Sutapa Roy

Tragedy Classics

4  

Sutapa Roy

Tragedy Classics

নীতিন জেঠু

নীতিন জেঠু

3 mins
299


শিরোনাম-নিতিনজেঠু

কলমে-সুতপা ব‍্যানার্জী(রায়)

নিতিন জেঠু মানুষটা ছিলেন আদ‍্যন্ত ভালমানুষ। পাড়ার বাচ্ছাদের যদি জিজ্ঞেস করা হোত তোদের প্রিয় মানুষ কে রে?- বাচ্ছারা এককথায় বলত-"কেন, নিতিন জেঠু"

প্রত‍্যেক জন্মাষ্টমীর স্পনসর ছিলেন নিতিন জেঠু, দোলনা সাজানো,রাধা-কৃষ্ণের পোশাক,-পূজোর উপকরণ কেনা সব চলত নিতিন জেঠুর উৎসাহে। সবার ছোট্ট মিনু বায়না ধরল-"আমার পুতুলের বিয়ে কে দেবে...উঁ...উ...মা রাজী হচ্ছে না।" নিতিন জেঠুর কানে যেতেই উনি মিনুর কান্না থামিয়ে বললেন-"কাঁদিস না সোনা, আমি দেব তোর পুতুলের বিয়ে, আমরা খুব খুব আনন্দ করব।"-ব‍্যস অমনি মিনু চুপ কারণ ও জানে নিতিন জেঠু মুশকিল আসান, ওর কাজ ঠিক হয়ে যাবে। ঝুলনের সময়ও একই রকম, যে যার বাড়িতে বায়না করে পাত্তা না পেলে নিতিন জেঠু ঠিক হাজির-"আমি আছি কি করতে, চল আগে মনমতো সব খেলনা কিনে আনি যেগুলো সাজালে বেশ ভাল লাগবে।" হইহই করে খেলনা কেনা, ঘাসের চাগড়া কাটা, মাটি কেটে নদী তৈরী করা, টুনি লাইট ঝোলানো সব নিমেষে হয়ে গেল। বাকী বড়রা এলো স্রেফ দর্শন করতে। পাড়ায় রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন হবে, রিহার্সাল কোথায় হবে, কেউ তো জায়গা দিচ্ছে না। নিতিন জেঠু বললেন-"কেন আমার বাড়িতে কর, আমার বাড়িটা তো তোদের জন‍্যই পড়ে রয়েছে।" মঞ্চস্থ হওয়া অব্দি এবার পুরো দায়িত্ব নিতিন জেঠুর। পাড়ায় দীনু বায়না ধরল-"আমি মুকুল স্কুল যাব না,-ওখানে সবাই আমার গাল টিপে দেয়, আমি সবার সঙ্গে প্রাইমারি স্কুলে যাব।"

বাড়ির লোক এই আবদারকে পাত্তা দিচ্ছে না,- নিতিন জেঠু বললেন-" কাঁদিস না,- দেখি তোর ভর্তির কি ব‍্যবস্থা করা যায়।" চুপিচুপি দীনুর ফর্মফিলআপ, পরীক্ষা দেওয়ানো সব সারা। দীনুও বাজিমাত করে লিস্টের প্রথমে নাম তুলে ফেলল,-এইবার সব জানাজানি হতে বাড়ির লোককে কম বয়সে ভর্তির জন্য বিশেষ অনুমতি করিয়ে ভর্তি করাতে হয়। একগাল হেসে দীনু বড়দের মতো করে বলে ওঠে-"নিতিন জেঠু জিন্দাবাদ।" পাড়ায় সব রকম অবস্থার লোক থাকায় প্রত‍্যেক রবিবার সব বাচ্ছার পাঁঠার মাংস জুটত না। এইজন্য রবিবার দুপুরে নিতিন জেঠুর বাড়িতে ভাত আর পাঁঠার মাংসের ঝোল খাওয়ার নেমন্তন্ন থাকত। মনে করে করে আবার দীনুর মেটে, মিনুর জন্য চর্বি, রিকুর জন্য হাড়ওয়ালা মাংস সব আলাদা আলাদা করে তোলা থাকত। মাসে একটা পিকনিক বাঁধা ছিল নিতিন জেঠুর উৎসাহে,- পাড়ার বড়রাও ছোটদের সঙ্গে গেলে কি হবে প্রধান উদ‍্যোগ থাকত নিতিন জেঠুর। পিকনিকের মাঝে বিভিন্ন খেলার আয়োজন করা তাও থাকত নিতিন জেঠুর সৌজন্যে।

একবার ভোম্বলের কঠিন এক জ্বর হল,- কেউ ওকে ওষুধ খাওয়াতে পারছে না, একমাত্র নিতিন জেঠুর কথা শুনেছে। টানা এক সপ্তাহ ভোম্বলের মাথার কাছে নিতিন জেঠু, জ্বর ছাড়িয়ে সবাইকে নিশ্চিন্ত করলেন। এ হেন নিতিন জেঠুর কাদের ঘটকালিতে জানি না,-প্রায় চল্লিশ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে গেল। পাড়ার বাচ্ছাদের একচ্ছত্র রাজত্বে ছেদ পড়ল দেখে ওরাও খুব একটা প্রীত নয় তবে

বড়রা খুশী কারণ আর একটা পরিবার শুরু হল। কিন্তু নিতিন জেঠুর বাচ্ছাদের নিয়ে রঙিন জীবনের ইতি ঘটলো। নতুন জেঠি বাচ্ছাদের বাড়ির আশেপাশে ঘেঁষতে দেয় না,- বাচ্ছা একদম পছন্দই করে না। এসব দোটানার মধ্যে সকলের প্রিয় নিতিন জেঠু একেবারেই পাল্টে গেল। যে মানুষটাকে একটা সিগারেট কোনদিন ছুঁতে দেখা যায় নি সেই মানুষটা মদ ধরলেন। স্খলিত পায়ে গলির মোড়ে মানুষটাকে দেখে একদিন মিনু বলে উঠেছিল-"ও আমাদের নিতিন জেঠু নয়,- ও আমাদের কেউ নয়।"

একদিন শুনতে পেয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে ছিলেন।

ইদানিং বউয়ের সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটিতে গালাগালির আওয়াজও আসতে থাকল;- ওই শুনে দীনু ওর মাকে জিজ্ঞেস করল-"মা নিতিনজেঠু গালাগালি শেখার স্কুলে ভর্তি হয়েছে বুঝি?"- ওর মা উত্তর না দিয়ে সশব্দে জানলা বন্ধ করে দিল যাতে ছেলে তা শুনতে না পায়। একদিন নিতিন জেঠুকে স্খলিত পায়ে পড়ে যেতে দেখে ভোম্বল ওর মাকে বলেছিল-"মা গো আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, নিতিন জেঠুকে তুলে দিয়ে আসি।" ভোম্বলের মা ভোম্বলকে বলেছিল-"কোনো দরকার নেই,-পড়ে থাকতে দে।" এইভাবে একজন দেবতূল‍্য মানুষ সকলের কাছে হেয় হতে থাকল তার নেশাসক্ত জীবনের জন্য। নিতিন জেঠুর ওই পাল ছেঁড়া সংসারে যে ছেলেমেয়েরা জন্মালো তাদেরও হল বিচিত্র শৈশব। যে মানুষ অনাত্মীয় দীনুকে স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য অতো ছুটোছুটি করেছিল তার আর নিজের ছেলেমেয়ের ওপর হুঁশ করার অবস্থা রইল না। তারা প্রায় অভিভাবকহীন হয়ে কেউ মামার বাড়ি কেউ পিসীর বাড়ি ঠাঁই পেল। মানুষটার সমস্ত সম্মান,প্রতিপত্তির সমাধি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবৎমৃত অবস্থারও পরিসমাপ্তি হল শীঘ্রই। শুধু মিনু, দীনু, ভোম্বল ও আরো অনেকের মনে আঁকা হয়ে থাকল সদা হাস‍্যময়,প্রাণবন্ত এক নিতিন জেঠুর ছবি।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy