আত্মহত্যা
আত্মহত্যা
রজত গঙ্গার পাড়ে বসে প্রায় ছ ' ঘণ্টা হয়ে গেছে। এর মাঝে দু পশলা বৃষ্টিও হয়ে গেছে, ভিজেছে কিন্তু উঠে যায় নি। আসলে এই নিয়ে তিনবার নিজের জীবন শেষ করে দেবে ভেবেও পারে নি। আজ প্রতিজ্ঞা করেছে আর কিছুতেই পিছিয়ে আসবে না। একটা একটা করে সিঁড়ি নেমে এগিয়ে যাচ্ছিল জলের দিকে কিন্তু এত রাতে পিছন থেকে একটা ডাক " বাবা আমাকে একটু সাহায্য করবে?" রজত পেছন ফিরে দেখে একজন বয়স্কা মহিলা, আবছা অন্ধকারে মুখ ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। রজত আবার কয়েকটা সিঁড়ি বেয়ে উঠলো। " কি হয়েছে বলুন"। মহিলাটি একটু এগিয়ে এসে বলল " আমার ছেলে রোজ এখানে বসে থাকে কিন্তু আজ নেই, তাকে খুঁজে দেবে?" রজত এবার কিছু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল কিন্তু ওপরে উঠে দেখলো মহিলাটি হেঁটে অনেকটা দূরে চলে গেছে । ঘাটের পাশে চায়ের দোকানে জিজ্ঞাসা করতেই শুনল এই মহিলা রোজ আসে আর সবাইকে ছেলেকে খুঁজে দিতে বলে। আসলে ছেলেটি এই গঙ্গায় এক রাতে আত্মহত্যা করেছিলো, সেই শোকে মহিলা পাগল হয়ে সারারাত গঙ্গার ঘাটে ঘুরে বেড়ায় আর ওর ছেলের বয়সী কাউকে দেখলে সাহায্যের কথা বলে। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো। ভাবলো তার মৃত্যুর পর মা হয়তো এভাবেই ছেলের শোকে চারিদিকে ঘুরে বেড়াবে হয়তো বা অসুস্থ হয়ে বিছানা নেবে। তবু আত্মহত্যার ইচ্ছেটা কিছুতেই বিসর্জন দিতে ইচ্ছে করছিল না কারণ পলি ছাড়া তার জীবন শূন্য, তার বেঁচে থাকা আর না থাকা সমান। আবার ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করলো। বৃষ্টিও নামলো মুষলধারে। রজতের বুক খুব জোরে ওঠানামা করতে লাগলো। একবার বুকে হাত দিয়ে যেনো নিজেকেই নিজে বলে উঠলো " আর
নয়, এবার মরতেই হবে"। ঝাঁপ দেওয়ার আগে শুধু একবার মা বলে চিৎকার করেছিলো শুধু এটুকুই মনে আছে, বাকি ঘটনা তার জানা ছিলো না। জ্ঞান ফিরে দেখে মা মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে অঝোর ধারায় কাঁদছে। রজত উঠে বসতে গেলো কিন্তু সারা শরীর ব্যথায় আড়ষ্ট। খুব আস্তে করে মাকে জিজ্ঞেস করলো " আমি বেঁচে গেলাম কেমন করে?" মা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠতেই পাশে দাঁড়ানো বন্ধু জানালো সে গঙ্গায় ঝাঁপ দেওয়ার সাথে সাথেই এক বয়স্কা মহিলা তাকে জল থেকে টেনে তোলে। মহিলাটির ছেলেও নাকি এভাবে একদিন গঙ্গায় আত্মহত্যা করেছিল।। ততক্ষণে রজতের সামনে ভেসে উঠেছে সেই রাতের সাহায্য চাওয়া মহিলার মুখ। যার ছেলেকে বাঁচানোর কথা বলেছিল কিন্তু ছেলে অনেকদিন আগেই মারা গেছে। এখন রজত আর আত্মহত্যার কথা ভাবে না। ওই মহিলাটির মুখ যেনো তাকে এইসব করা থেকে বারবার বিরত থাকতে বলে। একদিন বেশ রাতেই ভূতনাথ মন্দিরে পুজো দিয়ে ফিরছে আবার দেখা সেই মহিলার সাথে। ফোকলা মুখে যেনো বিষন্ন হাসি। বলল " বাবা, ভালো আছো তো, মায়ের বুকের ধন তুমি, মাকে কষ্ট দিও না কখনো"। রজতকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই মহিলা যেনো হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। রজতকে হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চা দোকানি বলে উঠলো " আজ আবার একজন নিজেকে বিসর্জন দিলো গঙ্গায়, সেই বয়স্কা মহিলাটি, যার ছেলেও এভাবেই আত্মহত্যা করেছিলো, এখনও দাহ হয় নি"। রজত চমকে উঠলো। একটু আগেই তো কথা বলেছে তার সাথে। দু চোখ চিক চিক করে উঠলো। ভাবলো মায়েরা বেঁচে বা মরে সন্তানদের রক্ষা করতে কখনো পিছপা হয় না।