Sutapa Roy

Inspirational

4  

Sutapa Roy

Inspirational

জীবন রহস‍্য

জীবন রহস‍্য

4 mins
345


বিভাগ-গল্প

শিরোনাম-জীবন রহস‍্য

কলমে -সুতপা ব‍্যানার্জী(রায়)

ক্লাস ইলেভেনে পড়ার সময় থেকে দেবায়নের স্বপ্ন ও শান্তিনিকেতনে পড়বে, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে চায় নি, পদার্থবিদ‍্যা ওর প্রিয় বিষয়, তাই নিয়েই অনার্স পড়তে চেয়েছে বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন বুকে নিয়ে।

বিশ্বভারতীতে প্রবেশিকায় সুযোগও পেয়ে যায়,ওর এই ক‍্যাম্পাস বেছে নেওয়ার কারণ এখানকার পরিবেশ;ছোট থেকেই ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভক্ত, উনি ওর মুক্তির আকাশ, অনুপ্রেরণা; স্কুলে পড়তে সবাই ওর গাওয়া রবীন্দ্রসংগীতের ভক্ত ছিল; রিয়ার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হতে আর গাইতে ইচ্ছে করে না,ওর আবদারেই নতুন নতুন গান তুলতে হতো, গানের জন্য ওরকম বায়না করার আর কেউ নেই।

এক বুক হতাশা ঝেড়ে ফেলে এই দুদিন হল ও বিশ্বভারতীর ক্লাসে জয়েন করেছে,ও ছাড়াও ওর ডিপার্টমেন্টের আরও দুজন দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার, এখানে আলাপ হওয়ার পর ওরা তিনজন মোটামুটি একসঙ্গেই থাকে,হস্টেলে ওরা রুমও নিয়েছে একসঙ্গে, তিনজনের তিনটে সাইকেল চক্কর কাটার আর অসুবিধে নেই।

বাড়ি থেকে দূরে এসে বাবা মা, বুনটির কথা খুব মনে পড়ছে, তবে যাতায়াতের পথে কৃষ্ণচূড়া, জারুলের বনে মনটা যেন কোথায় হারিয়ে যায়, নি:সর্গের মাঝে যে খুশি সে পাচ্ছে তা জীবনে পায় নি, কি যেন একটা আকর্ষণ আছে ইতিহাস আর প্রকৃতি এখানে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে, ঐ সুন্দর কাচে ঘেরা উপাসনা গৃহটাও টানে ওকে, অন‍্য দিন গ্রিলের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে, বুধবার ভেতরে ঢোকে। না এবার তাড়াতাড়ি হস্টেলে গিয়ে স্নান, খাওয়াদাওয়া সেরে সেকেন্ড হাফের ক্লাস করতে হবে, সাইকেলের বেগ বাড়ায়, সেই তাড়ায় রাস্তার খুঁটে খাওয়া পায়রাগুলো উড়ে যায়।

অনার্সের ক্লাসে জে.ডি আর পুষ্পেন স‍্যারের পড়ানো দেবায়নের খুব পছন্দের, চোখের সামনে একটা আস্ত ল‍্যাবরেটরি দেখতে পায়, ওনাদের পড়ানোয় হাইড্রোজেন বা নাইট্রোজেন কত সহজেই মুক্তি পায় তাদের বেঁধে রাখা যৌগ থেকে। পাস কোর্সের ক্লাসের দীব‍্যেন্দু স‍্যারকেও ওর ভাল লাগে, সংখ্যা যেন খেলা করে ওনার হাতের আঙুলে। বিকেলে ওর রুমমেট শোভনের সঙ্গে গেল শ্রীনিকেতনের দিকে, গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নতিতে রবীন্দ্রনভাবনায় যে পথচলার শুরু সে ও পড়েছে শুনেছে আজ চাক্ষুষ করতে চলল। ওখানে পৌঁছে অনেকক্ষণ ধরে খুটিয়ে খুটিয়ে তাঁতঘর, বাটিকঘর দেখল,চামড়ার কাজকর্মগুলো ওর বেশ ভাল লাগল, আলাপ হল স্থানীয় কয়েকজন গ্রামীণ শিল্পীর সঙ্গে।ওদের কাছে অনেক কিছু শেখা হল,জানা হল। রাতটা হস্টেলের বেডে কাটাতে কদিন সময় লাগবে, খানিক উসখুস করতে করতে চোখে ঘুম নামল; পরদিন শোভনের সঙ্গে শান্তিনিকেতনের ভোর দেখতে বেরোল, কলাভবনের দেয়ালের চিত্রিত রূপ তাকে মুগ্ধ করল, এখনো কি সুন্দর তাদের রঙ ও গঠন। ওখানে এক ফেরিওয়ালার কাছে মিষ্টি দই কিনে খেলো, কি অপূর্ব স্বাদ। কলাভবনের অফিস পেরিয়ে পৌঁছোল সেই চিরস্মরণীয় জায়গায়, রামকিঙ্কর বেজের ভাস্কর্য তাকে সুদূর এক অতীতে টেনে নিয়ে গেল, যেখানে এক নিভৃতচারী শিল্পী, নিরাড়ম্বর জীবনে,পাথরে তার স্বপ্নের বীজ বুনে চলেছেন, দেবায়ন মূর্তির প্রতিটা আঙ্গিকে যেন শিল্পীকে দেখতে পেলো। চোখ আটকে গেল পাথরে খোদাই সাঁওতাল পরিবারের দিকে, একটা চলমান আদিবাসী পরিবার, আগে চলেছে বাবা একটু পেছনে কেশরাশি ঝাঁকিয়ে মা আর তাদেরকে প্রায় লেপটে তাদের শিশুপুত্র; চলনে কি ব‍্যস্ততা, যেন পৃথিবীর সব কাজ তাদেরই কাঁধে; দেবায়নের মুগ্ধতা আর কাটে না, সে যেন ঐ পরিবারেরই একজন। সম্বিত ফিরল শোভনের ডাকে, "এই দেবায়ন দেরী হয়ে যাচ্ছে চ ব্রেকফাস্ট খেয়ে ক্লাসে যেতে হবে তো।" দেবায়নের কন্ঠে অবচেতনে উঠে এলো, "আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণ ধূলার পরে।"

কলেজ যাতায়াতের পথে দেবায়নের পছন্দের ঠাঁই হল ঐ সাঁওতাল পরিবারের পাথরের ভাস্কর্য, কি যে শান্তি পায় ওখানে দুদন্ড এলে। এরপর শোভনের সঙ্গে চলল খোয়াই-এর পথে দূরের আরও দূরের গ্রামে ঘোরা; এরমধ্যেই আদিবাসী গ্রাম, গ্রামের লোকজন ওর আপন হয়ে উঠেছে, ওরা কেউ এখন ওর পিসি, কেউ মাসি, কেউ বা ভাই বোন। ওদের দাওয়ায় বসে ভূষণ, কালু ওদেরকে পড়ায়, ওরা দেবায়নের খুব ভক্ত হয়ে উঠেছে।

শোভন প্রথম প্রথম দেবায়নের সঙ্গে সাঁওতাল পল্লীতে এসেছিল কিন্তু কেরিয়ার বাদ দিয়ে অযথা সময় নষ্ট করার ছেলে ও নয় তাই আসা বন্ধ করেছে। কদিনেই ভূষণরা অঙ্কে বেশ চটপটে হয়ে উঠেছে, স্কুলে যাওয়ার আগ্রহ বেড়েছে। দেবায়ন ঠিক করেছে এখানে বিজ্ঞানমঞ্চের কর্মশালা করবে তাতে যদি ওদের ঐ জরিবুটির বিশ্বাস ছাড়ে। সাঁওতাল পল্লীতে যাতায়াত করতে গিয়ে দেবায়নের আলাপ হয়েছে শ্রমণার সঙ্গে, ও বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগের ছাত্রী আর একটা এনজিওর সাথে যুক্ত যারা এই অঞ্চলে কাজ করে। ওখান থেকে ফেরার পথে দেখতে পায় গ্রামগুলোর দখল নিচ্ছে ইট কাঠ পাথরের বড় বড় বাড়ি, অন‍্যান‍্য শহর থেকে দোল, মেলা বা অন‍্য সময় কাটিয়ে যাবে বলে সব কেনে; এসব ছেড়েই তো দেবায়ন এখানে পড়তে এসেছে মাটির গন্ধ মাখবে বলে; তাই যত দূর সম্ভব ওগুলো দেখাকে এড়িয়ে চলে। রোজ একবার করে দাঁড়ায় সেই সাঁওতাল পরিবারের পাথুরে ভাস্কর্যের সামনে, তার রোজকার পথ চলার অনুপ্রেরণা; এই মূর্তিই তাকে টেনে নিয়ে গেছে ভূষণ, কালুদের কাছে। এখন ও ওদের হাসি কান্নার সঙ্গী; বারুইপুরের বাড়ি ছাড়া তার আর একটা পরিবার হয়েছে, সে হল ভূষণ কালুদের পরিবার।

একদিন পড়াতে গিয়ে দ‍্যাখে ভূষণদের বাড়ির আশপাশটা জরিপ হচ্ছে, ওখানেও নাকি বড় একটা হোটেল হবে, ওটা নাকি ভূষণদের জায়গা নয়, দেবায়ন প্রমাদ গুনলো, এরকম ঘটনা তার নিজের শহরে দেখেছে। জমি হাঙ্গরদের চেনে ও, আর দেরী করা যাবে না। তাড়াতাড়ি ছুটল দীব‍্যেন্দু স‍্যারের কাছে, খুলে বলল ভূষণদের ভাবী সংকটের কথা, স‍্যারের সাহায‍্য নিয়ে ও বিশ্বভারতী, স্থানীয় মহাফেজখানা, ডেভেলপমেন্ট অথরিটি সব ঘুরে ও ভূষণদের সত্ত্বের দলিল খুঁজে দেখতে

চায়, যাতে সে ভূষণদের ভিটে বাঁচাতে পারে। উনিশের দেবায়ন যেন এখন ভূষণদের ত্রাতা। অনেক কষ্টে একটা পুরোনো পরচা জোগাড় করতে পারল; তারপর অনেক কোর্ট কাচারী, আইন আদালত করে জরিপের কাজ বন্ধ করতে পারল। এ-কদিন শ্রমণাও তাকে অনেক সাহায্য করেছে। ভূষণদের প্রান্তিক জীবনে জড়িয়ে গেল আরও দুই নরনারী, ঠিক এক মগ্ন শিল্পীর ঐ পাথুরে মূর্তির মতো। আগামীর কর্মব্যস্ততা তাদের এখানেই। পাথরের মূর্তি যেন

প্রাণ পেলো।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational