STORYMIRROR

Manasi Ganguli

Tragedy Classics Thriller

4  

Manasi Ganguli

Tragedy Classics Thriller

ঐতিহাসিক লাল বাড়িটা

ঐতিহাসিক লাল বাড়িটা

10 mins
488


 ঐতিহাসিক লাল বাড়িটা

    ভারতবর্ষ তখন পরাধীন। ইংল্যান্ডের রাজা পঞ্চম জর্জ তখন ভারতের সম্রাট। সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ গোটা ভারতবর্ষকে করেছে তাদের উপনিবেশ। পুরোদমে চলছে শাসন আর শোষণ। শাসন করছে ইংরেজ রাজশক্তি আর শোষণ চালাচ্ছে ইংরেজ বণিকের দল। রেল-কোম্পানি, স্টিমার-কোম্পানি, চটকল, চা-বাগান, কাগজের কল প্রভৃতি শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং ব্যাঙ্ক, বীমা প্রভৃতি ব্যবসা খুলে দু'হাতে টাকা লুটছে ইংরেজ।

সরকারি চাকুরে বিশেষ করে পুলিশ বিভাগের চাকুরেরা ছিল ইংরেজের কেনা গোলাম। রায়সাহেব, রায়বাহাদুর, নবাব, স্যার প্রভৃতি উপাধি দিয়েও এক শ্রেণীর মানুষকে হাত করে রেখেছিল ইংরেজ। এরাই ছিল সমাজের মাথা। দেশে যেমন ইংরেজদের নেকনজরে থাকার জন্য লোভী কর্মচারী সমাজ, জমিদারের দল এবং উপাধিধারী দালালের দল বিদ্যমান ছিল, তেমনি ছিল সত্যিকারের দেশপ্রেমিক, যারা দেশের জন্য আত্মোৎসর্গে প্রস্তুত। এদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল এদেশ থেকে ইংরেজদের তাড়িয়ে দিয়ে দেশমাতৃকার চরণ থেকে পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচন করে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করা। এবং এই উদ্দেশ্যেই অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে আত্মোৎসর্গ করেছিলেন তাঁরা।

দিনে দিনে ইংরেজদের অন্যায়-অত্যাচার বেড়েই চলছিল। ব্রিটিশ পুলিশরা শতশত রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও বিপ্লবীদের গ্রেপ্তার করে জেলে আটকে রাখতে থাকে এবং তাদের ওপর চালাতে থাকে নির্মম নির্যাতন। দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে রাজবন্দীদের ওপর অত্যাচারের খবর। জানা যায়, এই অত্যাচারের নেপথ্যের খলনায়ক ইন্সপেক্টর জেনারেল কর্নেল এন এস সিম্পসন। তাই জেলের বাইরে থাকা বিপ্লবীদের পরবর্তী লক্ষ্য হলেন কর্নেল সিম্পসন যিনি বসতেন রাইটার্স বিল্ডিং-এ। সুতরাং এবার হামলা হবে সরাসরি মহাকরণে। শুধু সিম্পসনকে হত্যাই নয়, তাদের লক্ষ্য ছিল কলকাতা ডালহৌসি স্কোয়ারে অবস্থিত ব্রিটিশ শাসকদের সচিবালয় রাইটার্স ভবনে আক্রমণ করে ব্রিটিশ অফিসপাড়ায় ত্রাস সৃষ্টি করার, ইংরেজদের বুঝিয়ে দেওয়ার এবার সময় বদলাচ্ছে।

ভারতের সর্ববৃহৎ শহর ও প্রধান বন্দর হিসেবে বিরাজমান কলকাতা মহানগরী ১৯১১ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ছিল। লন্ডনের পরই দ্বিতীয় স্থানে অবস্থিত এটাকে 'সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় নগর' হিসেবে বিবেচনা করা হত। কলকাতার পরতে পরতে মিশে রয়েছে ইতিহাস। সবকিছুর পেছনেই লুকিয়ে রয়েছে কোনও না কোনও ইতিহাস। জায়গা থেকে রাস্তার নাম সবকিছুরই রয়েছে আলাদা আলাদা গল্প। কলকাতার অনেক জায়গার নামকরণের পিছনেই লুকিয়ে রয়েছে ইতিহাস। এর নিজস্ব মার্জিত ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের জন্য কলকাতাকে 'প্রাসাদ নগরী'ও বলা হত। এছাড়া ব্রিটিশ আমলে চৌরঙ্গীতে অনেক বড় বড় বাড়ি থাকার জন্যও এরকম নামকরণ। লর্ড ওয়েলেসলির(গভর্নর-জেনারেল ১৭৯৭-১৮০৫) শাসনকালে শহরের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটেছিল। তাঁর আমলেই কলকাতার অধিকাংশ সরকারি ভবনের নির্মাণকার্য শুরু হয়। এই ভবনগুলির বিশালতা ও স্থাপত্যসৌকর্যও কলকাতাকে "প্রাসাদ নগরী" বা "সিটি অফ প্যালেসেস" সম্মান প্রদান করেছিল।

কলকাতা শহরের লালদীঘি সংলগ্ন যে এলাকাটি অফিসপাড়া নামে পরিচিত অনেকেই সেটিকে 'কলকাতার হৃদয়' বলেও অভিহিত করে। কারণ এখানেই রয়েছে রাইটার্স বিল্ডিং, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, জিপিও, টেলিফোন ভবন এবং একাধিক গুরুত্বপূর্ণ অফিস ও ব্যাঙ্ক। ব্রিটিশ আমলে কাগজে-কলমে কলকাতার এই প্রশাসনিক কেন্দ্রের নাম ছিল 'ডালহৌসি স্কোয়ার'। এটি একটি চারকোণা জায়গা যা ঘিরে রেখেছে পুরনো লালদীঘি নামক জলাশয়কে আর তাই জায়গাটি প্রথমে 'ট্যাঙ্ক স্কোয়ার' নামে পরিচিত ছিল। উনিশ শতকের মাঝামাঝি এই এলাকার সঙ্গে জড়িয়ে গেল তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসির নাম। ট্যাঙ্ক স্কোয়ার হয়ে গেল ডালহৌসি স্কোয়ার। কলকাতা বিশেষজ্ঞ প্রাণকৃষ্ণ দত্তের মতে গোবিন্দপুরের মুকুন্দরাম শেঠ বা তাঁর পুত্রেরা এই দীঘি খনন করিয়েছিলেন। এই দীঘির ধারে তাঁর কাছারি ছিল। দোলের দিন দীঘির জল পুরো লাল হয়ে যেত রং খেলার জন্য, তাই দীঘির নামকরণ হয় লালদীঘি। জব চার্নকের আগমনের পূর্বেই ডিহি কলিকাতা গ্রামে লালদীঘির অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। লালদীঘির নিকটেই সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের একটি কাছারি ও গৃহদেবতা শ্যামরায়ের মন্দিরটি অবস্থিত ছিল। অনুমান করা হয়, দোলযাত্রা উপলক্ষে রং খেলার পর এই দীঘির জল লাল হয়ে উঠত বলে দীঘিটি লালদীঘি নামে পরিচিত হয়। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি উক্ত কাছারিবাড়িটি প্রথমে ভাড়া ও পরে ক্রয় করে নিয়েছিলেন।

অবশ্য লালদীঘির নামকরণ নিয়ে অন্য কাহিনীও প্রচলিত আছে। কেউ কেউ বলেন, পার্শ্ববর্তী ওল্ড মিশন চার্চের লাল রংটি এই দীঘির জলে প্রতিবিম্বিত হত বলে দীঘিটি লালদীঘি নামে পরিচিত হয়। অন্যমতে, জনৈক লালচাঁদ বসাক এই দীঘিটি খনন করিয়েছিলেন। তাঁর নামানুসারেই দীঘিটির নাম হয় লালদীঘি। এই লালদীঘির উত্তরে অবস্থিত রাইটার্স বিল্ডিং।

১৭৮০ সালে স্থাপিত ঐতিহাসিক রাইটার্স বিল্ডিংসের নকশা প্রস্তুত করেছিলেন টমাস লায়ন। ১৭৭৬ সালে লায়ন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইউরোপীয় কেরানিদের বসবাসের জন্য উনিশটি পৃথক অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি করেন, এগুলি দেখতে ছিল সারিবদ্ধ দোকানের মতো। কালের স্রোতে ‘করণিক’ হয়ে গেল ‘কেরানি’। লায়ন সাহেবের পরিকল্পনায় তৈরি সেই বাড়িতে বসে তাঁরা কাজ করতেন। তাই লাল ইঁটের সেই ভবনের নাম হল ‘মহাকরণ’। এই কেরানিদের বলা হত রাইটার। এদের নাম থেকেই ভবনের পূর্বতন নাম রাইটার্স বিল্ডিংস-এর উদ্ভব।

এই ভবন নির্মাণের জন্য যে জমি নির্ধারিত হয়েছিল, সেখানে আগে ছিল সেন্ট অ্যান চার্চ। ষোড়শ শতকের প্রথমে তৈরি এই গির্জা ছিল কলকাতায় ব্রিটিশদের তৈরি প্রথম উপাসনাস্থল। কিন্তু দু’দশকের বেশি স্থায়ী হয়নি তার অস্তিত্ব। রক্ষণাবেক্ষণের অভাব এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে দ্রুত ভেঙে পড়তে থাকে গির্জাটি। শেষে কার্যত পরিত্যক্ত গির্জা এবং তার চারপাশের জমিই নির্ধারিত হল রাইটার্স বিল্ডিং তৈরির জন্য। বরাদ্দ করা জমির ৩৭,৮৫০ বর্গফুট জুড়ে তৈরি হয়েছিল ভবনের মূল অংশ। পুরনো ফোর্ট উইলিয়মের কাছে ১৭৭৭ থেকে ১৭৮০, এই ৩ বছর ধরে তৈরি হল করণিকদের ভবন। এল গ্রেকো রোমান স্থাপত্যের সঙ্গে রাইটার্স বিল্ডিংয়ের নির্মাণশৈলিতে মিশে গিয়েছে ফরাসি নবজাগরণের প্রভাবও। ভবনের মাথায় রয়েছে প্রাচীন রোমান সভ্যতার জ্ঞান, যুদ্ধ ও ন্যায়ের দেবী মিনার্ভা-র মূর্তি। এ ছাড়াও এই ভবনে আছে প্রাচীন গ্রিক সভ্যতার দেবদেবী জিউস, হার্মিস, অ্যাথিনা এবং দেমেতের-এর মূর্তি। তাঁরা এখানে দাঁড়িয়ে আছেন যথাক্রমে বিচার, বাণিজ্য, বিজ্ঞান এবং কৃষির উন্মেষের প্রতীক হয়ে।

কাজের তত্ত্বাবধানে ছিলেন তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস। নতুন ভবনে যাঁরা কাজ করবেন, তাঁদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের জন্য সচেষ্ট ছিল ব্রিটিশরা। ইংল্যান্ড থেকে কাজ করতে আসা তরুণরা বাধা পাচ্ছিলেন ভাষা সমস্যার জন্য। সেই ভাষা প্রশিক্ষণের জন্য তৈরি হল ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। পরে কিছু জটিলতার জন্য সেই কলেজ উঠে আসে রাইটার্স ভবনে। কলেজের প্রয়োজনে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে বেশ কিছু পরিবর্তন করা হল। ৩২ জন পড়ুয়ার জন্য ছাত্রাবাস, পরীক্ষার হল, লেকচার হল, চারটি লাইব্রেরি-সহ বেশ কিছু নতুন সংযোজন হল দু’দশক ধরে। পরে কলেজটি এখান থেকে আবার স্থানান্তরিত হয়ে যায়। কলেজ তৈরির মূল উদ্দেশ্যই ছিল রাইটার্স বিল্ডিংয়ের জন্য দক্ষ কর্মী প্রস্তুত করা। নতুন ভবন এবং তার চারপাশের এলাকাকে সে সময় এর স্থপতির নামে বলা হত লায়ন্স রেঞ্জ, বর্তমানেও সেই নামই বহাল আছে।

২৪১ বছরের প্রাচীন এই ভবনে যুগে যুগে বহু পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। প্রশাসনিক প্রয়োজনে যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন ভবন। কিন্তু আড়ালে চলে গেলেও স্তিমিত হয়নি ব্রিটিশসহ অন্য ইউরোপীয় প্রভাব। কলেবরের সঙ্গে বদলেছে ভবনের নামও।

দীর্ঘদিনের ইতিহাস নিয়ে মধ্য কলকাতায় মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক এই লালবাড়িটি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকাল থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মহাকরণ হয়ে ওঠা রাইটার্স বিল্ডিং তার পুরনো ইঁটের আনাচে-কানাচে বয়ে নিয়ে চলেছে ভারতীয়দের পরাধীন করে রাখার নানান ইতিহাস। যখন যে ক্ষমতায় এসেছে রেখে গিয়েছে তার নিজস্ব শাসনতন্ত্রের ছাপ।

প্রাচীন এই লালরঙা ভবনটি স্বাধীনতা আন্দোলনের বহু উত্থান-পতনের সাক্ষী। অত্যাচারী ইনস্পেকটর জেনারেল কর্নেল সিম্পসন বসতেন এই লালবাড়িটির একটি কক্ষে। তাই বিপ্লবীদের সেবারের অভিযান ছিল কলকাতার 'রাইটার্স বিল্ডিং' আক্রমণ। আক্রমণের জন্য সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করা হল। খুব সতর্ক অবস্থায় তাদের প্রশিক্ষণের কাজও সমাপ্ত হল। অসংখ্য পুলিশ প্রহরী পরিবেষ্টিত দুর্ভেদ্য অফিস 'রাইটার্স বিল্ডিং'। এই ভবন আক্রমণ করে সেখান হতে ফেরার আশা কেউ করতে পারে না। ১৯৩০ সালের ৮ই ডিসেম্বর বেলা ঠিক ১২টায় ডালহৌসি স্কোয়ারে উপস্থিত হয়ে ট্যা

ক্সি থেকে নেমে পড়ল সিম্পসন হত্যার দায়িত্বপ্রাপ্ত বিপ্লবী তিন বন্ধু বিনয়-বাদল-দীনেশ। দেশপ্রেমের কষ্টিপাথরে কষলে দেখা যাবে যে তিনজনই খাঁটি সোনা। হিরের মত উজ্জ্বল তাদের চরিত্র। বজ্রের মত কঠোর তাদের সংকল্প। সূর্যের মত প্রদীপ্ত তাদের তেজ। পরণে তাদের নিখুঁত সাহেবি পোশাক। দৃঢ় পদক্ষেপে ওরা এগিয়ে চলল রাইটার্স বিল্ডিংস অভিমুখে। ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতের রাজধানী কলকাতার প্রশাসনিক কেন্দ্র রাইটার্স বিল্ডিং আর সব দিনের মতো সেদিনও গমগম করছিল নিত্যকার কর্মতৎপরতায়। ব্রিটিশ কর্মকর্তা, বাঙালিবাবু, কেরানি সকলেই ব্যস্ত ছিলেন নিজ নিজ কাজে। একতলায় পোস্ট অফিস ও বেঙ্গলী ট্রানশ্লেটার্স অফিস। ওখানে ওদের কোনও কাজ নেই। ওদের কাজ দোতলায়। সেখানেই হোমরা-চোমরাদের অফিস। দোতলায় উঠে এল ওরা। সান্ত্রীরা কোনো প্রশ্ন করল না। তাদের সাহেবী পোশাক এবং চলন বলন দেখে কারো মনে কোনও সন্দেহ জাগেনি। মাথায় সুন্দর টুপি, গলায় ঝোলানো মাফলার। ইউরোপীয়দের মতো গটগট করে ঢুকে গেলেন তারা। বিল্ডিংয়ে ঢোকামাত্রই তাদের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। চোখের দৃষ্টিতে প্রতিশোধের আগুন। সামনে প্রশস্ত বারান্দা। তার পাশে সারি সারি ঘর। আগের দিনই বাদল ঘুরে সব দেখে গেছে। সে-ই পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল কর্নেল সিম্পসনের অফিস। মহাকরণ তথা রাইটার্স বিল্ডিংয়ের একটি কামরায় বসে নিজের কাজকর্ম পরিচালনা করছিলেন কর্নেল সিম্পসন আর তার পাশে দাঁড়িয়ে আলোচনা করছিলেন ব্যক্তিগত সহকারী জ্ঞান গুহ। অফিসের দরজার পাশে তাঁর নামাঙ্কিত ফলক। নিচে লেখা, ইন্সপেক্টর জেনারেল অফ প্রিজনস, বেঙ্গল। বেলা বারোটা নাগাদ জানা গেল তিনজন বিলাতি পোশাক পরিহিত বাঙালী যুবক আগ্রহী কর্নেল সিম্পসনের সাক্ষাৎ পেতে। আচমকাই কামরার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা জ্ঞান গুহকে ঠেলে হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে পড়লেন সেই তিন বাঙালী যুবক। মুখ তুলে চাইলেন কর্নেল এবং যা দেখলেন তার জন্য তিনি বিন্দুমাত্র প্রস্তুত ছিলেন না। তিন বাঙালী যুবক দাঁড়িয়ে তাঁর সামনে, তাঁরই দিকে রিভলভার তাক করে। আজীবন নিরীহ-নিরাপরাধের ওপর নির্মম নির্যাতন চালিয়ে এসেছেন যে মানুষটি তিনি নিজের শেষ সময়ে বিন্দুমাত্র ভাবনার অবকাশই পেলেন না। আচমকাই তিনটি রিভলভার থেকে বের হওয়া ছয়টি বুলেট এসে তার শরীর ভেদ করে বের হয়ে গেল। বিস্ফারিত চোখে নিথর দেহ নিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন কর্নেল। এরপর তারা ছোট একটি তেরঙ্গা জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে বন্দেমাতরম ধ্বনি দিতে দিতে পূর্বদিকের বারান্দার দিকে ঢুকতে যান। এই তিন যুবক হলেন বিপ্লবী বিনয় বসু, বাদল গুপ্ত ও দীনেশ গুপ্ত। ব্রিটিশ শাসকদের প্রভুত্ব স্বীকার করে নিতে চাননি তারা। তাই প্রভাবিত হয়েছিলেন বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডে এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আইন নিজেদের হাতে তুলে নেওয়ার। পূরণ হয়ে গেছে বিনয়-বাদল-দীনেশ ত্রয়ীর প্রাথমিক লক্ষ্য। এরপরই গুলির আঘাতে আহত হন জুডিসিয়েল সেক্রেটারী মি. নেলসন। এলোপাথাড়ি গুলি বর্ষণ করতে করতে আততায়ীরা পরবর্তী লক্ষ্য হোম সেক্রেটারী আলবিয়ান মারের কক্ষের দিকে অগ্রসর হন। ততক্ষণে এই আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য ছুটে আসেন পুলিশ ইন্সপেক্টর জেনারেল মি.ক্র্যাগ ও সহকারী ইন্সপেক্টর জেনারেল মি.জোনস। তাঁরা কয়েক রাউণ্ড গুলিও ছোঁড়েন। কিন্তু বিনয়-বাদল-দীনেশের বেপরোয়া গুলির মুখে তাঁরা দাঁড়াতে পারলেন না। প্রাণ নিয়ে পালালেন। সমস্ত 'রাইটার্স বিল্ডিং' জুড়ে তখন এক বিভীষিকাময় রাজত্ব। চারিদিকে শুধু ছুটাছুটি। কে কোন দিকে পালাবে খুঁজে পায় না। কলরব- কোলাহল- চিৎকার। শুধু এক রব 'বাঁচতে চাও তো পালাও'। 'রাইটার্স বিল্ডিং' আক্রমণের সংবাদ পেয়ে পুলিশ কমিশনার টেগার্ট আসেন। ডেপুটি কমিশনার গার্ডন আসেন সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে। জুডিসিয়াল সেক্রেটারী মি.নেলসন প্রমুখ অনেক ইংরেজ আহত হলেন। আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য ডেকে আনা হল গোর্খা বাহিনীকেও। এবার তাদের প্রাণ নিয়ে পালানোর পালা। এখানে ঢোকা মানেই নিজেদের কবর নিজেরাই খোঁড়া। একবার এখানে আক্রমণের উদ্দেশ্যে ঢুকলে বাঁচার আর কোনও সম্ভাবনাই নেই। তবু পালানোর চেষ্টা তো করতেই হবে। কিন্তু সে সুযোগ তারা পেলেন না। কারণ রিভলভারের শব্দে মুহূর্তের মধ্যেই ছুটে এল পুলিশবাহিনী। রাইটার্স বিল্ডিংয়ের অলিন্দে তাদের সঙ্গে বিনয়দের শুরু হল আক্রমণ পাল্টা আক্রমণের লড়াই। একদিকে মাত্র তিনজন যুবক ও অন্যদিকে পুলিশ কমিশনার টেগার্ট ও ডেপুটি কমিশনার গার্ডেনের নেতৃত্বে রাইফেলধারী সুশিক্ষিত পুলিশ। ইতিহাসের পাতায় এই যুদ্ধ পরিচিত 'অলিন্দ যুদ্ধ' নামে। তাছাড়া স্টেটসম্যান পত্রিকা মারফত ইংরেজিতে এই যুদ্ধের নাম হয়েছিল 'বারান্দা ব্যাটেল'। ইংরেজদের প্রসাদলোভী স্টেটসম্যান পত্রিকা কিছু মিথ্যা বিবৃতিও দিয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামী এই তিন বিপ্লবীর বিরুদ্ধে।

পরাজয় নিশ্চিত জেনেও এত সহজে হাল ছেড়ে দিলেন না বিনয়-বাদল-দীনেশ। নিজেদের সর্বস্ব উজাড় করে দিয়ে, প্রাণপণে লড়াই করে যেতে লাগলেন তারা। পিঠে গুলিবিদ্ধ হলেন দীনেশ। তারপরেও গুলিবর্ষণ অব্যাহত রাখলেন তিনি। কিন্তু তাদের হাতে বুলেটের সংখ্যা সীমিত। ফলে ক্ষণকালের মধ্যেই প্রায় ফুরিয়ে আসতে লাগল তাদের শেষ সম্বল। অথচ ও প্রান্ত থেকে অনবরত গুলি চালিয়ে যাচ্ছে গোর্খা বাহিনী।

শেষ প্রচেষ্টা হিসাবে একটি শূন্য কামরায় প্রবেশ করলেন বিপ্লবী ত্রয়ী। বাঁচার আর কোনো রাস্তা খোলা নেই তাদের সামনে। কিন্তু ব্রিটিশ পুলিশের হাতে ধরা দিতে তারা নারাজ। শেষবারের মত তিনজন একসঙ্গে বন্দেমাতরম ধ্বনি দিলেন। এরপর তারা মৃত্যুবরণের জন্য প্রস্তুত হলেন। বাদলের পকেটে ছিল পটাশিয়াম সায়নাইড। সেটি গলাধঃকরণ করলেন তিনি। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। আর বিনয় ও দীনেশ তাদের রিভলভারের শেষ দুটি বুলেট চালিয়ে দিলেন নিজেদের মাথা লক্ষ্য করে। গুরুতর আহত হলেন তাঁরা। কিন্তু এত সহজে ধরা দিল না কাঙ্ক্ষিত মৃত্যু। বিনয় ও দীনেশ সাংঘাতিক আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মেঝের উপর পড়ে রইলেন। ভীষণভাবে আহত বিনয় ও দীনেশকে একটু সুস্থ করে ইংরেজ বাহিনী তাঁদের উপর চালাল প্রচণ্ড অত্যাচার। এরপর উভয়কেই পুলিশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। পুলিশ কমিশনার টেগার্টের বিনয়ের উপর আক্রোশ ছিল। এতদিন পরে মিটানোর সুযোগ পেলেন। অচেতন বিনয়ের হাতের আঙ্গুলের উপর বুট দিয়ে সবগুলি আঙ্গুল ভেঙ্গে ফেলে বীরত্ব প্রদর্শন করলেন।

