গিনি
গিনি
বিভাগ-গল্প
শিরোনাম-গিনি
কলমে-সুতপা ব্যানার্জী(রায়)
গিনির মা ঝাঁঝিয়ে ওঠে-"তুহার যখ্যন বিহা ট হুঁইছে, তখ্যন তো তুকে উকেই সোয়ামি মানতে হুবে, ঘর ট করিস
আর লাই করিস।" গিনি হাতের কাজ সারতে সারতে বলে-" মা অমন বিহা ট কি বিহা হইল্যো, কুন বছহর দশে বিহা দিলি তাহো সোয়ামি ট চল্যি গেলহ, মুর কি দোষ ট।"
গিনির মা খানিক কান্নার সুরে বলল-" হ হ তুর কেন্যে হবে, সব্ব মুর কপাল টর দোষ।" গিনি কাঁদতে কাঁদতে দুটো মুড়ি বেঁধে ইটভাটার কাজে চলে যায়, সেই কোন ছোটবেলায় এক কুড়ির জোয়ানের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল, তারপর ওরা আর শশুরবাড়ি নিয়ে যায় নি। এতোদিনে সে লোককে ও চিনতেই পারবে না। পথে বান্ধবী মেখলির সঙ্গে দেখা হয়, মেখলি বলে-" ম্যানজার
বাবহুর কাছকে হপ্তার টেকা ট পাঁইছ্যিস কি? শুনলম লথন ম্যানজার এইছ্যে।"- গিনি উত্তর দেয়-"লথন পুর্যান দিয়্যে ম কি কইরব, হপ্তার টেকা ট ফেইল্যে দিল্যে ম খুশ,
মা বিটিও খুশ।"
কারখানার ভোঁ পড়ে যাওয়ায় আরো দ্রুত পা চালায় গিনি। গিয়ে দেখে মেখলির কথাই ঠিক। ম্যানেজারের চেয়ারে বেশ সুন্দর দেখতে একটা লোক- মনে মনে তারিফ করলেও, হাতের কাজ সারতে সারতে পাশে বসা ভেলকিকে বলল-" মেখলির যত্ত্য আমোহদ ট, ম হপ্তা ট পাই লাই, লথন ম্যানজার লিয়ে করব্য কি?"- ম্যানেজার ওদের কথার মাঝে ওখানেই এসে হাজির হয়, গিনির দিকে তাকিয়ে বলল-" তুমি পাও নি যে হপ্তা বলবে তো, চল টিপ ছাপ দিয়ে হপ্তার টাকা নিয়ে নাও।" গিনি মনে মনে ভাবে-"ই কি মনহের কথ্যা ট পইরত্যে পারে।" ম্যানেজারের নাম চন্দন, ভেলকির কাছে শুনে নিয়েছে।
গিনি মনে মনে ভাবে-" দহাল পারা, না খারহাপ ট কে জান্যে।"- কলা পাতায় সাজানো তার বিয়ের মন্ডপের কথা মনে পড়ে, কিন্তু বরের মুখটা হাজার চেষ্টা করেও মনে করতে পারে না। কাজের নেশায় নেশায় দিনটা কেটে যায় নিশির, গোটা রাতটা অতীত দুঃখ গাথায় ভরে থাকে।
মা, বাপ তো হাড়িয়ার নেশায় চুর হয়ে থাকে, গিনি তার একাকিত্বের নেশায়। এমনি করে রাত ভোর হয়, আবার সেই হাড়ভাঙা খাটুনির সকাল, দুপুর পার হয়। একদিন কারখানায় গিনি চুল্লীতে ইট পোড়ানোর জন্য টানছে, ম্যানেজার চন্দন এগিয়ে এসে বলল-" তুমি একা করছ, তোমার তো কষ্ট হবে সাথে কাউকে নিয়ে নাও।" গিনি অবাক চোখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে বলল-" ই ইস্তক তো কেহ্য অমন দরদ ট দিখাই লাই, আপনি হঠাৎ দিখাইছ্যান
কেনে।" উত্তরের খড়তায় তুতলে যায় চন্দন, সামলে নিয়ে গাঢ় স্বরে বলে-" মনের মধ্যে এতো ঝড়ও তো কেউ তোলে নি আগে।"-গিনি লজ্জা পেয়ে দূরে সরে যায়, কিন্তু কথাগুলোর অনুরণন মনের মধ্যে বাজতে থাকে, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে মানুষটার কথাগুলোকে। ভেলকি দূর
থেকে ব্যাপারটা লক্ষ্য করে বলে-" কি বলছিল্য তহকে, ইসব্ব কথ্যা তে বিশ্বাস যাস লাই লিশ্চয় কন্য মতলব ট আছ্যে।"গিনি ভেলকির দিকে তাকিয়ে চুপ করে যায়, সত্যি-মিথ্যে জানে না, এমন আদর করে তার সাথে কেউ কথা বলে নি, তাই কথাগুলো বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে।
বাড়ি ফিরে মেখলি, ভেলকির সঙ্গে মিলে হাড়িয়া খেল খুব, তারপর- দ্রিম দ্রিম তালে পা মিলিয়ে নাচলও খুব। মা পলতি, গিনির কান্ডকারখানা দেখে অবাক হয়ে গেল, হল কী মেয়েটার, যা কোনদিন করে নি, তাই করছে।
পরদিন হপ্তার টাকার সঙ্গে কিছু টাকা বেশী দিল চন্দন গিনিকে, গিনি বেশী টাকাটা চন্দনকে ফেরত দিয়ে বলল-"আপনি যা ভাবছ্যিস, আমি অমনটা লয় বঠি, আমার মন টর মাল্যিক ট আমি লিজেই, ই টাকা ট দিয়্যে অন্য কাখ্যে বশ ট কর্যেন কেনে।" চন্দন বেশী টাকাটা ফেরত নিয়ে রেখে দেয়। গিনি বাড়ি ফিরে খুব কাঁদে, ভাবে স্বামী পরিত্যক্তা হওয়ায় সবাই তার সঙ্গে এরকম আচরণ করতে সাহস পায়, মেখলি আর ভেলকি খানিক সমবেদনা জানিয়ে যায়। দুদিন কারখানায় নিজের মনে চুপচাপ থাকে গিনি, চন্দনও নিজের কাজে ব্যস্ত থাকে।
সময় গড়াতে মন নরম হয় গিনির, কিন্তু আগ বাড়িয়ে কথা সে বলবে না, তাই কাজের ব্যস্ততায় নিজের দম ধরে রাখে। চন্দন দুঃখিত মুখ করে এসে দাঁড়ায়,ক্ষমা চেয়ে বলে-" আসলে ভেলকির কাছে শুনেছিলাম, তোমাদের অবস্থা খুব খারাপ, তোমার বাবার চিকিৎসা চলে, তাই বেশীটা দিচ্ছিলাম, কারখানার মালিককে বলে ওটা বরাবরের মতো বাড়িয়ে দিতাম।"গিনি চন্দনের ওপর খানিকটা নরম হয়। আসতে আসতে চন্দনের ওপর নির্ভরশীলও হয়। কারখানার আশেপাশের পথেঘাটে মাঝে মাঝেই দুজনকে একসঙ্গে দেখা যায়। এই নিয়ে গুঞ্জনও ওঠে, আজকাল মেখলি আর ভেলকির কথা গিনি বিশেষ শোনে না। এই সেদিন তো ভেলকির মুখের
ওপর বলল,-" তু দের কথা ট শুনব্যই না, আমার সোয়ামি ট কি দিয়াছ্যে, ছট্যকাল টয়ে মুর জীবন ট লষ্ট কইর্যা পলাইছ্যে, চন্দন মক্যে বিয়া ট কইরব্যে।" বান্ধবীর মাথাটা একেবারেই খারাপ হয়ে গেছে মনে করে ভেলকি আর প্রত্যুত্তর করে নি। সেদিন চন্দনের সঙ্গে গেল কাছাকাছি একটা পুরোনো মন্দিরে, চন্দন ঠাকুরের সামনে গিনি সিঁথি রাঙিয়ে দিল। গিনি ভাবে তার হিতাহিত জ্ঞান কি চলে গেছে, কি করল সে, বাড়িতে মাও তো কিছু জানল না। চন্দন ওকে স্বপ্ন দেখায় নতুন ইটভাটায় কাজ নেবে,
তারপর গিনিকে এখান থেকে নিয়ে গিয়ে নতুন জায়গায় ঘর বাঁধবে। গিনিও সে বিশ্বাসে মনের খুশিতে বাড়ি ফেরে। মাকে কোনরকমে সামলায়, ওর ধরণধারণ দেখে সন্দেহ হলেও অশান্তি বাড়বে বলে মুখে কিছু বলে না। পরদিন চন্দনের কথামতো ও বেরিয়ে পড়ে স্টেশনের উদ্দেশ্যে,
পথে দেখা হয় ভেলকির সঙ্গে, ভেলকি হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল-" যাস লাই উ ম্যানজারের সাথ, কারখানার বাপ্যন খাত্যা ট খুইল্যে দিখাইছে উর বিহা করা বহু ট আছে, তুর সাথ খিল্যা ট খেইলছ্যা।"- গিনির পায়ের তলার মাটি সরে যায়, মনে মনে ভাবে, সেই কলাপাতা ঘেরা তার ছেলেবেলার বিয়ের মন্ডপের কথা। মুখে বলল-
"তু লিয়ে চল বাপ্যনের কাছ ট কে, কথ্যা ট ঠিক হইল্যা,উর মাথা ট ধর তক ছাড়াই দিব।" ভেলকিও ছোটে উন্মত্ত গিনির পেছন পেছন, কারখানার অফিস ঘর পর্যন্ত গিনি ঝড়ের বেগে পৌঁছায়। চন্দন পরিস্থিতি উপলব্ধি করে পালাতে যায়। হাতের কাছে একটা কুড়ুল পেয়ে তাক করে চন্দনের দিকে। হঠাৎ এ সময়ে ছেলেবেলায় ফেলে আসা বিয়ের মন্ডপের বরটার মুখটা মনে পড়ে যায়,
"উ মাগ্য"- বলে গিনি বেহুঁশ হয়ে যায়। কর্মীদের আবেদনের ভিত্তিতে মালিক চন্দনকে বরখাস্ত করে।
গিনি শেষপর্যন্ত, মনে স্বপ্ন জাগানো প্রতারক প্রেমিকের প্রাণটা ভিক্ষে দিয়ে দেয়।