STORYMIRROR

Gopa Ghosh

Abstract Tragedy Others

3.3  

Gopa Ghosh

Abstract Tragedy Others

কালো

কালো

5 mins
373


রক্তিম আড়চোখে মেয়েটিকে একবার দেখে নিয়েই সরাসরি মায়ের দিকে তাকালো। মা ছেলের তাকানো দেখেই বুঝে গেলো ছেলের এই মেয়েটিও পছন্দ নয়। তবু চোখ দুটি ছোট করে একবার কাকুতি করতেও ছাড়লো না। তবে কাজের কাজ কিছু হলো না। রক্তিম সটান উঠে দাঁড়াতেই মেয়ের বাবা উঠে এসে হাত ধরে বসিয়ে দিতে উদ্যত হলো, আর এখানেই বাধল গন্ডগোল। মেয়ের মা বেশ জোর গলায় বলতে শুরু করলো " এটা কি অভদ্রতা? মেয়ে পছন্দ না হলে পরে জানাবে, কিন্তু একটাও কথা না বলে এ কি রকম আচরণ? রক্তিমের মা অবশ্য এর উত্তর দিতেও ছাড়ে নি। বললো " আপনার মেয়ে যে এত কালো সেটা তো আমরা ওর সাদা কালো ছবিতে বুঝতে পারি নি, তাই দেখতে এসেছিলাম, যাক আমাদের দোষ হয়ে থাকলে মার্জনা করবেন, আজ আসি"। 

কেটে গেলো আরো একটি বছর। রক্তিম এর মধ্যে আর কোথাও মেয়ে দেখতে যায় নি। মা যেতে বললে আগের অভিজ্ঞতার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে বারবার। কিন্তু মায়ের মনে তো শান্তি নেই। তার অবর্তমানে কে দেখবে ছেলেকে? তাই প্রতি সপ্তাহেই ঘটককে ফোন করে ডাকে। তবে এবার যেনো কোনো কালো মেয়ের সম্বন্ধ না আনে সে বিষয়ে বারবার সর্তক করে দেয়। 

এদিকে রক্তিমের এক বিপদ উপস্থিত হলো। অফিস থেকে ট্রান্সফারের চিঠি এলো ওর নামে। কলকাতার ছেলেকে পাঠালো বাঁকুড়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামে। একবার ভাবলো চাকরিটা ছেড়ে দেবে কিন্তু একে সরকারি চাকরি তার ওপর বেতনও বেশ বড় অঙ্কের। মাকে নিয়ে যেতে পারবে না কারণ বাড়িতে পঙ্গু বাবার দেখাশোনা করার কেউ নেই। অতঃপর আর কি করা, রওনা দিলো চাকরি স্থলের উদ্দ্যেশ্যে। 

গিয়ে খুবই মন খারাপ হয়ে গেলো রক্তিমের। অজ পাড়া গাঁ বললেও ভুল হবে, একে জঙ্গল বলাই ভালো। রক্তিম সরকারি হাসপাতালের কর্মচারী। বলা যায় মেইল নার্স। তাই এর আগেও দু বছর এক গ্রামের হাসপাতালে বদলি হয়েছে কিন্তু সেটা মফস্বল, এতটা প্রত্যন্ত গ্রাম ছিল না। যাই হোক রক্তিম ট্রেন থেকে নেমে ট্রেকার এ উঠলো। হাসপাতাল নতুন বিল্ডিং তাই সাদা নীল রঙে বেশ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। মনটা একটু ভালো হয়ে গেলো রক্তিমের। হাসপাতালের পাশেই কোয়াটার। দেখলো ব্যবস্থা ভালই। বড়ো ঘর সাথে বাথরুম। জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখতে রাখতেই দরজায় টোকা, একজন মাঝবয়সী মহিলা। বললো " আপনি কি রক্তিম সরকার?" রক্তিম সম্মতি সূচক ঘাড় নাড়তেই মহিলাটি বলে উঠলো " আমি আপনার ঘর পরিষ্কার করে রেখেছি, আপনি কি দুধ চা খাবেন, না লিকার করে দেবো?" রক্তিম বুঝলো ইনি হাসপাতাল দেখাশুনা করেন। ছোট্ট করে " লিকার চা" বলেই রক্তিম আবার গোছানো তে মন দিল। 

