Sharmistha Mukherjee

Crime Inspirational

5  

Sharmistha Mukherjee

Crime Inspirational

অসুর নিধন

অসুর নিধন

13 mins
724



শর্মিষ্ঠা মুখার্জী🔥 অগ্নিশিখা


রক্তাক্ত সমরেশের নিথর দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে । পাশেই রক্ত মাখা বটি হাতে দাঁড়িয়ে আছে সমরেশের স্ত্রী সোমা ।রাগে - ঘৃণায় থরথর করে কাঁপছে যেন অসুরদলনী দেবী ।বাইরে তখন কালীপূজার মন্ত্র ধ্বনিত হচ্ছে - 


 "ওঁ কালীকালী মহাকালী কালীকে পাপহারিণী

ধর্মার্থমোক্ষদে দেবী নারায়ণী নমোস্তুতে।"


কিছুটা দূরত্বে দরজার পর্দা ধরে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে বড়ো মেয়ে শাশ্বতী আর তাকে জাপটে ধরে আছে ছোটো মেয়ে ভাস্বতী । দুজনেই মায়ের উগ্রচন্ডী রূপ দেখে ভয়ে কাঁপতে শুরু করেছে । বড়ো মেয়ে যদিও জানে তার মা অসুরনিধন করেছে কিন্তু ছোটো মেয়ে ! সে এতোটাই ছোটো যে কিছু না বুঝতে পেরে " বাবা, বাবা " বলে চীৎকার করে 

কাঁদছে । ভাস্বতীর কান্নার শব্দ শুনতে পেয়ে পাশের বাড়ি থেকে সবাই ছুটে আসে । কিছুক্ষণ পরেই শোনা যায় পুলিশের গাড়ির সাইরেনের শব্দ । থেমে যায় কালীপূজার মন্ত্র , বাজির কানফাটানো আওয়াজ । সমরেশের বাড়ির সামনে জমা হতে শুরু করে উপচে পড়া ভীড় । সবার সামনে থেকে দুজন মহিলা কনস্টেবল সমরেশের স্ত্রী সোমাকে হাতকড়া পড়িয়ে নিয়ে ভ্যানে তোলে । সেইসময় দুই মেয়ের কান্নার শব্দে সোমার বুক ফেটে যেতে থাকে, তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে পাশের বাড়ির ছোটোবৌ কলিকে বলে - " কলি, তুই তো সব জানিস । আমার আর কোনো উপায় ছিল না রে । আমি যা করেছি, তাতে আমার কোনোরকম আফসোস বা দুঃখ নেই । শুধু আমার মেয়ে দুটোকে তোর ভরসায় রেখে যাচ্ছি , ওদের একটু দেখে রাখিস বোন । " এই বলতে বলতে ভ্যান রওনা দিয়ে দিলো থানার দিকে । 


ভ্যান রওনা দিলে কলি শাশ্বতী আর ভাস্বতীকে নিয়ে নিজের বাড়িতে ঢুকে যায় । পরপর কয়েকদিন ওরা দুই বোন বাড়ি থেকে বের হতে পারছিল না , ওদের দেখলেই পাড়া - প্রতিবেশী বলতো -" তোদের মা খুনি , তোদের মা তোদের বাবাকে খুন করেছে " । এইসব কারণে ওরা দুই বোন আস্তে আস্তে বাড়ি থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দেয় । ওদের মামাবাড়ির থেকেও সবাই মুখ ঘুরিয়ে নেয় আর পাড়া - প্রতিবেশীর কথাতো ছেড়েই দিন ।পাশের বাড়ির কলি মানে ওদের কলি কাকিমাই ওদের দেখাশোনা করতো । 


ওদিকে থানায় চলছিল সমরেশের স্ত্রী সোমার জেরা । অনেক জেরা করার পরেও সোমা কিছুতেই মুখ খুলতে রাজি নয় । কেনো সে নিজের স্বামীকে খুন করলো ? তাকে কি কেউ একাজ করতে বলেছে ? কেউ কি কোনো

