কেনো খুন
কেনো খুন
প্রায় এক ঘন্টা পেরিয়ে গেছে, বনমালী সদ্য বিবাহিতা বউ নিয়ে সদর দরজায় ঠায় দাঁড়িয়ে। বেল টিপে আর দরজায় টোকা দিয়ে হাত ব্যাথা হয়ে গেলেও কেউ দরজা খুললো না। ইতিমধ্যে দু একজন প্রতিবেশী উঁকি দিয়ে চলে গেছে। কিন্তু ব্যাপারটা চরমে পৌঁছালো ঠিক আরো ঘণ্টা তিনেক পর। কারণ এক প্রতিবেশী সাধন বাবু পুলিশে ফোন করায় তারা তৎক্ষণাৎ হাজির হয়ে দরজা ভাঙার তোড়জোড় করতে লাগলো। উৎসুক মানুষের ভীড় ক্রমশ বাড়তে থাকলো। তখন যদি ঘরের ভিতরটা কোনো জাদুবলে দেখা যেত, তো সবাই দেখতে পেত একজন প্রৌড়া মেঝেতে চিৎপাত হয়ে পড়ে, সারা মেঝে রক্ত জমাট বাঁধা অবস্থায়, অনতিদূরে এক কিশোরী উপুড় হয়ে পড়ে, তার গলার নলি কাটা। টেবিলে রাখা এক গুচ্ছ গোলাপ। গোলাপ যদিও বাসি হয়েও তার নাম হারায় নি কিন্তু এই মানুষ দুটি তাদের নাম হারিয়ে শুধুই ডেড বডিতে রূপান্তরিত হয়েছে। অবশেষে দরজা ভাঙ্গা হলো। বনমালী মা আর বোনের অবস্থা দেখে হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে। এক দিন আগেও ফোনে কথা হয়েছে, সবই স্বাভাবিক ছিল, তবে এই পরিণতি কেনো? বনমালীর মাথা ঘুরতে থাকে। কোনো রকমে নতুন বউ মালার হাতটা ধরে নিজেকে সামলে নেয়। বডি তোলার কাজ শেষ হলে পুলিশ তাকে থানায় নিয়ে আসে। মালাও যায় তার সাথে। থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার ভূষণ বাবুকে বনমালী আগে থেকেই চিনত। বাবা মারা যাওয়ার পর ওই এলাকার একটি দোকান নিয়ে সমস্যায় পড়েছিল বনমালীর মা রেখা দেবী। আসলে বনমালীর বাবা সুখেন বসাক ওই অঞ্চলের বেশ বড়ো ব্যবসাদার। প্রায় চারটি সোনার দোকানের মালিক। একটি ছেলে আর একটি মেয়ে নিয়ে তার বেশ সুখের সংসারই ছিল। রেখাও সংসার সামলে যতটা সম্ভব স্বামীকে ব্যবসার কাজে সাহায্যই করতো। ছেলে বনমালী কিন্তু একেবারেই বাবার মত হয় নি। সারা দিন বন্ধু বান্ধব আর বিলাসিতায় তার জীবন কাটত। হাজার বুঝিয়েও কোনো লাভ হয় নি। একবার এক প্রতিবেশী মারফত সুখেন বাবু জানতে পারেন বনমালী প্রায় রাতেই নিষিদ্ধ পল্লীতে যায়, আর সেখানে জলের মত টাকাও খরচ করে। সেদিন বনমালীকে এই কথা জিজ্ঞেস করায় অশান্তি চরমে পৌঁছুলো। এমনকি বাবার গায়ে হাত তুলতে কসুর করলো না ছেলে। এর পর থেকেই ক্রমশ মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়তে থাকে সুখেন বাবু। একসময় এক চরম সিদ্ধান্তও নিয়ে নেন। তার সমস্ত সম্পত্তি বউ আর মেয়ের নামে লিখে দেন। উকিল ডেকে তার সব ব্যবস্থা যেদিন পাকা হলো সেদিন বনমালী বাবার পায়ে ধরে কাকুতি মিনতি করতে লাগলো, অন্তত দুটি দোকান তার