বাবার মতো
বাবার মতো
আমাদের তিন বোনের পরিবারে একমাত্র শ্রোতা ছিলো বাবা। কারণ সবাই এত কথা বলতাম যে কেউ কারো কথা শোনা হতো না। বাবা কিন্তু অসীম ধৈর্য নিয়ে সবার কথাতেই ঘাড় কাত করে সম্মতি জানাতো। মায়ের কাছে বেশি কথা, হৈ হৈ করায় কান মলা খেলেও বাবা ছিলো আমাদের কাছে নিরাপদ স্থান। সারাদিন অফিসের পরিশ্রমের পরও বাড়িতে এসে আমাদের কাজে সাহায্য করায় কোনো জুড়ি ছিলো না বাবার। তবু কোনো দুঃখ বা আনন্দ হলে আমরা সবাই প্রথমে মায়ের সাথেই ভাগ করে নিতে পছন্দ করতাম। মায়ের থেকে পরে বাবা জানতে পারত। আসলে বাবা এতটাই নিরব থাকতে ভালোবাসতো যে আমরা মাঝে মাঝে ভুলে যেতাম বাবারও মন খারাপ বলে কিছু আছে। মা যেমন চিৎকার করে ভিতরের রাগ দুঃখ প্রকাশ করে নিত, আমাদের বাবা সেটা মনের ভিতরেই রাখতো, তাই কষ্টটা বাড়তো বই কমতো না।
এভাবেই আমরা তিন বোন একদিন সংসারী হলাম। বাবা ছোটো বোনের বিয়ের আগে বসত বাড়িটাও বিক্রি করে দিতে বাধ্য হলো। আমি বা মেজো বোন কিছুটা সাহায্য করতে পারতাম কিন্তু বাবা রাজি হলো না। মেয়েদের দায়িত্ব তার নিজের তাই আমরাও আর কিছু বলি নি। বিয়ের পর মাকে নিয়ে ভাড়া বাড়িতে উঠলো বাবা। ইতিমধ্যেই ছোটো বোন স্বামীর কর্মস্থল ব্যাঙ্গালোর চলে গেছে। মেজো বোন বিয়ের পর থেকেই পুনেতে থাকতো। বাকি রইলাম আমি। আমার শ্বশুর বাড়ি যৌথ পরিবার ফলে খুব একটা বাপের বাড়ি যেতে পারতাম না। ছেলের পড়াশুনা, সংসারের কাজ নিয়ে খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ঠিকমতো ফোনেও যোগাযোগ রাখা হচ্ছিল না। হঠাৎ টিভি তে একটা খবর দেখে চমকে উঠলাম। আমার বাবা অসুস্থ মাকে নিয়ে স্টেশন চত্বরে সবার সাহায্য চাইছে। মিডিয়ার লোক বাবার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। আমি তৎক্ষণাৎ বাবার মোবাইলে ফোন করি কিন্তু পাই না। স্বামী কে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি স্টেশনের উদ্দেশ্যে এক মুহূর্ত দেরি না করে। শেষমেশ বাবা মাকে নিয়ে বাড়ি ফিরি। বাবা মায়ের শরীর খুবই ভেঙ্গে পড়েছিল অযত্নে আর অভাবে। আমি কয়েকদিন পর বাবাকে প্রশ্ন করি " এত কষ্ট পেয়েও আমাদের জানাও নি কেনো?" বাবা আমার মাথায় স্নেহের হাতটি রেখে উত্তর দিয়েছিলো " আমি বাবা, তোদের এমনিতেই কত কাজ, তার মধ্যে আর বিরক্ত করতে মন চায় নি, তোরা সুখে থাক তাতেই আমাদের আনন্দ"। আমি ভিজে চোখে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললাম " গাছের শিকড় শুকিয়ে গেলে গাছের ফল কি করে বেঁচে থাকবে বাবা, তোমরা আর কোথাও যাবে না"। আমার স্বল্পভাষী বাবা বলে উঠলো "আরো সুখী হ তুই"।