প্রলোভন দেখিয়েছে ? তার কি অন্য কারো সাথে অবৈধ সম্পর্ক আছে ? এসকল প্রশ্নবাণের অবিরাম বর্ষণ চলতে থাকে সোমার উপর । সোমা যেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ কিছুতেই মুখ খুলবে না । টানা সাতদিন জেরা করেও সোমার মুখ থেকে পুলিশ কোনো কথা বের করতে পারলো না । সোমা শুধু বার বার একটি কথাই ক্রমাগত আওড়ে যাচ্ছে , " আপনারা আমাকে মারুন , মারতে মারতে মেরে ফেলুন , ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিন তবুও আমি কিচ্ছু বলবো না । আমি আমার স্বামীকে কেন মেরেছি সেটা কোনোদিন কেউ জানতে পারবে না । তার চেয়ে বরং আপনারা আমাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিন নয়তো ফাঁসি দেওয়ার ব্যবস্থা করুন । " আদালতেও সোমা একই কথাই বলতে

 থাকে । বাধ্য হয়ে বিচারক পুলিশকে আদেশ দেন সোমার জ্যেষ্ঠ কন্যা ও পাশের বাড়ির কলি সেনকে জেরা করার জন্য । সোমা সেই শুনে কান্নায় ভেঙে পড়ে এবং বারংবার বিচারকের কাছে হাতজোড় করে অনুরোধ জানায় যাতে তার বড়ো মেয়ে ও কলিকে জেরা না করা হয় । কিন্তু আইন চলবে তার নিজের পথে , বিচারকের সিদ্ধান্ত সর্বোপরি তাই সোমার কান্না কারো মনে সাড়া জাগাতে পারলো না । দুজন মহিলা কনস্টেবল সোমাকে আবার ভ্যানে তুলে নিয়ে যায় । 


বিচারকের নির্দেশ অনুযায়ী পুলিশ সোমার বড়ো মেয়ে ও কলিকে থানায় তুলে আনলো । যেহেতু সোমার ছোটো মেয়েটিকে বাড়িতে একা ফেলে আসা ঠিক হবে না তাই ওদের সাথে ছোটো মেয়েটিকেও নিয়ে আসে থানায় । থানার এক মহিলা কনস্টেবলের কাছে ছোটো মেয়েটিকে রেখে সোমার বড়ো মেয়ে ও কলিকে নিয়ে যাওয়া হয় এক বিশেষ ঘরে । সেখানে দুজন মহিলা কনস্টেবল ও ইন্সপেক্টর তাদের জেরা শুরু করে । প্রথমে জেরা করা হয় সোমার বড়ো মেয়েকে । ইন্সপেক্টর মিস্টার সাহা প্রশ্ন করা শুরু করেন । 


ইন্সপেক্টর সাহা : তোমার নাম কী ? 


সোমার বড়ো মেয়ে : শাশ্বতী  


ইন্সপেক্টর সাহা : তোমার বাবাকে তুমি ভালোবাসতে ? 


শাশ্বতী : আগে ভালোবাসতাম কিন্তু পরে ওনাকে ঘৃণা করতাম । 


ইন্সপেক্টর সাহা : ঘৃণা করতে ? কেনো ঘৃণা করতে কেনো ? কি এমন কারণ ছিল যে নিজের জন্মদাতাকে ঘৃণা করতে ? 


শাশ্বতী : এমনি ! 


ইন্সপেক্টর সাহা : এমনি ? কোনো কারণ না থাকলে কেউ কাউকে ঘৃণা করতে পারে বলেতো কোনোদিন শুনিনি ! কোনো কারণ তো নিশ্চয়ই আছে । বলো ঘৃণা করার কারণ কী ? 


শাশ্বতী চুপ করে মাথা নিচু করে বসে রইলো । 

ইন্সপেক্টর সাহা আবার বললেন, " বলো, কি এমন হয়েছিল ? " শাশ্বতী কোনো উওর না দিয়ে চুপ করেই বসে থাকলো । বার কয়েক শান্তভাবে প্রশ্ন করার পরেও কোনো উওর না পেয়ে ইন্সপেক্টর সাহার ধৈর্যচ্যুতি ঘটলো । তিনি সজোরে টেবিল চাপড়ে আবারও প্রশ্ন করলেন, " বলো, বলো, চুপ করে থেকে কোনো লাভ নেই । বলো , তাড়াতাড়ি সব বলে দিলে তোমাদের ছেড়ে দেব । " এতো করে বলার পরেও কোনো উওর না পেয়ে ইন্সপেক্টর সাহা চীৎকার করে বললেন , " Don't be silent. Speak out, fast. " ইন্সপেক্টর সাহার আচমকা চীৎকার শুনে ভয়ে থরথর করে কেঁপে উঠে কাঁদতে শুরু করে শাশ্বতী । পাশের চেয়ারে বসে থাকা পাশের বাড়ির কাকিমা কলিও খুব ঘাবড়ে যায় । শাশ্বতী কাঁদতে শুরু করলে ইন্সপেক্টর সাহা আবার নরম গলায় বললেন , " শাশ্বতী আমি জানি তোমরা দুজনেই সবকিছু জানো । দয়া করে আমাকে বলো কি এমন ঘটেছিল যার জন্য তোমার মা তোমার বাবাকে ঐরকম নৃশংসভাবে খুন করেছে ? তোমরা সত্যি কথা না বললে সোমাদেবীর ফাঁসিও হতে পারে । তুমি চাও না তোমার মা বেঁচে থাকুক । please, please

চুপ করে থেকে সময় নষ্ট কোরো না । "

শাশ্বতী হঠাৎ করে একবার কলি কাকিমার মুখের দিকে তাকিয়ে আবার মাথা নীচু করে বসে রইলো । ইন্সপেক্টর সাহা আবার প্রশ্ন করা শুরু করলেন । 


ইন্সপেক্টর সাহা : আচ্ছা, তোমার মায়ের কি কারো সাথে অবৈধ সম্পর্ক ছিল ? মানে হয়তো তোমার মায়ের পর পুরুষের সাথে অবৈধ সম্পর্কের কথা তোমার বাবা জেনে যায় তাই তোমার মা তোমার বাবাকে খুন করেছে । 


শাশ্বতী : আপনি কি বলছেন এইসব ? আপনি আমার মায়ের সম্পর্কে কিছু না জেনেই এতো জঘন্য কথা বললেন কি করে ? আমি আমার মায়ের জন্য গর্বিত । ভগবানের কাছে আমি কৃতজ্ঞ আমার মায়ের মা আমাকে দিয়েছেন । আর আপনি আমার সামনে আমার মায়ের সম্পর্কে নোংরা কথা বলছেন ? 


ইন্সপেক্টর সাহা : কলি দেবী এবার আপনি বলুনতো সোমা দেবী আদতে ঠিক কেমন মানুষ ? শাশ্বতী বাচ্চা মেয়ে কিন্তু আপনি তো আর বাচ্চা নন , so please tell me the truth . 


কলি দেবী : দিদি ভীষণ ভালো মানুষ । যেমন শান্ত, তেমন মিষ্টি স্বভাবের । মায়া - মমতা - মাতৃত্বে ভরা একজন মানুষ । আজ পর্যন্ত কারো সাথে কোনোদিন মনোমালিন্য হতে দেখিনি । বরং কেউ ঝামেলা করলে দিদি তাদের একটু এড়িয়ে চলতেন ফলে কিছুদিন পর আবার সবাই মিলেমিশে যেত । আমার বিয়ের পর থেকে কখনো মায়ের মতো, কখনো বড়ো দিদির মতো আমাকে আগলে রাখতো । কোনোদিন তার স্বভাবে কোনো উগ্রতা

 দেখিনি । 


ইন্সপেক্টর সাহা : হ্যাঁ, তাতো বুঝলাম ! তাহলে উনি ওনার স্বামীকে হঠাৎ খুন করলেন কেনো ? কি এমন হয়েছিল ওনাদের মধ্যে যার জন্য সোমা দেবী স্বামীঘাতিনী হলেন ? 



কলি দেবী একবার শাশ্বতীর মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা নীচু করে নিলেন । ইন্সপেক্টর সাহা আবার প্রশ্ন করলেন । 


ইন্সপেক্টর সাহা : আচ্ছা, সমরেশ বাবু তো শিক্ষক ছিলেন তাই না ? তা উনি মানুষ হিসেবে ঠিক কেমন ছিলেন ? 