নামে লিখে দেওয়ার জন্য। রেখাও ছেলেকে একেবারে বঞ্চিত করতে চাইছিল না দেখে সুখেন বাবু দলিলে সংযোজন করে দিলেন যদি স্বেচ্ছায় মা আর বোন তাদের সম্পত্তি বনমালীকে দিতে চান তবে সুখেন বাবুর মৃত্যুর পর সেটা করতে পারবেন। এরপর আর খুব বেশিদিন বাঁচেন নি সুখেন বাবু। রেখা আর মেয়ে অনি মিলে ব্যবসা বেশ ভালই চালাচ্ছিল। বনমালী প্রতি মাসে মায়ের থেকে টাকা নিত। সে এক একবার এত বেশি দাবি করতো যে মায়ের পক্ষে টাকা দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ত। আর তখনই শুরু হতো অশান্তি। রেখা মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য পাত্র খুঁজতে শুরু করলে অশান্তি চরমে পৌঁছায়। কারণ বনমালীর দাবি বোনের ভাগে যে সম্পত্তি বাবা লিখে দিয়েছেন সেটা আগে তার নামে করতে হবে। কারণ না হলে জামাই তাতে অবশ্যই ভাগ বসাবে। এইসব কথার মাঝেই একদিন মালাকে নিয়ে আসে বনমালী। মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে জানিয়ে দেয় সে খুব শীগ্রই মালাকে বিয়ে করে বাড়িতে নিয়ে আসবে। রেখা একটু অবাক হলেও ভাবে বিয়ে করলে যদি ছেলের মতি গতি ফেরে তো মন্দ কি। নিম রাজি হয়ে সম্মতি দিয়েও দেয়। এদিকে অনিকে দেখে এক পাত্র পক্ষ পছন্দ করেই গেছে। ছেলে ব্যবসাদার। অনির জন্মদিনে সে এসেছিল। একরকম বিয়ে পাকা। তাই মালাকে বউ করে আনতে খুব একটা আপত্তি করে নি।
থানার বড়বাবু ভূষণ বনমালী আর মালাকে বসতে বলে নিজের চিয়ারে বসে। প্রথম প্রশ্ন "তোমাকে তো অনেকদিন ধরেই চিনি, সেই তোমার বাবার আমল থেকেই, এই জঘন্য কাজটা কেমন করে করতে পারলে?
বনমালী চমকে উঠে বলে " না না স্যার আমি কিছুই জানি না, বিশ্বাস করুন, একজন ছেলে তার মা বোনকে খুন করতে পারে?
এবার মালার দিকে এক মোক্ষম প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন বড়ো বাবু " তুমি কখন থেকে জানতে পেরেছে, তোমার হবু স্বামী মা বোনকে খুন করে তোমাকে ঔ বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে?
মালা কিন্তু একটুও চমকালো না, একটুও ঘাবরালো না, শুধু দৃষ্টিটা একবার ছুঁয়ে গেলো বনমালীর মুখ, বললো " আমি ওর বাড়িতে আগেও গেছি, আমার হবু শাশুড়ি আর ননদের সাথে আমার সম্পর্ক খুবই আন্তরিক ছিল, তাই ওদের কোনো ক্ষতি হবে জেনে আমি চুপ করে থাকতাম না। আর বনমালী ওর পরিবারকে যথেষ্টই ভালোবাসতো, তাই আপনার এই প্রশ্ন অবান্তর"। বড়বাবুর দৃষ্টি মিনিট দুই দুজনের মুখে নিবন্ধ থাকার পর বেশ গুরু গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন " তবে এখন তো সব সম্পত্তি তোমাদের, আর কোনো বাধা রইলো না বলো?"
বনমালী টেবিল থেকে জলের গ্লাসটা তুলে দু ঢোক জল খেয়ে বললো " সম্পত্তি কোনো ব্যাপার নয়, বোনের বিয়ের আগেই মা ওটা আমার নামে করে দেবে বলেছিল, আর তাতে বোনেরও কোনো আপত্তি ছিল না"।
বড় বাবু সম্মতি সূচক ঘাড় নেড়ে বলেন " হ্যাঁ জানি তো, আমার সাথে রেখা বৌদির এই নিয়ে বেশ কয়েকবার কথা হয়েছে, তবে সম্পত্তি দিতে যে বোনের কোনো আপত্তি নেই, এটা ঠিক নয়"। বনমালী এই কথার কোনো উত্তর দিলো না। বড়বাবু সেদিনের মত ওদের বাড়ি যাওয়ার অনুমতি দিলেও বারবার বলে দিলেন থানায় না জানিয়ে কোথাও যেনো না যায়।
প্রতিবেশীদের সাথে খুব একটা সদ্ভাব না থাকলেও তাদের কারো কারো সাহায্যে মা আর বোনের শেষকৃত্য সম্পন্ন করতে হলো। পাড়ার বেশিরভাগ মানুষই এই খুনের পিছনে মালা আর বনমালির হাত আছে বলেই একশো ভাগ বিশ্বাস করে। তদন্তে যে ছেলে আর বৌমাই অপরাধী প্রমাণিত হবে সে বিষয়ে তারা নিশ্চিত। এরপর কেটে যায় এক সপ্তাহ। এর মধ্যে বার তিনেক বড়বাবু আর কয়েকজন পুলিশ বাড়ি এসে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে গেছে। সম্পত্তির দলিল নিয়ে গেছে তদন্তের স্বার্থে। এর কয়েকদিনের মধ্যে বনমালী আর মালাকে থানায় তলব করে বড়বাবু। হঠাৎ বড়বাবু বনমালীকে প্রশ্ন করেন " তুমি স্বপন হালদার নামে কাউকে চেনো?" বনমালী একটু কপাল কুঁচকে উত্তর দেয় " হ্যাঁ চিনি মনে হচ্ছে, এই নামটা বোনের মুখে অনেকবার শুনেছি, তবে দেখেছি মাত্র একবার, বোনের আগের বছর জন্মদিনে এসেছিল ছেলেটা, পরে মায়ের মুখে শুনেছিলাম ওর সাথেই নাকি অনির বিয়ে হবে"। এতক্ষণ বড়বাবুর দৃষ্টি স্থির হয়েছিল বনমালীর মুখে। এবার দৃষ্টি ফেরালো মালার দিকে " তুমি তো জানতে স্বপন একজন কুখ্যাত গুন্ডা, তার এই তিরিশ বছরের জীবনে বার দুয়েক জেল খাটা হয়ে গেছে, তবু অনিকে সাবধান করলে না কেনো? মালা কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই বড়বাবু আবার একটি মোক্ষম প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন মালার উদ্দেশে " নাকি স্বপনের সাহায্যে নিজের কাঁটা দূর করার উপায় বাতলেছিলে ?"
মালার মুখ এবার ফ্যাকাসে হতে শুরু করে, তবু গলায় জোর এনে বলে " কি সব যা তা বলছেন? আমি অনিকে খুবই ভালবাসতাম, আর স্বপনকে আমি চিনতাম না।" এবার যে ঘটনাটি ঘটলো তাতে মালার মাথার উপর ফুল স্পীডে পাখা চলতে থাকতেও সে দরদর করে ঘামতে থাকলো। বড়বাবু টেবিলের উপর কয়েকটি ফটো রাখলেন। তাতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মালা আর স্বপন হাত ধরাধরি করে বেশ সাহসী পোজ দিয়ে ছবি তুলেছে। বনমালী এই কান্ড দেখে এতটাই অবাক যে তার মুখে আর কথা সরছিল না। তবু দু তিনবার গলায় ঢোঁক গিলে কিছু বলার চেষ্টা করতে গিয়েও সফল হলো না। কারণ তখন বড়বাবু মালার দিকে তাকিয়ে এক ধমক দিয়ে পুরো ঘটনাটি বলার জন্য নির্দেশ দিচ্ছেন। এক মহিলা পুলিশ মালার চুল পিছন থেকে ধরে টান দিয়ে বলে উঠলো " যদি ভালোয় ভালোয় সব স্বীকার না করিস, তবে আমার অনেক অন্য উপায় জানা আছে, তবে তাতে তোর ব্যথা একটু বেশিই লাগবে"। এবার মালা যেনো আঁতকে উঠলো। চিৎকার করে বলে উঠলো " হ্যাঁ আমি আর স্বপন মিলেই ওদের সরিয়ে দিয়েছি পৃথিবী থেকে, এ ছাড়া আর অন্য উপায় ছিল না, বিশ্বাস করুন"। দুচোখ ভরা জল নিয়ে বলে ওঠে " বনমালীকে আমার বিয়ে করাও এই এক কারণে, আমি আর স্বপন স্বামী স্ত্রী, আমাদের দুটি ছেলে মেয়ে আছে, কিন্তু স্বপন যা রোজগার করে তাতে সংসার চালানো দুষ্কর, তাই আমরা এই ফন্দি করি। বনমালী দুটো ম তেই বেশ আসক্ত তাই আমাদের ফন্দি সফল হতে অসুবিধা হয় নি। স্বপন অনির কাছে নিজেকে একজন সৎ আর খুব বড় ব্যবসাদার প্রমাণ করতেও খুব একটা বেগ পেতে হয় নি। বনমালীর মা বেশ কিছুদিন ধরেই অনির বিয়ে দেওয়ার তোড়জোড় করছিল তাই উনিও স্বপনকে মেয়ের যোগ্য পাত্র ভাবতে বেশি সময় নেয় নি।"
এতক্ষণ একনাগাড়ে কথাগুলো বলে একটু থামতেই বড় বাবু আবার প্রশ্ন করে বসলেন " এর জন্য দু দুটো খুন করার কি দরকার হয়ে পড়লো?"
মালা আবার শুরু করে " আমাদের প্ল্যান ছিল আমি বনমালীর বউ হলে পরে ওকে দিয়ে সব সম্পত্তি লিখিয়ে নেবো আমার নামে, কিন্তু এখানেই ছিল বড়ো ভুল, ওর বাবা সব সম্পত্তি মেয়ে আর বউয়ের নামে লিখে দিয়ে গেছেন, তবে তাদের মৃত্যুর পর সেটা ছেলের নামে হতে পারে এটাও দলিলে লেখা ছিল। আর এটা যেদিন দেখলাম সেদিনই স্বপন সিদ্ধান্ত নিলো মা আর বোনকে আগে সরিয়ে দিতে হবে, তারপর সম্পত্তি বনমালীর নামে হলে পরে সেটা আমার নামে করে নিয়ে ওকেও পাঠিয়ে দেওয়া হবে মা আর বোনের কাছে।" এই পর্যন্ত শুনে বনমালী আর স্থির থাকতে পারলো না। সপাটে এই চড় কষালো মালার গালে। বড়বাবু এবার টেপ রেকর্ডার বন্ধ করতে বলে উঠে দাঁড়ালো। বনমালী তখনও টেবিলে মাথা রেখে হাপুস নয়নে কেঁদে চলেছে। মালাকে ইতিমধ্যে মহিলা পুলিশটি লকআপ এ নিয়ে গেছে। বড়বাবু বনমালীর পিঠে হাত রেখে বলে উঠলেন " তোমার ভুলের মাশুল গুনতে হলো দুটি নিরপরাধ মানুষকে"।