Indrani Bhattacharyya

Drama Action Classics

4.3  

Indrani Bhattacharyya

Drama Action Classics

সেই রাত

সেই রাত

5 mins
2.7K



মধুপুর থেকে আজিমগঞ্জ যাবার সারাদিনে একটাই ট্রেন। শিবু বোনের শরীর খারাপের খবরটা পেয়েই ছুটতে ছুটতে এসে ট্রেনটা ধরল। কামরায় পা রাখা মাত্র লম্বা হুইসেল বাজিয়ে ছেড়ে দিল ট্রেন। আর তারপরের মুহূর্তেই ভুলটা বুঝতে পারলো শিবু। সে তাড়াহুড়োতে এসে সেধিয়েছে লেডিস কামরায়। কিন্তু তখন আর নামার উপায় নেই। ট্রেন স্টেশন ছাড়িয়ে অন্ধকার ফুঁড়ে দুদ্দাড়িয়ে ছুটে চলেছে। অগত্যা পুটুলিটা বুকের কাছে চেপে ধরে প্রায় দরজার মুখেই বসে পড়ল সে। ঠিক করলো মোহনপুর এলেই নেমে কামরা বদল করে নেবে। যদিও মোহনপুর আসতে ট্রেন ঠিক মত চললেও ঘণ্টা তিনেক লাগবে। এখন বাজে সবে রাত আটটা। তার মানে মোহনপুর পৌঁছবে রাত এগারোটা নাগাদ। অবশ্য যদি ঠিকঠাক সিগন্যাল পায় তবে। আর অজিমগঞ্জ পৌঁছতে পৌঁছতে তো রাত ভোর হয়ে যাবে। তবে একদিকে ভালো। রাতের ট্রেনে মহিলা কামরায় তেমন প্যাসেঞ্জার ওঠার ভয় নেই যদি না কপাল খুব মন্দ হয়। মনে মনে সেটা ভেবে বেশ নিশ্চিন্ত হল শিবু।

ট্রেনটা ভালোই চলছে। হুহু করে ঠান্ডা হাওয়া কামরার ভেতর ঢুকে ঠোকাঠুকি লাগিয়ে দিচ্ছে হাড়ে হাড়ে। শিবুর দরজার কাছে বসে বেশ শীত শীত করতে লাগলো। তাড়াহুড়ো করে বেরোনোতে চাদর কম্বল কিছুই আনা হয় নি সাথে। আরো কিছুক্ষণ ঐ অবস্থাতেই কেটে যাবার পর শিবু উঠে দাঁড়িয়ে কামরার ভেতরটা একবার ভালো করে দেখলো। আর দেখেই ভুল ভাঙলো তার। সে তো একা এই কামরায় নেই। আরো একজন মহিলা সহযাত্রী সামনের সিটে কম্বলমুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। কাপড়চোপড় বেশ নোংরা আর অগোছালো। সারা শরীরে অপুষ্টি আর দারিদ্র্যের ছাপ স্পষ্ট। সম্ভবত কোনো ভিখারিনী হবে। এতটা সময় কেটে গেলেও শিবুর উপস্থিতি টের পায়নি সে। তার মেয়েটিকে দেখে বোনের কথা মনে পড়ে গেল। শিবুর মেয়েটিকে দেখে কামরার ভেতরে বসতে বেশ সঙ্কোচ হল।অগত্যা শীতের কামড় সহ্য করেই গুটিসুটি হয়ে দরজার পাশে গিয়ে আবার বসে পড়ল।

চুপচাপ একা একা বসে থাকতে থাকতে নানা কথা মনে আসতে লাগলো। বাবা অকালে চলে যাবার পর শিবু আর শিবুর মা কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে বোনকে। অভাবের আঁচ তেমন ভাবে লাগতে দেয় নি বোনের গায়ে। ভালো পরিবার দেখে বিয়ে দিয়েছে। সেখানে অর্থের অভাব নেই ঠিকই। তবে সুখের অভাব যথেষ্ট। বিয়ের পাঁচ বছর পরেও তার মা ডাক শোনার ইচ্ছে অপূর্ণই রয়ে গেছে আজও। অনেক চেষ্টা চরিত্রের পর পেটে এই মাস চারেক আগে একটা বাচ্চা এসছিল বটে, তবে ভগবান তাকেও কেড়ে নিয়েছে আজ। বোনের অবস্থাও বিশেষ সুবিধের নয়। খবরটা শুনেই খাবার ফেলে চোখ মুছতে মুছতে ছুটে এসেছে শিবু । ছোট বোনকে যে সে বড্ড ভালোবাসে। বোনের কথা ভাবতে ভাবতে কখন যেন জুড়িয়ে এলো চোখ দুটো। 

ট্রেন ছুটে চলল ঝড়ের বেগে।


খানিকক্ষণ পর আচমকাই শরীর জুড়ে অচেনা হাতের স্পর্শে ঘুম ভেঙে গেল শিবুর। চোখ খুলে তাকিয়ে একবিন্দু আলোও চোখে পড়ল না কোথাও।কামরা জুড়ে শুধুই নিকষ কালো অন্ধকার। এদিকে শিবু তার সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে উপলব্ধি করছিল কোনো ঘনিষ্ঠ নারী দেহের স্পর্শ। আর ততই ভয়ে, লজ্জায় কুঁকরে যাচ্ছিল ভেতরে ভেতরে। হাত দিয়ে ঠেলেও সরাতে পারছিল না গায়ের ওপর লেপ্টে থাকা শরীরটা। কম্বলের ভেতর খেলা করতে থাকা অচেনা আঙ্গুলগুলো ততক্ষনে একে একে খুলে ফেলেছে তার শার্টের সব বোতাম। ঘাড়ের কাছে অচেনা শরীরের উষ্ণ নিঃশ্বাসে ভয়ে উত্তেজনায় দম বন্ধ হয়ে আসছিল শিবুর। তবু শিবু শেষবারের মত চেষ্টা করলো সবটুকু শক্তি দিয়ে প্রাণপণে চেঁচিয়ে ওঠার কিন্তু ততক্ষনে তার ঠোঁট কব্জা করে নিয়েছে কোনো কুহকিনী। আঁচড়ে কামড়ে অবিরাম ক্ষত বিক্ষত হয়ে চলেছে তার জিভ, গাল, গলা। চেপে বসে থাকা শরীরের ভারে কেমন যেন অসাড় হয়ে আসছে শিবুর শরীর। তবু যেন অনন্ত তেষ্টা নিয়ে শিবুর শরীরে অমৃত খুঁজে চলেছে সেই মেয়েটির শরীর। শিবুর একবার মনে হল একি তবে কামরায় শুয়ে থাকা সেই মেয়েটি। কিন্তু ঘোর আঁধারে সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারলো না সে। একসময় চিন্তা করার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলল শিবু। এদিকে সেই মেয়ে তখন আরো সাহসী হয়েছে। তার আঙ্গুলগুলো খেলা করছে শিবুর সেই বিশেষ অঙ্গের চারপাশে। শিবু হাত পা ছুঁড়েও বাঁচাতে পারছে না নিজেকে। এমন সময় হঠাৎই একটা খুট করে শব্দ আর তীব্র আলোতে ভরে গেলো গোটা কামরা। শিবু তাকিয়ে দেখলো সামনে লাঠি হাতে রুদ্রমূর্তি ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে কামরার ঘুমিয়ে থাকা সেই যুবতী। আর শিবুর শরীরের ওপর হিংস্র বাঘিনীর মত আস্ফালন করছে কালো কোট প্যান্ট পরা এক মহিলা। পোশাক দেখে বোঝা গেল সে একজন মহিলা টিকিট চেকার। 

ট্রেনের সেই যুবতী কঠিন স্বরে বলল - "ভাগ্যিস আমার ঘুম ভেঙেছিল। এ বাবু তুই লেমে যা। একে আমি বুঝে লেবো।"শিবু দেখলো রাগে তার সারা শরীর কাঁপছে। এদিকে টিটি মহিলাও ছাড়বার পাত্রী নয়। শিবুকে ছেড়ে সোজা উঠে দাঁড়ালো ।তারপর সেই যুবতীকে হুমকির সুরে বললো - " মুখ সামলে কথা বল। টিকিট দেখা আগে। তারপর তড়পাবি।" দুই নারীই তখন যুদ্ধং দেহী মেজাজে রণমূর্তি ধারণ করেছে। 

ততক্ষনে শিবু সামলে উঠেছে কিছুটা। মাথাও কাজ করছে অল্প অল্প। সে দেখলো এদের না থামালে আরো বড় কোনো বিপদ ঘটে যেতে পারে। শিবু এবার উঠে দাঁড়িয়ে গলা তুলে বলল - " ম্যাডাম, আপনি কিন্তু যথেষ্ট অন্যায় করেছেন। এর পরে আর কিছু করলে কিন্তু চেন টানতে বাধ্য থাকবো। সরকারি কর্মচারী বা মহিলা বলে পার পেয়ে যাবেন ভাববেন না। পুরো ঘটনার সাক্ষী এই মেয়েটি।"


শিবুর কথায় যেন ওষুধের মত কাজ হল। টিটি সরে এলো একপাশে। শিবু এবার এগিয়ে গিয়ে যুবতীর উদ্দেশ্যে বলল - "আপনি কোথায় বা কত দূর যাবেন আমার জানা নেই। তবে মোহন পুর আসছে। ট্রেন থামলেই আমি কামরা বদল করে নেবো। আপনি আপনার বোনের বয়সি। তাই বোন হয়ে আজ এক দাদাকে আপনি বিপদের হাত থেকে যে ভাবে বাঁচলেন তার জন্য কোনো ধন্যবাদই যথেষ্ট নয়। এতদিন মায়ের মুখে শুনেছি যোগমায়ার কথা যে কিনা নিজের দাদা কৃষ্ণকে বাঁচাতে কংসের কারাগারে প্রাণ দিয়েছিল। আজ নিজের চোখে দেখলাম আরেক বোনের মহানুভবতা। বোনেরা বোধ হয় এমনই ভাবে চিরকাল রক্ষা করে দাদাদের। জানেন, আমি আজ নিজের বোনকে দেখতে যাচ্ছিলাম। ওর শরীর ভালো নেই। জানি না এখন কেমন আছে। বেঁচে আছে না নেই। ওর জন্য একটা শাড়ি নিয়ে যাচ্ছিলাম। এই শাড়িটা বরং আপনি রাখুন। বোন সুস্থ হলে আমি নয় ওকে কিনে দেবো আবার। এটা নয় এই বোনের জন্যই থাক।" তারপর সেই টিটি মহিলার দিকে ফিরে বলল " ওনার টিকিটের দাম আমি মিটিয়ে দিচ্ছি। আজকের রাতের কথা আমি ভুলে যাবো। পারলে আপনিও ভুলে যাবেন।"

ট্রেন তখন ঢুকছে মোহনপুর স্টেশনে। আর আকাশে গোল থালার মত একটা চাঁদ মুছে দিচ্ছে চরাচর বিস্তৃত সব অন্ধকার। কামরা বদল করে সিটে বসে জানলা দিয়ে সেদিকে তাকিয়ে শিবুর মনে পড়ল - আজ তো রাখী পূর্ণিমা।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama