ক্রন্দসী
ক্রন্দসী
কড়কড় করে বাজ পড়ার শব্দে চমকে উঠে ঘুম ভেঙ্গে গেল নীলুর। ঠিক এই সময়েই ঢংঢং করে বৈঠকখানার গ্র্যান্ডফাদার ক্লকে ছ'টার ঘন্টা বাজলো। বিছানার উপর উঠে বসে নীলু চোখ ডললো। বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টি হচ্ছে। ঝোড়ো হাওয়ার শনশন শব্দ হচ্ছে। হাওয়ার ধাক্কায় জানালার শার্সি মাঝে মাঝে ঝনঝন করছে। হঠাৎ বৃষ্টিতে শীতটা মনে হচ্ছে খুব জাঁকিয়ে পড়লো, হাড় অবধি কনকন করছে। কম্বলটা গলার কাছ অবধি তুলে ধরে সবে আর এক চোট ঘুম লাগাবে ভাবছিলো, এমন সময় ক্রিংক্রিং করে ফোনটা বেজে উঠলো।
অগত্যা উঠতেই হলো। মা বাবা গেছে পিসীর বাড়ি, পিসীর খুব শরীর খারাপ। নীলুকে অনেকবার বলেছিলো, সাথে যেতে। কিন্তু কয়েকদিন পরে থেকে ওর টেস্ট পরীক্ষা শুরু হবে, তাই নীলুও যেতে চাইলো না। মাও বললো, "তাহলে তুই থাক, আমি তো ফিরেই আসবো রাতে। দেখিস তুই একা একা আবার ভয় পাবি না তো?" নীলু বলেছিলো, "হ্যাঁ, ভয় পেয়ে একেবারে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকবো।" ওর কথা শুনে হেসে বাবা মা বেরিয়ে গেলেন।
কিন্তু কে জানতো এরকম বৃষ্টি শুরু হবে? সারাদিন পড়ে নীলু একটু ঘুমিয়ে নিচ্ছিল, রাতের পড়া শুরু করার আগে। এখন এই বৃষ্টিতে খালি বাড়িতে ওর একটু ভয় ভয়ই পেতে শুরু করলো। সবকটা লাইট জ্বালিয়ে ও শোয়ার ঘর থেকে বসার ঘরে গেলো, কিন্তু যেতে যেতে টেলিফোনের রিংটা বন্ধ হয়ে গেল।
ফোনের সামনে দাঁড়িয়ে ও যখন ভাবছে কি করবে, মাকে একটা ফোন করে বলবে কিনা যে তাড়াতাড়ি এসো, লজ্জাও লাগছে এরকম বলতে, এমন সময় ওর চোখ গেলো ফোনের পিছনে রাখা বইয়ের আলমারির কাঁচের পাল্লার দিকে। পাল্লায় বারান্দার ঘরের দরজার ছায়া পড়ছে অস্পষ্ট ভাবে। নীলুর কেন যেন মনে হলো, দরজার পাল্লাটা আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ক্যাঁএএচ করে একটা আওয়াজ ওর কানে এলো।
চমকে উঠে ও দরজার দিকে ফিরলো। নাঃ, দরজা তো খোলাই আছে। কিন্তু ভালো করে খেয়াল করলে দরজার পিছন দিয়ে একটা অস্পষ্ট খসখস আওয়াজ আসছে শোনা যাচ্ছে, যেন কেউ খুব হালকা পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। ঠিক এই সময়েই ও পিছন দিক থেকেও একটা সড়সড় আওয়াজ শুনতে পেলো। ওর বুক ধড়ফড় করতে শুরু করলো।
দরজার পাশের দেওয়ালে বেসিনের পাশে একটা আয়না ঝোলানো ছিলো। কোনরকমে ও চোখ ফেরালো সেটার দিকে। দেখতে পেলো, টেলিফোনের তারটার স্প্রিংএর মতো প্যাঁচানো অংশটা নিজে থেকেই খুলে সোজা হয়ে যাচ্ছে। ওর চোখের সামনেই দেড়ফুট কেবলটা খুলে চারফুট হয়ে গেলো। ঐ শীতেও ও তখন কুলকুল করে ঘামছে। পা দুটোকে মনে হচ্ছে কে যেন আঠা দিয়ে আটকে দিয়েছে মেঝের সাথে। না পারছে নড়তে, বা পারছে চড়তে।
আয়নার মধ্যে দিয়ে যখন দেখতে পেলো, টেলিফোনের কেবলটা একটা ফাঁসের মতো হয়ে তার গলার দিকে এগিয়ে আসছে, তখন মনের সব জোর একত্রিত করে নীলু দরজার দিকে দৌড় লাগালো। দরজা অবধি পৌঁছে একবার চকিতে পিছন দিকে তাকিয়েই দেখলো, কই, না তো! টেলিফোনতো তার মতোই আছে। নির্বিষ ঢোঁড়া সাপের মতো তারটাও তো ঐ যে প্যাঁচানো অবস্থায় পড়ে আছে।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো নীলু। বাইরে ঝড়ের আওয়াজটা কমে এসেছে যেন। বৃষ্টির আওয়াজটা একটা ব্যাকগ্রাউন্ড ন
য়েজের মতো শোনা যাচ্ছে। কিন্তু একটু কান পাতলে সেটা ছাপিয়ে একটা সুঁইইই সুঁইইই আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, খুব মৃদু, যেন দাউদাউ করে জ্বলা আগুনের আওয়াজ।
সাবধানে, অতি সাবধানে দরজার বাইরে মুখ বাড়ায় নীলু। বারান্দার ঘরের আলোটা জ্বলছে না, সেই আধো আলো আঁধারে দেখতে পেলো শূণ্যে নীচের দিকে দুটো লম্বাটে সবুজ রঙের আগুন পাশাপাশি জ্বলছে, নড়ে চড়ে বেড়াচ্ছে। তাড়াতাড়ি করে হাত বাড়িয়ে নীলু আলোটা জ্বালালো।
বাদামী রঙের ঐ বিড়ালের বাচ্চাটা না? সেটা কি করে এলো এখানে? কালকেই তো..ভয়ে বুক ধড়ফড় করে উঠলো নীলুর। কোথা থেকে ওটা এসে জুটেছিলো কে জানে! ঘরে হিসি করে দিয়েছিলো বলে নীলু পরশু রাতে ওটাকে একটা প্লাস্টিকের গামলা দিয়ে চাপা দিয়ে দিয়েছিলো, তারপরে ভুলে গেছিলো ওটার কথা। গতকাল সকালে উঠে দেখে গামলার নীচে মরে কাঠ হয়ে পড়ে রয়েছে। মা বাবা দেখার আগেই প্লাস্টিকে মুড়ে বাড়ির পিছনে ফেলে দিয়ে এসেছিলো।
বিড়ালের বাচ্চাটা কিরকম ভাবে যেন তাকিয়ে আছে, নীলুর দিকে, দৃষ্টিতে স্পষ্ট একটা অভিযোগ। নীলু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘামতে থাকে, বিড়ালের বাচ্চাটা কুঁইকুঁই করতে করতে নীলুর দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। বৃষ্টির ছাঁটে বোধহয় ওদিকের জানালাটা খুলে গেছে, ভেজা একটা ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা এসে নীলুকে কাঁপিয়ে দিলো। সেই হাওয়ায় কোথা থেকে একটা প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ উড়ে এলো নীলুর দিকে। হাওয়া ঢুকে ফুলে ফানুসের মতো দেখতে লাগছে ওটা। নীলুর চোখের সামনে ওটা নেচে নেচে উড়তে লাগলো। তারপরে হঠাৎ হাওয়ার এক ঝাপটায় প্লাস্টিকের ব্যাগটা এসে নীলুর মাথায় ঢুকে ওর ঘাড়ের উপর চেপে বসলো। শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ভেবে নীলু হাঁচোড়পাঁচোড় করে হাত দিয়ে প্লাস্টিকটা সরাতে যাবে, এমন সময়, আলোগুলো নিভে গেলো।
সেই নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে, হিমেল হাওয়ায় মাথায় একটা প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ নিয়ে অজ্ঞান হয়ে যাবার পূর্ব মূহুর্তে নীলু শুধু ভাবতে পেরেছিলো, "ঠাকুর, আর কোন দিন কোন অবলা প্রাণীকে কষ্ট দেবো না, এবারের মতো ক্ষমা করে দাও।"
রাত্রে নীলুর মা ফিরে এসে যখন বারংবার বেল বাজিয়েও ভেতর দিয়ে কোন সাড়াশব্দ পেলেন না, তখন ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে দেখলেন, বারান্দায় নীলু অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে নীলুর বাবাকে খবর দিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো নীলুকে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার পরে নীলুর জ্ঞান ফিরলো। কোন প্রশ্নেরই জবাব দেয় না, খালি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। ডাক্তারবাবু পরীক্ষা করে বললেন, "সিভিয়ার মেন্টাল স্ট্রেস। কয়েকদিন রেস্টে থাক, ঠিক হয়ে যাবে।"
চিন্তাগ্রস্ত মনে তারা বাড়ি ফিরলেন।
নীলুদের বাড়ির নীচে বাগানে সেই রাত্রে একটা মেনি বিড়াল তার একটা বাচ্চাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো। একইরকম দেখতে আর একটা পুঁচকে ছিলো, কোথায় যে হারিয়ে গেলো, আর খুঁজেই পাচ্ছে না। ওঁয়া ওঁয়া করে কেঁদে কেঁদে সে তার হারিয়ে যাওয়া বাচ্চাটাকে খুঁজতে থাকে। নীলুর মা চমকে উঠে নীলুর বাবাকে ডেকে তোলেন, "শুনছো, দেখো, বিড়ালটা আবার কাঁদছে, কাল রাত্রের মতো। আমার নীলুটার কোন অকল্যাণ না হয় আবার।"