প্লেকট্রাম
প্লেকট্রাম


সত্যি কথা বলতে কি অনিক দা কে ভীষণ ভীষণ ভালো লাগে ঝিলিকের
কিন্তু সে বোঝে কজন ?
অনিক দা নিজেও বুঝতে পারে না।আর পারবেই বা কি করে সারাদিন তো গিটার আর গান নিয়েই থাকে
এছাড়া তো আর কোনো জগৎ নেই অনীকদার
চৌধুরী মেস বাড়ির ছাতে প্রতি শনি রবি বিকেলে ওদের আসর বসে
কি যেন বলে বাংলা ব্যান্ড .... অনিকদার সব ডাকা বুক বন্ধুরা আসে
কোনো টার মেয়েদের মতো বিশাল লম্বা চুল
কোনোটার আবার ছাগল দাড়ি ,একটার তো মাথার চুল গুলো সবুজ রং করা
কি যে ছাই পাশ গান গায় ওরাই জানে
গিটার আছে ড্রাম আছে আরো অনেক রকম যন্ত্র পাতি আছে
দুটো দিদিও আসে জিন্স আর টপ পরে
ঝিলিক দেখেছে. ...
ওরা সবাই মিলে শনি রব বার বিকেলে প্রচুর আড্ডা মারে আর গান গায়
দিদি গুলো আবার ওদের সাথে সিগারেট খায়
ঝিলিক এটাও দেখেছে চা দিতে গিয়ে
রাস্তার উল্টো দিকেই ঝিলিক দের চায়ের দোকান
ঝিলিকের মা কাজ করে চৌধুরী মেস বাড়িতে
আর বাবা চালায় এই চায়ের দোকান টা
ঝিলিকের একটা দাদা ছিল
দাদা ওদের কে ছেড়ে চলে গেছে
ঝিলিক তখন অনেক ছোট দাদার একটা অসুখ হয়েছিল
হাসপাতালে ভর্তিও হয়েছিল ,ঝিলিক যেত হাসপাতালে দাদা কে দেখতে প্রতিদিন
বাবা নিয়ে যেত সাইকেলে করে
দাদা কিছু টা ঠিক হয়ে গিয়ে আবার বাড়ি ফিরেও এসেছিলো
কিন্তু তার কিছু দিন পরেই দাদা ওদের সবাই কে ছেড়ে চলে গেল।
দাদার সাথে অনিক দার কোথায় যেন একটা মিল খুঁজে পায় ঝিলিক। ... তবে অনিকদা দাদার মতো হলেও ঠিক যেন দাদা নয়।
শনি রোববার বিকেলে চৌধুরী মেস বাড়ির ছাদে অনিক রা যখন আসর বসায় তখন তিন থেকে চার বার চা নিয়ে যায় ঝিলিক
ঝিলিক কে দেখে ওরা অনেক গল্প করে
অনিক দা কিন্তু গম্ভীর হয়ে গিটার বাজিয়ে যায়
অনিক দা কারো সাথে খুব একটা বেশি কথা বলে না। কি রকম অদ্ভুত রকম নাক উঁচু
ঝিলিক জানে অনিক দারা অনেক বড় লোক অনিক দার মা বাবা দুজনেই অনেক বড় ডাক্তার। অনিক দা মেসে একা একটা ঘর নিয়ে থাকে।
ঝিলিকের একটা ইচ্ছা আছে।
দাদার একটা প্লেকট্রাম ছিল
দাদাও যে খুব ভালো গিটার বাজাতে পারতো অনিকদার মত
সংহতি ক্লাব থেকে দাদা কে গিটার বাজানোর জন্য ওই প্লেকট্রাম টা দিয়েছিল।হলুদ রঙের প্লেকট্রাম।
অসুখ হওয়ার সময় দাদার গিটার টা বাবা বিক্রি করে দেয়। কিন্তু ওই প্লেকট্রাম টা লুকিয়ে রেখেছিল ঝিলিক।
ঝিলিকের খুব ইচ্ছা ওই প্লেকট্রাম টা একদিন ও অনিক দা কে দেবে
*********************************************************************
হটাৎ মোবাইল টা বেজে উঠলো অনিকের
অনিক গিটার টা রেখে মোবাইল টা ধরলো
শুভময় দার ফোন।
ওদের রক ব্যান্ড ডার্ক ওয়াটার্স এর একজন প্যাট্রন হচ্ছেন শুভময় দা।
একটা দারুন খবর আছে ওদের জন্য।
একটি নতুন মিউজিক কোম্পানি ওদের এলবাম লঞ্চ করতে চায়
ছ টা ঋতু নিয়ে ছটা গান থাকবে এলবামে
পুরোটাই স্পনসর করবে ওই মিউজিক কোম্পানি
খুবই আনন্দিত অনিক কিন্তু ছটা ঋতু নিয়ে গান খুবই গতানুগতিক হয়ে যাবে।
অনিকের মনে হয় ছটা ঋতু নিয়ে না করে যদি
ষড়রিপু নিয়ে করা হয় সেটা বেশি ভালো হবে।
ষড়রিপু
কাম ক্রোধ লোভ লালসা মোহো মাৎসর্য
একটা উন্মাদনা একটা উল্লাস আকড়ে ধরলো অনিক কে
এই প্রত্যেক টা রিপুর উপরে বেস করে এক এক টা গান লেখা হবে
ব্যাপারটা অনিক জানিয়ে দেয় শুভময় দা কে।
পরের দিন শুভময় দা আবার ফোন করে অনিক কে মিউজিক কোম্পানি রাজি আছে।
ষড়রিপুই হোক।
যাক এই এক মাসে নামবে ষড়রিপু
কিন্তু আরো একটা কিছু হলে যেন ভালো হয় এমন মনে হলো অনিকের
শুধু ষড়রিপু দেখালেই চলবে কেন
তার থেকে বেরিয়ে আসাটাই তো বেশি গুরুত্বপূর্ণ
মানে ষড়রিপু কে জয় করার ব্যাপার টা
ভালো হবে
ছটা রিপু হওয়ার পর
শেষের নাম্বার টা হবে একটা দুর্দান্ত ফাটাফাটি ইন্সট্রুমেন্টাল
নাম
"মুক্তি" বা "সালভ্যাশন" বা "রিডেমশান"
এই ষড়রিপুর সাথে লড়াই করে ষড়রিপু কে জয় করার যে মুক্তি তার স্বাদ থাকবে শেষের সংগীতে।
সৃষ্টির একটা আনন্দ হটাৎ আপ্লুত করে ফেললো অনিক কে
এই "মুক্তি" টাই এলবামের থিম হবে
সারা শরীরে একটা শিহরণ বয়ে গেলো অনিকের
মোটামোটি ছটা রিপুর উপর ছটা গান ওরা পাঁচ দিনেই রেডি করে ফেললো
কিন্তু শেষের মুক্তির সংগীত অত সহজে করা গেল না।
একদিন শুভময় দা এলেন ওদের সব কটা গান শুনলেন কিন্তু সব শেষের মুক্তির সংগীত শুনে সেটা ওর একদমই পছন্দ হলো না।
"মুক্তি"
"সালভ্যাশন"
"রিডেমশান"
ঠিক ফুটছে না।
অনিক দশ দিন ধরে সবার সাথে অনেক চেষ্টা করলো
কিন্তু রিডেমশান আর আসছে না
মিউজিক ঠিক খুলছে না
ওরা বহুবার এই মুক্তির সংগীত কম্পোজ করে মিউজিক কোম্পানি টি কে পাঠায়।
কিন্তু না
মুক্তির সংগীত ঠিক বেরোচ্ছে না
সারা জীবনের সীমাহীন যন্ত্রণর সাথে যে
অপরিসীম লড়াই......
কত অপমানের কত কলঙ্কের থেকে যে নিজেকে বাঁচাবার লড়াই …..
মানসিক শারীরিক হাজার ব্যাথা কে উপেক্ষা করার যে ক্লান্তিহীন লড়াই.....
সেই মুক্তির সংগীত কি আর এক মাসে অত সহজে আসে।
******************************************************
এর মধ্যে অনেকবার ঝিলিক গেছে চোধুরী মেস বাড়ির ছাতে। অনিকদা দের চা দিতে
ওরা কেমন সবাই পাগলের মতো বাজিয়ে যাচ্ছে। হটাৎ হটাৎ অনিক দা রেগে থামিয়ে দিচ্ছে ওদের
"হচ্ছে না হচ্ছে না
মুক্তি আসছে না
সালভ্যাশন আসছে না
>
রিডেমশান আসছে না।"
আবার বাজানো শুরু করছে ওরা
একটু ভয় পেয়ে গিয়ে ঝিলিক আর সাহস করে উঠতে পারছে না দাদার প্লেকট্রাম টা অনিক দা কে দেওয়ার।
ঝিলিক জানে প্রতি রোববার বিকেলে অনিক দা এই ভবানীপুর সিমেট্রিতে আসে।
সিমেট্রির একদম শেষ প্রান্তে কয়েকটা ছোট স্মৃতি সৌধ আছে।
তার একপাশেই একটা বড় ছাতিম গাছ , গাছ টার পাশেই আন্তোনিও স্যারের কবর।
আন্তোনিও সার অনিক দা কে ভায়োলিন শেখাতেন
অনিকদার সংগীতের প্রতি অনুরাগ অনেকটাই আন্তোনিও স্যারের জন্য।
আজ ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে । বিকেল হতে আর বেশি দেরি নেই।
ঝিলিক দাদার প্লেকট্রাম টা আন্তোনিও স্যারের কবরের উপর রেখে দেয়।
ওদিকে দোকান খুলতে হবে দেরি হয়ে যাচ্ছে তাই তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসে সিমেট্রি টা থেকে।
বিকেলে ভীষণ বৃষ্টি পড়ছে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন।
অনিক একটা উইনচিটার পরে ঢুকেছে ভবানীপুর সিমেট্রিতে
চলে এসেছে সিমেট্রির একদম শেষ প্রান্তে।এখানে ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড ওয়ারের একদম যুবক সৈনিক দের ছোট ছোট স্মৃতি সৌধ পর পর রাখা আছে।এই ছোট্ট এক ফালি জায়গাটা দেখে ভারত বর্ষ বলে মনে হয়না। মনে হয় কোনো ব্রিটিশ ওয়ার সিমেট্রি।
এখানেই বড় একটা ছাতিম গাছের পাশে রয়েছে আন্তোনিও স্যারের কবর টা।
কবরের এপিটাফ এ লেখা "Teardrops and the butterfly."
এই "Teardrops and the butterfly" ছিল আন্তোনিও স্যারের একটা স্মরণীয় স্বরচিত কম্পোজিশন।পুরোটাই আন্তোনিও সার করেছিলেন amati ভাইওলিনে।
বৃষ্টি ভালই জোরে জোরে পড়ছে তাই অনিক এসে দাঁড়িয়েছে ওই ছাতিম গাছ টার তলায়।
একটা মিষ্টি মিষ্টি সুগন্ধ নাকে এসে লাগছে অনিকের। অদ্ভুত একটা নেশা আছে গন্ধটার মধ্যে।
কিরকম যেন একটা তন্দ্রা মত আসছে অনিকের।
হটাৎ তন্দ্রা ভেঙ্গে গেল অনিকের
আর ঠিক তখনি সেই আশ্চর্য্য ঘটনা টা ঘটলো
বৃষ্টি টা ধরে এসেছে। গোধূলির হালকা আলো মেঘ মন্ডলের সাথে মিশে আকাশে বাতাসে একটা অদ্ভুত পরিবেশের রচনা করেছে।
অনিক স্পষ্ট দেখলো আন্তোনিও স্যারের কবরের যে এপিটাফ। ঠিক সেই এপিটাফের উপর উড়ে এসে বসেছে একটা উজ্জ্বল হলুদ ছোট্ট প্রজাপতি , হলুদের উপরে পড়ন্ত সূর্যের আভা পরে একটা ঐশ্বরিক সুন্দর্য সৃষ্টি করেছে ,হালকা লালের ছটা ডানা গুলোর উপরে পরে একটা রক্তিম আভার সৃষ্টি করছে
"মুক্তি"
"সালভ্যাশন"
"রিডেমশান"
কি অদ্ভুত প্রজাপতিটা ,পাখনা দুটো মৃদু তালে খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে ....খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে... ঠিক যেন হৃদয়ের স্পন্দন ...
অনিক এগিয়ে গেলো আন্তোনিও স্যারের কবরে দিকে। প্রজাপতি টা কোথায় যেন উড়ে পালালো
কবরের উপরে রাখা হলদে রঙের প্লেকট্রাম টা দেখে অবাক হলো অনিক।
কাঁপা কাঁপা হাত দিয়ে তুলে নিলো প্লেকট্রাম টা।
**********************************************************
এর পর অনিক দের আর বেশি দিন বসতে হয় নি
এলবাম কমপ্লিট হয়ে বেরোনোর পর ভু ভারতে সেনসেশন হয়ে উঠলো ডার্ক ওয়াটার্স।
সবার মুখে মুখে ঘুরতে থাকে ডার্ক ওয়াটার্স এর ভোকালিস্ট অনিক সেনের এর প্রতিভার কথা।
ষড়রিপু আর তার মুক্তির সংগীত শুনে সবাই অভিভূত।
ঝিলিক চা দিতে গিয়ে দেখেছে অনিক দা এখন আর খালি হাতে গিটার বাজায় না।
ঝিলিকের দাদার প্লেকট্রাম টা ব্যাবহার করে বাজায়
একটা অদ্ভুত শান্তি পায় ঝিলিক।
অনিক দাও ঝিলিকের সাথে অনেক কথা বলে আজকাল। আগের সেই গম্ভীর গম্ভীর ভাব টা যেন এখন আর নেই।
ডার্ক ওয়াটার্স এর নতুন অনুষ্ঠান হবে শহর তলীর এক মেডিক্যাল কলেজে।অনিক দা ঝিলিক কে একটা পাস দিয়েছে।
*************************************************
শহর তলীর সেই মেডিক্যাল কলেজ
ওরা প্রাণ পণে সেই অসাধারণ কম্পোজিশন "মুক্তি" বাজিয়ে চলেছে। মুক্তির স্বাদ পেয়েছে যেন আকাশ, বাতাস, মাটি, জল ,নিঃশাস, প্রশ্বাস ।
"মুক্তি"
"সালভ্যাশন"
"রিডেমশান"
ছড়িয়ে পড়ছে শিরায় শিরায়। মুক্তির জোয়ার ভেসে চলছে প্রতিটি শ্রোতার রন্ধ্রে রন্দ্রে।
মুক্তির ঐকতানে যেন কাঁপছে মেডিক্যাল কলেজের গোটা অডিটোরিয়াম টা।
অডিটোরিয়ামের বাইরেই শাল বন টার কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝিলিক সেই মনমাতানো পাগল করা সংগীত শুনতে থাকে।
অনিক দার দেওয়া পাস টা হাতেই রয়ে গেছে কেন যেন ভিতরে যেতে একটা ভয় বা সংকোচ হয়েছে তাই হাজার চেষ্টা করেও ঢুকতে পারেনি ।
হটাৎ হালকা হালকা হাওয়া দিতে শুরু করেছে। মুক্তির সুর যেন আস্তে আস্তে ঝিলিক কেও পেয়ে বসছে একটু একটু করে।
এবার ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি পড়ছে।
অনিক দা মুক্তির সংগীত বাজাচ্ছে। আরো অনেক বড় হবে একদিন অনিকদা।
পৃথিবী জোড়া নাম ডাক হবে অনিক দার।
দাদার প্লেকট্রাম টা দিয়েই বাজাচ্ছে অনিক দা।
চোখের কোণা থেকে দু ফোটা মুক্ত বেরিয়ে এলো ঝিলিকের।
বৃষ্টি ধরে আসছে। সূর্যের হালকা একটা রক্তিম আভা মেঘ মুলুকে যেন মাদকতা ছড়াচ্ছে।
নিজের অস্তিত্ব কে যেন বিলীন করে ঝিলিক অনিক দার মুক্তির সংগীত শুনছে।
ঝিলিকের অজান্তেই একটা ছোট্ট প্রজাপতি ঝিলিকের কাঁধে এসে বসেছে।
ছোট্ট নীল হলদে রঙের প্রজাপতি।
গোধূলির হালকা লালের ছটা ডানা গুলোর উপরে পরে একটা রক্তিম আভার সৃষ্টি করছে
"মুক্তি"
"সালভ্যাশন"
"রিডেমশান"
পাখনা দুটো মৃদু তালে খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে ....খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে... ঠিক যেন হৃদয়ের স্পন্দন ...
চোখের কোণা থেকে আরো দু ফোটা মুক্ত বেরিয়ে এলো ঝিলিকের।
.......দূরে বহু দূরে ভবানীপুর সিমেট্রি তে খুব বৃষ্টি হচ্ছে
আর সেই বৃষ্টির মধ্যে যেন মুক্তির সাধে মাতোয়ারা হয়ে হাসছে আন্তোনিও স্যারের এপিটাফ টা।....Teardrops and the butterfly."
**********************************