হরিপদ অন্তর্ধান রহস্য
হরিপদ অন্তর্ধান রহস্য
আচ্ছা , আপনারা কোনোদিন টিকটিকি কে খুব কাছ থেকে দেখেছেন? মানে লক্ষ্য করেছেন কি? দেখবেন, প্রত্যেকটা টিকটিকি দেখতে আলাদা, মানে, দেখলে চেনা যায়। সন্তোষবাবু ইদানীং তার ঘরের টিকটিকিদের দিকে মন দিয়েছেন। লক্ষ্য করে দেখেছেন ওদের মধ্যে একটা বেশ বুদ্ধি কাজ করে।
এই মাস দুয়েক হলো রিটায়ার করেছেন তিনি , হাতে বেশ খানিকটা সময় পেয়েছেন। তাঁর কয়েকটা শখ ছিল । এক , সত্যজিৎ রায়ের সমস্ত গল্পগুলো প্রায় মুখস্ত করে ফেলা । দুই, কাছাকাছি যেসব পশুপাখি কীট পতঙ্গ আছে, তাদের ভালো ভাবে লক্ষ্য করা। তো , এবার তিনি সেই শখগুলো প্রাণভরে মিটিয়ে নেবেন।
রাতে একটা সবুজ আলো জ্বেলে রাখেন সন্তোষ। ঐ আলোতে টিকটিকিরা ঘুরে বেড়ায় দেওয়াল জুড়ে। 'কালচে রঙের ওপর হলদেটে ডোরা'
একটা অদ্ভুত টিকটিকি আছে, ওর 'প্রায়-সাদা' সঙ্গীকে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। অন্যান্যরাও ওকে বেশ মানে-টানে বলেই মনে হয়। ওকে দেখলেই কেমন যেন মনে হয়....একটা ভয় মিশ্রিত সম্ভ্রম।
একটু বেশি রাতে বেরোয়,'গাঢ়-হলুদ'-রঙের একটা, কয়েকটা কালো ফুটকি আছে ওর পিঠে।
আর 'মোটা-সোটা' যেটা, তার লেজের শুরুতে দুটো লালচে দাগ, ওদের দেখতে দেখতেই ঘুমিয়ে পড়েন সন্তোষ।
বাড়ির আর মাত্র একজন সদস্য আছে, সে হরিপদ। হরিপদর গায়ের রঙ্ বেশ কালো, বাঁ চোখের ওপর কপালে একটা সাদা লম্বাটে দাগ। উত্তেজিত হয়ে গেলে আবার লালচে দেখায় দাগটা। হাসলে সাদা দাঁতের সারি ঝকঝক্ করে।
তার ওপরেই রয়েছে সন্তোষের সংসারের দায়িত্ব।
সে সারা বাড়ি দিনরাত পরিষ্কার
করে আর গজগজ্ করে,
---------এ্যাত্তো জীব থাকতে পোষার আর কিছু পেলেনা!! শেষে টিকটিকি? কি নোংরা করে রাখে চারিদিক, এদিকে তো শুনি বিষাক্ত,-----
হরিপদর কাজ কি একটা? ও তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে ঢোকে। বাবু বেড়িয়ে ফিরলেন বলে। যাবার সময় বলে গেছেন,
------ আজ একটু লুচি খাওয়াবি হরি?
হরিও লুচি খেতে ভালোবাসে। তাই বেশ জম্পেস করেই আলুরদম রেঁধেছে। লুচি বেলে, ভাজার
জন্য তেল চাপিয়ে দিল গ্যাসে। তাক থেকে খুন্তিটা নিতে গিয়ে চোখে পড়লো, 'প্রায়-সাদা' একটা টিকটিকি তাকিয়ে আছে।
হরি হেসে ফেললো,
----কিরে তুইও লুচি খাবি নাকি? কিছুই বিশ্বাস নেই-- খেতেও পারো তোমরা---
হরি লুচিতে মন দেয়।
কয়েকটা ভাজা হয়েছে!!এমন সময় ওপর থেকে
থপ্ শব্দে ডানকাঁধে, কি একটা পড়লো, হরি চমকে উঠে হাতটা ঝাড়তেই ওটা নিচে পড়লো, সঙ্গে সঙ্গে হরির হাত লেগে শিলের পাশ থেকে নোড়াটা গড়িয়ে স্ল্যাব্ থেকে দমাস্ করে ওটার ওপর পড়ে গেল।
লিখতে এতোটা সময় লাগলেও এসব ঘটে গেল চোখের নিমেষে। সেই মূহুর্তে চিক্ চিক্ শব্দ শুনে হরি দেখে, কালচে রঙের ওপর হলুদ ডোরা একটা টিকটিকি ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
নোড়াটা তুলে 'প্রায়-সাদা'-টার থ্যাঁতলানো দেহটা বাইরে ফেলে দিল হরি। মনে একটা অস্বস্তি লেগে রইলো।
যাই হোক,খাওয়ার পর সন্তোষ লক্ষ্য করলেন হরির মুখটা কালচে,
-------কি হয়েছে রে হরি?
সব শুনে মুখটা গম্ভীর করে বললেন,
-----যা হলো সেটা ঠিক হলো না রে হরি!!
কেন কে জানে, হলুদডোরা- টাকে দেখে টিকটিকি সমাজের বাক্-সিদ্ধ তন্ত্রিকের কথা
মনে হয় সন্তোষের, ওটা লিডার ওদের।
সেদিন সবুজ আলোয় ন'টা টিকটিকি ঘুরে বেড়ালো। 'হলুদডোরা' টা-কে দেখা গেলনা।সন্তোষ অনেকক্ষণ জেগে থেকে থেকে ঘুমিয়ে পড়লেন।
*******************
*******
পরের দিন হরি একটু দেরীতে ঘুম থেকে উঠলো।চুপচাপ সব কাজ করতে দেখে, সন্তোষ বললেন,
-----শরীর খারাপ নাকি রে?
-----নাঃ না তো!!---( চোখে অন্যমনস্ক দৃষ্টি)
-----কিছু হয়েছে?
----- কাল মরা টিকটিকিটার জোড়াটা এসেছিল, সারারাত আমার ঘরে ছিল।
সন্তোষ মনে মনে চমকে উঠলেও বললেন,
-----ওরা তো সব জায়গাতেই যায়, ভয় পাস না।
হরি খুব একটা আস্বস্ত হলো বলে মনে
হলো না। ভয়ে ভয়ে তাকাতে লাগলো মুখ উঁচু করে।
এর পর থেকে হরি কেমন ঝিমিয়ে পড়লো, দিনের বেলায় শুয়ে থাকে, রাতে খুটখাট্ করে কাজ করে বেড়ায়।
সন্তোষ দিন চারেকের জন্য পুরী যাবেন,ওর বন্ধুর সাথে, ওরা প্রায়ই বেড়িয়ে পড়েন। গোছগাছ করতে করতে হরিকে ডেকে কোথাও পেলেন না। এদিকে দেরী হয়ে যাচ্ছে। তিনি চেঁচিয়ে,
-------হরি ই -- যাচ্ছি -ই---বলে বেড়িয়ে গেলেন।
***********************
চারদিন পরে যখন ফিরলেন তখন বিকেল হয় হয়। কলিং বেল টিপে কোনো সাড়া পেলেন না।খুবই আশ্চর্য !! হরি এরকম তো করে না!
দরজাটা একটু চাপ দিতেই খুলে গেল। ঘরে ঢুকলেন।ক্লান্ত লাগছিল, হরির দেখা নেই।
একটু ফ্রেস হয়ে পাড়ার চায়ের দোকানে গেলেন চা খেতে। দোকানদার হাবুল বললো,
----- কি -- ছিলেন না নাকি?
-----এই একটু পুরী গিয়েছিলাম, হরিপদকে দেখেছো?
----- না তো!! দেখুন বাজার টাজার গেছে বোধহয়----
সন্তোষ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। রাত হয়ে
এলো হরির দেখা নেই, গত বারো বছরে এমন হয়নি। ওর সাতকুলে কেউ নেই। গেল কোথায়?
কাল সকালে একবার থানায় যাবেন ঠিক করলেন সন্তোষ। সবুজ আলোটা জ্বালিয়ে শুয়ে পড়লেন। অনেকদিন দেখেননি ওদের, এক্ষুনি ওরা বেড়োবে। অপেক্ষা করতে থাকেন সন্তোষ।
ঐ তো ওরা আসছে একে একে। একটা--দুটো--মোট ন'টা। না না ঐ যে হলুদডোরা-টা, কিন্তু ওর সঙ্গে ওটা কে? নতুন বুঝি? বাঃ, একটু মন দিলেন সন্তোষ ওটার দিকে, বেশ বড়োসড়ো কালচে রঙের, বাঁ চোখের ওপর,লম্বাটে একটা সাদা দাগ।
দেখে সন্তোষের বুকটা ছাঁৎ করে উঠলো, বহু-পঠিত একটা গল্পের কথা মনে হলো---বাক্-সিদ্ধ ঋষি----হলুদডোরা-কে সবুজ আলোয় কেমন রহস্যময় মনে হলো মুখটা যেন হাসিহাসি-?-বিদ্রুপের হাসি কি?
সন্তোষের বিছানার পাশের ডেস্কে একটা মথ বসেছিল। নতুন টিকটিকি টা ওটা লক্ষ্য করেই বোধহয় এগোতে লাগলো।
এমনিতে খুব কাছে আসেনা ওরা, কিন্তু এটা সটান ডেস্কে উঠে এসে মথটার দিকে তাকিয়ে রইলো,--- লেজটা অল্প অল্প নড়ছিলো,টিকটিকি টা এখন খুব কাছে,---সাদা দাগটার দিকে নজর গেল, লালচে দেখাচ্ছে কি?
সন্তোষ বেড ল্যাম্পটা জ্বালতেই আলো পড়লো ওটার গায়ে। পালালো না, মথটাকে এক ঝাপটায় ধরে ফেললো --বাঁ চোখের ওপর সাদা দাগটা এখন বেশ লালচে। চেটেপুটে মথটা খেয়ে টিকটিকিটা সন্তোষের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো একবার। পরিষ্কার মনে হলো, -----
যেন বলল,
----কেমন আছেন বাবু------??
ছোট্টো লাফে নেমে গেল ওটা।
বজ্রাহত সন্তোষ বসে রইলেন,'হলুদডোরা'-টা যেন বিদ্রুপ করেই চিকচিক্ করে ডেকে !! না না-- হেসে উঠলো, -- বাকসিদ্ধ ঋষি---
-----না, হরিপদ তাকে ছেড়ে যায়নি। কোথাও যায়নি।