অন্তরাল - অন্তিম পর্ব
অন্তরাল - অন্তিম পর্ব
কোলকাতার এক নিঝুম গলি। রাতও হয়েছে অনেক। সরকারি ল্যাম্প পোস্টের হলদে আলো সরু গলিটাকে যেন আরও রহস্যময় করে তুলেছে। এই সময় লোকজনের আনাগোনা প্রায় নেই বললেই চলে। একটা বেড়াল পাঁচিলের উপর থেকে লাফ দিয়ে রাস্তার অপর প্রান্তে চলে গেল। মাঝে মাঝে ঠাণ্ডা বাতাস ইতিউতি বয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ কোথায় যেন নিশাচর পাখি ডেকে উঠল। রাতের পরিবেশের এই নেশা যেন এই মুহূর্তে আরও দুটো মানুষের মনে নেশা ধরিয়ে দিয়েছে। একে অপরকে পাওয়ার নেশা। মহিতের হাত দুটো জড়িয়ে ধরে আছে শিঞ্জিনীর কোমরটাকে। তার ঠোঁট দুটো গভীর স্পর্শে মেতে আছে মোহিতের ঠোঁটের সাথে। মোহিতের শরীরের উত্তেজনা এতটাই বেশি যে এতো বছরের অপূর্ণ থেকে যাওয়া ইচ্ছে গুলোকে এই মুহূর্তে পূরণ করবে। শিঞ্জিনীরও অর্জুনের কথা একটুও মনে পড়ছে না। সে এই সময়টার আরও গভীরে তলিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু হঠাৎই তার মনে হল এই সময় আর এই মানুষ দুটোই ভুল। এদিকে মোহিতও ছাড়ার পাত্র নয়। শিঞ্জিনী যত নিজেকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করে মোহিতও যেন আরও তাকে জড়িয়ে ধরে। আজ যেন সে কিছুতেই ছাড়বে না নিজের ভালোবাসাকে। শিঞ্জিনী বলে ফেলে-
" This is not done. "
মোহিতও পাল্টা প্রশ্ন করে বলে-
" তাহলে তুই বা কেন অমনভাবে Good night বলার পরেও আমার দিকে এগিয়ে এসেছিলিস? তার মানে তুই অর্জুনের সাথে খুশিতে নেই। "
শিঞ্জিনী আর কিছু না বলে বাড়ির দিকে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায়।
রাত প্রায় ৩ টে। বাড়ির পুরনো ঘড়িটায় ঢং ঢং করে শব্দ হল। সময়ের পর সময় বৃথাই চেষ্টা করে গেল। চোখের মধ্যে আজ যেন কোনো ভাবেই ঘুম আসতে চায় না। সেও যেন মোহিতের মতই শিঞ্জিনীর ভাবনায় মত্ত। অজস্র চিন্তা উড়ন্ত পাখির মতো এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে মনের আকাশ জুড়ে। গতকাল রাতের কাজটা কি ঠিক হল? শিঞ্জিনীকে বাধা দেওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু ভালোবাসা এমনই জিনিস যা মানুষকে খুব দুর্বল করে দেয় আবার সময় বিশেষে পৃথিবীর সব থেকে শক্তিশালী মানুষ করে তোলে। মোহিতের হঠাৎ মনে হল শিঞ্জিনীকে যে করেই হোক অর্জুনের থেকে দূরে সরিয়ে নিতে হবে। তাই সে সাথে সাথে একটা নম্বরে কল করল। কিন্তু রিং হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে কলটা রিজেক্ট হয়ে গেল। তারপর বেশ কয়েকবার কল করার পর শেষ পর্যন্ত কলটা রিসিভ হল। ফোনের ওপার থেকে ফ্যাশ ফ্যাশে গলায় শিঞ্জিনী বলে উঠল-
" সব শেষ হয়ে গেছে। সব শেষ। " বলেই চাপা স্বরে কান্নার শব্দ ভেসে এল।
মোহিতের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো।
" আমি জানতাম এরকমই কিছু একটা হবে। তুই একদম মন খারাপ করিস না। যা করার আমি করব। "
এরপরেই মোহিত আরও একজনকে ফোন করে যা বলল তাতে এই দাঁড়ায় যে শিঞ্জিনীকে কষ্ট দেওয়ার পেহনে যে দায়ী তাকে যেন একটু দেখে নেয়। প্রানে না মারলেও হাত-পা ভাঙলেও ক্ষতি নেই।
মোহিতের দুজন বন্ধু, অয়ন আর সাগনিক, বলা ভালো সাগরেদ। ভাগ্যক্রমে তারা দুজন বিশ্বভারতীতে পড়ার সুযোগ পায়। দুই বন্ধুর ভাগ্য কতটা ভালো হয়েছে জানা নেই। তবে মোহিতের ছিল সেটা সৌভাগ্য। অয়ন আর সাগনিকের মাধ্যমে শিঞ্জিনীর চলাফেরার সব খবরই আসতো মোহিতের কাছে। তাই অর্জুনের খবরটা তার অজানা ছিল না। কিন্তু এখানে এসেই সব থেকে অজানা গল্পটা ছবির মতো সামনে এল।
দুই বন্ধু সেই রাতেই মোহিতের কথা মতো রওনা হয়েছিল অর্জুনের বাড়ির উদ্দেশ্যে। বন্ধুর প্রতি এতটা আনুগত্য হয়তো আর কোথাও দেখা যায় না। হিন্দিতে একটা কথা আছে- " চাড্ডিওয়ালা দোস্ত। " এরা তিনজনে তাই ছিল।
রাস্তাঘাট চারপাশে শুনশান। কেউ কোথাও নেই। অর্জুনের বাড়ির সামনে একটা ঘোলাটে আলো কিছুটা অংশে অন্ধকার কোনমতে দূর করেছে। বাড়ি ঘেরা বাইরের পাঁচিল খুব বেশি উঁচু নয়। তাই সেটা পেরোতে অয়ন ও সাগনিকের খুব বেশি কষ্ট করতে হল না। বাড়ির সামনে ছোট একটা বাগান। সেটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। সেখানেই তারা কিছুক্ষণ গা ঢাকা দিয়ে রইল। বাগান পেরিয়ে সামনে ছোট দোতলা বাড়ি। উপরের একটা ঘর ছাড়া বাড়িতে আর কোনো আলো জ্বলছে না। অয়ন বলে উঠল-
" মালটা মনে হয় ঐ ঘরটায় আছে। ব্যাটাকে রাতের সুখ দিয়ে আসি চল্। "
বাড়ির পেছনের দরজা খোলাই ছিল। যেটাতে তারা বেশ অবাক হল। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আলো জ্বলতে থাকা ঘরের সামনে যেতেই অয়ন আর সাগনিক যেন বিদ্যুৎ চমকের মতো চমকে গেল। একটি লোক বিছানায় শুয়ে থাকা অর্জুন এবং একটি মেয়ের ঘুমন্ত শরীরে দিকে একটা রিভল্ভার নির্দেশ করে ধরে আছে। চোখের পলকে দুটো গুলি রিভল্ভার থেকে বেড়িয়ে দুটো শরীরের বুকের বাঁ দিকে গেঁথে গেল এবং এই পুরো ঘটনাটাই মোবাইলে রেকর্ড করেছিল সাগনিক। কিন্তু অয়ন ভয় পেয়ে সাগনিককে সেখান থেকে বেড়িয়ে যেতে বলে। তাড়াহুড়ো করে বেরোতে গিয়ে ভিডিও রেকর্ড করা মোবাইলটা বাগানে পড়ে যায়। অন্ধকারের মধ্যে সেই মোবাইল খোঁজার সুযোগ পায়নি। আর সেই মোবাইল দেবজিতের হাতে আসে।
এতোক্ষণ ধরে মোহিত সমস্ত ঘটনাটা বলে গেল। এরই মধ্যে অয়ন ও সাগনিকও উপস্থিত হয়েছে। অয়ন বরাবরই ভীতু। সে বলে উঠল-
" আমি কিছু করিনি স্যার। আমায় ছেড়ে দিন। "
দেবজিত চেয়ার ছেড়ে উঠে বলল-
" ছেড়ে দেওয়া হবে নাকি আটকে রাখা হবে সেটা পরে দেখা যাবে। "
হাতের ইশারায় একজন কন্সটেবেলকে ওদের দুজনকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে বিশ্বদাকে একটা ল্যাপটপ নিয়ে আসার কথা বলে। দশ মিনিটের মধ্যে সেই ল্যাপটপ চলে এলে সেখানে চালানো হল সাগনিকের মোবাইলে তোলা খুনের ভিডিও। সেই ভিডিওতে খুনিকে দেখে সবার চোখ চলে যায় শিঞ্জিনীর মেসো প্রত্যয় হালদারের দিকে।
মানুষের জীবন বড়ো অদ্ভুত। আত্মসম্মানের যে ইমারত গড়তের এতো পরিশ্রম এতো পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত সেটাকেই অনেক ছোট বলে মনে হয়। প্রত্যয় নিজের সম্মানের পদকটার উপর খুব বেশি ভরসা করতে পারেননি। জীবনের কঠিন পথটাকে আরও সহজ করার জন্য নতুন করে পরিকল্পনা শুরু করেন। ড্রাগ সাপ্লাই, স্মাগ্লিং, কিডন্যাপিং, কোনো কিছুই তার পরিকল্পনার বাইরে ছিল না। সরুিজিনী এবং অর্জুন তার পথের সাথি ছিল। কিন্তু যখন তারা নোংরা পথটাকে পরিত্যাগের কথা ভাবে প্রত্যয় বাবু তাদের চিরদিনের মতো জীবনের পথ থেকে সরিয়ে দিলেন। যে মানুষটা এতো বছর ধরে সবার চোখে আদর্শ ছিলেনী, এখন তার আদর্শ জায়গা হল জেলখানা। প্রতিটা মানুষের জীবনের অন্তরালে এমন কিছু সত্য থাকে যা কখনও প্রকাশ পায় নয়তো অপ্রকাশিত থেকে যায়।
সমাপ্ত......