অত্যাধুনিক চিকিৎসা প্রদান করা হতে লাগল বিনয় ও দীনেশকে। কারণ ব্রিটিশরা এত সহজে শেষ করে দিতে চায় না তাদের শত্রুপক্ষকে। চূড়ান্ত যন্ত্রণা দিয়ে শত্রু নিধনই তাদের পছন্দ। তাই ডাক্তার ও নার্সরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে লাগলেন দুই বিপ্লবীকে সুস্থ করে তোলার জন্য। কিন্তু বিনয় ছিলেন মেডিকেলের ছাত্র, চিকিৎসা শাস্ত্রের ওপর তাই তাঁর ছিল ভালোই দখল। সবার অলক্ষ্যে নিজের ক্ষতস্থানে আঙ্গুল চালাতে চালাতে সেপটিক করে ফেলেন তিনি। ফলে চিকিৎসকদের পক্ষে আর সম্ভব হয়নি তার প্রাণ বাঁচানো। ১৯৩০ সালের ১৩ ই ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তবে এতটা সৌভাগ্যের অধিকারী ছিলেন না দীনেশ। ক্রমশ সুস্থ হয়ে উঠতে থাকেন তিনি। মেডিকেল ক্লিয়ারেন্স পাওয়ার পর তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কনডেমড সেলে। শুরু হয় তার বিচারকার্য। এরপর ১৯৩১ সালের ২৭ জুলাই তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। মৃত্যুর আগে তবু তার ছিল একটি অনন্য অর্জন, আর তা হল জেলবন্দি অবস্থায় সুভাষ বসুর চরণ স্পর্শের সৌভাগ্য।

বিনয়-বাদল-দীনেশ এই তিন অগ্নিযুগের বিপ্লবীর নির্ভীক দেশপ্রেম আত্মত্যাগ ও দুঃসাহসিক কর্মটি একদিকে যেমন ব্রিটিশ শাসকদের উদ্বিগ্ন ও ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলেছিল, ব্রিটিশ প্রশাসনের ভিতকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল, ঠিক তেমনি অন্যদিকে ভারতীয় বিপ্লবীদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে উজ্জীবিত করেছিল। দেশের কাজের জন্য যারা নিজেদের উৎসর্গ করেছিলেন দেশের স্বাধীনতা তারা দেখে যেতে পারেননি। তবে ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট ভারত যে মুক্তির হাসি হাসতে পেরেছিল তার জন্য এই সমস্ত মানুষদের অবদান অনস্বীকার্য। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর এই তিন বিপ্লবীর নাম অনুসারে ইংরেজ শাসক লর্ড ডালহৌসির নামাঙ্কিত ডালহৌসি স্কোয়ারের নাম রাখা হয়েছে 'বি-বা-দী বাগ'। সেখানে স্থাপিত হয়েছে বিপ্লবী বিনয়, বাদল ও দীনেশের সুন্দর স্মৃতিস্তম্ভ। কোনও ঐতিহাসিক বিবাদ থেকে এলাকাটির নাম 'বি-বা-দী বাগ' হয়নি। তবে এর নামকরণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিবাদের চেয়েও বড় একটি বিষয়। সেটি হল ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র যুদ্ধ, আর সেই যুদ্ধের তিন বীর সেনানী বিনয়, বাদল, দীনেশের নামের আদ্যক্ষর অনুসারে এলাকাটি পেয়েছে তার বর্তমান নাম। আর রাইটার্স বিল্ডিংয়ের অলিন্দে স্থাপিত হয়েছে এই তিনজন অমর শহীদের চিত্র।

রক্তক্ষয়ী পর্বের মধ্যে দিয়ে ডালহৌসি স্কোয়ারের নাম পরিচয় পাল্টে হয়ে গিয়েছে বিনয়-বাদল-দীনেশ বাগ। রাইটার্স বিল্ডিংয়ের গথিক বারান্দা কিন্তু মনে রেখেছে ১৯৩০ সালের ৮ ডিসেম্বরের কথা।


   


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy