Somtirtha Ganguly

Children Stories Horror Classics

4.3  

Somtirtha Ganguly

Children Stories Horror Classics

রাঙা পিসি

রাঙা পিসি

5 mins
720



সবাই বলে ছোট বয়সের কথা অত নাকি মনে থাকে না আমার কিন্তু দিব্বি মনে আছে অনেক ছোটবেলার স্মৃতি। 

একবার যা ভয়ানক জিনিস দেখেছিলাম তা এখনো যেন চোখের সামনে ভাসে।

তখন আমার বয়স চার আমার দিদির সাত বছর ।


আমরা কল্যাণী তে জে এন এম হাসপাতালের ডক্টরস কোয়ার্টার্সে থাকতাম।


কোয়ার্টার্স বলছি ঠিকই কিন্তু একরকম ছোট বাংলো গোছের বাড়ি ছিল সেটা। আসে পাশে চৌহুদ্দির মধ্যে আর কোনো বাড়ি নেই। শুধু ধু ধু করছে মাঠ।

মাঠ পেরোলে নার্সসিং হোস্টেল 


বাংলো টার পিছনে একটা গ্যারাজের মতো ঘর । সেখানে শুধু দারোয়ান রামদিন থাকতেন।


বাংলো টায় থাকতাম আমরা চারজন আমি আমার দিদি, আমার মা এবং রাঙা পিসি 

বাবা কলকাতায় চাকরি করতেন হপ্তা খানেক বাদে বাদে দর্শন দিতেন ।


মা ছিলেন হাসপাতালের নারসিং সুপারিনটেনডেন্ট

বেশির ভাগ সময় হাসপাতালেই থাকতেন।

আমি আর দিদি রাঙা পিসির কাছেই বড় হয়েছি।


 

অদ্ভুত মানুষ ছিলেন এই রাঙা পিসি 

এই টুকু সংসারের সব খুঁটিনাটি ছিল ওনার হাতে ।

উনি বলতেন উনি নাকি মা কেও কোলে পিঠে মানুষ করেছেন। 


আমাদের দুই ভাই বোন কে যত্ন করে খাইয়ে দিতেন প্রত্যেক দিন প্রত্যেক বেলা। অপূর্ব ডিমের ডালনা রাঁধতে পারতেন। খাওয়াতে খাওয়াতে আমাদের সাথে কত রকম মজার মজার গল্প বলতেন রাঙা পিসি।


কম বয়সে নাকি সাংঘাতিক তেজ আর সাহস ছিল রাঙা পিসির। বন বন করে লাঠি ঘোরাতে পারতেন একাই একবার চারটে ডাকাত কে পিটিয়ে শায়েস্তা করেছিলেন।


দেখতেও ছিল নাকি দুর্দান্ত


সবাই ওনার রূপের প্রশংসা করতো প্রচুর।

ওনার নাকি পায়ের গোড়ালি অবধি লম্বা এলোকেশী চুল ছিল

সেই দেখে কত পাড়ার তাবড় তাবড় রোমিও রা মজনু তে পরিণত হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই ।


আমাকে খুবিই ভালোবাসতেন রাঙা পিসি একটা ছোট সাইকেল কিনে দেবেন বলে একটা পুটুলি তে টাকা জমাতেন কিন্তু সেই টাকার পুটুলিটা একদিন যে কোথায় হারিয়ে গেল তা আর পাওয়া গেলো না

দুঃখ করে বলতেন " ছোটন খোকা তোমাকে বাইসাইকেল এনে দব বলে যে এত্ত টাকা জমালেম কোথায় হারে ফেললাম কে জানে"।



এক ধরণের নস্যি নিতেন রাঙা পিসি । কি সুন্দর অপূর্ব গন্ধ।



সেবার প্রচুর বন্যা হলো।

রাঙা পিসির দেশের বাড়ি থেকে ওনার ভাই এসে ওনাকে নিয়ে গেলেন। ঘর বাড়ির বাজে অবস্থা এখুনি ঠিক ঠাক করতে হবে।



মা পড়লেন ভীষণ বিপাকে আমি আর দিদি দুজনেই খুবই ছোট। এতো তাড়াতাড়ি লোক পাওয়া খুব মুশকিল । এখন কি করেন ?


মুশকিল আসান করলেন আমার মামী মা 

ওনার মেয়েদের দু মাসের গরমের ছুটি পরে গেছে তাই মায়ের ফোন পেতেই দেরি না করে বেলঘরিয়া থেকে আমার দুই মামাতো দিদি কে নিয়ে সটান কল্যাণী এসে হাজির।


আমাদের আনন্দের সীমা রইলো না 

আমার দুই মামাতো দিদি আমার দিদির থেকেও তিন বছরের বড় তাই আমাদের অভিভাবকের অভাব রইলো না খুব হৈ হৈ করে প্রতিদিন কাটতে লাগলো l 

 

এইভাবে আনন্দের সাথে কাটাতে কাটাতে হটাৎ একদিন একটা ঘটনা ঘটলো একদিন দুপুরেমামী মা ছাদে গেছেন কাপড় মেলতে ।

মামী মা অনুভব করলেন একটা ঠান্ডা হাওয়ার রেশ যেন ওনাকে ছুঁয়ে বেরিয়ে গেল। ওনার মনে হলো সামনের নিম গাছটা থেকে কেউ যেন ওনাকে দেখছে।অথচ কেউ কোথাও নেই। 


খুব ভয় পেয়ে মামী মা কাপড় গুলো তাড়াহুড়ো করে মেলে নেমে এলেন কিন্তু বিকেলে কাপড় গুলো আনার সময় আরো একটা ঘটনা ঘটলো।


তখন বিকেল পাঁচটা হবে । মামিমা কাপড় গুলো আনতে যাবেন হটাৎ আমরা শুনলাম ছাদে কেমন যেন ঘর ঘর করে আওয়াজ হচ্ছে ।

মনে হচ্ছে একটা লম্বা ড্রাম ছাদের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত গড়িয়ে যাচ্ছে। মামী মা ভয়ে ভয়ে ছাদের সিঁড়ি বেয়ে উঠে দেখেন ছাদের দরজা ছাদের ওপার থেকেই কেউ খিল দিয়ে বন্ধ করে রেখেছে।

রাত্রে মা হাসপাতাল থেকে ফেরার পর রামদিন কে ডাকিয়ে অতি কষ্টে একটা মইয়ের সাহায্যে ছাদে উঠিয়ে দরজা খুলিয়ে ছিল।

ছাদ অন্ধকার তাই ছাদের দরজার খিলটা রামদিন কে খুব কষ্ট করে খুলতে হয়েছিল একটা মোমবাতি জ্বেলে।

ও বললো খিল টা এমন ভাবে বসে গেছিল যে দেখে মনে হচ্ছিল কয়েক যুগ ধরে এই খিল তোলা আছে আর সব থেকে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এই কয়েক ঘন্টা তেই খিলটার উপর ছত্রাক পরে গিয়েছে। লেগে গেছে উইয়ের বাসা। মোমবাতির আলোয় রামদিন স্পষ্ট দেখেছে।

এরপর থেকেই কত গুলো অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে থাকতো বাংলো টায়।

ঠিক সন্ধ্যে নামার আগে বসার ঘরের একটা জানলার কপাট নিজে থেকেই খুলে যেতো।ভিতর থেকে দেখলে মনে হতো বাইরে থেকে কেউ টেনে খুলছে আর বাইরে গিয়ে দেখলে মনে হত ভিতর থেকে কেউ আচমকা ধাক্কা মেরে পাল্লা টা খুলে ফেলছে। অথচ কোনো হওয়া বাতাস কিচ্ছুটি নেই। 

সব থেকে ভয়ের ব্যাপারটা ঘটতো দুপুর তিনটে নাগাদ আমরা যখন খাওয়া দাওয়া করে বসার ঘরে পাটি পেতে গল্প করতাম তখন পশ্চিমের ভাড়ার ঘরটা থেকে একটা কান্নার শব্দ ভেসে আসতো।একটি মেয়ে যেন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।


মূল ঘটনা ঘটলো প্রায় এক সপ্তাহ পর । শনিবার রাত আট টা বাজে। ভীষণ কাজের চাপ বাবা কে বাইরে কোনো জেলায় যেতে হয়েছে তাই এই সপ্তাহ শেষে উনি আসতে পারেন নি। 

আজ মার নাইট ডিউটি তাই কিছুক্ষন আগেই মা বেরিয়ে গেছেন । আমি দিদি আর আমাদের দুই মামাতো দিদিরা বাইরের বারান্দায় খেলছি। মামিমা ভিতরে রান্না করছেন হটাৎ হু হু করে ঠান্ডা হওয়া দিতে লাগলো। কিছুক্ষন পরই দেখলাম প্রচন্ড ঝড় উঠেছে।

মামী মা চিৎকার করে আমাদের ভিতরে আসতে বললো আমরা ওনার কথা না শুনে লম্বা বড় বারান্দায় খেলতে লাগলাম। ঠিক তখনই আলো গুলো সব নিভে গেল। লোডশেডিং

বাইরে মুষল ধারায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে । মাঝে মাঝেই করাত করাত বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।বৃষ্টির ঝাঁট গ্রিল থেকে বারান্দায় এসে পড়ছে। তাই নিয়ে আমাদের উন্মাদনার শেষ নেই আমি লাফাতে লাফাতে সদর দরজা পেরিয়ে দালানে চলে এসেছি।বৃষ্টি তে ভিজতে খুব ভালো লাগছে।

হঠাৎ মনে হলো কালো রবারের পাইপ জাতীয় কিছু আমার দিকে এগিয়ে এলো মেন গেট থেকে। অদ্ভুত ছটফটে 

সঙ্গে সঙ্গে সামনের নিম গাছটায় একটা বাজ পড়াতে চারিদক কিছুক্ষনের জন্যে আলোকিত হয়ে উঠলো।সেই আলোতেই পাইপটা কে দেখতে পেলাম।পিছনে দিদি রা সব থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছেযেই জিনিস টা কে পাইপ বলে মনে করছিলাম সেটা একটা জলজ্যান্ত কেউটে সাপ। ফনা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। কালো চক চক করছে সাপ টা।

দিদি রা ভয়ে কাঠ। আমি কেউটে টার থেকে শুধু এক হাত দূরে দাঁড়িয়ে ।এক ছোবলেই সাবাড় করে দিতে পারে আমায়।


বৃষ্টি পড়লেও কিছুটা মেঘ সরে গেছে। হালকা চাঁদের আলো আঁধারে দেখলাম আমার পাশে কাউকে দেখে সাপটা যেন ভয় পেয়েছে।

একটা মিষ্টি মিষ্টি চেনা সুন্দর হালকা গন্ধ নাকে এলোনস্যি র গন্ধ। রাঙা পিসি ফিরে এসেছে নাকি গ্রাম থেকে। কখন এলো।


বাম দিকে তাকাতেই আরেকটা বাজ পড়লো আর এই বাজ পড়ার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আমি দেখতে পেলাম একটা উনিশ কুড়ি বছরের মেয়ের অবয়ব বাম দিকের দালানের দেয়াল জুড়ে।


কোমড় অবধি লম্বা চুল। খুব যত্ন করে আঁচড়াচ্ছে চুলগুলো।বিদ্যুতের পরেও চাঁদের আলোয় দেখলাম সেই মেয়েটার ছায়া টা কেখুব যত্ন করে চুল আঁচড়াচ্ছে আসতে আসতেচুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে মিলিয়ে গেল ছায়া টা।


সাপ টা আসতে আসতে মেন গেট পেরিয়ে বেরিয়ে গেল । দমকা হাওয়া একটা ডাল আছড়ে পড়লো মেন গেটের সামনে তুলসী তলার নীচে। একটা ছোট্ট ঘটি গড়িয়ে গেল। আলো আধারির হালকা আলোয় দেখলাম বৃষ্টির জলের উপর পড়ে আছে একটা ময়লা পুটুলি খুব সম্ভব ওই ঘটি টা থেকে বেরিয়েছে।

দিদিরাও দেখেছে ওই ছায়াটা ওটা কে নস্যি র গন্ধ এখনো মো মো করছে চারদিক।আমাদের ত্রিসীমানায় আমরা চারজন ছাড়া আর কেউ নেই।

আমরা ভয় ভয় ভিতরে চলে এলাম

কিচুক্ষন পর আলো চলে এলো


সকালে মা কে পুরো ঘটনা টাই জানানো হলো।

দুপুরে রাঙা পিসির গ্রাম থেকে এক ভদ্রলোক এসে খবর দিলেন রাঙা পিসি মারা গেছেন কেউটে সাপের কামড় খেয়ে।

যে যা ভাবে ভাবুক আমি জানি রাঙা পিসিই এসেছিল আমাকে বাঁচাতে তার অল্প বয়সের এলোকেশী নিয়ে।

পুটুলির ভিতর থেকে যা জমানো টাকা বেরোয় তা দিয়ে মা আমায় একটা রেজেন্ট বাইসাইকেল কিনে দিয়েছিলেন।

সাইকেল টা এখনো আছে আমার ছোট ছেলে ওটি চালায়। ও যখন সাইকেল টা চালায় আমি হালকা হালকা একটা সুন্দর নস্যি র গন্ধ এখনো পাই।





Rate this content
Log in