্ণা গুহ ঠাকুরতা এই সময়ের একজন নামকরা লেখিকা। এত বড় মাপের একজন ব্যক্তিত্বের একান্ত সাক্ষাৎকার নেওয়ার মত বড় সুযোগ সংহিতার কর্মজীবনে ইতিপূর্বে কখনো আসেনি। তাই আজকের ইন্টারভিউটা নেওয়ার আগে সংহিতা নিজেও প্রস্তুতি নিয়েছে যথেষ্ট। খুঁটিয়ে পড়েছে আলোকপর্ণার লেখা বিভিন্ন উপন্যাস। বহু পাঠক পাঠিকার আবেগ জড়িয়ে আছে এই মানুষটির লেখার সাথে।
সংহিতার প্রশ্নের উত্তর দিতে বেশ কিছুটা সময় নিলেন তিনি। তারপর ভেবে বললেন -" দেখুন,
সেভাবে তো বলা খুব কঠিন। প্রতিটি লেখাই আমার কাছে আমার সন্তানের মত। প্রতিটি গল্প লেখার সময় আমার মন প্রাণ সবটুকু উজাড় করে দেই তাতে। কাহিনীর প্রয়োজনে চরিত্রদের সৃষ্টি, গতিবিধি , কার্যকলাপ সবই গভীর ভাবে স্পর্শ করে থাকে আমার চেতনাকে। তাদের যন্ত্রণার কথা লিখতে লিখতে নিজের মনে মনে দগ্ধ হই, রক্তাত্ব হই। আবার একইভাবে তাদের প্রেম ভালোবাসা সুখানুভূতির কথা লিখতে লিখতে নিজেই আর্দ্র হয়ে উঠি স্নেহে, ভালোবাসায়। কিছু সময়ের জন্য তারা যেন আমার ভীষন চেনা ঘরের লোক হয়ে ওঠে। আমিও হয়ে উঠি তাদেরই একজন। তবু যদি কোনো একটি উপন্যাসকে আলাদা করে বাছতে হয় তবে আমি বলব 'মুছে যাওয়া দিনগুলি' উপন্যাসটির কথা।
সংহিতা হাতে ধরা কফি মগে ছোটো একটি চুমুক দিয়ে বললো, " এই উপন্যাসটি আমারও খুব পছন্দের। তবে আপনার কাছে জানতে চাই এত লেখার মধ্যে কেনো এই লেখাটির কথাই মনে হল আপনার। কোনো বিশেষ কারণ আছে কি?"
আলোকপর্ণা হালকা হেসে বললেন - " জেনে খুশি হলাম আপনিও লেখাটি পড়েছেন। আপনি তো জানেন উপন্যাসটির মূল চরিত্র শম্পা। এই শম্পাকে আমি উপন্যাসটি লেখার সময় প্রতিদিন প্রত্যক্ষ করেছি। বাস্তবে হয় তো তার নাম শম্পা নয়, অন্য কিছু হবে। হয় তো তাকে সামনাসামনি কোনোদিন দেখিনি কিন্তু তাঁর লেখার মধ্যে দিয়ে প্রতিদিন আবিষ্কার করেছিলাম আমার এই চরিত্রটিকে। করতে করতে প্রতিবার মনে হয়েছে ইনি যেন ভীষণ রকম চেনা। আমরা এঁদের প্রায় প্রতিটি পরিবারেই কখনো মায়ের রূপে কখন দিদিমা কখনো দিদা হিসেবে জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে দেখেছি। দেখেছি তাদের সংসারের চাপে নিজেদের গুটিয়ে যাওয়া, সংসারের বোঝা টানতে টানতে নিজেদের স্বত্তাকে হারিয়ে ফেলা, সমাজের চোখে লক্ষ্মী বৌ হওয়ার চক্করে সব কিছু মানিয়ে নিতে নিতে প্রতিবাদ করার সাহসটুকুও হারিয়ে ফেলা। এই মানুষগুলো সংসারে যেন থেকেও ' নেই ' হয়ে থাকেন। অথচ এঁদের উপস্থিতি ছাড়া সংসারটাই হয় তো তাসের ঘর হয়ে যাবে। বলতে পারেন অনেকটা রান্নায় লবণ দেবার মত ব্যাপার। লবণ যেমন চোখে পরে না, মিশে যায়। অথচ লবণ ছাড়া রান্না স্বাদহীন, তেমন এঁদের ছাড়াও আমাদের জীবন অচল। অথচ সংসারে সব চেয়ে কম গুরুত্ব বোধ হয় এঁরাই পান। শম্পাও এমনই একজন। তবে দিনের শেষে সকলে ঘুমিয়ে পড়লে তার ভালোলাগা মন্দলাগা মনের কথা সে লিখে রাখে তার ডায়রীতে । সে সময়টুকুই তার নিজের। দিনের ওইটুকু সময়ই সে নিজের মত করে বাঁচে। সময় গড়িয়ে চলে। নতুন বৌএর ভূমিকা থেকে মা, দিদিমার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় সে। সময়ের সাথে পাল্লা দিতে দিতে কখন যেন ভুলে যায় লিখতে, ভুলে যায় তার অসময়ের বন্ধু সেই ডায়রিকে। তার ঠাই হয় পুরোনো জিনিসপত্রের ট্রাঙ্কে ,আর পাঁচটা অকাজের জিনিসের মধ্যে। একদিন তাঁর নাতনি সোহিনীর চোখে পড়ে সেটি। ততদিনে শম্পা উপনীত হয়েছেন জীবন সায়াহ্নে। গত হয়েছে তার স্বামী অরুণ। তবু সেই নাতনির উৎসাহেই তিনি আবার কলম ধরেন। চল্লিশটি বসন্ত পার করে তিনি আবার শুরু করেন লেখালিখি। শুরু হয় ছকভাঙার খেলা।" একটু থেমে আলোকপর্ণা আবার বললেন," তবে এখানে একটি গল্প আছে যেটি অনেকেই জানেন না।"
সংহিতা বেশ উৎসাহের সঙ্গে প্রশ্ন করলো," সেটি কি দিদি?"
-" সেটাই বলবো এবার। শম্পা নামের চরিত্রটি আমি এত জীবন্ত ভাবে হয়তো ফুটিয়ে তুলতেই পারতাম না যদি না সেই ডায়রিটা হাতে পেতাম?"
-"ডায়রি মানে কোন ডায়রি? যদি পাঠকদের আরেকটু খুলে বলেন।"
-" অবশ্যই বলবো। এটির বিষয়ে আগে কোনোদিন আমি বলিনি, বা বলতে পারেন বলার তেমন সুযোগ ঘটে নি। আপনি যখন প্রসঙ্গটি তুললেন তখন ডায়রির কথাটি না বললে উপন্যাসটির প্রেক্ষাপট ঠিক বোঝানো যাবে না। আপনি তো জানেন আমি লেখালেখির পাশাপাশি একটি কলেজে তুলনামূলক সাহিত্য নিয়ে অধ্যাপনা করি। আমাকে তাই বইপত্র নিয়েই থাকতে হয় সর্বক্ষণ। ফলে বিভিন্ন দরকারি বইয়ের সন্ধানে কলেজস্ট্রিট যাতায়াত করাটাও আমার বর্তমানে দৈনন্দিন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। বছর দুয়েক আগে এমনই এক কারণে কলেজ স্ট্রিট গেছিলাম। সেখানে পুরোনো বইয়ের দোকানে এটা ওটা ঘাটতে ঘাটতে হঠাৎই একটা পুরোনো অক্সফোর্ড ডায়রি আমার চোখে পড়ে। দোকানিকে বলে সাথে সাথে সেটি তাক থেকে নামিয়ে হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখি। ওপর ওপর দেখে যেটুকু বুঝলাম তাতে মনে হলো কোনো মহিলার জীবনের নানা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তাতে লেখা আছে। ভাবলাম নিয়েই দেখি। আর কিছু না হোক, গল্প লেখার রসদ কিছু হলেও তো পেতে পারি। তখন পুজোর লেখার জন্য প্রতিদিনই প্রকাশকের দল তাগাদা দিয়ে মাথা খারাপ করে দিচ্ছিল। ফলে নতুন লেখার চাপও ছিল যথেষ্ট। তাই আরো কিছু পুরোনো বইয়ের সাথে নাম মাত্র দামে ডায়রিটাও নিয়ে নিলাম। বাড়ি ফিরে পড়ে বুঝলাম এটি একটি খনি। ঠিক ভাবে ব্যবহার করতে পারলে গল্প কেন, ভালো একটি উপন্যাস পাঠককে উপহার দিতে পারবো। হলও তাই। উপন্যাস প্রকাশের সাথে সাথে পাঠকেরা উজাড় করে দিলেন তাদের ভালোবাসার ঝুলি। সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতে সেটি চলে এলো সর্বাধিক বিক্রীত বইয়ের সংখ্যার নিরিখে তালিকার এক্কেবারে শীর্ষে। "
-" সত্যিই দারুণ অভিজ্ঞতা।"
-" হ্যাঁ। তা ঠিকই। দেখবেন ডায়রিটা? " বলেই সংহিতার উত্তরের অপেক্ষা না করে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন " একটু বসুন তবে। আমি নিয়ে আসছি।"
মিনিট সাতেকের মধ্যেই আলোকপর্ণা ভেতর থেকে একটি ডায়রি নিয়ে এসে রাখলেন টেবিলের ওপর।দেখলেই বোঝা যায় যথেষ্ট পুরোনো।বেশ রংচটা, পাতাগুলো হলুদ হয়ে গেছে একেবারে। কিছু পাতা পোকায় কেটে দিয়েছে। আলোকপর্ণা ডায়রিটা তুলে দিলেন সঞ্চালিকা সংহিতার হাতে। বললেন-" এই সেই ডায়রি। আমার উপন্যাসের এটিই কাঠামো বলতে পারেন। এই কাঠামোতেই আমি আমার মনের মাধুরী মিশিয়ে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছি মাত্র। তাই এই উপন্যাস রচনার কৃতিত্বের সমান দাবিদার এই ডায়রির লেখিকাও বটে। তাঁকে আমি চিনি না। চিনলে অবশ্যই তাঁকে প্রাপ্য সম্মান জানাতাম। জানি না তিনি এখন বেঁচে আছেন কিনা, থাকলেও কি করছেন , দেখছেন কিনা আমার সাক্ষাৎকারটি। যদি দেখে থাকেন তবে আমি আপনাদের মাধ্যমেই তাঁকে ধন্যবাদ জানাতে চাই।"
টেবিলের অপর প্রান্তে বসে থাকা সংহিতা ডায়রিটা হাতে নিয়ে কান্না ভেজা স্বরে বলে উঠল - "আপনি সেই সুযোগ অল্পের জন্য হারালেন দিদি। মা তিন মাস আগেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।"
আলোকপর্ণা গুহ ঠাকুরতা তখন ঘোর বিস্ময়ে তাকিয়ে আছেন সংহিতার দিকে। সংহিতা তখন ডায়রির দিকে চোখ রেখে মাথা নিচু করে বলে চলেছে - " আমি মায়ের হাতের লেখা চিনি। এই যে দেখছেন ওপরে লেখা 'ঝুমুর কথা ', ঝুমু আসলে মায়ের ডাক নাম। আমার দাদু আদর করে ঐ নামে ডাকতেন মাকে। মায়ের ভালো নাম বহ্নিশিখা। এই অমূল্য সম্পদ আজ আমার হাতে তুলে দেবার জন্য অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আমার মায়ের একান্নবর্তী সংসারে বিবাহ পরবর্তী জীবনের যন্ত্রণার দিনগুলোর সাক্ষী এই ডায়রি। একদিন এই ডায়রিটি বাড়ির লোকেদের নজরে পড়ে যায়। জানাজানি হয়ে যাওয়ায় মা বাধ্য হয়েছিল পুরোনো বইখাতার সাথে ডায়রিটা বিক্রি করে দিতে। মা চাইলে পুড়িয়ে কিংবা ছিঁড়ে ফেলতে পারত। মা তা করেনি। হয় তো ভেবেছিল যদি হাত ফেরত হয়ে আপনার মত কোনো দরদী মানুষের হাতে পড়ে তবে, যৌথ পরিবারের দোহাই দিয়ে মেয়েদের যে গার্হস্থ্য হিংসার স্বীকার হতে হয় , সেকথা জানতে পারবে সকলে। মার সেই গোপন ইচ্ছে না জেনেই আপনি পূরণ করেছেন। মা যেখানেই থাকুন অনেক আশীর্বাদ করছেন আপনাকে। ভালো থাকুন আপনি। দীর্ঘজীবী হোক আপনার কলম। আমার মায়ের মত আরো অনেকের হার না মানা ইচ্ছাশক্তি অক্ষরের পূর্ণতা পাক আপনার হাত ধরে। আজকের সাক্ষাৎকার এখানেই শেষ করলাম দিদি। ধন্যবাদ।"