এই প্রশ্ন করার সাথে সাথেই শাশ্বতী রাগে হঠাৎ ফুঁসতে শুরু করে আর বারবার কলি দেবীর মুখের দিকে তাকাতে থাকে । শাশ্বতীর মুখের ভাব লক্ষ্য করে ইন্সপেক্টর সাহা বুঝতে পারেন তিনি এবার ঠিক জায়গায় ঘা দিয়েছেন । বুঝতে পেরে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকেন ইন্সপেক্টর সাহা , তারপর আবার প্রশ্ন করতে শুরু করেন । 


ইন্সপেক্টর সাহা : শাশ্বতী তোমার মুখের ভাব দেখে এইটুকু বুঝতে পারছি তোমার বাবার ওপর তোমার প্রচন্ড ঘৃণা , তা কারণটা এবার একটু খুলে বলোতো ? উনি কিরকম মানুষ ছিলেন ? 


শাশ্বতী আর কলি দেবী দুজনেই চুপ । বাধ্য হয়ে ইন্সপেক্টর সাহা বলেন , " এবার যদি আপনারা মুখ না খোলেন তবে আমাদের আর কিছু করার নেই । মাননীয় বিচারপতি আমার কাছে এই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে জানতে চাইলে আমি বলবো সোমা দেবীর চারিত্রিক দোষ তার স্বামী জানতে পারেন তাই তিনি তার স্বামীকে হত্যা করেন এবং আমরা জানতে পারি সোমা দেবীর ছোটো মেয়ে সেই অবৈধ সম্পর্কের ফসল । আদতে সোমা দেবী একজন জঘন্য মহিলা । " এই কথা শুনে শাশ্বতী রীতিমতো রাগে চীৎকার করে ওঠে ইন্সপেক্টর সাহার ওপর । প্রচন্ড রাগে ইন্সপেক্টর সাহাকে মারতে উদ্যত হয় । সেইসময় একজন মহিলা কনস্টেবল শাশ্বতীকে ধরতে এলে ইন্সপেক্টর সাহা চোখের ইশারায় সরে যেতে বলেন । কলি দেবী সাথে সাথে শাশ্বতীকে ধরে বুকে জড়িয়ে ধরে । কলি দেবী তাকে বুকে জড়িয়ে ধরতেই অঝোরে কাঁদতে শুরু করে শাশ্বতী । অনেক কষ্টে মাথায় হাত বুলিয়ে শাশ্বতীর কান্না থামায় তার কলি কাকিমা । ইন্সপেক্টর সাহা এক গ্লাস জল এগিয়ে দেন শাশ্বতীকে । জল খেয়ে একটু ধাতস্থ হয়ে শাশ্বতী বলে , " আমি সব বলবো কি হয়েছিল যার জন্য আমার মা বাবাকে খুন করেছে । না ,না , খুন নয়, খুন নয় বধ করেছে । আমার মা স্বয়ং দেবীরূপে অসুর নিধন করেছেন । আমি, আমি সব বলছি । "


অসুর নিধন কথাটি শুনে ইন্সপেক্টর সাহা অবাক হয়ে গেলেন । একজন শিক্ষক , অসুর ! মানেটা কি ? এই ভাবতে ভাবতে পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে ভয়েস রেকর্ডারটা চালু করলেন জবানবন্দী নেবার জন্য । শাশ্বতী এবার সব ঘটনা বলতে শুরু করলো । সব ঘটনা বলা শুরু করার আগে মা সোমা দেবীর উদ্দেশ্যে বললো , " আমাকে ক্ষমা করে দিও মা, তোমাকে কথা দিয়েছিলাম বাবার ব্যাপারে কোনোদিন কারো সামনে মুখ খুলবো না । কিন্তু তোমার অপমান সহ্য করে আমি আর চুপ থাকতে পারলাম না । আমি জানি তুমি আমাকে ঠিক মাফ করে দেবে ।"-- এই বলে একটু ঢোঁক গিলে তাকালো কলি কাকিমার দিকে । কলি দেবী চোখের ইশারায় শাশ্বতীকে আশ্বস্ত করলে শাশ্বতী মুখ

খুললো । বলা শুরু করার আগে আরো একবার মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে ইন্সপেক্টর সাহাকে বললো , " স্যার কারো সম্পর্কে না জেনে দয়া করে কোনো বাজে মন্তব্য করা উচিত নয় । আপনি আমার মায়ের সম্পর্কে অজান্তেই কিছু খারাপ কথা বলেছেন , তবে সমস্ত ঘটনা শোনার পর আমাদের দুজনের মতো আপনিও মাকে শ্রদ্ধা জানাতে বাধ্য হবেন । "


শাশ্বতী এবার সমস্ত ঘটনা বলতে শুরু 

করলো ।


" আমার বাবা সমরেশ ঘোষ ছিলেন এক উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষক । মায়ের মুখে শুনেছিলাম বাবা এবং মায়ের ভালোবাসা করে বিয়ে । যেহেতু মায়ের বাবা মানে আমার দাদু এই সম্পর্ক মানতে রাজি হন নি সেহেতু বাবা ও মা নিজেরাই রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করেন । আমি জন্মাবার প্রায় বছর দুয়েক বাদে দাদু আমার বাবা - মাকে মেনে নেন ঠিকই কিন্তু মামাবাড়ির সাথে আমাদের সম্পর্ক খুব একটা ভালো ছিল না । আমি ছোটো থেকেই দেখতাম বাবা আর মায়ের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হোতো । কিন্তু যতো বড়ো হতে শুরু করি ততো বুঝতে পারি বাবা আর মায়ের ঝগড়ার কারণ কী ? সময়ে - অসময়ে বাবা আমার মাকে মারতো, শুধু তাই নয় বলপ্রয়োগ করে শারীরিক সম্পর্ক করতো মায়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে । জোর করে বলপ্রয়োগের ফলস্বরূপ আমার ছোটো বোন ভাস্বতীর জন্ম । যদিও মা ওকে জন্ম দিতে চায়নি তাই গর্ভপাত করাতে হাসপাতালে 

যান । মা বুঝতে পারেন নি ততোদিনে গর্ভাবস্থার তিন মাস পার হয়ে গেছে । ডাক্তার তাই গর্ভপাত করানোর ঝুঁকি নেন নি । বাধ্য হয়ে মা বোনকে জন্ম দেয় । যখন আমার বোন হয় তখন আমার বয়স এগারো । বাবা আমাদের দুই বোনকে খুব একটা না ভালোবাসলেও আমাদের খাওয়া - দাওয়া , পড়াশোনা, কোনো প্রকার চিকিৎসা সেসব দিকে কোনোদিন কার্পণ্য করেনি । আমি বড়ো হতে শুরু করলে মা আমাদের দুই বোনকে নিয়ে রাতে আলাদা ঘরে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে ঘুমোতেন , যাতে বাবা আমাদের শোবার ঘরে ঢুকতে না পারে । আমার যখন পনেরো বছর বয়স তখন থেকেই বুঝতে পারলাম আমার উপর আমার বাবার লোলুপ দৃষ্টি , নিজের মেয়ের শরীরের দিকে কোনো বাবা এতো নোংরা চোখে তাকাতে পারে ভেবেও ঘৃণা হয় । ওনার চোখে মেয়েদের শরীর মানেই ভোগ্যপণ্য । অন্য কোনো মেয়ে বা মহিলাদের উপর যে ঘৃণ্য দৃষ্টি শরীরের আনাচে-কানাচে ঘোরাফেরা করতো , আমার দিকেও ছিল সেই একই প্রকার ঘৃণ্য দৃষ্টি । চোখ তো নয় যেন এক্সরে মেশিন । সেই একই দৃষ্টি ছিল কলি কাকীমা ও মেয়ে ছাত্রী আর তাদের মহিলা অভিভাবকদের উপরও । মাকে বহুবার ঝামেলা করতে শুনেছি কলি কাকীমার দিকে লোলুপ দৃষ্টি নিয়ে তাকানোর জন্য । অনেক সময় অনেক মেয়ে ছাত্রীরা পড়া ছেড়ে দিতো , তাদের সবার অভিযোগ একই মাস্টারমশাই পড়ানোর সময় বকাবকি করার ছলে অথবা নানান কৌশলে আচমকা শরীরের বিভিন্ন অংশে হাত দিতেন । শেষে এক সময় এমন হোলো বাবার কাছে আর কোনো মেয়ে ছাত্রী পড়তে আসতো না , শুধুমাত্র ছেলেরাই পড়তো । আসলে বাবার ইংরেজির উপর দারুণ দক্ষতা ছিল তাই  

ছাত্রও হোতো অনেক । ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাস অনুযায়ী ভাগ করে একেকটি দল গঠন করে পড়াতেন আমাদের বাড়িতেই একটি ঘরে । মা অনেক সময় অনেক কিছু দেখেছিল, অনেক অভিভাবকেরা মায়ের কাছে বাবার অসভ্যতার কথাও জানাতেন । লজ্জায়-ঘৃণায় মা লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতো । "


এতো পর্যন্ত বলে একটু চুপ করলো শাশ্বতী , তারপর একটু জল খেয়ে আবার বলতে শুরু করলো । 


" বাবা মানুষ হিসেবে ভালো না হলেও ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে ছিলেন দূর্দান্ত । তাই উনি যেই বিদ্যালয়ে চাকরি করতেন সেই বিদ্যালয়ের এক নবম শ্রেণীর ছাত্রী মধুমিতাকে ওর বাড়িতে গিয়ে পড়াতো । মধুমিতার বাবা - মা চাকরি করতেন , তাই বাড়িতে থাকতেন মধুমিতার বৃদ্ধা ঠাকুমা । মধুমিতাকে বাবা ওর ঘরে বসেই পড়াতো । পড়ানো শুরু করার মাস দুয়েক পর একদিন মধুমিতার মা আমাদের বাড়িতে আসেন, সেই সময় বাবা ছিলো বিদ্যালয়ে । মধুমিতার মা এসে রীতিমতো আমার মায়ের কাছে কান্নায় ভেঙে পড়েন । তখন আমার বয়স পনেরো তাই সব কথাই ভালো করে বুঝতে পারি । আমার বোন তখন মাত্র চার বছরের বাচ্চা । মধুমিতার মা আমার আর আমার মায়ের কাছে কেঁদে যা বলেছিলেন তা শুনে আমার মা আর আমি ভয়ে - লজ্জায় - ঘৃণায় - অপমানে মাটিতে যেন মিশে যাচ্ছিলাম । "


ইন্সপেক্টর সাহা : " কেনো ? কি এমন হয়েছিল ? " 


শাশ্বতী একটু মাথা নীচু করে বসে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবারও বলতে শুরু করে । 


 শাশ্বতী : মধুমিতা আমার বাবার বিদ্যালয়েই পড়তো । বাবা একবার পরীক্ষায় খুব কম নাম্বার দেওয়ায় মধুমিতা ভেঙে পড়েছিল , আসলে বাবা ইচ্ছা করেই তা করেছিল । কম নাম্বার পাওয়ার পর থেকেই বাবা নানারকম ভয় দেখিয়ে মধুমিতাকে যৌন হেনস্থা করতে শুরু করে । প্রথম প্রথম নানা অছিলায় শরীরের বিভিন্ন অংশে হাত দিতেন পরে তা পিপাসায় পরিণত হয় । মধুমিতার বাবা - মায়ের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে দরজা বন্ধ করে ভয় দেখিয়ে জোর করে শারীরিক সম্পর্ক করতো । অনেকদিন এই নির্যাতন সহ্য করার পর মধুমিতা একদিন তার মাকে সব ঘটনা জানিয়ে দেয় ।মধুমিতার মা সব কথা শুনে আকাশ থেকে পড়েন । কি করবেন , কাকে জানাবেন , তার স্বামী অর্থাৎ মধুর বাবা জানতে পারলে তার প্রতিক্রিয়া কি হবে এই ভেবেই অস্থির হয়ে পড়েন । অনেক ভেবে মধুমিতার মা আমার মা সোমাদেবীকে সমস্ত ঘটনা খুলে জানানোর সিদ্ধান্ত নেন । 


একদিন বাবা স্কুলে চলে যাবার পর মধুমিতা ও তার মা আসে আমাদের বাড়িতে । আমি আর মা মধুমিতা ও তার মায়ের মুখে সমস্ত ঘটনা শুনি । সব শুনে আমি রীতিমতো রাগে ফেটে পড়ি বাবার সম্পর্কে এইধরনের কথা শুনে , অথচ মা কিন্তু একটুও বিচলিত বা অবাক হয় নি । মাকে দেখে আমি মায়ের উপর খুব রেগে গিয়েছিলাম । রাগ করে উঠে চলে গিয়েছিলাম নিজের ঘরে । কয়েকদিন মায়ের সাথে কথাও বলিনি প্রচন্ড রাগে । এই ঘটনার সপ্তাহ দুয়েক পর একদিন মাঝরাতে হঠাৎ মায়ের ঘুম ভেঙে যাওয়ায় মা পাশে বাবাকে না দেখে অবাক হয়ে যায় । আস্তে আস্তে উঠে এসে দ্যাখে বাবা আমার শোবার ঘরে এসে একদৃষ্টে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে । মা তখনই চীৎকার করে করে ঝামেলা শুরু করে দেয় । মায়ের চীৎকারে আমার আর বোনের ঘুম ভেঙে যায় । মাকে বলতে শুনি - 

" সব ছাত্রীদের উপর তোমার নোংরা নজর । সন্তানতুল্য ছাত্রীদের সাথে নোংরামি করতে তোমার না লজ্জা করে না , কিন্তু তাই বলে নিজের সন্তানের দিকেও তোমার নোংরা নজর পড়েছে ? " এই বলে বাবাকে এক ধাক্কা মেরে আমার ঘর থেকে বের করে দিয়ে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেয় । এই ঘটনার পর থেকেই মা আমাদের দুই বোনকে নিয়ে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে ঘুমাতো । পরের দিকে আমিও লক্ষ্য করতে থাকি আমার দিকে বাবার দৃষ্টি । সেই দৃষ্টিতে কোথাও যেন পিতৃত্বের ছাপ নেই , আছে শুধু লালসা । তারপর এলো সেই ভয়ংকর রাত । কালীপূজার দিন সন্ধ্যায় মা আমাকে সাজগোজ করতে বলে বোনকে নিয়ে একটু কলি কাকীমার বাড়িতে গিয়েছিল । কি মনে হতে মা হঠাৎ বাড়িতে ঢুকে দ্যাখে বাবা দরজার ফাঁকা দিয়ে আমার জামাকাপড় পড়া দেখছে । মায়ের প্রচন্ড চীৎকারে আমি চমকে উঠি । মায়ের পিছন পিছন ছোটো বোন আমার ঘরে ঢুকে এসে ভয়ে আমাকে জরিয়ে ধরে । হঠাৎ দেখি মা ছুটে যায় রান্নাঘরের দিকে , আর আমাদের চোখের পলক পড়তে না পড়তেই বাবার গলায় বসিয়ে দেয় বটির কোপ । আমার ছোটো বোন ভয় পেয়ে আমাকে জরিয়ে ধরে চীৎকার করে কাঁদতে শুরু করে কিন্তু আমি বুঝতে পারি আমার মা অসুর নিধন করেছে । নারী শরীরের উপর প্রত্যহ ছোবল বসানো আমার পিতৃরূপী অসুরকে আমার মা নাশ করেছে । তাই আমার কাছে আমার মা স্বামীঘাতিনী নয়, অসুরদলনী । 


ইন্সপেক্টর সাহা ও অন্যান্য পুরুষ ও মহিলা কন্সস্টেবলরা অবাক হয়ে সমস্ত ঘটনা শুনছিল । থানার Intarogation রুমে তখন পিন পতন নিস্তব্ধতা । সেই নিস্তব্ধতা ভেঙে

ইন্সপেক্টর সাহা বললেন , " কলি দেবী আপনি শাশ্বতী আর ওর বোনকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে যান । "


বাড়িতে ফিরে যাবার আগে শাশ্বতী তার মায়ের সাথে দেখা করে ক্ষমা চেয়ে নেয় সমস্ত সত্যি কথা পুলিশের কাছে বলার জন্য । 


বিচারে সোমাদেবীর হাজতবাস হলেও ভালো ব্যবহার ও আজ্ঞাকারি হওয়ার কারণে শাস্তি সম্পুর্ন হবার অনেক আগেই সাজা মকুব হয়ে যায় । পাড়া - প্রতিবেশী থেকে আত্মীয় স্বজনদের মাঝে সোমাদেবী অসুরদলনী হিসেবে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন । হাজতবাস থেকে মুক্তি পেয়ে সোমাদেবী একটি সেচ্ছাসেবী সংস্থায় যোগদান করেন এবং দুই মেয়েকে সমাজের উপযুক্ত করে গড়ে তোলেন । 



  🔱 🔱 🔱 সমাপ্তি 🔱 🔱 🔱


 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Crime