কেটে গেছে প্রায় তিন মাস। রক্তিম এখন এই অঞ্চলটি বেশ চিনে গেছে। রোজ সকালে প্রাত ভ্রমনে বেরিয়ে অনেকের সাথেই পরিচয় হয়েছে। হাসপাতালে কাজ খুব একটা নেই। রোগীর সংখ্যাও হাতে গোনা। দেখাশুনা করার মহিলা রেবতীর রান্নাটি বেশ ভালো। ব্যবহারও মন্দ নয়। সব মিলিয়ে ভালই কাটছিল রক্তিমের দিন। তবে এর ঠিক কয়েক মাস পরেই ঘটলো এক দুর্ঘটনা। রক্তিম দিনের আলো পড়ে গেলে সচরাচর কোথাও বের হয় না কারণ এখানে রাতে জন্তু জানোয়ারের ভয় আছে। সেদিন এক হাসপাতালের ডাক্তার মহিম বাবুর সাথে অনিচ্ছা সত্বেও যেতে হলো রক্তিমকে। কিছু প্রয়োজনীয় ওষুধ ফুরিয়ে যাওয়ায় তাদের সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা সম্ভব হয় নি। তখন ঘড়ির কাঁটা আটটার ঘর পেরোয়নি। চারিদিক দেখে মনে হয় গভীর রাত। ট্রেকার থেকে নেমে কাজ সারতে খুব বেশি সময় লাগে নি কিন্তু ফেরার সময় ঘটলো দূঘটনাটি। ট্রেকার চালক কোনো ভাবে টাল সামলাতে না পেরে হুর মুড়িয়ে পড়লো এক পচা পুকুরে। যেদিকে টাল খেয়েছে সেদিকেই ছিল রক্তিম। ডাক্তার এর আঘাত খুব বেশি

না লাগলেও রক্তিম সাথে সাথেই জ্ঞান হারায়। মাথা ফেটে রক্তারক্তি। 

পরদিন চোখ খুলেই রক্তিম একজন অপরিচিতার মুখ দ্যাখে। খুব বেশি বয়স নয়। মুখটি যেনো পান পাতা। তবে গায়ের রং বেশ কালো। রক্তিমের ঠোঁট নড়ে উঠতেই বকুল বলে ওঠে " আমি বকুল, রেবতীর মেয়ে, মায়ের খুব জ্বর তাই আপনার এই বিপদে আমাকে পাঠিয়ে দিল, আপনি চিন্তা করবেন না, যা দরকার আমাকে বলবেন শুধু, ঠিক আছে?" রক্তিম ঘাড় নেড়ে আবার চোখ বুজলো। শরীর খুব দূর্বল। মেয়েটির গলার স্বরটি খুব মিষ্টি। কথাগুলো শুনতে বেশ লাগে। আবার চোখ মেললো। " বকুল আমাকে ধরে তুলতে পারবে?" বকুল আস্তে আস্তে হাত ধরে তুলে বসায় রক্তিমকে। 

এভাবেই কেটে গেলো সাতটি দিন। এখন রক্তিম আগের থেকে সুস্থ। বকুলের সেবা তাকে এত তাড়াতাড়ি সুস্থ করে তুলেছে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। এবার বকুলের যাওয়ার পালা। রেবতী সুস্থ হয়েছে। বকুলের সাত দিন যেনো সাতটি রঙের রামধনু হয়ে ধরা দিয়েছে রক্তিমের মনের আকাশে। বকুলের গলার স্বর আর ব্যবহার সত্যিই মন কেড়েছে ওর। সেদিন বকুল বিদায় জানাতে এসে বারবার ওদের বাড়ি যাওয়ার নিমন্ত্রণ করে গেলো।

রক্তিম এই নিয়ে প্রায় বার তিনেক গেছে বকুলের বাড়িতে। প্রতিবারই মুগ্ধ হয়েছে ওর আতিথেয়তা দেখে। রেবতীর মুখে বকুলের পড়াশুনার কথা শুনে রক্তিম যথেষ্টই অবাক। কারণ বকুল কোনোদিন নিজে মুখে বলে নি সে প্রতিবার ক্লাসে প্রথম হয়েছে, আর এখন এক স্কুল দিদির সাহায্যে শহরের ল কলেজে অ্যাডমিশন নিয়েছে। থাকার ব্যবস্থাও তিনিই করে দিয়েছেন। আর কয়েকদিন পরেই বকুল সেখানে চলে যাবে। রক্তিম বকুলকে জিজ্ঞেস করে " বকুল তুমি আমার এত সেবা করে আমাকে সুস্থ করে তুললে, আমার থেকে কিছু নেবে না?"

বকুল একটু স্মিত হেসে উত্তর দেয় " আমাকে মনে রাখলেই হবে, আর কিছু চাই না"। 

বকুল চলে গেলো শহর প্রায় বছর ঘুরতে চললো, এর মধ্যে রক্তিমও আবার ট্রান্সফার হয়ে বাড়ি এসেছে। বকুলের সাথে এখন প্রায়ই দেখা হয়। রক্তিম ভালোবেসে ফেলেছে বকুলকে কিন্তু বাড়িতে কাউকে জানায় নি। আসলে ঘটকের আনা প্রায় জনা দশেক পাত্রী শুধু গায়ের রঙের কারণে সে বাতিল করেছিল কিন্তু এখন বকুলের গায়ের রঙও বেশ কালো। সে তো আর কাউকে বোঝাতে পারবে না যে বকুল কালো হতে পারে কিন্তু মানুষ হিসাবে সে কতটা ভালো। তবে একদিন সব জানাজানি হয়েই গেলো। মা বকুলকে বাড়ি আনতে বললো। এক রবিবার দেখে বকুল এলো রক্তিমের বাড়ি। বকুল কিন্তু কোনো প্রশ্ন করে নি, সেটা তার অভ্যাসও নয়। তবে রক্তিম যে তাকে ভালোবাসে বা বিয়ে করতে চায় সেটা কোনোদিন মুখে বলে নি। বললে হয়তো সেদিন তার আর বাড়ি যাওয়া হতো না। বকুলকে দেখে রক্তিমের মা খুব খুশি। এতদিন চেষ্টা করেও ছেলেটাকে সংসারী করতে পারে নি কিন্তু আজ সে নিজেই নিজের ব্যাবস্থা করেছে। বেশ কিছুক্ষণ গল্প আর খাওয়া দাওয়ার পর বকুল যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতেই মা বলে ওঠে " বকুল তোমার মা কে নিয়ে কবে বিয়ের কথা পাকা করতে আসছো , বেশি দেরি করতে চাই না, মাকে বলে দিও"। বকুল মাকে প্রণাম করে বললো ", বিয়ে? আমার তো এখন বিয়ে করার কোনো ইচ্ছে নেই, আগে পড়াশুনা শেষ করি, আর আমার কাছে রক্তিম শুধুমাত্র দাদা, বা বলতে পারেন শুভাকাঙ্ক্ষী, বিয়ে করতে কখনোই পারবো না"। রক্তিম কখনো কারো কাছে না শোনে নি, বরং কাউকে না করতে বিন্দু মাত্র সময় নেয় নি। আজ বুঝলো বিনা দোষে শুধুমাত্র তার ভগবান প্রদত্ত গায়ের রঙের জন্য মুখের সামনে তাকে না বলে দেওয়া কতটা যন্ত্রণা দায়ক হয়। রক্তিম দু হাতে নিজের মাথাটা ধরে বসে থাকে। তার বুকটা ব্যথায় যেনো ভেঙ্গে চৌচির হয়ে যাচ্ছে।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract